জ্বলদর্চি

বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন -৭

বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন

পর্ব ― ৭ 

 চুম্বকত্বের বিনিময়ে প্রাণ ?

দৃশ্য – ১ :
প্রথম দৃশ্যটি বোস্টন শহরের। সেদিন ছিল Green World Day । সময় সকাল সাড়ে দশটা। বেশ উজ্জ্বল রৌদ্রস্নাত আরও একটি দিন। আবালবৃদ্ধ মানুষজন খুশিতে মাতোয়ারা। কেউ নাগরদোলায় চড়ছে, তো কেউ নির্মল পৃথিবীর আনন্দ উপভোগে ব্যস্ত। এমন সময় ঘটে গেল এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। সকলের চোখের সামনে। এক এক করে বত্রিশ জন একদম সুস্থ মানুষ হঠাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। নিমেষে। একই সময়ে। ঠিক ১০:৩০। হসপিটালের ডাক্তার, নার্স কোন‌ও রোগ বা অসুস্থতা শনাক্ত করতে অসমর্থ। আসলে সকলেই প্রায় সুস্থ ছিল। তবে প্রত্যেকের বুকের মাঝখানে ওপর-নীচে শুধু একটা সেলাই। শরীরে কৃত্রিম পেস-মেকার যন্ত্র বসানোর চিহ্ন। ব্যাস, আর কিছু না!

দৃশ্য – ২ :
ক'দিন পরের ঘটনা। স্থান লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ার। মা-বাবার সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছে বছর পাঁচের এক শিশু। তাদের মাথার ওপর চক্কর কাটছে এক ঝাঁক পরিযায়ী। খুব মনোরম দৃশ্য। সকলে তাকিয়ে সেদিকে। এমন সময় আচমকা রাস্তার ওপর একটি মৃত পরিযায়ী পাখি পড়ে থাকতে দেখে অবাক হয় শিশুটি। বিস্ময়ে সেদিকে বাবা-মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সে। তৎক্ষণাৎ শয়ে শয়ে পরিযায়ী ভূপতিত হয়। সব মৃত। ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় রাস্তার মানুষজন। ভয়ে, আতঙ্কে, জীবন রক্ষার তাগিদে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে তারা। ঘটনার অস্বাভাবিকতা জনজীবনকে করে বিপর্যস্ত। বাক-স্তব্ধ।

দৃশ্য – ৩ :
মহাকাশ থেকে বাড়ি ফিরছে নাসার নভশ্চররা। সকলে খুব রিলাক্সড। আর মাত্র কয়েক মিনিটের প্রতীক্ষা। তারপর পৃথিবীতে অবতরণ করবে তাদের মহাকাশযান 'এনডেভর'। অনুকূল আবহাওয়া। নির্দিষ্ট অক্ষাংশ মেপে নাসার কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা সিগন্যাল অপারেটর হাসিমুখে মেসেজ ফরোয়ার্ড করে দিয়েছেন। হঠাৎই নাসার বড় স্ক্রিন থেকে এনডেভর-এর সিগন্যাল উধাও। এদিকে নভশ্চররা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে গেছে। পৃথিবীপৃষ্ঠে ল্যান্ডিং করতে আর মাত্র দু'মিনিট সময় বাকি। কিন্তু কত ডিগ্রি অক্ষাংশে তারা ল্যান্ড করবে সে তথ্য এন্ডেভরের স্ক্রিন থেকেও সম্পূর্ণ ভ্যানিশ। এমন দুর্বিপাকে কো-পাইলটের কথায় শহরের মাঝে ল্যান্ড করে মহাকাশযান। নিরাপদ কেবিনের সব স্ক্রু-মেম্বার। তবে ক্ষতিগ্রস্ত এনডেভর।

ওপরের তিনটি ঘটনা হয়তো আপাত বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, আগামী এক বছরের মধ্যে নাকি এক এক করে ধ্বংস হবে গাছপালা, জীবজন্তু, মানুষ– পৃথিবীর সবকিছু। ভূবিজ্ঞান পণ্ডিতদের এমনই অভিমত। ওপরে বর্ণিত ঘটনাগুলো অবশ্য বাস্তব জীবনের নয়। 'দ্য কোর' নামক হলিউড চলচ্চিত্রের। এখন প্রশ্ন, কোন অজানা ভৌতিক কারণে বত্রিশ লোক ও শতাধিক পাখি মারা গেল, মহাকাশ যান অক্ষাংশের দিশা হারিয়ে এমার্জেন্সি ল্যান্ডিং করল জনবহুল শহরের বুকে ? সে-গল্প আজ শোনাব।

ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোম অর্থাৎ মাটি-জল-বাতাস-আগুন-শূন্য (স্পেস )― এই পাঁচটি উপকরণ দিয়ে সবকিছু তৈরি। একসময় প্রাচীন হিন্দু দর্শন শাস্ত্রের এমনই বিশ্বাস ছিল। যুক্তিতর্কের পরীক্ষায় পাশ করার অবকাশ ছিল না সে-সময়। ধীরে ধীরে মানুষের চিন্তন ও মননের বৌদ্ধিক বিবর্তনের হাত ধরে অন্তরালে থাকা একটির পর একটি সত্য ঘটনার পর্দা উন্মোচন সম্ভব হয়েছে। দিনকে দিন ব্রম্ভাণ্ডের আধুনিক থেকে আধুনিকতর স্বরূপ উপলব্ধি করেছে মানুষ। এখনও করছে। সে-সব সত্য ঘটনার নিরিখে বলা যায়, পৃথিবীতে জীবের জীবনযাপনের জন্য উপরে উল্লিখিত পাঁচটি জিনিস যথেষ্ট নয়। কেন ? কারণ শূন্যস্থানের ভেতর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে খুব শক্তিশালী মহাজাগতিক রশ্মি (কসমিক রশ্মি) সবদিক থেকে পৃথিবীতে আঘাত হানতে চায়। এমনকি তারা পৌঁছেও যায় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বহিঃস্তর পর্যন্ত। ধীরে ধীরে শক্তি কমিয়ে আরও কাছে। ভূপৃষ্ঠে।  এ হেন রশ্মি শূন্যস্থানের ক্ষতি করে না ?

না, করে না। কারণ প্রথম দিকে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করত ইথার মাধ্যম দিয়ে তৈরি শূন্যস্থান। তার মধ্য দিয়ে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ তথা আলোক এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচলে সক্ষম। এমন ধারণার মূল ভিত্তি কী ছিল ? আসলে শব্দ এক ধরনের তরঙ্গ। সে জড় মাধ্যম ( বায়ু, কঠিন, তরল, গ্যাসীয়) ব্যতীত স্থানান্তরে গমনে অক্ষম। তাই বিস্তারের জন্য হয়তো সব তরঙ্গের একটি করে মাধ্যমের দরকার― এমনই ধারণা প্রচলিত ছিল বহুদিন। যেহেতু আলোক একটি তরঙ্গ, তার চলাচলের জন্যও একটি মাধ্যম অবশ্য প্রয়োজন বলে কল্পনা করা হয় এবং তার ফলস্বরূপ ইথার মাধ্যমের অবতারণা। কিন্তু মাইকেলসন -মুরলি পরীক্ষা এমন মাধ্যমের অস্তিত্বহীনতা হাতে কলমে প্রমাণ করে। ইথারের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দেয় আইনস্টাইনের 'অপেক্ষবাদ তত্ত্ব'। তার মতে ইথার বলে কিছু নেই। তাহলে শূন্যস্থান কী ? 

শূন্যস্থান প্রকৃতপক্ষে স্থান-কালের বক্রতার জ্যামিতিক বহিঃপ্রকাশ। এই শূন্যতার মধ্য দিয়ে প্রায় আলোকের বেগে পৃথিবী লক্ষ্য করে দশ দিক থেকে ছুটে আসছে ঐ অদৃশ্য শত্রু। কত তার ক্ষমতা ? অ্যাটম বোম নয়, লক্ষ নিযুত কোটি হাইড্রোজেন বোম (একটি হাইড্রোজেন বোমার শক্তি হাজারটা অ্যাটম বোমার সমান)-এর সমান বা তার বেশি শক্তি তার। এমনই শক্তিধর সে যে নিমেষে ধ্বংস করতে পারে পৃথিবীর প্রাণের সব স্পন্দন। একবার ভূপৃষ্ঠে পৌঁছলে মুছে যাবে সবকিছু― সবুজ, জীবজন্তু, মানুষ। ১৮৯৯ সালে বিজ্ঞানীদ্বয় এলস্টার ও গেইটাল এবং ১৯০০ সালে সি টি আর উইলসন প্রথম সে-শত্রু― 'মহাজাগতিক রশ্মি বা কসমিক রশ্মি' শনাক্ত করেন।

কসমিক রশ্মি (Cosmic ray) কী ?

কসমিক রশ্মি মুলত খুব উচ্চ শক্তির আহিত কণার স্রোত। এ রশ্মি প্রায় ৯২% ধনাত্মক প্রোটন কণা, ৭% ধনাত্মক হিলিয়াম নিউক্লিয়াস এবং ১% ভারি মৌল (ভরসংখ্যা ৬০-এর সমান বা কম)-এর নিউক্লিয়াস দিয়ে তৈরি। এদের গড় শক্তি গিগা ইলেকট্রন-ভোল্ট (১৫ GeV) পাল্লার। এই পরিমাণ শক্তি বিজ্ঞানীগণ সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডরে তৈরি করেছেন। কখনো-কখনো একটি কসমিক কণার শক্তি ১০^১১ GeV হতে পারে। এ হেন শত্রুকণা  রশ্মি নামে পরিচিত হল কেন ? কারণ প্রথম দিকে পণ্ডিতরা ভেবেছিলেন এ বুঝি আলোকের মতো উচ্চশক্তির তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। তখন থেকেই নামের পাশে 'রশ্মি' যোগ। কিন্তু পরে স্বর্ণপত্র তড়িৎবিক্ষণ যন্ত্রের পরীক্ষায় প্রমাণ হয় এ আসলে তড়িদাহিত কণা। 
                              
কোন বস্তু তড়িৎগ্রস্থ কিনা, তার তড়িতের প্রকৃতি (ধনাত্মক, ঋনাত্মক, নিস্তড়িৎ) কী― এসব জানবার যন্ত্র স্বর্ণপত্র তড়িৎবিক্ষণ যন্ত্র। একটি সরু উল্লম্ব ধাতব দণ্ডের ওপর প্রান্তে আটকানো একটি গোল ধাতব চাকতি ও নীচের প্রান্তে একই বিন্দুতে দু'টি পাতলা সোনার পাত যুক্ত। পাত দু'টির মুক্ত প্রান্ত বাধাহীনভাবে নড়াচড়া করতে পারে। চাকতি বাদে পুরো ব্যবস্থাটি কাচ দিয়ে ঘেরা। এটাই স্বর্ণপত্র তড়িৎবীক্ষণ যন্ত্র। ধরা যাক, এ যন্ত্রে সোনার পাত দু'টি সম আধানে আহিত। ফলে তাদের মধ্যে সামান্য ফাঁক। এই ফাঁক কমতে থাকলে বুঝতে হবে যন্ত্রের ধাতব চাকতি-সহ পাতের আধান ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। বিপরীত আধান চাকতির তড়িৎ প্রশমিত করছে। কিন্তু কে সেই বিপরীত আধান ? কোথা থেকে এল ? এহেন পরীক্ষার জন্য যন্ত্রটিকে তড়িৎগ্রস্থ বস্তুর সংস্পর্শ থেকে বাঁচিয়ে  সূর্যের আলোতে বা অন্ধকারে ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা রেখে দেওয়া হল। তারপর ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেল সোনার পাত দু'টির মাঝখানে গ্যাপ খানিকটা কমে গেছে। কেন ? দু'রকম সম্ভাবনা। এক, সৌরঝড়ের সঙ্গে আগত আহিত কণাগুচ্ছ। দুই, পৃথিবীর অভ্যন্তরে থাকা তেজস্ক্রিয় মৌলের বিকিরণ। রাতের অন্ধকারে যখন সূর্যের আলো আসে না তখন পরীক্ষা করে দেখা গেছে সোনার পাত দু'টি একই রকম নিমিলিত হয় যতটা দিনের আলোয় হত। সুতরাং প্রথম তত্ত্বটি এখানে খাটে না। আবার যন্ত্রটি বড় বেলুনের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে মাটি থেকে ওপরে পাঠানো হল। ভূপৃষ্ঠ থেকে ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতায় বায়ুতে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই করে দেখা গেল, পৃথিবীপৃষ্ঠের চাইতে আকাশে পাত দু'টির নিমিলিত হওয়ার হার যত ওপরে ওঠা যায় তত বেশি। অথচ উল্টোটা ঘটার কথা যদি তেজস্ক্রিয় বিকিরণের জন্য এ ঘটনা ঘটে থাকত। মাটিতে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের হার বেশি, ওপরে কম। ১৯১১ সালে বিজ্ঞানী হেস (Hess) এমন পরীক্ষা করেছিলেন। তাহলে নিশ্চয় তেজস্ক্রিয়তার জন্য এ ঘটনা ঘটেনি। কোন‌ও তৃতীয় কারণ আছে নিশ্চিতরূপে। তা মহাজাগতিক রশ্মি― যার জন্য মেরু অঞ্চলে অরোরা দৃশ্যমান হয় , বায়ুমণ্ডলে আয়নোস্ফিয়ার বা আয়নমণ্ডল সৃষ্টি হয়েছে। বাতাসের এই স্তরে তাপমাত্রা প্রায় ১২০০ ℃ থেকে ২০০০ ℃ ( বিশুদ্ধ জল মাত্র ১০০ ℃ উষ্ণতায় ফোটে)। এত উষ্ণতা এল কোত্থেকে ? কসমিক কণা বিশেষত প্রোটনের সঙ্গে বায়ুর অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন পরমাণুর সংঘাতে অক্সিজেন বা নাইট্রোজেন পরমাণু ভেঙে আয়ন উৎপন্ন করে এবং প্রচুর শক্তি মুক্ত হয়ে এই স্তরের উষ্ণতা এত বাড়িয়ে দেয়। 

পৃথিবীর এমন বিপদের দিনে তার রক্ষাকবচ হবে কে ? প্রবাদ আছে― যে সৃষ্টি করে, রক্ষা করার দায়-দায়িত্বও তার। তাই বুঝি শূন্যস্থানে পৃথিবীর চারপাশে জীবকুলের রক্ষার্থে অদৃশ্য চৌম্বকক্ষেত্রের কেরামতি সাজিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা। এই চৌম্বকীয় প্রভাব এল কোত্থেকে ? 
                             
ইংল্যান্ডের রানি প্রথম এলিজাবেথের গৃহ চিকিৎসক ড: গিলবার্ট। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি গোটা ছয়েক অধ্যায় সংবলিত 'De Magnete' বইতে প্রথম বলেন, ' পৃথিবী একটি বড় চুম্বক'। এবং তার চুম্বকের প্রভাব কেন্দ্র থেকে বায়ুমণ্ডলের সীমা ছাড়িয়ে শূন্যস্থানে আরও দূরে বিস্তৃত। এই প্রভাবের মধ্যে একটি তড়িদাহিত কণা ঢুকে পড়লে সহজে ছাড় পায় না। ধরা যাক, নির্দিষ্ট অঞ্চল জুড়ে একটি ক্ষুদ্র চুম্বকের খ্যাতি (Field)। সেখানে একটি আধান প্রবেশ করল। আধানটি এবার সরলরেখা ধরে এগোচ্ছে না, তার সঞ্চারপথ বেঁকে যাচ্ছে। যত এগোয়, তত বঙ্কিম হয় তার চলার পথ, অনেকটা মানবদেহে জিনের গঠন বা হেলিক্স-এর মতো। কিন্তু আধানটি লম্বভাবে চৌম্বক ক্ষেত্রে প্রবেশ করলে তার গতিপথ বৃত্তাকার হয়। অনুরূপে ভূচুম্বকের চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাব শূন্যস্থানে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। মহাশূন্য থেকে কসমিক রশ্মির প্রোটনকণা (খুব উচ্চ শক্তি) সবদিক থেকে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রে ঢুকে পড়ছে। সেখানে ঢুকে হেলিক্যাল পথ অবলম্বন করে পৃথ্বীর দিকে এগোয়। এগোতে এগোতে বায়ুর আয়নমণ্ডলে অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন পরমাণুর সঙ্গে ধাক্কা খায়। সংঘর্ষে প্রচুর আয়ন উৎপন্ন হয় ও প্রোটন ক্রমাগত শক্তি হারিয়ে গৌন কসমিক রশ্মি (secondary cosmic ray)-তে পরিণত হয়। এই মুক্ত শক্তি বায়ুস্তরের তাপমাত্রা অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় যে সব কসমিক রশ্মি মেরু বরাবর বায়ুমণ্ডলে ঢোকে তাদের ক্ষেত্রে। চৌম্বকক্ষেত্রের সমান্তরালে আগত কসমিক রশ্মিকে বায়ুমণ্ডলে ঢোকার হাত থেকে প্রতিহত করতে পারে না ভূ-চূম্বক। তখন তারা আয়নমণ্ডল পেরিয়ে ভূপৃষ্ঠের আরও কাছাকাছি চলে আসে ও বায়ুর উপাদানের সঙ্গে একই রকম বিক্রিয়া ঘটায়। তার ফলে মেরুজ্যোতি সৃষ্টি হয়। 
                               
এ হেন ভূ-চৌম্বকক্ষেত্রের সৃষ্টি কীভাবে ? পৃথিবীর চারটি স্তর (Layer)― সবচেয়ে বাইরে ক্রাস্ট, তারপর ম্যান্টল, বাহ্যিক কোর (Outer Core) ও ইনার-কোর (Inner Core)। 
                               
ইনার-কোর খুব উচ্চ চাপ ও ঘনত্বের লোহা ও নিকেল দিয়ে তৈরি। উষ্ণতা প্রায় ৫৪০০ ℃।  একে বেষ্টন করে যে আউটার কোর, তা ভূপৃষ্ঠের তলায় ২৮৮০ কিমি থেকে ৫১৮০ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত। এর মধ্যে রয়েছে লোহা ও নিকেলের গলিত লাভা। এই লাভার ঘূর্ণনের জন্য যে তড়িৎপ্রবাহ ঘটে, তা থেকে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের উৎপত্তি বলে পণ্ডিতদের ধারণা। কিন্তু লাভার ঘূর্ণগতির জন্য দায়ী কে ? দায়ী ইনার-কোরের উষ্ণতা। এই উচ্চ উষ্ণতায় গলিত লাভা লাট্টুর মত ঘোরে, যেমন পাত্রের জল তাপ পেলে উপর-নীচে, পাশাপাশি পরিচলন স্রোত তৈরি করে। এখন লাভার বিক্ষুদ্ধ স্রোত (Turbulent current) বন্ধ হয়ে গেলে ভূ-চৌম্বকক্ষেত্রও স্তব্ধ হয়ে যাবে। তাই যতক্ষন স্রোত চলমান, ততক্ষণ ভূ-চুম্বকত্বের অস্তিত্ব। ততটা সময় পৃথিবীতে প্রাণ টিকে থাকবে। স্রোত চালিত না হলে সঙ্গে সঙ্গে বিনাশ হবে প্রাণীকুল। তখন সুজলা সুফলা ধরিত্রী নয়, আমরা দেখব রুক্ষ-শুষ্ক এক পৃথিবীকে, ঠিক যেন মঙ্গল গ্রহ।

এমনই কাল্পনিক ঘটনার আশ্রয় নিয়েছেন 'দ্য কোর' চলচ্চিত্রের পরিচালক জন এমিয়েল (Jon Amiel)। মুভিতে দেখানো হয়েছে পৃথিবীর অভ্যন্তরে বিক্ষিপ্তভাবে বহিস্থ কোরের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় গলিত লাভার ঘূর্ণন বন্ধ। তাই পৃথিবীর অনুরূপ স্থানগুলোয় ভূ-চুম্বকত্ব নেই। সে-সব অঞ্চলে মহাশূন্যের কসমিক রশ্মি বাধাহীনভাবে সরাসরি পৃথিবীপৃষ্ঠে পৌঁছে যায় এবং সেখানে উচ্চ তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্র বিস্তার করে। এহেন ক্ষেত্রের প্রভাবে পেস-মেকার যন্ত্রের তড়িৎ স্পন্দন (Electrical Pulse – যা হৃৎপিণ্ডের রক্ত চলাচল সচল রাখে) মূহূর্তে বন্ধ হয়ে যায়, পরিযায়ী পাখিদের মাথার সামনের দিকে জন্মগত যে চুম্বক লাগানো রয়েছে, তা তাদের দিশেহারা করে শক্ত দেওয়ালে-কাচে ধাক্কা খাইয়ে মেরে ফেলে। বিলুপ্ত চৌম্বকক্ষেত্রে অক্ষাংশের সঠিক পাঠ দেখতে না পেয়ে ব্যস্ত শহরের বুকে ইমারজেন্সি ল্যান্ডিং করে এনডেভর। হয়তো আগামী এক বছরের মধ্যে পুরো লাভার ঘূর্ণন বন্ধ হবে। তখন সমগ্র পৃথিবী জুড়ে হেলায় নেমে আসবে কসমিক রশ্মি। ধ্বংস হবে গাছপালা, জীবজন্তু, মানুষ ইত্যাদি।

Post a Comment

4 Comments

  1. খুব সুন্দর লাগলো স্যার 💓💓💓

    ReplyDelete
  2. দুর্দান্ত / পার্থ প্রতিম আচার্য

    ReplyDelete
  3. দুর্দান্ত / পার্থ প্রতিম আচার্য

    ReplyDelete