জ্বলদর্চি

উদ্ভিদনামে পূর্ব মেদিনীপুরের গ্রামনাম ( পর্ব - ২ )


উদ্ভিদনামে পূর্ব মেদিনীপুরের গ্রামনাম 
( পর্ব - ২ )

ভা স্ক র ব্র ত  প তি


আগেই উল্লেখ করা হয়েছে কিভাবে জেলায় গ্রামনামগুলির সৃষ্টি হতে পারে। উদ্ভিদ সংস্পর্ষ কীভাবে তার সাথে জড়িত, তা জানতে পরবর্তীতে গাছগুলির নাম এবং গ্রামনাম সৃষ্টির সাথে তাদের জড়িত থাকার সম্ভাব্য কারণগুলি উল্লেখ করা হল। এই গ্রামনাম সৃষ্টির সাথে রয়েছে নানা ইতিহাস। জড়িত আছে জেলার কৃষিচিত্র এবং সংস্কৃতির নানা ঝলক। বলতে গেলে পূর্ব মেদিনীপুরের উদ্ভিদযুক্ত গ্রামনামগুলো আসলে জেলার উদ্ভিদকুলের পরিচিতিই বহন করে। 

যেসব গাছের নামে গ্রামনামগুলির সৃষ্টি হয়েছে সেগুলি হ'ল - 

দূর্বা -- গ্রামিনী (GRAMINEAE) গােত্রের দূর্বাঘাসের বিজ্ঞানসম্মত নাম CYNODON DACTYLON | এই দুর্বাঘাসের নামে সৃষ্ট গ্রামনাম হ'ল—দুর্বাবেড়্যা। এই গ্রামনাম সৃষ্টির পিছনে একটি জনশ্রুতি চালু আছে। কোনাে এক সময় মাজনামুঠা স্টেটের মালিক রাজা যাদবরাম চৌধুরী খুবই প্রজা বৎসল, বৈষ্ণব ভাবাপন্ন, ধার্মিক ছিলেন বলে কথিত আছে । প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য ছদ্মবেশ ধরে তিনি ঘুরে বেড়াতেন। ঘুরতে ঘুরতে একদিন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিল। পরগনার রাজধানী মানে পরগনায় অবস্থিত জমিদারি সেরেস্তায় ফেরার উপায়ন্তর না দেখে কাছাকাছি এক প্রজার বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। বাড়ির মালিককে আহার ও রাত্রি যাপনের জন্য বললেন নিজের অসহায় অবস্থার কথা জানিয়ে। অতিথি বৎসল বাড়ির মালিক অতিথিকে সাদরে গ্রহণ করলেন। কিন্তু বাড়ির হাঁড়ির খবর তাঁর জানা ছিলনা। তাই খুবই বিপদে পড়লেন। 

সে যুগে মানুষ অতিথিকে মুনি ঋষি জ্ঞানে ভক্তি করত। তাই অতিথিকে আপ্যায়নের দায় বাড়ির মালিককে ভীষণভাবে পীড়ন করেছিল তখন। অনন্যোপায় হয়ে গৃহকর্তা ও গৃহকর্তী মিলে মাঠের দুর্বা ঘাসের কচি কচি কলি তুলে যত্ন সহকারে রান্না করেছিল। রাত্রিতে আহারের সময় অতিথিকে সেটাই পরিবেশন করেছিল। ছদ্মবেশী রাজা যাদবরাম রায় এই আতিথেয়তায় খুবই তৃপ্ত হন। তারপর ভােরে সেরেস্তায় ফিরে যান। 
পরে একদিন পাইক পাঠিয়ে ওই প্রজাকে সেরেস্তায় তলব করেন। প্রজা পাইক মারফত রাজার তলবে সাংঘাতিক কোনাে অপরাধ হয়েছে এই আশঙ্কায় ভীত হয়ে কোনাে রকমে সাহস সঞ্চয় করে কাছারি বাড়িতে উপস্থিত হয়। উক্ত প্রজা কাছারি বাড়িতে এলে তিনি প্রজাকে অতীতের ওই রাত্রিতে আতিথেয়তার কথা মনে করিয়ে দেন ও রান্না সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। তখন সেই প্রজা সে রাতে বাড়িতে চাউল না থাকায় মাঠের কচি কচি ঘাসের কলি তুলে যত্ন সহকারে রান্না করে অতিথিকে পরিবেশন করেছিল, তা অকপটে স্বীকার করে। প্রজার এই অসহায় অবস্থার কথা ও সত্যবাদিতায় সন্তুষ্ট হয়ে কিছু ভূমি দান করেছিলেন। সেই ঘটনার স্মরণে দান করা জমি সংলগ্ন এলাকার নামকরণ হয়েছে 'দূর্বাবেড়্যা'। 

এই দূর্বা ঘাসকে হিন্দিতে বলে দূর্বা, তামিলে অরুগু, সংস্কৃতে গ্রন্থী এবং তেলুগুতে গরিকে বলে। এছাড়া শতপঠিকা, সহস্রবীটা, ভার্গবী, রুহা, অনন্ত, হরিতা, হরিতালী, কচ্ছরুহা, বহুবীৰ্য্য, দুমরা, তিক্তপর্বা নামে দূর্বাঘাস পরিচিত। দূর্ববেড়্যা ছাড়াও দূর্বাচটি নামের সৃষ্টি দূর্ব্বা থেকেই। জেলায় এখন পাঁচ ধরনের দূর্বাঘাসের (পানীদূর্ব্বা, মালাদূর্ব্বা, শ্বেতদূৰ্ব্বা, নীলদূৰ্ব্বা ও গন্ডদূৰ্ব্বা) মধ্যে সবগুলির দেখা পাওয়া যায় না এখন।

খেজুর -- খেজুরের বিজ্ঞানসম্মত নাম PHOENIX SYLVESTRIS । 'পামি' গােত্রভুক্ত খেজুর গাছ জেলার সর্বত্র দেখা যায়। উপকূল অঞ্চলে বালি এলাকায় এবং দোঁয়াশ মাটিতে প্রচুর জন্মে। খেজুর গাছের দীর্ঘতা কোনাে এলাকার পরিচিতিজ্ঞাপক হয়ে উঠে গ্রামনাম সৃষ্টিতে সহায়তা করে। খেজুরি, খেজুরদা, খেজুরতলা, খেজুরগেছিয়া গ্রামনামগুলি তারই ফল।

পূর্ব মেদিনীপুরে পিন্ডখর্জুরী জন্মায় না। যেগুলি দেখা যায় তা হ'ল ভূখর্জুরী বা জংলী খেজুর এবং বন্য খর্জুর বা খৰ্জুরিকা। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, ভালাে গাছপাকা খেজুরকে শুকিয়ে তৈরি হয় 'খুর্মা এবং কাঁচা খেজুরের শুকিয়ে তৈরি হয় 'ছোয়ারা'। খেজুর গাছ থেকে 'খেজুরি' নামকরণ হয়েছে এ মতামত নিয়ে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে। মহেন্দ্রনাথ করণ মন্তব্য করেছেন -- “খেজুরি নাম সম্ভবত খেজুর গাছের সংস্রবে সৃষ্ট হইয়া থাকিবে। এই স্থান খেজুরি অপেক্ষা খাজুরি নামেই অধিক পরিচিত। খেজুরিকে মুখরােচক 'খিচুড়ি' নামক খাদ্যের সমসংজ্ঞক ভাবিয়া যুরােপীয়েরা KEDGEREE করিয়াছেন। কারণ, খিচুড়ি কে ইংরেজিতে KEDGEREE বলে। আমাদের মনে হয়, নদী বা খালের মুখে নৌকা প্রভৃতির আশ্রয়স্থানে দৃশ্যমানভাবে একটি খেজুর গাছ বর্তমান ছিল—তাহা দেখিয়া দেশীয় নৌ-চালকেরা খেজুরি নামকরণ করিয়া থাকিবে। খেজুরি বন্দরকেই স্থায়ীয় লােক 'খাজুরি ঘাট' বলিত"। 

তবে বিদেশীদের রচনায় এবং মানচিত্রে খেজুরির উচ্চারণ বিভিন্ন করা হয়েছে। তাতেই সন্দেহ উদ্রেক করে যথার্থই কি খেজুর গাছ থেকে খেজুরির উৎপত্তি হতে পারে? ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত ডেভিস অ্যান্ড কোম্পানির 'কোকানাডা টু বেসিন রিভার' মানচিত্রে তৎকালীন মেরিন সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সুপারিটেনডেন্ট আর ক্যারিংটন খেজুরীকে উল্লেখ করেছেন 'KHIJIRI’ নামে। এই মানচিত্রটি এখন রয়েছে কাঁথির ধাড়াস গ্রামে অরবিন্দ মাইতির 'রজনীকান্ত সংগ্রহশালা'তে। 

১৭০১ সালে নাবিকদের চার্টে 'গ্যাজুরি' (GAJOURI) উল্লেখ আছে। বৌরী অবশ্য (১৬৮৭) খেজুরিকে 'ক্যাজুরি' CASUREE লিখেছেন। এই CASUREE -র সাথে কোনােভাবেই ঝাউ বা CASURINA-র সম্পর্ক থাকতে পারেনা। কেননা সপ্তদশ শতকে এই গাছের অস্তিত্ব ছিলনা এখানে। সম্ভবত ভাষাগত উচ্চারণের দোষেই বৌরী এই CASUREE লিখেছেন। রেনেলের মানচিত্রে (১৭৮০) কাদজেরি বা CUDJEREE-র উপস্থিতি দেখা যায় ১৭৬৩ সালে ডি, এনভিল লিখেছেন 'ক্যাজোরি' (CAJORI)। এমনকি এই নামটিই ব্যবহার করেছেন সেয়ার (১৭৭৮)। এর পাশাপাশি উইলিয়াম হেজেস KEGERIA, হিরােন KEDGEREE, হ্যামিল্টন KEDGEREE নাম ব্যবহার করেছেন খেজুরিকে। মেদিনীপুর গেজেটিয়ারে KHEJRI এবং ইম্পিরিয়াল গেজেটিয়ারে KHIJURI ও KIJURI লক্ষ্য করা গিয়েছে।

Thana Sabang Jurisdiction List, Village No-323 তে পােস্ট অফিসের তালিকা থেকে জানা যায় বল্লু, ভূপাল এবং টোচী উপত্যকায় খেজুরি (KHAJURI) এবং ফৈজাবাদের দুই স্থানে ‘খেজুর হাট' রয়েছে। সার্ভে ইন্ডিয়া-র প্রকাশিত BENGAL SHEET তে উপরিউক্ত KHAJURI বানানটিই পরিলক্ষিত হয়। তবে বেইলীর রিপাের্টের উল্লেখ আছে KAJOOREAH নাম। যাই হােক খেজুরির নামকরণে এতদঞ্চলে খেজুর গাছের প্রাধান্য থাকার কারণেই সেই গাছের নামে হয়েছে বলে বিশ্বাস এলাকার মানুষের।

এই খেজুর গাছের রস যাঁরা সংগ্রহ করেন তাঁদের বলা হয় 'শিউলি'। পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় তাে বটেই রাজ্যের অন্যান্য জেলাতেও শীতের সময় রস সংগ্রহে পাড়ি দেন শিউলিরা। যাঁদের মূল আবাসস্থল খেজুরি এবং নন্দীগ্রাম। এই জেলাতেই গ্রাম নাম রয়েছে—শিল্ল্যাবেড়িয়া এবং শিল্লিবাড়ি। শিউলিদের বাড়ি বা আবাস্থল - এই অর্থানুসারে তৈরি হয়েছে গ্রামের নাম। সরাসরি উদ্ভিদজনিত সংযোগ থাকলেও পরােক্ষভাবে গ্রামনাম দুটির সাথে উদ্ভিদ অনুসর্গ কাজ করেছে। আবার গুড় উৎপাদন হয় যে গ্রামে তাই-ই গুড়গ্রাম। 

তেঁতুল -- জেলায় সবচেয়ে বেশি গ্রামনাম হয়েছে যে গাছগুলিকে সামনে রেখে, তার মধ্যে তেঁতুল একটি। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম TAMARINDUS INDICUS। এটি সিসালপিনীয়েসী গােত্রভুক্ত। তেঁতুলিয়া, তেঁতুলতলা, তেঁতুলিয়াগিরি, দক্ষিণ তেঁতুলিয়া, তেঁতুলমুড়ি, তেঁতুলবেড়িয়া গ্রামনামগুলির সৃষ্টি তেঁতুল থেকেই। তেঁতুল গাছের নামে অনেক গ্রামের নাম হয়েছে। এই ধরনের গ্রামনামের সৃষ্টির পিছনে মূল কারণ এর বিশাল বপু। একসময় গ্রামে প্রচুর বড় বড় তেঁতুলগাছ দেখা যেত। তখন ওই গাছই হয়ে উঠছিল এলাকার পরিচিতিজ্ঞাপক নিদর্শন। পাঁশকুড়া থানার সাহড়দা গ্রামে একটি বিশাল তেঁতুলগাছ ছিল আজ থেকে ৩০ বছর আগে। বহু দুর থেকে তাকে দেখা যেত। গাছের মগডালে ছিল শকুনের বাসা। অসংখ্য শকুন থাকত সেখানে। সেই গাছের তলায় শেকড়ের ঘেরাটোপের মধ্যে খেলাধুলা করত গ্রামের ছেলেমেয়েরা। মাঠটির নাম হয়েছিল- 'তেঁতুলতলা'। হঠাৎ একদিন গাছটি কেটে নেওয়া এবং সেই জায়গাটি অন্যভাবে দখলিকৃত হওয়ায় সেখানে এখন কেউ খেলেনা। আর কোনােদিন ওই এলাকার নাম 'তেঁতুলতলা' হিসেবে উচ্চারিত হয়নি। তেঁতুলকে সংস্কৃতে বলা হয় তিন্তিড়ী, হিন্দিতে ইমলি, গুজরাটিতে অম্বালী, কন্নড়-এ হুনিসে, তেলুগুতে চিন্তাচেটু চিন্ট, তামিলে পুঠঠি এবং ওড়িয়াতে কংআং। তেঁতুলকে আরও যে যে নামে ডাকা হয়, সেগুলি হল - তিন্তিড়ীক, সুতিন্তিড়া, চিঞ্চা, অম্লিকা, আম্লিকা, চুঞ্চু, চুক্রিকা, সুচক্রিকা, চরিত্রা, ভুক্তা, শাকচুক্রিকা, পিচ্ছিল, গুরুপত্রা, ভুক্তিকা, অত্যম্লা ইত্যাদি। 

শিমুল -- এটিও তেঁতুলের মতাে একটি জনপ্রিয় গাছ। বােম্বাকেসী গােত্রের শিমূল গাছ তথা SALMALIA MALABARICA-র নামে প্রচুর গ্রামনাম হয়েছে। যেমন - শিমুলিয়া, শিমুলখণ্ড, শিমুলদাঁড়ি, চক শিমুলতলা, শিমুলবেড়িয়া, শিমুলহান্ডা, শিমুলবাড়ি ইত্যাদি। 
শিমুল + ইয়া (প্রত্যয়) > শিমুলিয়া। 
এই নামটি অনেকগুলি রয়েছে জেলায় (তেঁতুলিয়া ও পাকুড়িয়া - গ্রামনাম দুটিও অনেকগুলি)। ওড়িয়া শব্দ ‘হন্ডা' বা মারাঠি শব্দ 'হংডা' যুক্ত হয়েছে শিমুল-এর সাথে । 
শিমুল + হন্ড/হংড়া > শিমুলহান্ডা। 
'বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অনুসারে হন্ডা বা হংড়া-র অর্থ হাঁড়া বা বড় হাঁড়ি বা পাকপাত্র। অর্থাৎ শিমুলগাছ সমৃদ্ধ বড়াে হাঁড়ির মতাে গ্রাম। শিমুলকে তামিলে ইনাভাম, গুজরাটিতে রতো, সংস্কৃতে শাল্মলী, ওড়িয়াতে শিমুরী, তেলুগু শভর নামে ডাকা হয়। এছাড়া শিমুলকে বলা হয় নন্দিতরু, ধুরন্দর, কষ্টকদ্রুম, যমদ্রুম, চিরজীবী, পিচ্ছিল, সপুষ্পক, রম্যপুষ্প এবং নমাচ। 

পাকুড় -- এই গাছকে কেন্দ্র করে একটি বিশেষ রীতি মেনে চলেন জেলার বাসিন্দারা। সন্ধ্যেবেলায় পাকুড় গাছের তলে সন্ধ্যা দেওয়ার চল দেখা যায় অনেক বাড়িতে। ক্রমশঃ কমছে অবশ্য এই পাকুড় গাছের ( FICUS INFECTORIA) সংখ্যা। মােরেসী গােত্রভুক্ত পাকুড়ের নামে সৃষ্ট পাকুড়িয়া গ্রামনামটি অনেকগুলি পাওয়া যাবে পূর্ব মেদিনীপুরে। পাকুড়তলা-ও একটি গ্রামনাম। প্লবগ, গর্দভাণ্ড, কপীতক, সুপার্শ্ব, শক্ষীরী, কপীতন ইত্যাদি নামগুলি পাকুড়ের বৈশিষ্ট্য অনুসারে দেওয়া। পাকুড়কে সংস্কৃতে প্লক্ষ, শৃঙ্গী, পর্কটী, তামিলে পেপরি, তেলুগুতে পসারি, হিন্দিতে পাকরি বলা হয়। 

কাঁকুড় -- বেশ কয়েকটি গ্রামনাম পাওয়া যায় কাঁকুড় থেকে। কাঁকুড়িয়া, কাঁকুড়িয়াডাঙ্গা, কাঁকুড়খানা ইত্যাদি সেসব নাম। এটি শসা সদৃশ প্রজাতি বিশেষ।
খরখরে পাতা, গােল ডােরকাটা লম্বা ফল এবং পাকলে লাল বর্ণের হয়। মূলতঃ বেলে মাটিতে হয়। তাই এই গাছের নামে সৃষ্ট গ্রামনামগুলির অবস্থান মূলতঃ পূর্ব মেদিনীপুরের দক্ষিণ দিকগুলিতে। জমিতে লতিয়ে চলে। এখন অবশ্য তেমন চাষ করা হয়না। কিউকারবিটেসী বা কুমড়া বর্গের এই গাছকে ল্যাটিন পরিভাষায় CUCUMIS UTILISMUS নাম দেওয়া হয়েছে। গুজরাটিতে কাঁকড়ী, সংস্কৃতে এধারু, হিন্দিতে ককড়ী, কাশ্মিরীতে খ্যাটজাব, কন্নড়ে ক্যেয়সৌত, অসমীয়া কিসাসকদম এবং তেলুগুতে দোসকায়া বলা হয়। 

আকন্দ -- ক্ষীরদল, ক্ষীরকান্তক, ক্ষীরপর্ণা, বিক্ষীর, ক্ষীরী, শীতপুষ্পক, বিকীরণ, পুচ্ছী, প্রতাপ, অর্কপর্ণ, আস্ফোত, শূকফল, জম্ভন, সদাপুষ্প, সূর্যাহ্ব, বসুক নামে পরিচিত আকন্দ গাছ। এ গাছেরও ক্ষীর বা LATEX পাওয়া যায়। জেলাতে অবশ্য বেগুনি রঙের আকন্দ বেশি মেলে। আকন্দবাড়ি, আকন্দি গ্রামনামগুলির সৃষ্টি হয়েছে আকন্দ থেকেই। ল্যাটিন পরিভাষায় CALOTROPIS GIGANTIA বলে (গােত্র- অ্যাসক্লেপিয়াডেসী)। রেল লাইনের ধারে কিংবা বাস রাস্তার ধারে প্রচুর আকন্দ গাছ জন্মায়। বহু গরিব লােক এই আকন্দ ফুল বিক্রি করে আয় করে। শিবের পূজোতে আকন্দের মালার চাহিদা খুবই।
অশ্বত্থ -- ক্ষীরবৃক্ষের দলে আকন্দ, মান্দার, ক্ষীরাই-এর মতাে অশ্বত্থ-ও পড়ে। ধর্মীয় বা রিলিজিয়াস ব্যাপার এই গাছের সাথে জড়িত। তাই ল্যাটিন নামেও তার ছোঁয়া — FICUS RELIGIOSA। 'মোরেসি' গোত্রভুক্ত এই গাছের তলে শাক্যমুনি বােধিলাভ করেন। তাই এটি 'বোধিবৃক্ষ'। যদিও ক্ষীরদ্রুম, গুহ্যপুষ্প, শ্রীমান, অচ্যুতবাস, চলপত্র, পবিত্রক, মাঙ্গল্য, ধর্মবৃক্ষ, চৈতদ্রুম, শুচিদ্রুম, বিপ্রসেব্য, শ্যামল, সত্য নামেও পরিচিত অশ্বথ গাছ। সংস্কৃতে একে গজভক্ষ, পিপুল, ক্ষীরদ্রুম। হিন্দিতে পিপল, গুজরাটিতে জেরি, সাঁওতালিতে হেসাক, তামিলে অর্শেমরম নামে ডাকা হয়। কেবল অশ্বথ থেকে যে সব গ্রামনামের সৃষ্টি তা হল—অশ্বত্থতলিয়া, আসদতলিয়া, আস্তাড়া, আশুতিয়া, অশ্বত্থপুর ইত্যাদি।
অশ্বত্থ + তলা > অশ্বত্থ তলা > অশ্বত্থলিয়া > আসদতলিয়া
অশ্বত্থ + আড়া > আস্তাড়া
অশ্বত্থ + ইয়া প্রত্যয় > আশুতিয়া
অশ্বত্থ + পুর > অশ্বত্থ পুর 
এই অশ্বত্থের অন্য নাম পিপুল বা পিপল (আগে উল্লেখ করা হয়েছে)। তা থেকে সৃষ্ট হয়েছে দুটি গ্রামনাম পিপুলতলা এবং পিপুলবেড়িয়া বা পিপুলবেড়্যা। তবে তাম্বুলাদিবর্গের গাছ পিপুল বা পিপ্পলী (যার উদ্ভিদবিদ্যাগত নাম PIPER LONGUM) থেকে এই গ্রামনামগুলির সৃষ্টি হয়েছে, এ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু জেলায় পিপুল গাছের তুলনায় পিপল বা অশ্বথ গাছ বেশি সহজলভ্য এবং বেশি এলাকায় জন্মায়। তাই পিপুল থেকেই নামগুলি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

Post a Comment

0 Comments