জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত - ৫



শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত 

পর্ব- ৫ 

সু দ র্শ ন  ন ন্দী

ঐ একই দিন অর্থাৎ ৫ই আগস্ট ১৮৮২। বিদ্যাসাগরের বাড়িতে বিশ্বাস আর ভক্তি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ঠাকুর বললেন,  তাঁকে ভক্তিতে সহজে পাওয়া যায়। তিনি ভাবের বিষয়।এ-কথা বলতে বলতে ঠাকুর  আবার গান ধরলেন:

মন কি তত্ত্ব কর তাঁরে, যেন উন্মত্ত আঁধার ঘরে ।
সে যে ভাবের বিষয় ভাব ব্যতীত, অভাবে কি ধরতে পারে ৷৷
  
গান গাইতে গাইতে ঠাকুর সমাধিস্থও । সবার সাথে পণ্ডিত বিদ্যাসাগরও নিস্তব্ধ হয়ে একদৃষ্টিতে দেখছেন।
ঠাকুর প্রকৃতিস্থ  হয়ে বললেন, “ভাব ভক্তি, এর মানে -- তাঁকে ভালবাসা। যিনিই ব্রহ্ম তাঁকেই ‘মা’ বলে ডাকছে।
হল ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদত্ব আলোচনা। যেমন অগ্নি আর দাহিকাশক্তি, অগ্নি বললেই দাহিকাশক্তি বুঝা যায়; দাহিকাশক্তি বললেই অগ্নি বুঝা যায়; একটিকে মানলেই আর একটিকে মানা হয়ে যায়।তাঁকেই ‘মা’ বলে ডাকা হচ্ছে। ‘মা’ বড় ভালবাসার জিনিস কিনা। ঈশ্বরকে ভালবাসতে পারলেই তাঁকে পাওয়া যায়। ভাব, ভক্তি, ভালবাসা আর বিশ্বাস। আর একটা গান শোনঃ
“ভাবিলে ভাবের উদয় হয়  ।
(ও সে) যেমন ভাব, তেমনি লাভ, মূল সে প্রত্যয় ...
 
গানটি গেয়ে ঠাকুর বোঝালেন, “চিত্ত তদগত হওয়া, তাঁকে খুব ভালবাসা। ‘সুধাহ্রদ’ কিনা অমৃতের হ্রদ। ওতে ডুবলে মানুষ মরে না। অমর হয়। কেউ কেউ মনে করে, বেশি ঈশ্বর ঈশ্বর করলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। তা নয়। এ-যে সুধার হ্রদ! অমৃতের সাগর। বেদে তাঁকে ‘অমৃত’ বলেছে, এতে ডুবে গেলে মরে না -- অমর হয়।”
এই গানটি কথামৃতে তিনবার উল্লেখ পাই। তবে হুবুহু এক নয়, অন্যভাবে।
 
পরের গান ১৮৮২, ১৬ই অক্টোবরের।আজ নরেন্দ্র এসেছেন। ঠাকুরের আনন্দ আর ধরে না।
নরেন্দ্র গান গাইছেন। রাখাল, লাটু, মাস্টার, নরেন্দ্রের ব্রাহ্মবন্ধু প্রিয়, হাজরা সকলে আছেন।
নরেন্দ্র কীর্তন গাইলেন, খোল বাজতে লাগল:
চিন্তয় মম মানস হরি চিদঘন নিরঞ্জন;
কিবা অনুপম ভাতি, মোহন মূরতি, ভকত-হৃদয়-রঞ্জন...
 
নরেন্দ্র আবার গাইলেন:
     (১) সত্যং শিব সুন্দর ভাতি হৃদি মন্দিরে।
নিরখি নিরখি অনুদিন মোরা ডুবিব রূপসাগরে।
 
(২)     আনন্দবনে মল মধুর ব্রহ্মনাম।
নামে উথলিবে সুধাসিন্ধু পিয় অবিরাম...
 
কীর্তনান্তে নরেন্দ্রকে ঠাকুর অনেকক্ষণ আলিঙ্গন করলেন! বললেন, “তুমি আজ আমায় আনন্দ দিলে!!!”  দুটি গানই পুণ্ডরীকাক্ষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা। 
ঐ দিন রাতে খাবার পরও হল কীর্তন। ঠাকুর নরেন্দ্রকে  বললেন “চিদাকাশে হল পূর্ণ প্রেমচন্দ্রোদয় হে” গানটি গাইতে। নরেন্দ্র ঠাকুরের ইচ্ছে মতো গাইলেন-

চিদাকাশে হল পূর্ণ প্রেমচন্দ্রোদয় হে।
উথলিল প্রেমসিন্ধু কি আনন্দময় হে।
(জয় দয়াময়, জয় দয়াময়, জয় দয়াময়)
চারিদিকে ঝলমল করে ভক্ত গ্রহদল...
কীর্তন করতে করতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নৃত্য করছেন।ভক্তেরাও নৃত্য করছেন তাঁকে ঘিরে ।
গানটি ত্রৈলোক্যনাথ স্যান্যালের লেখা। কথামৃতে ছবার গাইতে শুনি এই গানটি।

পরের গানটি এর পরের দিন ১৭ই অক্টোবর গাওয়া। নরেন্দ্ররা সব রাতে থেকেছেন দক্ষিণেশ্বরে । বেলা দশটা নাগাদ পঞ্চবটীতে ব্রাহ্মভক্তদের ধ্যান বিষয়ে শ্রীরামকৃষ্ণদেব কথা বলতে বলতে বললেন - ধ্যান করবার সময় তাতে মগ্ন হতে হয়। উপর উপর ভাসলে কি জলের নিচে রত্ন পাওয়া যায়?
এই বলে ঠাকুর মধুর স্বরে রামপ্রসাদের গান গাইতে লাগলেন:
ডুব দে মন কালী বলে। হৃদি-রত্নাকরের অগাধ জলে...
 
ঠাকুর বলছেন, “ডুব দিলে কুমির ধরতে পারে, কিন্তু হলুদ মাখলে কুমির ছোঁয় না। ‘হৃদি-রত্নাকরের অগাধ জলে’ কামাদি ছয়টি কুমির আছে। কিন্তু বিবেক, বৈরাগ্যরূপ হলুদ মাখলে তারা আর তোমাকে ছোঁবে না।পাণ্ডিত্য কি লেকচার কি হবে যদি বিবেক-বৈরাগ্য না আসে। ঈশ্বর সত্য আর সব অনিত্য; তিনিই বস্তু আর সব অবস্তু; এর নাম বিবেক।তাঁকে হৃদয়মন্দিরে আগে প্রতিষ্ঠা কর”।
_________________________________________
প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার  নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে এই ধারাবাহিক।    
www.jaladarchi.com 

Post a Comment

0 Comments