শ্রীঅরবিন্দ : স্বামী ও আসামী
পর্ব- দুই
মু ক্তি দা শ
"Marriage is a three-ring circus. First is engagement ring, then the wedding ring and then the suffering.”
গান মৃণালিনীর বড়ই প্রিয়। বিয়ের আগে বাবার কর্মস্থল শিলং-এ তাদের বাড়ির লাগোয়া বাগানে ঘুরতে ঘুরতে প্রায়শঃই গুনগুন করে গান গাইতো মৃণালিনী। বিশেষত, রবি ঠাকুরের সেই গান – ‘আমার পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই – তুমি তাই গো…’ কিন্তু বিয়ের পর সেই গানের সুরে যেন তাল কেটে গেল। হাজার চেষ্টাতেও গলায় সুর খেলানো যেতো না কিছুতেই। কন্ঠের যে-জায়গা থেকে সুর উঠে আসার কথা, ঠিক সেই জায়গা থেকেই উঠে আসতো এক বিরাট জিজ্ঞাসা। ‘আমার পরাণ যা চায়, তুমি কি সত্যিই তাই?’ এর কোনও মনের মতো উত্তর পাবারও উপায় নেই। কে-ই বা দেবে উত্তর? আসলকথা হলো, অরবিন্দের মতো যুগের বিশিষ্টতম দ্রষ্টাপুরুষের সংগে বিয়ে হওয়ায় তার জীবনটাই বেসুরো হবে গিয়েছিল। যাঁরা প্রকৃত অর্থে জ্ঞানী-গুণী, কঠোর তপস্বী, যাঁদের কর্মধারা ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তাঁদের মহাপুরুষ রূপে চিহ্নিত করবে, আমরা প্রাথমিকভাবে ভালো করে চিনতে পারিনা তাঁদের। কেন না, আমাদের মন ভীরু ও অস্বচ্ছ, স্বভাব শিথিল, অভ্যাস দুর্বল। আমাদের জাগতিক জ্ঞানবুদ্ধি, সংস্কার কিছুতেই তাঁদের সংগে মেলে না। মনে সেই সহজ শক্তিও নেই যে, মহৎকে সম্পূর্ণ বোঝা ষায়। মৃণালিনীর হলো সেই দশা। মানুষটার কথাবার্তা, চিঠিপত্র – সবই যেন কেমনধারা! ভাব-গম্ভীর। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো নয়। অবশ্য ১৯০৫ সালের ৫ই আগস্ট লেখা একটি দীর্ঘ চিঠিতে অরবিন্দ নিজেই সেকথা মৃণালিনীকে সোজাসুজি জানিয়ে দিয়েছেন – “তুমি বোধহয় এরমধ্যে টের পেয়েছ, যাহার ভাগ্যের সংগে তোমার ভাগ্য জড়িত, সে বড় বিচিত্র ধরণের লোক। এই দেশে আজকালকার লোকের যেমন মনের ভাব, জীবনের উদ্দেশ্য, কর্ম্মের ক্ষেত্র, আমার কিন্তু তেমন নয়; সব বিষয়েই ভিন্ন, অসাধারণ…’
কিন্তু কী করবে মৃণালিনী অমন একজন ‘অসাধারণ’ মানুষকে নিয়ে? একজন সাদামাটা নিপাট ভালোমানুষ সংসারী বর হলেই তো মৃণালিনীর দিব্যি চলে যেতো! তা না, খালি গালভরা কথার ফুলঝুরি – “হিন্দুধর্মের প্রণেতৃগণ অসামান্য চরিত্র চেষ্টা ও আশাকে বড় ভালবাসিতেন – পাগল হোক বা মহাপুরুষ হোক –অসাধারণ লোককে বড় মানিতেন। কিন্তু এ সকলেতে স্ত্রীর যে ভয়ংকর দুর্দশা হয়, তাহার কি উপায় হইবে? ঋষিগণ এই উপায় ঠিক করিলেন, তাঁহারা স্ত্রীজাতিকে বলিলেন, তোমরা অদ্য হইতে পতি পরম গুরু, এই মন্ত্রই স্ত্রীজাতির একমাত্র মন্ত্র বুঝিবে। স্ত্রী স্বামীর সহধর্মিনী, তিনি যে কার্য্যই স্বকর্ম বলিয়া গ্রহণ করিবেন, তাহাতে সাহায্য দিবে, মন্ত্রণা দিবে, উৎসাহ দিবে, তাঁহাকে দেবতা বলিয়া মানিবে। তাঁহারই সুখে সুখ, তাঁহারই দুঃখে দুঃখ করিবে। কার্য্য নির্বাচন করা পুরুষের অধিকার, সাহায্য ও উৎসাহ দেওয়া স্ত্রীর অধিকার।”
‘অসাধারণ’ মানুষের অসাধারণ মনের ভাব, কথাবার্তা! আচ্ছা একজন রক্তমাংসের মানুষ, বলা নেই কওয়া নেই, অসাধারণ হয়ে যায় কী করে? ‘অসাধারণ’ মানেটা কী? মনুষ্যদেহধারী কোনো দেবতা? তবে দেবতা হোক আর যা-ই হোক, মানুষটা যে নির্লজ্জের বেহদ্দ সেকথা একশোবার! নইলে, মৃণালিনী ভাবে, তার বাবার কাছেও কেউ এরকম চিঠি লেখে? অরবিন্দ তাঁর শিলংবাসী শ্বশুরমশাইকে লিখেছেন – “আমার আশঙ্কা গৃহী হিসাবে আমি কখনোই বড় একটা কাজের হব না, পুত্র হিসাবে, সহোদর হিসাবে এবং স্বামী হিসাবে আমার কর্তব্যের কিছুটা অন্ততঃ নিষ্ফল প্রয়াস আমি করেছি, কিন্তু আমার মধ্যে কিছু একটা রয়েছে খুবই প্রবল যা সবকিছুকে তার অনুবর্তী করে রাখতে আমায় বাধ্য করে।”
আ-হা-হা! সবকিছুতেই উনি বাধ্য হতে পারেন, কেবল স্ত্রীর প্রতি কর্তব্যের ক্ষেত্রেই উনি বাধ্য নন। মাঝেমাঝে রাগের বশে মৃণালিনীর মনে হয়, এইসব কথাগুলি স্বামীকে সরাসরি একবার বলতে পারলে ভালো হতো। আর কিছু না হোক, এহেন নিরুচ্চার যন্ত্রণার হাত থেকে তার নারীসত্ত্বা হয়তো বা নিষ্কৃতি পেতো। কিন্তু সে আর পারে কই? সেই যুগে, বিংশ শতাব্দীর গোড়ায়, স্বামীর বিরুদ্ধে কোনোরকম সোচ্চার বিদ্রোহে নামার মতো অভ্যস্ত মানসিকতার কথা কোনো স্ত্রীর ক্ষে্ত্রে ভাবা যায়? নারীজীবনের যাবতীয় পরিপূর্ণতা যে তার স্বামীসঙ্গসুখলাভের মধ্যেই নিহিত, স্বামী-স্ত্রীর যুগ্মসত্ত্বার একাত্মীকরণের মধ্যেই যে সৃষ্টিসুখের অনাবিল আনন্দ – তার অমৃতস্বাদ মৃণালিনীকে বুঝি আর ইহজীবনে পেতে হবে না।
আমাদের দেশের অধিকাংশ মনীষীদের মতো অরবিন্দের জন্ম ঊনবিংশ শতাব্দীতে হলেও তাঁর জীবনের মূল কর্মধারা প্রবাহিত হয়েছে বিশ-শতকের সূচনাকাল থেকেই। বিয়েও তিনি করেছেন বিশ-শতকের একেবারে প্রত্যুষ লগ্নে, ১৯০১ সালে। মৃণালিনী তখন চোদ্দ বছরের বালিকা মাত্র। আর অরবিন্দের বয়েস ঊনত্রিশ। অরবিন্দ তখন বরোদা রাজ-কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল। সম্পূর্ণ নিজস্ব উৎসাহে ও উদ্যোগে, রীতিমতো কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে হিন্দু আচারমতে বিয়ে করেছেন মৃণালিনীকে। মৃণালিনী তখন কলকাতা ব্রাহ্মবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। সদ্য প্রস্ফুটিতা কিশোরী। ডাকনাম, মেনু। বাবা ভূপালচন্দ্র বসু কৃষিবিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। এবং সেইসূত্রে সপরিবারে শিলংবাসী। মৃণালিনী তার বাবার পরমবন্ধু বঙ্গবাসী কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ গিরীশচন্দ্র বসুর কাছে থেকে বিয়ের আগে অবধি তাঁরই তত্ত্বাবধানে কলকাতায় পড়াশুনো করতো।
মৃণালিনীর স্বামী-সৌভাগ্য, নিঃসন্দেহে, যে-কোনো নারীর ক্ষেত্রেই ঈর্ষনীয়। কিন্তু দাম্পত্যজীবন বলতে যে জাগতিক সুখ ও পরিতৃপ্তির একটি অনিন্দ্যসুন্দর নান্দনিক ছবি আমাদের অভ্যস্ত বাঙালী-মননে সর্বাগ্রে উঁকি দিয়ে যায়, অরবিন্দ-মৃণালিনীর সতেরো বছরের বিবাহিত জীবনে তার লেশমাত্রও নেই। আছে শুধু হৃদয়-মথিত করা এক মহৎ দুঃখ ও বেদনার ছবি। সতেরো বছরের বিবাহিত জীবনে বরোদায়, কলকাতায় ও দেওঘরে সব মিলিয়ে প্রকৃত অর্থে তাঁদের দাম্পত্যজীবনের আয়ুষ্কাল বড়জোর তিন কি চার বছর। তাও নিরবচ্ছিন্নভাবে নয়। এরমধ্যে বিয়ের অব্যবহিত পর বরোদায় পুরো একটি বছর, হয়তো কিছু বেশিও হতে পারে, মৃণালিনীর দাম্পত্যজীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন মধুময় বসন্তকাল। ব্যস। এই পর্যন্ত। এরপর তো তাঁদের দাম্পত্য-সম্পর্ক কেবলই পত্র-নির্ভর।
১৯০৬ সালে বরোদার চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম মাইনেয় ন্যাশানাল কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে ফিরে আসার পরও কিন্তু মৃণালিনী সবসময়ের জন্যে কাছে পায়নি স্বামীকে। এমনই পোড়া কপাল! চিঠিপত্রের আদান-প্রদান তখনও অব্যাহত। আর সেসব চিঠিপত্রের বিষয় ও ভাষা ‘অসাধারণ’ই বটে! কখনো অরবিন্দ লিখেছেন - “তাঁর কাছে সর্বদা এই প্রার্থনা করিতে হয়, আমি যেন স্বামীর জীবন-উদ্দেশ্য ও ঈশ্বরপ্রাপ্তির পথে ব্যাঘাত না করিয়া সর্বদা সহায় হই। এটা করিবে?”
কিংবা হয়তো লিখলেন - “আবার সেই কথা বলি – তুমি একজন সাধারণ লোকের স্ত্রী হও নাই, তোমার বিশেষ ধৈর্য্য ও শক্ততার দরকার। এমন সময়ও আসিতে পারে যখন একমাস কিংবা দেড়মাস নয়, ছয়মাস পর্য্যন্তও আমার কোনও খবর পাইবে না। এখন থেকে একটু শক্ত হইতে শিখিতে হয়, তাহা না হইলে ভবিষ্যতে অনেক দুঃখ ভোগ করিতে হইবে।”
দুঃখ যে ভোগ করতে হবে এবং হচ্ছেও – সে তো হাড়ে হাড়েই টের পাচ্ছে মৃণালিনী। যে মানুষটা তার অশেষ দুঃখের নিমিত্ত, সে-ই আবার মৃণালিনীকে কেমন সান্ত্বনা দেয় দেখো! পাগল। সত্যিই একটা বদ্ধ পাগলের সংগেই বিয়ে হয়েছে মৃণালিনীর। তার ‘পরাণ’ যা কোনোদিন স্বপ্নেও চায়নি, তার স্বামীদেবতাটি ঠিক সেরকমই হয়েছে। এখন যেন মৃণালিনী বুঝতে পারছে, রবি ঠাকুরের সেই গানটি – ‘আমার পরাণ যাহা চায়’ – গাইতে গিয়েও গলার কাছে সুরটা কেন তালগোল পাকিয়ে যায়। ‘পাগল’ বললে অবশ্য মানুষটার কিছু এসে যায় না। ‘পাগল’ বিশেষণটা যেন ওঁর কাছে কোনো লজ্জা নয়, বরং অহংকার। তিনি নিজেই তো মৃণালিনীকে জানিয়েও দিয়েছেন – “এখন কথাটা এই, তুমি হিন্দুধর্মের পথ ধরিবে, না নূতন সভাধর্মের পথ ধরিবে? পাগলকে বিবাহ করিয়াছ সে তোমার পূর্বজন্মার্জিত কর্মদোষের ফল। নিজের ভাগ্যের সঙ্গে একটা বন্দোবস্ত করা ভাল। পাঁচজনের মতের আশ্রয় লইয়া তুমিও কি ওকে পাগল বলিয়া উড়াইয়া দিবে?... তুমি কি কোণে বসিয়া কাঁদিবে মাত্র, না তাহার সঙ্গেই ছুটিবে, পাগলের উপযুক্ত পাগলী হইবার চেষ্টা করিবে?...”
উফ্! মৃণালিনীকে সত্যিই একেবারে পাগল করে ছাড়বে লোকটা! এ যে ‘পাগলী’ বানানোর একদম সরাসরি প্রস্তাব!
স্বামীর উদ্দেশে লিখিত মৃণালিনীর অভিযোগ ও অনুযোগপূর্ণ চিঠিগুলিতে অরবিন্দের প্রতি তার গভীর অসন্তোষের ভাব স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল। তবে এই অসন্তুষ্টির মধ্যে যত না বিদ্রোহ ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল প্রচ্ছন্ন অভিমান-মিশ্রিত নীরব ভর্ৎসনা। ১৯০৭ সালের ২০ ডিসেম্বর তারিখে অরবিন্দকে দেওঘর থেকে লেখা মৃণালিনীর সেরকমই সম্বোধনহীন একটি চিঠি –
“কয়েকদিন হইল তোমাকে একখানি পত্র লিখিয়াছিলাম, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্যবশতঃ অত সাধ্যসাধনাতেও তাহার উত্তর পাইলাম না। তুমি Congress-এ যাইলে কিনা তাহাও জানিতে পারিলাম না। তোমরা লাজপতকে লইয়া যেরূপ গোলমাল আরম্ভ করিয়াছ, তাহাতে শুনিলাম যে সেইজন্য তোমার Congress-এ যাওয়া হইবে না। কি যে তুমি করিতেছ তাহা তো কিছুতেই লিখিবে না, এদিকে আমি পাগলের মত হইয়া রহিয়াছি। যদি Congress-এ না যাও তবে এখনি আমাকে লইয়া চল। তুমি আমাকে লইয়া যাইবার জন্য ন’মেসোকে টেলিগ্রাফ করিয়াছিলে, কিন্তু আমি গিয়া দাঁড়াইব কোথায়? রাস্তায় গিয়া দাঁড়াইব নাকি? তোমার ইচ্ছা যে আমি গিরীশবাবুর বাড়ি থাকি। কিন্তু তোমার মত নির্লজ্জকে আমি যে কি প্রকারে বুঝাইব, কিসে যে তোমার লজ্জা হইবে, তাহা আমি ভাবিয়া কিনারা পাই না। কথায় কথায় অমনি ‘গিরীশবাবুর বাড়ি যাও’, কেন, গিরীশবাবুর তোমার স্ত্রীকে রাখিবার কি দায়িত্ব আছে? তোমার দ্বারা কি গিরীশবাবুর কোন উপকার হয়? শুধু একটু গিয়ে দেখা করা তাহাও তোমার দ্বারা হয় না। তুমি আর গিরীশবাবুর বাড়ি থাকিতে আমাকে বলিও না, তোমার সাধ্যমত যদি গাছতলাতেও আমাকে রাখিতে পার, তাহাও রাখ, আর যদি সেটুকুও সাধ্য তোমার না হয় তবে আমাকে বুকে ছুরি দিয়া মারিয়া ফেল। দুই কাজের এক কাজ কর। তুমি বিবাহ করিয়াছ, এখন আমার ভার গিরীশবাবু ছাড়িয়া বাবাই বা কেন লইবেন? তুমি খাইতে দিতে পার দাও, নাহয় না খাইয়া মরিব। আর এক কথা, তুমি আর বাবার টাকা লইতে পারিবে না, যাহা লইয়াছ তাহা লইয়াছ, কিন্তু এখন আর তাহা লইতে কখনই পাইবে না। আর তুমি গিরীশবাবুর নিকট হইতে বাবার টাকা লইতে পারিবে না। এবং আমিও তাঁহাদের বলিয়াছি যে, সে টাকা কখনই লইব না। তুমি লোকের নিন্দাকে গ্রাহ্য কর না, লোকের দ্বারা নিন্দিত হইয়াও অপমানিত হও না, সেটা তোমার মহৎ মনের মহত্ত্ব ও পৌরুষত্ব হইতে পারে, কিন্তু শ্বশুরের টাকায় প্রতিপালিত হইবে সে অপমান ঘাড় পাতিয়া লওয়া কখনই তোমার পৌরুষত্বের কাজ নয়। বরং যারপরনাই ঘৃণার কথা। তোমার লজ্জা নাই বলিয়া তুমি গৌরব কর, কিন্তু এ বিষয়ে ও-গৌরব কখনই খাটে না। দেখ, আমার বাবার টাকা, কিন্তু তাহা হইলেও, আমার অন্তর দিবানিশি ঘৃণায় জ্বালায় জ্বলিতেছে। আমি প্রথমদিন যখন গিরীশবাবুর নিকট ঐ টাকা দেওয়ার কথা শুনিলাম, সেদিন আমি সমস্তদিন কিরূপ প্রাণের জ্বালায় কাঁদিয়াছি, তাহা ভগবানই জানেন। সকলে দেখিয়াছে এবং তুমিও শুনিয়াছিলে কিন্তু আমার মনের ভাব কেহ জানে নাই। আমি এখন তোমার স্ত্রী হইয়াছি, আমি কেন এখন অন্যের টাকা খাইতে যাইব? হইলই বা আমার বাবার টাকা। অন্য লোক হইলে কখনই সে ঐ টাকা লইত না। ইহা বড়ই অপমানের কথা। তোমার অপমানেই আমার অপমান। কিন্তু যাঁর জন্য অপমান বোধ করি, তাঁরই অপমান জ্ঞান নাই। অন্যের নিকট হইতে টাকা লইয়া উদরপোষণ করা হইতে নিজের পরিশ্রমে যাহা জুটে তাহাতেই তৃপ্ত থাকা মহৎ অন্তঃকরণের কার্য্য। সেবিষয়ে বড়মামার চরিত্রে চিরকালই দেখিয়াছ। তিনি অন্যের নিকট হইতে লওয়া দূরের কথা, তোমরা যে অতি আপনার লোক, তোমাদের নিকট হইতে কখনও এক কপর্দক গ্রহণ করিতে অপমান জ্ঞান করিতেন। মরণকালে তিনি বিনা ঔষধে বিনা ডাক্তারে কিরূপ শোচনীয়ভাবে মারা গেলেন। কিসের জন্য? নিজের মানের জন্যই কেবল তিনি কাহারও সাহায্য লন নাই। নতুবা তিনি কি ইচ্ছা করিলে তোমাদের নিকট হইতে কিম্বা ন’মেসোর নিকট হইতে টাকা লইয়া ভালরূপে চিকিৎসিত হইতে পারিতেন না?
একে আমি ঐ জ্বালায় জ্বলিতেছি, তাহার উপরে ঐ টাকা লইয়া আমি সকলের নিকট বড় কথা শুনিতেছি। ঠাকুরঝি বলিতেছে যে সে যদি আগে জানিত যে বাবার টাকা তুমি লইয়াছ এবং তাহা দ্বারা আমাদের খরচ হইতেছে, বাড়ীভাড়া হইয়াছে এবং তাহাই আবার মাকেও দিয়াছ, তাহা হইলে কখনই সে কলিকাতায় আমাদের বাড়ী থকিত না এবং মাকে তোমার দাদার নিকট ঘাড় ধরিয়া টাকা আদায় করিয়া আনিয়া দিত। সে বলিতেছে যে, ‘সেজদাদার টাকায় আমরা খাইব, তোমার বাবার টাকায় কেন খাইতে যাইব?’ শুনিলে ত? আশা করি এই কথায় এখন হইতে তোমার লজ্জা হইবে। অতএব তুমি নিজে যে করিয়া পার টাকা পাঠাও। তুমি ত বল যে, ‘আমি মেয়েমানুষ নই, আমি পুরুষমানুষ, আমি যে করিয়া পারি টাকা উপার্জন করিবই, তোমার তাহাতে কোন চিন্তা নাই।’ ইহা ত বেশ কথা, ইহাই ত পুরুষের মত কথা। তবে কেন তুমি অন্যের টাকা নাও? যাহা হউক, তুমি টাকা তোমার কাছে না থাকিলেও ধার করিয়া কিম্বা যে করিয়া পার শীঘ্র এখনই টাকা পাঠাও। মোটে ৫০ টাকা পাঠাইয়াছ, তাতে কি হইবে? মার খরচও ইহা হইতে হইতেছে। দু সংসারে কি করিয়া ঐ টাকায় চলিবে। তাছাড়া মার বাড়িভাড়া আছে। টাকা যদি শীঘ্র না পাঠাও তবে আর ২/৪ দিন পরে না খাইয়া মরিতে হইবে। কিন্তু তবুও প্রতিজ্ঞা করিয়াছি কখনই ঐ টাকা লইব না। তুমিও যদি ঠাকুরঝির উপরিউক্ত কথায় লজ্জাবোধ করিয়া থাক, তবে কখনই সে টাকা লইবে না। যদি তবুও তোমার মনে ধিক্কার না হইয়া থাকে তবুও তুমি সে টাকা কখনই লইতে পারিবে না, আমি বারণ করিয়াছি। তারপরে এখন যদি তুমি টাকার অভাবে বাড়ী ছাড়িয়া দাও, তাতেও স্বীকৃত আছি। আর বাড়ি থাকিলেই বা কি হইবে, তুমি যে আর শীঘ্র আমাকে লইয়া যাইবে তাহাতে আর আমার বিশ্বাসও নাই, আশাও নাই। যখন আমাকে তোমার সঙ্গে লইয়া যাইবে বলিয়া প্রতিশ্রুত হইয়া এখানে আনিয়া শেষে ফেলিয়া গেলে, তখন তোমার কথায় আর আশা কি? নিত্যই তোমার একটা না একটা কাজের ওজর আসে। টাকা শীঘ্র২ পাঠাইও, কিন্তু ও টাকা থেকে কখনই না। ওখানকার বাড়ীভাড়ার টাকা শীঘ্র চুকাইয়া দাও, আর কতদিন রাখিয়া দিবে? গিরীশবাবুর নিকট বাবা যে টাকা রাখিয়াছেন সে টাকা আমাদের খরচের জন্য দেন নাই, তবে যদি তোমার ইচ্ছা হয় তবে লইতে পার। কিন্তু তোমার মাকে ও ঠাকুরঝিকে সে টাকায় খাওয়াতে কখনই উচিত নহে। তুমি এখানে তোমার নিজের যোগাড় করা টাকা পাঠাইবে, ইহা আমি তোমায় স্পষ্ট বলিয়া দিতেছি। ২ মাসের বাড়ীভাড়া ৮০ টাকা বাবার টাকা হইতে লইতে পার, কিন্তু আর না, কখনই না। এখানে দিদিমা প্রভৃতি সকলেই তোমাকে শত শত ধিক্কার দিতেছেন, বলিতেছেন, তোমার কিরকম বিবেচনা যে তোমার শ্বশুরের টাকায় মা, বোনকে খাওয়াইতেছ? কি লজ্জার কথা! কি ঘৃণার কথা! আর যেন কখন অমন না কর। আমারও যথেষ্ট অপমান হইয়াছে, আর আমাকে এরূপ অপমানিত করিও না, ইহার উপর আরও কিছু হইলে আমি নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করিব। তোমার ও বাবার নিন্দা ঢের সহিতে হইতেছে। তোমার আপনার লোকে তোমার নিন্দা করে তাহাতে আমার কিছু বলিবার অধিকার নাই, কিন্তু আমার বাবার নিন্দা আমি অত্যন্ত নির্লজ্জ বলিয়াই নীরবে সহ্য করি। এই চিঠিতে অনেক কঠিন কথা লিখিলাম, কিন্তু দিনরাত মনের মধ্যে নানাবিষয়ের জ্বলনে যেরূপ জ্বলিতেছে, তাহাতে ভাল কথা আর কোথা হইতে লিখিব! তুমি আমার কথা শোন না বলিয়াই বড় রাগ হয় এবং এত কথা বলিতে হয়। কেন যে তোমার মত জ্ঞানী লোককে এত কথা বুঝাইতে হয় জানি না। অপমান জ্ঞান যে তোমার নাই, ইহাও আমার বিশ্বাস নয়। তুমি যখন বরোদায় ছিলে তখন দেখিয়াছি তুমি মহারাজার নিকট হইতে নিজ প্রাপ্য বেতন চাহিয়া পাঠাইতে অপমান জ্ঞান করিতে, বলিতে, ‘আমি কি ভিক্ষা করিব?’ কিন্তু এখন দেখিতেছি যে তোমার সব উল্টা। নিজের প্রাপ্য যাহা তাহা চাওয়া তোমার নিকট ভিক্ষা চাওয়ার ন্যায় হইল, আর পরের কাছ থেকে লওয়া একটুও অপমানকর বোধ হইল না। পরের কাছ থেকে নেওয়াই ত ভিক্ষা, ভিক্ষা আর কাহাকে বলে! পরে যদিই বা সাধিয়া দেয়, তুমি তাহা কেনই বা লইবে? আমি যে বাবার নিকট হইতে কোন জিনিষ লইতে লজ্জিত হই, সে কেবল তোমার মানরক্ষার জন্য, এখন তোমার মান অপমানে আমার মান অপমান, তোমার সুখদুঃখে আমার সুখদুঃখ, ইহাই হইতেছে কারণ। নহিলে বাপ-মা কি এখনও আমার পর? বাপ-মার মত কে স্নেহ করিবে, কে বাপ-মার মত আপনার? বাপ-মার মত এত নিকট সম্বন্ধ আর জগতে কাহার সহিত আছে? তবুও লোক সমাজ মানিয়া চলে, মনুষ্য হইয়া জন্মিলে তাহার মনুষ্যোচিত আত্মসম্ভ্রম রাখিয়া চলা একান্ত উচিৎ। সংসারের মধ্যে থাকিয়া সংসার করিতে হইলে, লোকজনের সহিত, সমাজের সহিত সম্বন্ধ রাখিয়া চলিতে হইলে, সমাজের লোকের কথায় চলিতে হয়, যদিও লোকে সব কথা ঠিক বলে না। আর আত্মসম্ভ্রম জ্ঞান যে তাহা সকলেরই আছে, শিক্ষার তারতম্যে কমবেশী। তোমারও আছে। কিন্তু সব বিষয়ে তোমার আত্মসম্ভ্রম জ্ঞান নাই দেখিয়াই অধম হইলেও তোমাকে শিক্ষা দিই।
তুমি আমাকে লইয়া যাইবার জন্য ন’মেসোকে টেলিগ্রাফ করিয়াছিলে, সে কি আমি যাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছি বলিয়া রাগ করিয়া লিখিয়াছ? নিশ্চয়ই তাহাই। ঠাকুরঝি বলিল যে, সে তোমাকে এখানে বসন্ত হওয়ার কথা লিখেছিল, তুমি সেই ভয়ে আমাকে কলিকাতায় লইয়া যাইতে চাও। আমি শুনিয়া মনে মনে ভাবিলাম যে, তুমি ত আমি মরিয়া যাইব সেই ভাবনায় ত তোমার ঘুম হইতেছে না, তা আবার আমাকে সেই ভয়ে কলিকাতায় লইয়া যাইতে চাহিতেছ। অত প্রাণের টান যদি তোমার থাকিত তবে বাড়ীর বন্দোবস্ত করিয়া নিজে আসিয়া লইয়া যাইতে। তা না করিয়া অন্যের উপর লইয়া যাইবার ভার দিলে, আর যাইব কোথায়? না, গিরীশবাবুর বাড়ী! তার চেয়ে এখানে বসন্ত হইয়া এখনই আমার মরণ হউক, তাহাই আমার শত শত বার ভগবানের চরণে প্রার্থনা। মরণের এক প্রকার পূজা করি বলিলে হয়, কিন্তু মরণকে যে সাধে, সে হতভাগ্যকে মরণ আরও ত্যাগ করে। যেমন সকলে ভালবাসা দেখায়, কিন্তু কাজে কিছুই নয়, তেমনি তুমিও কর। কাজে ও মুখে যদি এক হয় তাহা হইলে সেই ত ঠিক। কিন্তু কজনে সেরকম! তুমি বল যে, আমি অনেকদিন বাঁচিব এবং তোমার কাজে লাগিব। অনেকদিন বাঁচিব কি এইরূপভাবে চিরকাল বাপের বাড়ী, গিরীশবাবুর বাড়ী ও এখানে নিষ্কর্মা বসিয়া২ হাতপা ছাড়িয়া কাঁদিয়া মরিবার জন্য? স্বার্থপর পুরুষ! মেয়েমানুষের জীবন ত তোমরা একেই হীনতম অবস্থায় আনিয়া ফেলিয়াছ, যা কিছু আছে তাহা তুমি আরও শেষ করিলে। আমার ভাগ্যে সে স্বামীর দাসীত্বপদ, সে পদসেবার পদ তাহাও আমার ভাগ্যে নাই। আমার দ্বারা মেয়েমানুষের জীবনে অধোগতির চরমসীমার আদর্শ জগতে দেখান হইল। এরকম ভবঘুরে তোমার মত আর কেহ কাহাকেও দেখে নাই, দেখিবেও না। কিন্তু আমি ত আর চুপ করিয়া তোমার কথায় আশান্বিত হইয়া থাকিতে পারিব না। এখন হইতে আমাকে শক্ত হইতে হইবে, তোমার সঙ্গে লড়াই করিয়া আমার ভাগ্যের একটা ভালমন্দ যাহা হউক ব্যবস্থা করিয়া লইতে হইবে। এরূপভাবে আর বসিয়া থাকিলে চলিবে না। তুমি আমাকে শীঘ্র লইয়া চল। যদি তোমার আগে মেসো ন’মাসীদের লইতে আসেন তবে আমি সেই সময়েই যাইব, এবং সেই ভাড়া বাড়ীতেই যাইব। আমি একলাই থাকিব, চাকর বামুন না থাকে, আমি একলাই সব করিব। ইহাই আমার প্রতিজ্ঞা হইল, শুনিয়া জানিয়া রাখ। শুনিতেছি যে, বাড়ী ছাড়িয়া দেওয়া হইতেছে, তুমি কি মত দিয়াছ নাকি? কিন্তু তুমি শুনেছ বোধহয় যে, ৪০ টাকায় ঐটুকু বাড়ী কেহই লইতে চাহিতেছে না। দাদামশায়ের মত ত সকলেই বোকা নয়। অবিনাশ অন্য বাড়ীও খুঁজিতেছে, কিন্তু অন্য বাড়ী না ঠিক করিয়াই এ বাড়ী ছাড়িয়া দিও না, আমাকে জব্দ করিবার জন্য। আমি বড়ই বজ্জাত হইয়া উঠিয়াছি, না? তা যাই বল। শুনিলাম তোমার জ্বর হইয়াছিল, কিন্তু আমায় জানাও নাই কেন? কেনই বা জানাইবে? আমি ত আর তোমার কেহ নই, আর তোমার অসুখের সংবাদে যে মন অস্থির হয় তাহা যদি তুমি বিশ্বাস করিতে, তবে নিশ্চয়ই খবর না দিয়া স্থির থাকিতে পারিতে না। তোমার নিজের যেমন আমার জন্য মন একটুও খারাপ হয় না, সেইরূপ আমাকেও মনে কর। যাক, আর বলিয়া কি হইবে? আশাকরি এখন ভাল আছ। ঠাকুরপোরও নাকি জ্বর হইয়াছে, কেমন আছে? এই চিঠিটার উত্তর দিবে কি? শুধু কয়েকলাইনে জানাও যে তুমি Surat-এ যাইবে কিনা এবং কেমন আছ এবং Surat না যাও তবে আমাকে শীঘ্র লইয়া যাইবে কিনা ইহাই লিখিও। বেশী কিছু তোমার কাছে পাইতে আশা করি না, শুধু ইহাই, কেবলমাত্র এই কয়েকলাইন। কৃপা করিয়া এই কয়েকলাইন একটু কষ্ট স্বীকার করিয়া লিখিয়া বাধিত করিবে কি? এখানকার সকলের মঙ্গল। বসন্ত এখনও হইতেছে। ছোটমামার জ্বর পরদিনই ছাড়িয়া গিয়াছিল। কিছু হয় নাই। আমরা সকলে টিকা নিয়াছি। আমার টিকা উঠিবে কিনা জানিনা। আমার এখন মরণই বাঞ্ছনীয়, টিকা দিয়া কি হইবে? আজ এই পর্য্যন্ত। টাকা যোগাড় করে শীঘ্র পাঠাও। ইতি। -“কি লিখিব জানিনা”
মৃণালিনীর আত্মসম্মানবোধ যে কত প্রখর, কত তীব্র, তা বোঝার পক্ষে এই একটি চিঠিই বোধহয় যথেষ্ট। শুধু কি তাই? তার অভিমানাহত হৃদয়ের গভীর ব্যঞ্জনাও ব্যক্ত হয়েছে এই সুদীর্ঘ চিঠিতে – বিশেষত, ইতির পর ‘কি লিখিব জানিনা’ বাক্যটিতে। চিঠিখানি লিখে স্বামীর কাছে পাঠানোর পর অনুতাপে জর্জরিত হয়েছিল মৃণালিনীর মন। কিন্তু এছাড়া উপায়ও ছিল না যে! বিয়ে করা বউকে ফেলে রেখে অনেকেই প্রবাসে চাকরি করে, তাই বলে নিয়মিত চিঠিও লিখবে না? সংসারের প্রতি, স্ত্রীর প্রতি ন্যূনতম কর্তব্যবোধও কি থাকতে নেই? এই নিস্পৃহতা, এই ঔদাসীন্য মৃণালিনীই বা সহ্য করতে যাবে কেন? একি তার নারীত্বের চরম অবমাননা নয়? অবজ্ঞা ও অপমানের যন্ত্রণায় মৃণালিনী তো অহর্নিশ জ্বলছেই, মাঝখান থেকে তার কথা চিন্তা করে তার বাবা-মায়েরও কি কম কষ্ট, কম যন্ত্রণা! ১৯০৩ সালের ১৫ই এপ্রিল শিলং থেকে মায়ের লেখা একটি চিঠিতে সেকথা পরিষ্কার – “প্রাণাধিকা মেনু, আজ তোমার বাবাকে যে চিঠি লিখিয়াছ তাহাতে সব জানিলাম। বরদার পত্র এখনও পাও নাই জানিয়া বড়ই দুঃখিত হইলাম। তুমি সর্ব্বদা অরবিন্দকে পত্র লিখিবে, তুমি তোমার কর্ত্তব্য কাজ করিবে, তারপর তাঁহার যাহা ইচ্ছা তিনি সেইরূপ করিবেন, তাহাতে আর তোমার কি হাত আছে? সর্ব্বদা প্রফুল্লচিত্তে থাকিবে। সুখ দুঃখ সমস্তই ভগবানের ইচ্ছা, তাহাতে বাধা দিতে মানুষের সাধ্য নাই। সর্ব্বদা ঈশ্বরের উপর নির্ভর করিয়া থাকিবে, তিনি যাহা করিবেন তাহাই করিবে। তোমার ননদ ও গুরুজনদের বাধ্য হইয়া চলিবে। তোমার ভাইবোনেরা সকলে ভাল আছে। সর্ব্বদা পত্র লিখিবে, আলস্য করিও না। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। ইতি- আঃ তোমার মা”।
চিঠিখানির স্নেহপূর্ণ ভাষা ও সান্ত্বনার সুরে আচ্ছন্ন হয়ে প্রাণ জুড়িয়ে যাবার কথা, কিন্তু তার বদলে মৃণালিনীর নিজেকে বড় অপরাধী অপরাধী মনে হয়। সন্তান হয়ে তাকে কিনা বাবা-মায়ের অসীম দুঃখের নিমিত্ত হতে হলো!
বরোদা রাজ-কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল অরবিন্দের মাইনে নেহাৎ হেলাফেলা গোছের নয়। অথচ এরকম একজন সুউপার্জনশীল স্বামীর স্ত্রী হয়েও মৃণালিনীকে সাংসারিক অসচ্ছলতায় দিনযাপন করতে হয়েছে। তা-ও হয়তো মানিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু তার সেই ‘অসাধারণ’ পতিদেবতাকে নির্লজ্জের মতো কিনা শ্বশুরের সাহায্য নিতে হচ্ছে, বিবেকে একটুও বাধছে না – ভাবা যায়! সুতরাং মৃণালিনী যদি তার চিঠিতে এ ব্যাপারে ক্ষোভে ও গ্লানিতে স্বামীকে দুটো কটুকথা শুনিয়েই থাকে, তো কী এমন দোষের! মাস-মাইনের মোটা উপার্জন যায়ই বা কোথায়? দেশের সেবায়?
এই প্রসংগে বাবার লেখা একটি চিঠির কথা মৃণালিনীর আচমকা মনে পড়ে গেল। মৃণালিণীকে তার বাবা রাজশাহী থেকে লিখেছেন – “স্নেহের মৃণালিনী, তোমার ২২শে তারিখের পত্র কাল এখানে পৌঁছিয়া পাইয়া সুখী হইয়াছি। শ্রীমান অরবিন্দ সম্ভবতঃ সুরাটে গিয়াছেন। তাঁহার জন্য চিন্তা করিও না। তাঁহার পত্র লেখার অভ্যাস নাই। সেজন্য তাঁহার উপর বিরক্ত হইও না। তিনি দেশের কাজ করিতেছেন, সুতরাং অন্যান্য বিষয়ে ত্রুটী হইলেও তাহার জন্য কিছু মনে করা উচিৎ নহে। অরবিন্দ যেরূপ স্বদেশের চিন্তার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছেন, তাহাতে আমার কেন, সকলেরই তাঁহাকে শ্রদ্ধা করা উচিৎ। আমার নিকট হইতে ২/৪ টাকা লইতে তোমার এত কেন লজ্জাবোধ হইবে?...”
এমনিতে চিঠিখানি পড়লে মনে হবে, জামাতা বাবাজীবনের কর্মকান্ডে শ্বশুর রীতিমতো সন্তুষ্ট এবং পরিতৃপ্ত, হয়তো বা গর্বিতও। ভালো! মৃণালিনীর তো এতে বুক ভরে ওঠারই কথা। কিন্তু তবু কোথায় যেন একটা সম্ভাবনার ফাটল থেকে যায় তার ভীরু মনে। বাবার এই চিঠি তার হৃদয়ের গভীর ক্ষতস্থানে সান্ত্বনার প্রলেপ দেওয়ার একটা সুকৌশলী অথচ শিশুসুলভ ছলনা নয় তো? কে জানে, হয়তো কন্যার বিবাহিত জীবনের অসাফল্যজনিত বেদনা থেকে উদ্ভুত কোনো গোপন দীর্ঘশ্বাস এই চিঠির মধ্যে কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা!
অরবিন্দকে যেদিন ভোররাতে মৃণালিনীর শয্যাপার্শ্ব থেকে জোর করে তুলে নিয়ে গেল ইংরেজ পুলিশবাহিনী সেদিন লুপ্ত জ্ঞান হয়েছিল মৃণালিনী। সেই জ্ঞান যখন ফিরলো, তখন সে তার মেসোশ্বশুর কৃষ্ণকুমার মিত্রের বাড়িতে। জ্ঞান ফিরতে ধড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসলো মৃণালিনী। বুকের ঠিক ভেতরটায় একধরণের হা-হা শূন্যতা।
সেদিন তার খুব মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। কী হবে আর এই জীবনের বোঝা বয়ে? কিন্তু মৃত্যুর সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি সম্ভবত এই যে, মৃত্যুর পর তার অস্তিত্বের শূন্যতা সম্পর্কে নিকট আত্মীয়দের নিঃস্বতাবোধজনিত প্রতিক্রিয়া বোঝার কোনো উপায়ই থাকে না মৃতব্যক্তির। তবু –
হ্যাঁ, মৃণালিনীর মরণই শ্রেয়। মানুষটাকে ভোররাতে ঘুম থেকে তুলে টেনে হিঁচড়ে কোমরে দড়ি পরিয়ে তারই চোখের সামনে ভ্যানে তুললো পুলিশেরা। আর মৃণালিনী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিরুপায় হয়ে যন্ত্রণাবিদ্ধ চোখে তা-ই দেখলো! সেদিন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু মরণ হলো না কেন? কেন? কেন?
স্বামীর চিঠিগুলো ছিল মৃণালিনীর কাছে একবুক নিঃশ্বাসের মতো স্বস্তিকর, শীতের সকালের রোদের মতো উষ্ণ-মেদুর। ছোট একটি বাক্সে পরম সম্পদের মতো যত্নে সেগুলো তুলে রেখেছিল মৃণালিনী। স্বামীবিরহে মন কাতর হলে অবরে-সবরে সেগুলো একটু নাড়াচাড়া করেও সুখ। সম্বল বলতে তো ওইটুকুই। ভেবেছিল, কাগুজে-দাম্পত্যের উষ্ণ স্পর্শেই কাটিয়ে দেবে বাকি জীবনটা। তা-ও কপালে সইলো না! নিষ্ঠুর পুলিশের দল পৈশাচিক উল্লাসে সেই চিঠিগুলোও সব উজাড় করে নিয়ে গেল বাক্স ভেঙে। নাকি মৃণালিনীর বুকের পাঁজর ভেঙে?
(পরের পর্বে আলিপুর বোমা মামলা)
________________________________
আগামীকাল প্রকাশ পাবে পর্ব- ৩
2 Comments
এই পর্বটি পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এতো দীর্ঘ চিঠি হয় না।এ যেন আত্মজীবনীর কয়েকটি পাতা।
ReplyDeleteঅরবিন্দ ঘোষকে আমার বরাবরই মনে হয় সংগ্ৰাম থেকে পলায়নপর ব্যক্তিত্ব।
ওঁর পত্নীর চিঠিতে তা অনেকটাই ধরা পড়েছে।
পরের কিস্তির অপেক্ষায় অধীর থাকলাম।
প্রথম পর্বটি পড়ে দ্বিতীয় পর্বের অপেক্ষায় ছিলাম।দ্বিতীয় পর্বটি অসাধারণ লেগেছে। তৃতীয় পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
ReplyDelete