শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত - ২
সু দ র্শ ন ন ন্দী
আসি রচনার মুল বিষয়ে। কথামৃতকারের সাথে ঠাকুরের সাক্ষাৎ হয় ১৮৮২র ফেব্রুয়ারিতে। তার আগে ভক্তদের সাথে যে গানের উল্লেখ পাই তা ১লা জানুয়ারি, ১৮৮১, শনিবার, ১৮ই পৌষ, ১২৮৭ এর বিবরণ থেকে। সেদিনের ঘটনা।
ব্রাহ্মসমাজের মাঘোৎসব আসন্ন। প্রতাপ, ত্রৈলোক্য, জয়গোপাল সেন প্রভৃতি অনেক ব্রাহ্মভক্ত নিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করতে দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে এসেছেন। রাম, মনোমোহন অনেকে উপস্থিত।পরে কেশবচন্দ্র সেন এলেন। তাঁর হাতে দুটি বেল ও ফুলের একটি তোড়া। কেশব শ্রীরামকৃষ্ণের চরণ স্পর্শ করে ওগুলি কাছে রাখলেন এবং ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলেন। ঠাকুরও প্রতিনমস্কার করলেন ভূমিষ্ঠ হয়ে ।
এদিকে সংকীর্তনের আয়োজন হয়েছে। অনেক ভক্ত যোগ দিয়েছেন। পঞ্চবটী থেকে সংকীর্তনের দল দক্ষিণদিকে আসছে। হৃদয় শিঙা বাজাচ্ছেন। গোপীদাস বাজাচ্ছেন খোল আর দুজন করতাল বাজাচ্ছেন।
এরকম ঐশ্বরিক পরিবেশে শ্রীরামকৃষ্ণ গান ধরলেন, সঙ্গে নাচছেনও।
হরিনাম নিসে রে জীব যদি সুখে থাকবি।
সুখে থাকবি বৈকুণ্ঠে যাবি, ওরে মোক্ষফল সদা পাবি ৷৷
(হরিণাম গুণেরে)
যে নাম শিব জপেন পঞ্চমুখে
আজ সেই হরিনাম দিব তোকে।
গাইতে গাইতে তিনি সমাধিস্থ হয়ে গেলেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই গানটি ঠাকুর ও ব্রাহ্মভক্তরা ১৮৮৪এর ৪ঠা অক্টোবর কেশব চন্দ্র সেনের বড়দা নবীনচন্দ্র সেনের বাড়িতে কোজাগর পূর্ণিমার দিন গেয়েছিলেন।
পরের গানটির উল্লেখ পাই ১৮৮১, জুলাইয়ে।
সিমুলিয়ায় সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণ এসেছেন। সঙ্গে
রাম, মনোমোহন, ত্রৈলোক্য ও মহেন্দ্র গোস্বামী প্রভৃতি ভক্তরা।
ঘরের মধ্যে ত্রৈলোক্য গান গাইছেন। ঠাকুর মাতোয়ারা হয়ে নৃত্য করছেন। সুরেন্দ্রের দেওয়া মালা যা প্রথমে ফেলে দিয়েছিলেন ঠাকুর, সেই মালা তুলে গলায় পরলেন তিনি। এক হাতে মালা, অন্য হাত দোলাতে দোলাতে গান ও নাচ করছেন। —
হৃদয় পরশমনী আমার —
(ভূষণ বাকি কি আছে রে!)
(জগৎ-চন্দ্র-হার পরেছি!)
সুরেন্দ্র আনন্দে বিভোর — ঠাকুর গলায় সেই মালা পরে নাচছেন! মনে মনে বলছেন, ভগবান দর্পহারী। কিন্তু কাঙালের অকিঞ্চনের ধন!
শ্রীরামকৃষ্ণ এবার আরেকটি গান ধরলেন:
যাদের হরি বলতে নয়ন ঝুরে
তারা তারা দুভাই এসেছে রে...
অনেক ভক্ত ঠাকুরের সঙ্গে নৃত্য করছেন।
প্রসঙ্গত এই গানটি সম্ভন্ধে জানাই যে ঠাকুর এই গানটি নয়বার গেয়েছেন। কখনো দক্ষিণেশ্বরে, কখনো বাগবাজারে বলরাম মন্দিরে, কখনো গিরিশ ঘোষের বাড়িতে তো কখনো নবীনচন্দ্র সেনের বাড়িতে। তবে কোনকোন দিন ভিন্ন ভিন্ন আখর যোগ করে গেয়েছেন তিনি।
এবারের গানের প্রসঙ্গ ব্রাহ্মভক্তদের সাথে। ১লা শ্রাবণ, ১৫ই জুলাই, ১৮৮১ শুক্রবার , কেশব তাঁর জামাই কুচবিহারের মহারাজার জাহাজে (Steam Yacht) করে অনেক ব্রাহ্মভক্ত নিয়ে কলকাতা থেকে সোমড়া বেড়াচ্ছিলেন। পথে দক্ষিণেশ্বরে জাহাজ থামিয়ে পরমহংসদেবকে তুলে নেন, সঙ্গে ছিলেন হৃদয়। জাহাজে কেশব, ত্রৈলোক্য প্রভৃতি ব্রাহ্মভক্তরা ছাড়াও, কুমার গজেন্দ্রনারায়ণ, নগেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তরা ছিলেন।
ভক্তদের সাথে নিরাকার ব্রহ্মের কথা বলতে বলতে শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিস্থ হলেন। এবার শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল গান গাচ্ছেন ও খোল, করতাল বাজছে। সমাধিভঙ্গের পর ঠাকুর গাইছেন:
শ্যামা মা কি কল করেছে।
চৌদ্দপুয়া কলের ভিতরি কত রঙ্গ দেখাতেছে।
গানটি কমলাকান্তের । কথামৃত থেকে পাই যে ঠাকুর গানটি দুবার গেয়েছিলেন, একবার উল্লেখ করেন এবং একবার তাঁর ভক্তরা গান।
ঠাকুরের গাওয়া পরের গান ১৮৮১, ১০ই ডিসেম্বর তারিখে উল্লেখ পাই।রাজেন্দ্র মিত্রের বাড়িতে। কেশব চন্দ্র সেনই রাজেন্দ্রকে বলেছিলেন তাঁর ( রাজেন্দ্র) বাড়িতে একদিন উৎসব করালে ভালো হয়। তাই ঠাকুরের আসা এখানে।
ব্রাহ্মভক্তদের সাথে ঠাকুরের আলোচনা হচ্ছে। হচ্ছে ব্রহ্ম ও শক্তির অভেদতত্ব নিয়ে কথা। বললেন তাঁকে মা বলে ডাকলে শীঘ্র ভক্তি হয়, ভালবাসা হয়।”
এই বলে শ্রীরামকৃষ্ণ দুটি গান ধরলেন:
প্রথম গান- শ্যামাপদ আকাশেতে মন ঘুড়িখানা উড়িতেছিল।
কলুষের কুবাতাস খেয়ে গোপ্তা খেয়ে পড়ে গেল।।
দ্বিতীয় গান — যশোদা নাচাতো গো মা বলে নীলমণি
সে বেশ লুকালি কোথা করালবদনি।।
ঠাকুর গানের সাথে নাচছেন। ভক্তরাও উঠেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ মুহুর্মুহু সমাধিস্থ হচ্ছেন। সকলেই একদৃষ্টে দেখছেন তাঁকে।
প্রথম গানটি ঠাকুর ১লা জানুয়ারি ১৮৮২তে ঠাকুর গেয়েছিলেন। কেশবচন্দ্র সেন তাতে গলা মেলান। এ ছাড়াও কথামৃতে আরও চারবার ঐ গানটি গাইতে দেখি ঠাকুর ও ভক্তদের।গানটির একাধিক রচয়িতার কথা জানা যায় বিভিন্ন গ্রন্থে। দ্বিতীয় গানটি আরও দুবার গাওয়ার উল্লেখ পাই কথামৃতে। একবার নবীন চন্দ্র সেনের বাড়িতে আরেকবার বলরাম মন্দিরে।(চলবে)
________________________________
প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হবে এই ধারাবাহিকটি।
www.jaladarchi.com
1 Comments
খুব ভালো লাগল,তথ্যবহুল লেখা।অনেক কথা জানতে পারলাম।ধন্যবাদ জানাই লেখককে।
ReplyDelete