জ্বলদর্চি

বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন - ৬

বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন || পর্ব – ৬ 

পূ র্ণ চ ন্দ্র  ভূ ঞ্যা    


লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডর, সার্ন

বিশ্বযুদ্ধ ( ০১.০৯.১৯৩৯ – ০২.০৯.১৯৪৫) শেষ হয়েছে। ঘর থেকে, পরিবার-পরিজন থেকে, স্বদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষজন-সৈন্যদল-বিজ্ঞানী-শ্রমিক স্বগৃহে ফিরছেন। আহত। লজ্জা ও নিয়তি সঙ্গী করে। অথচ যুদ্ধের পূর্বে প্রায় চার দশক ইউরোপের সোনা ফলানো মাটি বিশ্বমানের বিজ্ঞানীদের ধাত্রীভূমি হিসেবে অবশিষ্ট বিশ্বে সমাদৃত ও পূজিত। ঈর্ষার কারণও। নাম করা ইউনিভার্সিটিজ, বিখ্যাত সব ল্যাবরেটরি, নোবেল প্রাপক স্বনামধন্য বিজ্ঞানীবর্গ – ইউরোপ তখন আভিজাত্যের শিখরে বিরাজমান। সমগ্র ইউরোপ স্বগর্বে দাপটের সঙ্গে চষে বেড়াচ্ছেন প্রথিতযশা বিজ্ঞানীগন। তাঁদের এক একটি আবিষ্কার ও উদ্ভাবন বিজ্ঞানে নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে ও উচ্চ প্রশংসা বর্ষিত হচ্ছে। এটা আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ধারণা– দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত না হলে জার্মানির গোটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো শুধু ইউরোপ মহাদেশ নয়, সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ইউনিভার্সিটির তকমা পেত। কারণ মহাযুদ্ধের আগে সেখানে অধ্যাপকের পদ অলংকৃত করছেন বেশ কয়েকজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পণ্ডিতব্যক্তি– আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫), ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক (১৮৫৮-১৯৪৭), ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ (১৯০১-১৯৭৬), এনরিকো ফার্মি (১৯০১-১৯৫৪), পল ডিরাক (১৯০২-১৯৮৪), বিজ্ঞানী হার্ৎজ (১৮৮৭-১৯৭৫)-সহ আরও অনেকে। দুর্ভাগ্য গোটিনজেনের, দুর্ভাগ্য জার্মানির। সে সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তার আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের ইহুদি অপসারণ ও শোষণনীতি ইউরোপের আকাশ কালো মেঘে ঢেকে দিল। যে ইউরোপ বিজ্ঞানের পীঠস্থান হিসেবে সমগ্র বিশ্বে এতকাল চর্চিত, পূজিত, যুদ্ধের অন্তিমে সে কি-না বিশ্বমানের বিজ্ঞান গবেষণার খেতাব হারিয়ে ধুঁকছে ? 

আসলে যুদ্ধের কারণে অধিকাংশ নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী তখন ইউরোপে নিজের ধাত্রীভূমিতে লাঞ্ছিত অপমানিত ও শেষমেশ বিতাড়িত। এতদিন ভিটেমাটি ছেড়ে স্বদেশ থেকে বিচ্যুত সে-সব পণ্ডিতগণ যুদ্ধের শেষে স্বভাবতই মাতৃভূমিতে ফেরার তাগিদে ইউরোপিয়ান অ্যাটমিক ফিজিক্স ল্যাবরেটরি স্থাপনে অত্যুৎসাহী‌। অ্যাটমিক ফিজিক্স গবেষণাগার তৈরি হলে পণ্ডিতগণ শুধু একজোট হবেন তা নয়, নিউক্লিয়ার ফিজিক্স গবেষণায় ক্রমবর্ধমান খরচ জোগান দিতে উৎসাহ পাবেন।

তাই, যুদ্ধশেষে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার অল্প সংখ্যক স্বপ্নদর্শী বিজ্ঞানী ইউরোপে উচ্চমানের ফিজিক্স রিসার্চের গুরুত্ব অনুভব করেন। তাদের লক্ষ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে আমেরিকায় শুরু হওয়া মেধা-পাচার বন্ধ করা ও যুদ্ধোত্তর পৃথিবীকে একজোট হওয়ার শক্তি জোগানো। বর্তমানে যেমন বিশুদ্ধ জ্ঞানার্জনের অবিচল লক্ষ্যে বিশ্বের সমস্ত বিজ্ঞানীগণকে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে সার্ন।
                               
তবে যে ক'জন বিজ্ঞানী অপমানের জয়টিকা মস্তকে ধারণ করেও টিকে রইলেন বা থাকতে বাধ্য হলেন, তা একমাত্র জন্মভূমিকে ভালোবেসে এবং বিদেশ বিভুঁইয়ে নিজের অনাত্মীয় যোগের কারণে, ক্ষমতাবান রাষ্ট্র তথা শত্রুর বাহুবলের জন্য নয়― তাঁদের মধ্যে অন্যতম ফ্রান্সের রাউল ডাউট্রি (১৮৮০–১৯৫১), পিয়ের অগার (১৮৯৯–১৯৯৩), লেউ কোয়ার্স্কি (১৯০৭–১৯৭৯) ; ইতালির এডোআর্ডো এমাল্ডি (১৯০৮–১৯৮৯) এবং ডেনমার্কে নীলস বোর (১৮৮৫–১৯৬২)। 

১৯৪৯ সালের ৯-ই ডিসেম্বর। যুদ্ধের পর চার বছর অতিক্রান্ত। ইউরোপীয় সংষ্কৃতি বিষয়ক কনফারেন্স চলছে দক্ষিণ-পশ্চিম সুইজারল্যান্ডের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র লাউসানে। সেখানে ফ্রান্সের পদার্থবিজ্ঞানী লুইস ডি-ব্রগলি (১৮৯২–১৯৮৭) সরকারিভাবে প্রথম ইউরোপে আণবিক গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবনা পেশ করেন। এরই সূত্র ধরে ১৯৫০ সালের জুনে মধ্য-ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে অনুষ্ঠিত পঞ্চম ইউনেস্কো (UNESCO) জেনারেল কনফারেন্সে আমেরিকার নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ইসিড‍র রবি (১৮৯৮–১৯৮৮) ইউনেস্কোর উদ্দেশ্যে একটি বক্তব্য রাখেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল, আন্তর্জাতিক সায়েন্টিফিক সৌহার্দ্যের বাতাবরণে প্রদেশ ভিত্তিক বড় গবেষণাগার তৈরিতে উৎসাহ প্রদান ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া।

তারপর ১৯৫১ সালের ডিসেম্বরে ফ্রান্সের প্যারিস শহরে ইউনেস্কোর ইন্টারগভর্মেন্টাল আলোচনা সভায় ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর নিউক্লিয়াস রিসার্চ বা সংক্ষেপে 'সার্ন ' তৈরির স্বাক্ষর গ্রহণ করা হয়। দু'মাস পর এগারোটি দেশ প্রভিশনাল কাউন্সিল (CERN) গঠনের সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করে।
                             
UNESCO-এর সদর দপ্তরে সার্ন প্রভিশনাল কাউন্সিলের প্রথম মিটিং বসে, ৫-ই মে থেকে ৮-ই মে ১৯৫২। সভাপতিত্ব করেন সুইজারল্যান্ডের পল শিয়ারার (১৮৯০–১৯৬৯)। সেখানে নতুন ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সরকারি সভাসদগণ ঐ বছরে জুলাই মাস সমাপ্ত হওয়ার আগে প্রস্তাবনা দাখিলের আমন্ত্রণ জানায়। সেই সঙ্গে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ অফিসিয়াল পদ তৈরি করা হয়। কাউন্সিলের জেনারেল-সেক্রেটারি নির্বাচিত হন এডোআর্ডো এমাল্ডি , ন্যূনতম ৫০০ MeV শক্তির সিনক্রো-সাইক্লোট্রোন (Synchro-Cyclotron, সংক্ষেপে SC) মেশিন বানানোর পরিকল্পনা দলের প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমস্টারডামের কর্নলিস বেকারকে (১৯০৪–১৯৬০)। প্রোজেক্টের থিওরি গ্রুপের পদ অলংকৃত করলেন সম্মাননীয় নীলস বোর।

সবচেয়ে শক্তিশালী ও পেল্লাই মেশিন বানানোর লক্ষ্যে যা সমগ্র ইউরোপে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের একই ছাতার তলায় আনবে, নরওয়ের অড দাহল (Odd Dahl, ১৮৯৮–১৯৯৪)-কে সব বিজ্ঞানীদের দলে টানার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। নিউক্লিয়ার অ্যাক্সিলেটর সহযোগে ইন্টারন্যাশনাল ল্যাবরেটরি, ওয়ার্কশপ, বিল্ডিংস তৈরির জন্য সঠিক অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া হয় সার্নের প্রস্তাবক লেউ কোয়ার্স্কিকে।

এবার প্রোজেক্ট সাইট নির্বাচন চূড়ান্ত করার পালা। UNESCO-র তৃতীয় সভায় ১৯৫২ সালে (০১.১০.১৯৫২) প্রোজেক্টের ল্যাবরেটরি সাইট হিসাবে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরকে বেছে নেওয়া হয়। যদিও চারটি দেশ – ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ড সার্ন প্রোজেক্ট সাইটের নকশা জমা দেয়। কিন্তু ইউরোপের মধ্যভাগে অবস্থিত জেনেভা শহরের ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধা পর্যাপ্ত ছিলই, তার সঙ্গে পুরো মহাদেশ জুড়ে সুইজারল্যান্ডের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি ও ইতিমধ্যে সেখানে একগুচ্ছ আন্তর্জাতিক সংগঠন সফলভাবে গড়ে তোলা– সিকে ছিঁড়ল জেনেভার ভাগ্যে।  জেনেভার নিকট মেরিন সাইটে সার্নের ল্যাবরেটরি গড়ে উঠলেও সমস্ত থিওরিটিক্যাল কাজকর্ম ডেনমার্কের রাজধানী শহর কোপেনহেগেন থেকে সংঘটিত হয়। শেষমেশ ১৯৫৩ সালের জুন মাসে (২৯.০৬.১৯৫৩ – ০১.০৭.১৯৫৩) ষষ্ঠ সভায় জেনেভার পক্ষে ১৬৫৩৯ – ৭৩৩২ ভোটে জেনেভা ক্যান্টনমেন্ট প্রোজেক্ট সাইট ছাড়পত্র পায়। পূর্ব নির্ধারিত আঠারো মাসের মধ্যে প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিবর্গের স্বাক্ষরের জন্য প্রয়োজনীয় দলিল তৈরি হয় এবং ঐদিন গ্রেট ব্রিটেন-সহ এগারোটি দেশের সরকার স্বাক্ষর নথিভুক্ত করে। সেই বারোটি দেশ– বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন ও যুগোস্লাভিয়া। সকল সদস্য দেশ তাদের বার্ষিক জাতীয় আয়ের আনুপাতিক ভাগ হারে এ হেন প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ করতে চুক্তিবদ্ধ। 

জেনেভা শহরের প্রশাসন ও সার্নের অফিসিয়াল সদস্যদের উপস্থিতিতে সুইজারল্যান্ডের মেরিন সাইটে মাটি খোঁড়ার কাজ শুরু হয় ১৭-ই মে, ১৯৫৪। 
                              
ঐ বছরের সেপ্টেম্বরে ফ্রান্স ও জার্মানি প্রভিশনাল কাউন্সিলের নাম 'CERN' (Conseil Europeen pour la Recherche Nucleaire, অর্থাৎ European Organization for Nuclear Research) অনুমোদন করে। ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডের বর্ডারে জেনেভার মাটির তলায় ধীরে ধীরে ২৭ কিমি দৈর্ঘ্যের বৃত্তাকার টানেল খোঁড়ার কাজ চলতে থাকে।

কণাবিজ্ঞান ও নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানে সার্নের প্রথম বড় সাফল্য ১৯৫৭ সালে। ঐ বছর সার্নের প্রথম অ্যাক্সিলেটর ৬০০ MeV শক্তির সিনক্রো-সাইক্লোট্রোন যন্ত্র তৈরি হয়।
                                
১৯৬৪-তে এ যন্ত্র সম্পূর্ণরূপে নিউক্লিয়ার সায়েন্সে মনোনিবেশ করে। আর কণাবিজ্ঞান গবেষণার কাজে ভূমিষ্ঠ হয় আরও শক্তিশালী প্রোটন সিনক্রোট্রন (Proton Synchrotron, সংক্ষেপে PS)। দীর্ঘ তেত্রিশ বছর মহাকাশ বিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে অবশেষে ১৯৯০ সালে SC প্রোজেক্টটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। 

এমন আরও কণাত্বরক মেশিন সার্নে উদ্ভাবন করা হয়েছে। ধরা যাক প্রথম চেইন অ্যাক্সিলেটর (chain accelerator) Linac–২-এর কথা যা প্রোটন কণার স্রোতকে ৫০ MeV শক্তিতে ত্বরান্বিত করে। এর থেকে প্রাপ্ত প্রোটন-কারেন্ট পুনরায় Proton Synchrotron Booster (PSB) ত্বরকের ভেতর ঢুকিয়ে আরও শক্তিশালী করা হয়। PSB-এর ভেতরে প্রোটন কণা সর্বোচ্চ ১.৪ GeV শক্তি লাভ করে। এত উচ্চশক্তির প্রোটন-স্রোত পুনরায় Proton Synchrotron (PS)-এর মধ্যে পাঠানো হয় যা প্রোটনকে ২৫ GeV শক্তি প্রদান করে। সবশেষে প্রোটন-স্রোতকে Super Proton Synchrotron (SPS) যন্ত্রে পাঠিয়ে ৪৫০ GeV উচ্চ ক্ষমতায় ত্বরিত করা হয়। SPS থেকে প্রাপ্ত প্রোটন কণার স্রোতকে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডর (LHC)-এ দুটি পৃথক নলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। 
                                
একটি নলে ঘড়ির কাঁটার দিকে ও অন্যটিতে তার বিপরীত দিকে প্রচণ্ড ক্ষমতায় আধানগুলি চক্রাকারে আবর্তিত হয়। কুড়ি মিনিট পর ধনাত্মক কণাগুলি সর্বোচ্চ ৬.৫ TeV শক্তি আহরণ করে। বেশ ক'ঘণ্টা সময় LHC -এর ভেতরে ঘুরিয়ে দুটি বিপরীতমুখী ধনাত্মক আধানের স্রোতকে চারটি ডিটেক্টর – ALICE, ATLAS, CMS এবং LHCb -এর মধ্যে চালিত করে সংঘাত ঘটানো হয়।এখানে দুটি বিপরীতমুখী প্রোটন স্রোত প্রায় প্রতি সেকেন্ডে ২৯৯,৭৯২,৪৫৫ মিটার বেগে (শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগ ২৯৯৭৯২৪৫৮ মিটার/সেকেন্ড) চালিত হয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটায়। উক্ত ডিটেক্টরে এক একটি সংঘর্ষ বিন্দুতে শক্তির মোট পরিমাণ প্রায় ১৩ TeV। এত উচ্চ তাপশক্তিতে ল্যাবরেটরি পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার কথা। হয় না, তার কারণ ল্যাবরেটরির কুলিং সিস্টেমের তাপমাত্রা মাত্র ১.৯ ডিগ্রি কেলভিন বা -২৭১.২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। 

প্রিয় পাঠক, আপনারা নিশ্চিত অবগত আছেন – সার্নের প্রধান দুটি কণাত্বরক ATLAS (১১৬ – ১৩০ GeV) এবং CMS (১১৫ – ১২৭ GeV)-তে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে বিজ্ঞানীরা স্ট্যান্ডার্ড মডেলের শেষ মৌলিক কণা হিগস বোসন সনাক্ত করেন। ২০১২ সালের ৪ঠা জুলাই ডিরেক্টর-জেনারেল হয়্যার ঈশ্বর-কণা প্রাপ্তির সরকারি ঘোষণা করেন। অবশ্য অনেক আগে ১৯৮৩ সালে পণ্ডিতগণ SPS যন্ত্রে মৃদু বলের বাহক কণা ডব্লিউ বোসন ও জেড জিরো বোসনের সন্ধান পায়। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে (১৯৯০–২০০০) অন্য আর একটি কণা-ত্বরক Large Electron Positron (LEP) Collider-এ গবেষণার জন্য লক্ষ লক্ষ জেড জিরো বোসন উৎপাদন করা হয়।
                                 
শক্তির উপরোক্ত মানগুলি (MeV, GeV, TeV) কি নিছক সংখ্যা ? সংখ্যাগুলির শক্তির পরিমাণই বা কত ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক ? আমরা জানি,
১ MeV = ১০^০৬ eV = ১ মিলিয়ন eV
১ GeV = ১০০০ MeV = ১০^০৯ eV
১ TeV = ১০০০ GeV = ১০^০৬ MeV = ১০^১২ eV 
শক্তির হিসেবটা এখনও নিশ্চয় বোঝা গেল না। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ আমাদের হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে সন্দেহ নেই। সে-কারণে স্মৃতি প্রায়শই ভারাক্রান্ত হয়। লক্ষাধিক মানুষ ও বিপুল পরিমাণ সম্পদের বিনাশ ঘটেছিল সেদিন।  বিস্ফোরণে যে পরিমাণ শক্তি পরিবেশে মুক্ত হয়েছিল তা মেগা ইলেকট্রন-ভোল্ট (MeV) পাল্লার। তাহলে বোঝা গেল, সার্নে কণা-ত্বরক যন্ত্রে প্রোটন কণা কত শক্তি নিয়ে সংঘর্ষ ঘটায় ? লক্ষ নিযুত কোটি অ্যাটম বোমার শক্তি নিয়ে একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত। পরিবেশে সে-শক্তির মুক্তি ঘটলে কী সাংঘাতিক অবস্থার সম্মুখীন হব আমরা ? ভাবলেই কোমল হৃদয় আবারও শিউরে ওঠে।  

যাইহোক, বিজ্ঞানের এ হেন দক্ষ্মযজ্ঞ আজ আর মাত্র বারোটি দেশের মিলিত প্রয়াস নয়। এখন যুক্ত হয়েছে অনেক দেশ। বর্তমানে ইজরায়েল-সহ ইউরোপের বাইশটি দেশ (মোট তেইশ) সার্নের স্থায়ী সদস্য এবং পাকিস্তান-সহ আরও  আটটি দেশ অ্যাসোসিয়েট সদস্য দেশ। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাস থেকে আমাদের সোনার দেশ ভারতবর্ষ সার্নের অ্যাসোসিয়েট মেম্বার। অবশ্য অনেক আগে ১৯৯১ সালে ভারত এবং সার্ন বিজ্ঞান ও টেকনিক্যাল ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার মউ স্বাক্ষর করে। ফলস্বরূপ ২০০২ সালে ভারতকে পর্যবেক্ষক স্ট্যাটাস (Observer Status)-এর স্বীকৃতি দেয় সার্ন।

প্রিয় পাঠক, আপনি কি সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডর ঘুরে দেখতে চান ? তাহলে এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে সার্ন ভ্রমণের বিজ্ঞাপন পেজটি খুলে দেখতে পারেন। যদি কখনও LHC ঘুরে দেখার সৌভাগ্য আপনার হয় ; আমি নিশ্চিত, পরিদর্শনের পূর্বে সার্নের প্রবেশ পথে একটু হলেও আপনি থমকে দাঁড়াবেন ও বিস্মিত হবেন– চোখের সম্মুখে ভগবান শিবের দুই মিটার লম্বা নটরাজ মূর্তিটি দর্শন করে। বিজ্ঞানের মন্দিরে নটরাজ ভঙ্গিমায় মহেশ্বরের তাণ্ডব মূর্তি!
                         
আজ্ঞে হ্যাঁ, ১৯৬০ থেকে সার্নের সঙ্গে দীর্ঘ সময় সংযুক্ত থাকার চিহ্ন স্বরূপ নটরাজের প্রতিরূপটি সার্নের ডিরেক্টর-জেনারেল ডঃ রবার্ট আয়মার ( ডিরেক্টরস টার্ম : ২০০৪–২০০৮)-এর হাতে তুলে দেয় ভারত, ২০০৪ সালের ১৮-ই জুন। কারণ হিন্দু শাস্ত্রে লর্ড শিবার তাণ্ডব-নৃত্যের দৃশ্যটি শক্তির প্রতীক মানা হয়। স্ট্যাচুর পাশে ফলকে লেখা,'The belief is that Lord Shiba danced the Universe into existance, motivates it and will eventually extinguish it.' সাব-অ্যাটমিক পারটিক্যাল ও নটরাজ মূর্তির কসমিক নৃত্যের রূপক এঁকেছিলেন কার্ল সাগান।

ঈশ্বর-কণা আবিষ্কারের পরে সার্ন বা LHC-এর ভবিষ্যৎ কী ? এবার লক্ষ্য আরও বড়। শোনা যাচ্ছে, কোয়ার্ক না-কি মৌলিক কণা নয়। তার থেকেও ক্ষুদ্র কণা আছে। কী যেন নাম ? প্রিয়ন (Preon)। এত ক্ষুদ্র কণা পরীক্ষাগারে ধরতে চাই বেশি শক্তি। আর প্রয়োজন টানেলের ভেতর বড় ল্যাবরেটরি। লম্বায় অন্তত ১০০ কিমি। তাই পূর্বের LHC-এর চাইতেও শক্তিশালী কণাত্বরক তৈরিতে মনোনিবেশ করছে পণ্ডিতগণ। নাম দিয়েছেন লার্জার হ্যাড্রন কোলাইডর। আপাতত সেদিকে নজর সারা বিশ্বের। প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছি আমরাও।

Post a Comment

2 Comments

  1. দারুণ লেখা ধন্যবাদ ।


    ReplyDelete
  2. মহাশক্তি অর্থাৎ ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। তিনি নিরাকার আবার সাকার একমাত্র শব্দ ব্রক্ষ্ম ওঁ দিয়ে তাঁকে প্রকাশ করা হয়। তিনিকে নির্দিষ্ট কোন রূপ দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয় কারণ আমি আপনি এবং পৃথিবীর সমস্ত মানুষ জীব জন্তু গ্রহ নক্ষত্র উদ্ভিদ অনু পরমানু জীবন মৃত্যু ঘর বাড়ি দালান কথা বার্তা সব কিছুর মধ্যেই তিনি প্রকাশিত। সুতরাং তিনি যেমন নিরাকার ঠিক সেই ভাবে সব কিছুই তাঁর সাকার রূপ। একমাত্র গভীর ধ্যান এর দ্বারাই তাঁর অস্তিত্ব অনুভব করা সম্ভব। এক দিন বিজ্ঞান এটা স্বীকার করবেই।
    আমি আন্তরিকভাবে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা বুঝতে পেরেছি তা লিখলাম। ধন্যবাদ।

    ReplyDelete