জ্বলদর্চি

দেবব্রত দত্ত (কবি, বাচিকশিল্পী, ছড়াকার, তমলুক) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৬৫

দেবব্রত দত্ত (কবি, বাচিকশিল্পী, ছড়াকার, তমলুক) 

ভাস্করব্রত পতি

"পাড়ার মদন পাশ করেছে ইতিহাসে এম. এ. 
চাকরি পাওয়ার চেষ্টা ক'রে যায় না তবু থেমে। 
মদন পেলো গোপন খবর, আলিপুরের জু-তে, বনমানুষের চাকরি আছে, জানতে গেল ছুটে। বনমানুষের মুখোশ পরে থাকতে হবে খাঁচায়, 
মাইনে পাবে সাতশো টাকা, খাবার পাবে, যা চায়। 
বেকার মদন অনিচ্ছাতেও চাকরিখানা নিলো, 
দর্শকরাও বেজায় খুশি, দারুণ মজা পেলো। 
একদিন তো লম্ফ দিয়ে পড়ল পাশের খাঁচায়, 
পাশেই ছিল নেকড়ে বাঘ, কেই বা তাকে বাঁচায়! 
'হালুম' করে বাঘবাবাজি যেই তুলেছে থাবা, 
বনমানুষ চ্যাঁচায় বিষম, 'মরে গেলুম বাবা!' 
বাঘটা তখন বলল কানে, 'উঠছ কেন ঘেমে, 
আমিও ভাই তোমার মতন, ইতিহাসের এম. এ.।"
      (কর্মখালি, দেবব্রত দত্ত) 
রাজ্যজুড়ে শিক্ষিত বেকারদের অবস্থা আজ শোচনীয়। তাঁদের সেই দুর্দশাগ্রস্থ রূপ দেখা যাচ্ছে এই মজার ছড়াতেও। যা তুলে ধরেছেন কবি ও ছড়াকার দেবব্রত দত্ত। এম. এ. ডিগ্রি পাশ করেও পেট চালাতে সঙ সাজতে হচ্ছে শিক্ষিত বেকারদের! মজাচ্ছলে লেখা হলেও কবির এই ছড়াটি যেন সমাজের একটা নগ্ন রূপ তুলে ধরেছে অত্যন্ত সহজ সরলভাবে। বেকারত্বের জ্বালা যন্ত্রনা কবিসত্তাকে আলোড়িত করে নিবিড়ভাবে। সাদা কাগজের গায়ে কালো অক্ষরের প্রতিবাদ মূর্ত হয়ে ওঠে কবির স্ব উৎসারিত লেখনিতে। 'কর্মখালি' যেন সমাজের সেই অন্ধকার দিকটিই প্রতিভাত করেছে। 

কবি দেবব্রত দত্তের এই কবিতাটি একটি বিখ্যাত ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের সিলেবাসে রাখা হয়েছে ছাত্র ছাত্রীদের পড়ার জন্য। বাংলাদেশের বুকে এই কবিতাটির ভিডিও ফেসবুকে ১১ হাজার মানুষ লাইক করেছেন আর আড়াই হাজার মানুষ শেয়ার করেছেন। এ এক বিশাল প্রাপ্তি। এরকম অসংখ্য ছড়া তিনি লিখেছেন দুহাতে। আজ দেশ বিদেশের বহু স্থানে, বহু কবিতা আবৃত্তিচর্চা কেন্দ্রে কবি দেবব্রত দত্তের ছড়া কবিতা পাঠ করেন বাচিকশিল্পীরা। বিভিন্ন ছড়া কবিতা প্রতিযোগিতায় বেছে নেওয়া হয় তাঁর কবিতা ও ছড়া। বঙ্গীয় সঙ্গীত পরিষদের সিলেবাসেও স্থান পেয়েছে দেবব্রত দত্তের বেশকিছু কবিতা। বর্তমানে তিনি একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্ণধার। কবিতা ভালোবাসেন, ছড়া ভালোবাসেন। কবিতা লেখেন, ছড়া লেখেন। আসলে চলমান সমাজের নানা বিষয় ছন্দে গন্ধে কলমের আঁচড়ে তুলে ধরেন নিজস্ব ক্যারিশমায় --
"বৃষ্টিভেজা প্রেম নিয়ে আজ মেঘবাতাসে ছুট,
উঠোনজুড়ে যাচ্ছে ভেসে পুরনো চিরকুট!"

নতুন নতুন কবিতার চিরকুটে তিনি খবর পাঠান পাঠকদের। বিগলিত করেন ভাষার কারিকুরিতে। চমকিত করেন আধুনিক ভাবনার অঙ্কুরোদগমের মাধ্যমে। তাই তিনি উচ্চারণ করেন --
"প্রতিদিন নীচু স্বরে পাড় ভাঙ্গে যে নদীর, সবটুকু তার 
তরল মেঘের মতো ছুঁয়ে থাকে জীবনের এপার ওপার...!" 
ছন্দায়নের সকলের সাথে

১৯৬৫ এর ১৫ ই ফেব্রুয়ারি কবির জন্ম অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানার মন্দিরের গ্রাম রাধাকান্তপুরে। যদিও এখন থাকেন তমলুক শহরে। বাবা প্রফুল্ল কুমার দত্ত এবং মা অনিমা দত্ত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্য বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেছেন। একসময় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক বিভাগেও ভর্তি হয়েছিলেন। অভিনয়ের প্রতি ছিল তীব্র আকাঙ্ক্ষা। ভীষণ নেশা। তার মূলে তাঁর বাবা প্রফুল্ল কুমার দত্ত। তিনি ছিলেন স্টাফ রিক্রিয়েশন ক্লাবের অন্যতম অভিনেতা। নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতেন। এজন্য প্রায়ই কলকাতা যেতে হত। সঙ্গে ছোট্ট দেবব্রতকেও নিয়ে যেতেন। আর তখন থেকেই অভিনয় করার বীজ বপন হয়ে গিয়েছিল যেন। অভিনয় শেখার জন্য পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটেও ভর্তি হতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিধি বাম। বাড়ির লোক রাজি ছিলনা। ফলে অভিনয় করার ইচ্ছেগুলো আর দানা বেঁধে ওঠেনি। বাস্তবায়িত হয়নি। জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন অন্যদিকে। সেই ছোট থেকে মনের গভীরে লালিত পালিত করা সাহিত্যচর্চাতেই বুঁদ হলেন পরবর্তীতে। আজ তিনি জেলা তথা রাজ্যের অন্যতম ছড়াকার, কবি এবং বাচিকশিল্পী। তবুও স্বপ্ন নিয়েই বাঁচতে ভালোবাসেন। সেই স্বপ্নের শিখরে বসে তাঁর ভাষার অনুরণন -- "দিগন্তরেখা ধুয়ে গেলে স্বপ্নগুলো অসীম হয়ে যায়...!"
আবৃত্তিশিল্পীদের সাথে

ছড়া, কবিতা লেখার প্রতি আলাদা নেশা ছিল ছোট থেকেই। প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় তমলুকের কালীপূজার এক শুভ্যেনিরে। তবে তেমনভাবে লেখালেখির দিকে ঝোঁক ছিল না প্রথমে। কিন্তু আবৃত্তি করতে ভালোবাসতেন। একসময় উপলব্ধি করলেন একঘেঁয়েমি হয়ে যাচ্ছে অন্যদের লেখা কবিতা ছড়া আবৃত্তি করতে করতে। তখন তিনি নিজেই লিখতে শুরু করলেন আবৃত্তিযোগ্য নতুন নতুন ছড়া ও কবিতা। প্রশংসা পেলেন। ব্যাস, আর থেমে থাকা যায়না। গড়গড়িয়ে চলতে লাগলো লেখকের গাড়ি। কলমের কালিতে ডুবে সাদা কাগজ ভরে উঠলো ছড়া, কবিতায়। 
"সবাই জানে এই পাড়াতে পয়সা বেশি মামার, 
সবার মামা বাজান ধামা, ভালোই লাগে আমার।
খারাপ লাগে ঠিক সেখানে, সবজান্তা মামার, 
বললে কথা ভুলেই যান, কোথায় আছে থামার!
টাকা পয়সা থাকতে পারে, তাই বলে কি মামার 
হেঁড়ে গলায় শুনতে হবে ধ্রুপদ থেকে ধামার!
'দারুণ গলা' কাগজওলা খবর ছাপে মামার, 
সেটাই নিয়ে ঘোরেন মামা, কলার তুলে জামার।
যেদিন থেকে পুঁজিপাটার টান পড়ল মামার, 
সেদিন থেকে সময় এল ওপর থেকে নামার।
নেমে দ্যাখেন 'মঞ্চ ফাঁকা'! টনক নড়ে মামার
'গাইতে হলে করতে হবে, রেয়াজ সারেগামার।"
    (মামার সারেগামা, দেবব্রত দত্ত) 
বাচিকশিল্পী ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় ও কবি দেবব্রত দত্ত

তাঁর মতে, ছড়া লেখা হল জ্যামিতির নকশা আঁকা। অঙ্কের মতো হিসেব কষে মস্তিষ্ক থেকে বের করতে হয়। এর একটা লিমিটেশন রয়েছে। আ। আর কবিতা লেখা হল আলপনা আঁকা। কলমের তুলি দিয়ে মনের মতো লেখা যায় হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে। কবি বলতে পারেন তাঁর লেখনির মাধ্যমে -- "ভিতরে থাকা অবসাদ! দেখো! দেখো, আমি আবার নতুন প্রেমে পড়েছি"। ছড়া ও কবিতা লেখা -- দুটিতেই তিনি সফল। এই সাহিত্যচর্চার পেছনে বাকি সকলের মতো তাঁর জীবনেও রবিকবির প্রভাব স্বীকার করে নেন। আসলে তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলেন স্বর্গের প্রকৃত দেবতা। যাঁর শরণাপন্ন হলেই মেলে লিখতে পারার অদম্য শক্তি। তাই তিনি অনায়াসে স্বীকার করে নেন --
"স্বপ্নডানা দিচ্ছে পাড়ি পথভোলা এই পাখি, 
গীতার মতো মাথার কাছে গীতাঞ্জলি রাখি...!"
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সামনে রেখে কবির উপলব্ধি যখন গান হয়ে ওঠে, তখন তাঁর কলমের কালি অনুরণিত হয়ে উচ্চারণ করে ---
"কারুর জীবন কখনওই সম্পূর্ণ হয় না! কত পাতা ঝরে, সহস্র বছর ধরে ঝরে, অরণ্যের ভ্রূক্ষেপ নেই।
তবুও একটু একটু করে দানাবাঁধা অবসাদ ভেসে উঠে ডুবে যায় অনন্ত আঁধারে। মৃত্যু আসে স্তব্ধ অন্ধকার ঘিরে, বর্ণহীন উত্তাপহীন অপার শূন্যতায়। বেঁচে থেকে কী লাভ! ভেবে ভেবে বার বারই চরম পথটা বেছে নেওয়ার আগে
থমকে গেছি। আমাদের হৃদয় কিছুই হারাতে দেয় না।
নিজেই নিজেকে বলেছি, 'ফাইট, কোনি ফাইট'!
নিজের সঙ্গে সেই যুদ্ধ করা কতটা কঠিন, তা আমি জানি। 
বুঝিও। ঘুম থেকে উঠে মনে হয়, উফ্! আবার একটা দিন! 
আর একা একা লড়াইটা করা যাবে না। যে-আমি নিজেকে 
বার বার ফিরে পেতে চাইতাম, শূন্য ও নিঃশব্দ অন্ধকারের 
সামনে, সেই আমিই অনেকটাই নিজেকে খুঁজে পেয়েছি! চোখের সামনে সমস্ত ইচ্ছে অশ্রু হয়ে নেমেছিল যন্ত্রণায়, শস্য হয়ে আদিগন্ত ক্ষেতে। তাই গিয়েছিলাম রবি ঠাকুরের কাছে! 
তাঁর গান কবিতার কাছে! আমার হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস 
ফের ডানা মেলেছে, ধীরে ধীরে খুঁজে পেয়েছে জীবনের ছন্দ! 
বাঁচার আনন্দ! মনের দরজাটা খুলে দিয়েছি সমগ্রতার মধ্যে,
আর গুনগুন করে মহাশক্তি সেই জীবনের অভিকর্ষমুখে দিনের চঞ্চলতা, রাতের নীরবতায় গান ধরেছি রবি ঠাকুরের...!"
    (গান ধরেছি রবি ঠাকুরের, দেবব্রত দত্ত) 
কচিকাঁচাদের সাথে...

দেবব্রত দত্তর ছড়া, কবিতা এক অভিনব চিন্তার ছাপ নিয়ে পাঠকের মনে নাড়া দেয়। তাঁর ছড়ায় মোড়া থাকে জীবনের কথা। তাঁর কবিতায় গড়া থাকে হৃদয়ের কথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে কাজী নজরুল ইসলাম, স্বামী বিবেকানন্দ থেকে সেনাবাহিনীর জওয়ান-- বাঙময় হয়ে ওঠে কবি দেবব্রত দত্তের লেখনীর গুনে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানেই বৈশাখের পিয়াসী আবাহন। যে বৈশাখ নিয়ে আসে নতুন বছরের সূচনা, নতুনভাবে জেগে ওঠার মন্ত্র, নতুন সুরে গাওয়ার শক্তি। রবি ঠাকুর আর বৈশাখ মাস বাঙালির জীবনের কাছে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সেই বৈশাখ নিয়ে তিনি লিখেছেন --
"রবির গান জুড়ায় প্রাণ বেহাগ রাগ
হাজার ঋণ রাত্রিদিন হে বৈশাখ...
গভীর সুর এই মধুর চারপাশে
নয় সে দূর হৃদয়পুর ভোর আসে...
শহর গাঁয় অপেক্ষায় বাজছে শাঁখ
এই আকাশ পুষ্পবাস হে বৈশাখ...
চরণতল মন শীতল অন্তরে
মোহন তান তোমার দান বুক ভরে...
এই জীবন মন কেমন লক্ষ দুখ
সকল ক্ষয় এ আশ্রয় পূর্ণ সুখ...
ভয় কি ভয় করছি জয় শান্তি প্রাণ
এই আবেশ লাগছে বেশ রোজ প্রণাম...
রবির গান জুড়ায় প্রাণ বেহাগ রাগ
হাজার ঋণ রাত্রিদিন হে বৈশাখ...!"
    (হে বৈশাখ, দেবব্রত দত্ত) 
কবির আইডল কবির বাবা

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জীবনের পরতে পরতে মিশে রয়েছে। লড়াই, আন্দোলন, বিদ্রোহ, প্রতিবাদ আর দাসত্বশৃঙ্খল মোচনের অন্যতম হাতিয়ার নজরুলের লেখা। নজরুলের গান, নজরুলের কবিতা, আজকের দিনেও সমান প্রাসঙ্গিক সেসব। বিদ্রোহী কবির সেই রূপ রস গন্ধ আর রণদামামা সমৃদ্ধ কলম নিঃসৃত উপঢৌকনকে সম্মান জানিয়ে কবি দেবব্রত দত্ত যে নির্যাস উপস্থাপন করেছেন, সেটাই 'নজরুল আজও'। 
"নজরুল আজও বন্ধনহারা শৃঙ্খল ছেঁড়া স্মৃতি, 
নজরুল আজও ভুবনবিদিত ন্যায় সাম্যের গীতি।
নজরুল আজও শস্যশ্যামলা গোলা ভরে ওঠা ধান, 
নজরুল আজও কাদা মাটি জলে বাউল সুরের গান।
নজরুল আজও সজীব মাটিতে সবুজ প্রাণের ছবি, 
নজরুল আজও নতুন দিনের ঝড় তুফানের কবি।
নজরুল আজও কলকল বেগে গঙ্গা-পদ্মা চুক্তি, 
নজরুল আজও দুশো বছরের দাসত্ব থেকে মুক্তি।
নজরুল তুমি দূর করে দিলে দৈন্য লজ্জা ক্লেশ, 
নজরুল ধ্যানে ধন্য জীবন, কৃতার্থ এই দেশ।
নজরুল আজও মশালের আলো, আগুনের মতো গান, 
নজরুল আজও ঝরনার জল, বাতাসের সন্ধান।
নজরুল আজও উদার আকাশ, বৃষ্টির মতো ঝরে, 
অগ্নিবীণায় জ্যৈষ্ঠের ঝড়, নজরুল মনে পড়ে"।
    (নজরুল আজও, দেবব্রত দত্ত) 

তেমনি, বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে এসেছেন তাঁর ছড়ায়। বিবেকানন্দ সেখানে 'বিবেক' ও 'আনন্দ' সহকারে প্রস্ফুটিত হয়েছেন ছন্দের নিবিড় বন্ধনে --
"কে দিয়েছেন সমাজকে আজ এমন মহাশক্তি? 
কে বলেছেন, 'জগৎকে দাও আস্থা এবং ভক্তি।'
কে দেখালেন বিশ্বাসই এক পরমসহিষ্ণুতা, 
তার সাথে দূর করতে হবে অশিক্ষা আর ক্ষুধা।
কে বলেছেন, 'সবার আগে সত্য গ্রহণ করো, 
সর্ব ধর্মে, সর্ব কর্মে, মানুষ অনেক বড়ো।'
পৃথিবীতে কে ছড়ালেন পবিত্র এ সৌরভ? 
পুনরুদ্ধার কে করেছেন মহিমা ও গৌরব!
তিনিই হলেন অন্তরে সুর বাহির নানা ছন্দে, 
জীবন বাণী এক করেছেন বিবেক ও আনন্দে।"
       (বিবেকানন্দ, দেবব্রত দত্ত) 

সেনাছাউনি থেকে সমরাস্ত্র সজ্জিত সেনাবাহিনীর এক জওয়ানের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কি ধরনের ভাবনা ছলকে ওঠে, তাও তিনি তাঁর পাঠকদের শুনিয়েছেন এক গভীর মর্মবেদনাকে সাক্ষী করে --
"তোমায় ছেড়ে থাকতে পারি না তোমাকে সেই দেখেছি কবে, 
চিঠিও তোমার পেয়েছি আমি কতদিন আগে ভাবতে হবে।
সৈন্যের বেশে আছি এখন জয়ের আশা মনের কোণে, 
আমার জন্য ভেবো না মা, ভাবছি কথা ছোট্ট বোনের।
বোনকে ভীষণ পড়ছে মনে, চোখ ছলছল একটা তারা। 
বাবার এখন শরীর কেমন, হাঁটতে পারে তোমায় ছাড়া?
আকাশ এখানে দেখতে লাল, আমি তো সেই পাখির ছানা, 
বোনকে ভাবি, বাতাস আমার, তোমরা দুজন দুইটি ডানা।
বৃষ্টি ভেজায়, রোদে পোড়ায়, দেশের জন্য ভুলেছি সুখ। 
বোনের স্পর্শ গায়ে আমার, ভারতবর্ষ তোমার মুখ।
পুজোয় এবার হবে না যাওয়া ঘোরাও হবে না লোকের ভিড়ে, 
যোদ্ধার বেশে সেজেছি আমি, জয়ের স্বপ্ন দেশকে ঘিরে।
যেতেই হবে যুদ্ধে এখন, অনেক লেখাই রইল বাকি-
ফিরলে তোমায় লিখব আবার, প্রণাম নিয়ো, আজকে রাখি।"
      (সেনা ছাউনি থেকে, দেবব্রত দত্ত) 

'দেশ' পত্রিকায় ২০২২ সালে শুরু হওয়া 'রম্যরচনা' বিভাগে প্রথম লেখার সিরিজ শুরু হয়েছিল তাঁরই লেখা দিয়ে। যা তাঁর কাছে এক অনাকাঙ্ক্ষিত উপহার। রম্যরচনার মতো তাঁর লেখা ছড়াতেও মেলে হালকা হাসির দোলদুলানো মিস্টি ছোঁয়া। সেই ছোঁয়ায় মুগ্ধ কবিতাপ্রেমী আবালবৃদ্ধবনিতা। 
"বাবা মাও তো ছোটো ছিলেন, ছিল না শখ কোনো?
তবে কেন, 'খেলতে যাও' বলেন না কক্ষনো।"
এরকম অসংখ্য ছড়া তাঁর জিম্মায়। 'ফ্রি বাজার' কবিতায় অত্যন্ত মজার ছলে তুলে ধরেছেন ফ্রিতে ভোগের বিভিন্ন দিক। সবসময় সব 'ফ্রি' জিনিস যে আমাদের লাভের অঙ্ক হয়ে ওঠেনা, সেই কাহিনি তিনি পরিস্ফুটিত করেছেন তাঁর রম্য ছড়ায় --
"বিজ্ঞাপনের বাজার এখন শুধুই বিজ্ঞাপনে, 
ফ্রি-টা দেখে কিনব কী কী ঠিক করেছি মনে।
এটা কিনলে ওটা ফ্রি-তে ওটা কিনলে এটা, 
ফ্রি-টা পেয়ে ভুলেই গেছি কিনতে গেছি যেটা!
দুধ কিনেছি জলটা ফ্রি-তে জলও এখন দামি, 
আটার সাথে গোটা হলুদ ফ্রি পেয়েছি আমি।
সেদিন দেখি 'পুজোর অফার' বিশেষ সুযোগ দিতে
'দুইটি দাঁত তুললে পরে একটি তোলা ফ্রি-তে!"
     (ফ্রি বাজার, দেবব্রত দত্ত) 

তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত আবৃত্তিশিল্পীও। ১৯৮৭ সালে শুরু করেন ছন্দায়ন আবৃত্তি সংস্থা। অসংখ্য ছেলে মেয়ে আজ তাঁর এই সংস্থার মাধ্যমে আবৃত্তিচর্চা করে চলেছেন। একটা সুখময় সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলেছেন সবাই মিলে। তাঁর লেখা ছড়া, কবিতা এরাজ্যের প্রায় সমস্ত পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলি পাঠক সমাজে পেয়েছে অকুণ্ঠ জনপ্রিয়তা, প্রশংসা ও ভালোবাসা। এর পাশাপাশি দূরদর্শন, বেতার, FM, মঞ্চ, HMV সারেগামার প্রতিষ্ঠিত আবৃত্তিশিল্পী ও সংগীতশিল্পীদের কন্ঠেও বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়েছে তাঁর লেখা কবিতা ও ছড়া। আকাশবাণী মৈত্রী প্রচারতরঙ্গে কবিকন্ঠতে প্রায়ই শোনা যায় তাঁর ছড়া ও কবিতা। দূরদর্শনের জি নেটওয়ার্কে 'মজার খেলা কবিতা'য় বিচারক মনোনীত হয়েছেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কবিতা আকাদেমি, শিশু কিশোর আকাদেমি, ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে কবিতা, ছড়া পাঠে বহুবার আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত থেকেছেন সশরীরে। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের শতাধিক সংকলনে তাঁর কবিতা, ছড়া স্থান পেয়েছে। চলতি ২০২৫ এর জুন সংখ্যায় 'কৃত্তিবাস' পত্রিকায় লিখেছেন -
"গাছের পাতা বেয়ে ঝরঝরিয়ে জল পড়ছে, 
বিচিত্র আওয়াজ উঠছে সারা জঙ্গল জুড়ে। 
পাহাড়ের ঢালে আলো, কিন্তু জঙ্গলের নীচে ! 
ধীরে ধীরে চারপাশের সামান্য আলোও 
নিঃশব্দে মুছে যায়, মুছে যায় শুয়ে থাকা রোদ্দুর। 
কালো মেঘ ঝুলে রয়েছে জঙ্গলের মাথায়, 
দেখতে দেখতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে-
অবিরাম বৃষ্টি। দিন রাত ভেসে যাচ্ছে চরাচর, 
ঝাপসা। সারা শরীরের সঙ্গে আমার 
চোখ দুটিও নিঃশব্দে ভরে যাচ্ছে জলে। 
প্রকৃতির বর্ষণের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে দু-চোখের জল, 
যা আলাদা করে চিনতে পারবে না কেউই। 
আর এই হল বৃষ্টির প্রবণতা, অশ্রুর প্রবণতা। 
থেমে গেলে মনে হয়, কিছুই হয়নি তো।"
      (বৃষ্টির প্রবণতা, অশ্রুর প্রবণতা, দেবব্রত দত্ত) 

কবি দেবব্রত দত্তের ছড়ার বইগুলি হল -- ছড়ার মজা মজার ছড়া (১৯৯৬), বই নিয়ে ষোলো কথা (১৯৯৭), গুপ্তভূতের ফুল পঞ্জিকা (১৯৯৭), অদলবাবু বদলবাবু (২০০০), আনন্দে গান গাই (২০০১), কারণ বলা বারণ (২০০২), চলো পিকনিক (২০০৪), আজকের বীরপুরুষ (২০০৮), রামধনুকের রঙিন সাঁকো (২০১৪), একশো হাসির আনন্দ (২০১৪) এবং ছন্দে মিলে রবি ঠাকুর (২০২৪)। এছাড়াও তাঁর লেখা কবিতার বইগুলি হল -- এস্রাজ বাজছে একা একা (২০০১), আর একটু অপেক্ষা করো (২০০৭), পাতার আড়াল থেকে (২০১৩), সামান্য কয়েক লাইন (২০১৫), হৃদয়ে হাজার ঋণ (২০১৯), প্রথম তারার আলো (২০২৩) এবং নির্বাচিত মেদিনীপুর (মেদিনীপুরের কবিদের কবিতা সংকলন, প্রচ্ছদ: পরেশ মাইতি, ২০০৯)। লেখায় বিরাম নেই তাঁর। একদিকে উদাত্ত কন্ঠে আবৃত্তির পরিবেশন, আর অন্যদিকে উদার মনে কবিতা যাপন। 
"হাজার কোটি তারার মধ্যে চাঁদটা যেন একা, 
ঘোমটা দেওয়া মেঘ সরে যায় আর গেল না দেখা।
আড়াল থেকে চাঁদকে আবার দেখতে যত থাকি, 
চাঁদের ওপর বসছে এসে একটি দুটি পাখি।
ভালো করে যখন দেখি পাখি তো নয়, তারা! 
মায়ের কাছে শিশুর মতো মাতায় আকাশপাড়া।
চতুর্দিকে জ্যোৎস্না তখন পড়ছে নদীর জলে, 
নদীর ধারে পথশিশুরা ঘুমোচ্ছে সক্কলে।"
      (চাঁদটা যেন একা, দেবব্রত দত্ত) 

বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে তাঁকে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য সম্মান। ২০০৬ এ কবিতার জন্য পেয়েছেন 'জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার', ২০১৪ তে 'বিভূতিভূষণ স্মৃতি পুরস্কার', ২০০৯ এ ছড়ার জন্য পেয়েছেন 'শিশুসাহিত্য পরিষদ পুরস্কার', ২০১৩ তে 'সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি সম্মান' এবং ২০১৯ এ একটি জনপ্রিয় দূরদর্শন চ্যানেল থেকে সমগ্র সাহিত্যের জন্য 'বাংলার মুখ' নির্বাচিত হয়েছেন। যদিও এসব পুরস্কারপ্রাপ্তি দিয়ে তাঁর কীর্তির বিচার করা সম্ভব নয়। কবি বিশ্বাস করেন, বাংলা ভাষার কোনও বিকল্প নেই। এ ভাষা তাঁর মাতৃভাষা। এ ভাষা তাঁর প্রাণের ভাষা। তাঁর শয়নে স্বপনে জাগরণে মধুর ভাষা বাংলা ভাষা দেহপটে এঁকে দেয় কল্পনার মায়াজাল। বুনন করে স্বর্গীয় সুখ। সেই বাংলা ভাষা নিয়ে তিনি এঁকেছেন সাতরঙা জ্যোৎস্নাভেজা চিত্রপট --
"এখন আমি ইচ্ছেমতো ভাবি 
রামধনুকের রঙিন সাঁকো আঁকি, 
জানলা দিয়ে উড়াল দিল মন 
সাঁকোয় বসে বৃষ্টিতে মুখ ঢাকি।

নীল আকাশে পদ্যে পাঠাই চিঠি 
পাখিরা সব আঁকনবাঁকন করে, 
অরুণ আলোয় বাংলা ভাষা লিখি 
জ্যোৎস্না জাগে হরফে অক্ষরে।

মাটিতে গাছ সবুজ ডানা মেলে 
বাতাস মেখে ঝিকিয়ে ওঠে ফুল, 
সন্ধে থেকে চাঁদ ধরা দেয় যেই 
নদীর কানে দোলে তারার দুল।

কবে যে সেই ঘুমপাড়ানি গান 
শুনিয়েছিলে কাজের মাঝে মাঝে, 
একুশ এলে ফেব্রুয়ারি মাসে 
আজও প্রাণের একতারাটি বাজে।
         (রামধনুকের রঙিন সাঁকো, দেবব্রত দত্ত)

🍂
ad

Post a Comment

0 Comments