জ্বলদর্চি

প্রেমের গল্প -সানগ্লাস - স ন্দী প দ ত্ত

   ফটোগ্রাফি- সৈয়দ স্নেহাংশু   


প্রেমের গল্প

সানগ্লাস

স ন্দী প  দ ত্ত


" তুই ঠিক জানিস, লিসা রণবীর কাপূরের ফ্যান? "
অর্পিতার সন্দেহে জল খেতে গিয়ে থমকে গেল চুমকি।
" জানি মানে? হান্ড্রেড পার্সেন্ট জানি। বিশ্বাস না হয়, কস্তুরীকে জিগ্যেস করে দেখ না। ও তো তোর সামনেই বসে আছে। "
" আরে তুই বুঝতে পারছিস না, এটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয়। প্রশ্নটা হল, ওকে টোপ দেওয়া যায় কেমন করে? আমাদের সাপও মারতে হবে আবার লাঠি ভাঙাও চলবে না। "
মোবাইল ঘাঁটছিল কস্তুরী। চোখ না সরিয়েই বলল, " ফিদা বুঝিস? রণবীরের লুকে ও ফিদা হয়ে যায়। "
" তাই নাকি? আমাদের এটাকেই ঢাল করতে হবে, বুঝেছিস? " বলে কফিতে চুমুক দেয় অর্পিতা। " দেবাঞ্জনকে একবার ফোন লাগা তো। ওকে দরকার। "
দেবাঞ্জনকে রিং করল চুমকি। অর্পিতার দিকে এগিয়ে দিল ফোনটা।
" তুই কোথায় রে, দেবা? "
" কেন? "
" আঃ, যা জিগ্যেস করছি, বল না! "
" উল্টোডাঙায়। "
" তাহলে তো কাছাকাছিই। একবার আসতে পারবি? "
" আসতে পারব! কোথায়? "
পার্টিকুলার লোকেশনটার নাম বলল অর্পিতা। দোকানের নামটাও।
" কেন রে? "
" আয় না, এলেই বলব। "
" ঠিক আছে, বোস। যাচ্ছি। "
     মিনিট কুড়ির মধ্যেই বাইক নিয়ে শাঁ করে এসে পৌঁছে গেল দেবাঞ্জন। একটা চেয়ার এগিয়ে দিল চুমকি। এক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে ফেলল কস্তুরী।
" আচ্ছা দেবা, তোদের পাড়ায় কোনো রণবীর কাপূর থাকে না? "
অর্পিতার কথায় বিষম খেল দেবাঞ্জন। " রণবীর কাপূর ! এই কলকাতায়? "
" আরে বুদ্ধু, বলছি ওরকম কোনো হ্যান্ডসাম তোদের পাড়ায় এক পিস পাওয়া যাবে? তোর চেনাশোনা? "
" কেন বল তো? "
    শুধু কফি নয়, প্লেট ভর্তি চাউমিন এল দেবাঞ্জনের জন্য। কিছুক্ষণ ধরে বকবক করে পুরো ঘটনার ইতিহাস শোনাল অর্পিতা। বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখা ক্ষোভটাকে দীর্ঘদিনের পুরোনো বন্ধুর সাথে শেয়ার করে সমাধানের প্ল্যান কষল চোয়াল চেপে।
    ক্ষোভই বটে। কলেজ হোস্টেলগুলোতে এখন র‍্যাগিং বন্ধ। যেটুকু হয়, তাতে মনের আশ মেটেনা। অর্পিতাদের হোস্টেলেও তাই হয়েছে। প্রথম বর্ষের মেয়েরা সবাই বশ্যতা স্বীকার করলেও ওটুকুও মানতে চায়নি লিসা। শুরু থেকেই ঝাঁঝ দেখিয়েছে সে। " আমি এখানে পড়াশোনা করতে এসেছি। এর তার কথায় উঠতে বসতে নয়। " 
তৃতীয় বর্ষের অর্পিতা দ্বিতীয় বর্ষের চুমকিকে নিয়ে তাই লিসাকে লেগপুল করতে চায়। মেয়েটা লেখাপড়া করতে ভালবাসে। ওটাকেই ফাঁদ করলে মন্দ কী ! প্রথম বর্ষের কস্তুরী লিসার রুমমেট। কলেজের বড়ো দিদিদের কথা মেনে সে এখন সকলের বন্ধু হয়ে গেছে। রণবীর কাপূরের ওপর লিসার যে ক্র‍্যাশ রয়েছে, এ গোপন তথ্য কস্তুরীর চেয়ে ভাল আর কে জানবে !
    সব শুনে দেবাঞ্জন ভাবুক হল একটু। তারপর সবাইকে চমকে দিয়ে বলল, " আছে একজন।তবে একেবারে রণবীর কাপূর না হলেও বেশ হ্যান্ডসাম। রীয়েল হিরো। আমার বন্ধু। তোদের কপাল ভাল, ওর নামও রণবীর। আমি ডাকি রণ। "
" বলিস কীরে দেবা ! চাইলাম হ্যান্ডসাম, নামটাও ম্যাচ খেয়ে গেল ! বেঁচে থাক বাবা তুই। রণ। দারুণ! রণ নামের ওপরই লিসার যত আঁতলামি। এবার টের পাবে মজা! "
" রণর কাজটা কী, বললি নাতো? "
     দেবাঞ্জনকে আস্তে আস্তে সব খুলে বলল অর্পিতা। দেবাঞ্জন তার স্কুললাইফের বন্ধু। হুগলির এক স্কুলে মাধ্যমিক পাস করার পর লেখাপড়ায় ইতি টেনে কাজের খোঁজে তার কলকাতায় চলে আসা। আর এইচ এস পাস করে বছর তিন আগে অর্পিতা কলকাতায় আসে পড়তে। একদিন হঠাৎ করেই দেখা। তারপর আবার সেই পুরোনো বন্ধুত্ব।
    এখন প্ল্যানমাফিক দেবাঞ্জন হবে কস্তুরীর মাসতুতো দাদা। ক ' দিন ধরেই একজন ভাল অধ্যাপকের খোঁজ করছে লিসা। তার বিষয়ে কলেজে যাঁরা পড়ান, তাঁরা প্রত্যেকেই পার্টটাইমার। নিয়োগ প্রক্রিয়া থমকে আছে। স্বাভাবিক হতে লিসার কোর্স না শেষ হয় !
    লিসার সঙ্গে একদিন দেবাঞ্জনের আলাপ করাল কস্তুরী। দেবাঞ্জন বলল, ভাল এক অধ্যাপকের নাম সে জানে। দারুণ পড়ান। প্রচুর স্টুডেন্ট। ওনারই এক স্কলার স্টুডেন্ট তার বন্ধু। সেই বন্ধুকেই সে লিসার জন্য পাঠাবে। সেই তাকে নিয়ে যাবে অধ্যাপকের বাড়ি।
    কস্তুরী বলল " যে সে স্টুডেন্ট নয় রে, লিসা। এক্কেবারে রণবীর কাপূর। পারলে ওর সাথে নিজেকে একটু সেট করে নিস। লাভটা তোরই হবে। অনেক সাহায্য পাবি। শুধু লেখাপড়ায় আজকাল চলে নাকি? একটু আধটু প্রেম কর, দেখবি মন ভাল লাগবে। ছেলেটার পেছনে কত মেয়ে ঘোরে, জানিস? ওই কাউকে পাত্তা দেয়না। তুই যদি পাত্তা পেয়ে যাস, কী হবে ভেবে দেখেছিস? আরে লাইফটা তোর পাল্টে যাবে রে লিসা ! শুনেছি বড়োলোকের ছেলে। প্রচুর সম্পত্তি বাবার। "
    অর্পিতা চুমকি, কস্তুরী আর হোস্টেলের জনা কয়েক মেয়েকে নিয়ে গোপন বৈঠকে এক ফাজিল হাসি হাসল আর বলল, " দেখিস, প্রেম ওর মাথাটাকে চিবিয়ে খাবে। লাটে উঠবে পড়াশুনো। তখন কত করে বললাম, আমাদের কথা মেনে নে। শুনলি না। এখন এই র‍্যাগিংয়ের সামনে পড়, দেখি কত ঝাঁঝ থাকে ! "
    কস্তুরীর কথা শুনে রাজি হল লিসা। ওরা যদি ডালে চলে, সে চলবে পাতায়। ভাল এক অধ্যাপকের গাইড পাওয়ার জন্য যদি ছেলেটার সাথে কথা বলে মিথ্যে প্রেমের নাটক করতে হয়, সে করবে। হ্যাঁ, নাটকই। পুরুষজাতটাকে তার চেনা হয়ে গেছে। দিদির জীবনটাকে চোখের সামনে দেখেছে সে। এগারো ক্লাস পড়তে পড়তে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করল যাকে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই শুরু করল অত্যাচার। গায়ে হাত তোলা। মারধর। বাপের বাড়িতে থেকে দিদি এখন ডিভোর্সের মামলা লড়ছে। লিসা তাই পড়তে চায়। অনেক দূর পড়তে চায় সে। চাকরি করতে চায়। লেখাপড়া আগে, পরে বাকি সব।
    দেবাঞ্জনের প্ল্যান আর রুমমেট কস্তুরীর কথামতো লিসা তাই আজ সকাল দশটায় নামি অধ্যাপকের বিশ্বস্ত ও কাছের স্টুডেন্ট রণবীরের জন্য অপেক্ষা করবে অর্পিতার ঠিক করে দেওয়া কস্তুরীর নির্দেশে নিদিষ্ট একটা জায়গায়।
    কিন্তু  রণবীর যে এভাবে তীরে এসে তরী ডুবিয়ে দেবে, কে জানত ! সকাল সাড়ে নটায় দেবাঞ্জন তাকে ফোন করতেই সে বলে, " আমি আজ যেতে পারছিনা রে, দেবা। মাসখানেকের জন্য একটা লম্বা ট্যুরে যাচ্ছি। তিন তিনটে টুর্নামেন্ট আছে ওখানে। আমাকে ছাড়া ওদের চলবে না। বিরাট কোহলির মতো ব্যাট করি তো ! তুই যেভাবেই হোক ম্যানেজ করে নে। প্ল্যান তো ভালই ভাঁজতে পারিস। আর একটা প্ল্যান করতে সময় লাগবে না। প্লিজ ! "
    সব ঘেঁটে গেল দেবাঞ্জনের। চোখের সামনে অন্ধকার দেখল কিছুক্ষণ। তারপরই মাথায় এল অনীককে। প্রতীকদার ভাই অনীক। প্রতীকদা তার সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশলেও প্রতীকের চেয়ে এক বছরের ছোট দেবাঞ্জন। বেশ কয়েকবারই প্রতীকদার বাড়িতে গেছে সে।
     অনীকের চোখের মণির কালো অংশটা এখন আর কালো নেই। আস্তে আস্তে সাদা হয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টিশক্তি কমতে কমতে ক্ষীণ। দেবাঞ্জনদার সঙ্গে দেখা হলেই একটা কাজের কথা বলে অনীক। যে কোনো একটা কাজ। ছোট। আরো ছোট। সামান্য কিছু টাকা পেলেই সে খুশি। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়বে। আত্মবিশ্বাস বাড়লে মন থেকে আস্তে আস্তে মুছে যাবে হীনমন্যতাটা। বাঁচতে ইচ্ছে করবে নতুন করে। বাবা মা মারা যাওয়ার পর তাকে আর কেউ বাঁচতে বলে না। অমন মানুষের বাঁচা মানেই তো বোঝা ! বাড়িতে অঙ্গনওয়ারির কাজ করা বিধবা পিসি আর দাদা, যে মাস পাঁচেক আগে বিয়ে করেছে।
    ফোনটা অনীককেই ধরাল দেবাঞ্জন। তারপর সোজা একেবারে অনীকদের বাড়ি।
    কাজ পাইয়ে দেওয়ার টোপ দিয়ে প্ল্যানমাফিক ঠিক করা নিদিষ্ট জায়গাটাতে অনীককে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দিল তারপর, যেখানে লিসা এসে দাঁড়াবে। 
    শুধু চোখের ঐ সাদা অংশটা ঢাকতে দেবাঞ্জন নিজের সানগ্লাসটা পরিয়ে দিল অনীককে। আর কিচ্ছু বলা হল না। মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে সব। অনীক দেখতে ভাল। মুখের আদল মিষ্টি। গায়ের রঙ ফর্সা। বোকামির এই আশ্বাসই আসল কথাগুলো বলতে দিল না দেবাঞ্জনকে।
    তাই লিসার সামনে অনীক অভিনয় করতে পারল না। 
    একের পর এক সত্যি কথা আর আঘাত সহ্য করার গল্প শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিল ঝাঁঝাল, জেদি মেয়েটা।
    দাদার চাকরির টাকা জোগাড়ের কথা ভাবতে গিয়ে অনীকের দৃষ্টি নিয়ে আর চিন্তা করা হয়নি বাবার। এ রোগের চিকিৎসা আছে। অপারেশনে দৃষ্টিতে খানিকটা হলেও স্বচ্ছতা আসতে পারে। কিন্তু  আগ্রহ দেখায়নি কেউ। অনীক দেখতে না পেলে কার কী আসে যায় !
    শুনতে শুনতে চোখদুটো ছলছল করে লিসার। অনীক সানগ্লাসটা খুলে ফেলতে চাইলে বাধা দেয়।
" থাক না ওটা। দিব্যি মানিয়েছে আপনাকে। "
" সত্যি বলছেন ! জানেন, আমাকে সবাই ব্যঙ্গ করে। " দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনীক। " জীবনে একটাও বন্ধু হল না। সবাই বলে, ওর সাথে মিশে কী হবে ! জীবনে কিছু করতে পেরেছে ও? পারবে কোনোদিন?"
" পারবেন। মনের জোর রাখুন, নিশ্চয়ই পারবেন। পারতেই হবে আপনাকে। আর কে বলল আপনার বন্ধু নেই? আজ থেকে আমি আপনার বন্ধু। আমাকে বন্ধু বলে স্বীকার করবেন তো ! "
" আপনি ! "
" হ্যাঁ। তবে আমার কথা শুনতে হবে কিন্তু  ! "
" কী কথা? "
" ক ' দিনের মধ্যেই আপনাকে নিয়ে আমি সরকারি কোনো হাসপাতালে যাব। আপনার চোখের ব্যাপারে কথা বলব ডাক্তারদের সাথে। যাবেন তো? "
অনীক চুপ করে থাকে।
" কী হল, যাবেন না? না গেলে আমি রাগ করব। "
" যাব। " আবেগতাড়িত হয়ে যায় অনীক। এমন আন্তরিকতা তাকে কোনোদিন কেউ দেখায়নি। এতখানি গুরুত্ব পায়নি কখনও। সানগ্লাসটা আবার খুলতে যায় সে। আবার বাধা দেয় লিসা। ধরে ফেলে হাত। " থাক। "
চোখের জলটা তাই আর মোছা হয়না অনীকের। চোখের মধ্যেই মিশে যায়।
    
    লিসা এখন হোস্টেল ছেড়েছে। বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। মামুলি বেতনের পার্টটাইম একটা কাজ। সবটাই অনীকের জন্য। চোখের চিকিৎসা হচ্ছে তার। ডাক্তাররা বলেছেন, সেরে যাবে। অনেকটাই ফিরে পাবে দৃষ্টি। নতুন একটা সানগ্লাস কিনে দিয়েছে লিসা। আরও সুন্দর। ওটা পরলে অনীককে বেশ লাগে। এক্কেবারে রণবীর কাপূর !

Post a Comment

3 Comments

  1. খুব ভালো একটি গল্প পড়লাম।
    সিদ্ধার্থ সাঁতরা

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো একটি গল্প পড়লাম।
    সিদ্ধার্থ সাঁতরা

    ReplyDelete