জ্বলদর্চি

ব্ল্যাক প্যান্থার ( Black Panther)


ব্ল্যাক প্যান্থার : ওয়াকান্ডা ফরএভার, চ্যাডউইক বোসম্যান ফরএভার

পরিচালনা – রায়ান কুগলার
অভিনয় – চ্যাডউইক বোসম্যান, মাইকেল বি জর্ডান, লেটিটিয়া রাইট, অ্যাঞ্জেলা ব্যাসেট প্রমুখ।
মুক্তি – ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৮
রেটিং – 5/5


In my culture…………. Death is not the end.’
-      Prince T’Chala aka Black Panther (Captain America : Civil War)
'আমাদের সংস্কৃতিতে, মৃত্যু পরিসমাপ্তি নয়।’
নিজের পিতা এবং ওয়াকান্ডার মহারাজা টি’চাকার মৃত্যুর পর এই উক্তি দিয়ে এক যুবরাজ থেকে ব্ল্যাক প্যান্থার হয়ে ওঠার পথচলা শুরু করে টি’চালা (চ্যাডউইক বোসম্যান)। শুরু হয় মার্ভেল সিনেম্যাটিক দুনিয়ায় এক নতুন সুপারহিরোর যাত্রা।
গত ২৮ আগস্ট ২০২০, সকল সিনেমাপ্রেমী, মার্ভেল ফ্যানদের কাঁদিয়ে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে পরলোক গমন করেছেন মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সে ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ সুপারহিরো চরিত্রাভিনেতা  চ্যাডউইক বোসম্যান। অভিনয়ের শ্রেষ্ঠত্বে আমাদের হৃদয়ে অমর করে দিয়ে গেলেন আফ্রিকার মাটি থেকে উঠে আসা এক কৃষ্ণাঙ্গ সুপারহিরোকে। ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ সুপারহিরো সিনেমার এক দুর্লঙ্ঘ্য মাইলস্টোন। এমন সিনেমাপ্রেমী থাকা বিরল যারা এখনও এই ক্লাসিক সুপারহিরো ছবিটি মিস করেছেন। অনেকেই বলবেন ওসব সুপারহিরো সিনেমা বাচ্চাদের দেখার, তাদের জানাই একটিবার মুখোমুখি হন ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’-এর আপনার এতদিনের সব স্টিরিওটাইপ ধারনা চিরতরে বদলে যাবে। শুধু মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সই নয়, পুরো সুপারহিরো সিনেমার জগতেই যেন ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ যোগ করেছে নতুন এক মাত্রা। এই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে হলিউডে তৈরি হওয়া বিশাল বাজেটের এই সিনেমার বক্স অফিস সাফল্য বদলে দিল সিনেমা নিয়ে হলিউডের প্রচলিত রীতি। প্রথম সুপারহিরো সুপারম্যানের আবির্ভাব হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমসাময়িকে। এরপরে কমিক্‌স এর দুনিয়ায় আরও অনেক সুপারহিরো এসেছে। কেউবা থর,  সুপারম্যানের মতোই দেবতা-সম, কেউ অন্য কোনো যোগ্যতায় অতিমানব। তাদের মধ্যে সার্বজনীন যে বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় তা হচ্ছে তাদের সবাই শ্বেতাঙ্গ এবং তাদের প্রায় সবাই তথাকথিত আমেরিকান সংস্কৃতি  লালন করে। কখনোই আমরা একজন কৃষ্ণাঙ্গকে সুপারহিরো চরিত্রে দেখিনি। এর প্রধান কারণ, হাজার বছর ধরে কালো চামড়ার মানুষদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ হিসেবে দেখার এক ঘৃণ্য রুচি। ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ এই কূপমণ্ডূক চিন্তাধারাকে বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে। ব্ল্যাক প্যান্থারকে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক দেশ ওয়াকান্ডার সম্রাট হিসেবে দেখানোর মূল উদ্দেশই হচ্ছে মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া ‘অভিজাত’ শব্দটা শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গদের জন্য নয়।
 শত-সহস্র বছর পূর্বে যখন আফ্রিকার পাঁচ জাতি ভিনগ্রহী ধাতু ভাইব্রেনিয়াম নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পরে, তখন একজন যোদ্ধা ওই ধাতুর দ্বারা প্রভাবিত একটি হৃদয়াকৃতির ভেষজ সেবন করেন যা তাকে অতিমানবিক ক্ষমতা দান করে। তিনিই হয়ে উঠেন প্রথম ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ এবং সব গোত্রকে এক করে ‘ওয়াকান্ডা’-র প্রতিষ্ঠা করেন। যুগে যুগে ওয়াকান্ডাবাসী পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ধাতু ভাইব্রেনিয়াম ব্যবহার করে অতিআধুনিক ভিন্ন মাত্রার প্রযুক্তি গড়ে তোলে। এই অগ্রসর প্রযুক্তি এবং তাদের শত বছরের সংস্কৃতিকে আগলে রেখে তারা এক অনন্যসাধারণ জাতিতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু বহির্বিশ্বের নজর এড়ানোর জন্য এই অগ্রসর প্রযুক্তি ব্যবহার করেই তারা নিজেদের একটি তৃতীয় বিশ্বের হলোগ্রাফিক চাদরে ঢেকে রাখে। যখন সম্রাট টি’চাকা মৃত্যুবরণ করেন, তখন তার সন্তান টি’চালা (ব্ল্যাক প্যান্থার) সিংহাসনে অভিষিক্ত হয়। নতুন সম্রাট হয়েই বিভিন্ন সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয় টি’চালা/ব্ল্যাক প্যান্থারকে। জাবারি গোত্রের চ্যালেঞ্জ, ওয়াকান্ডার ভাইব্রেনিয়াম চুরি করে পাচার করা অস্ত্রের চোরাকারবারি ইউলেসিস ক্ল-কে ধরার চ্যালেঞ্জ। আর সাথে যোগ হয় তার হঠাৎ রাজত্ব প্রাপ্ত হওয়ায় রাজা হিসেবে নিজেকে অপ্রস্তুত মনে করা ব্ল্যাক প্যান্থারের মানসিক দ্বন্দ্ব। কেমন রাজা হবে সে? পূর্বপুরুষের মতো দেশকে রক্ষার নাম করে নিজেদের সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখবে? নাকি সারা বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের সাহায্যে এগিয়ে আসবে? উন্মুক্ত করবে ওয়াকান্ডার দরজা?
রায়ান কুগলারের পরিচালনা এককথায় ছিল অসাধারণ। জো রবার্ট কোলের সাথে সিনেমার চিত্রনাট্যও লিখেছেন তিনি। রুথ কার্টারের কড়া জাঁকজমকপূর্ণ কস্টিউম ডিজাইন বিশেষভাবে নজর কেড়েছে। র‍্যাচেল মরিসনের সিনেম্যাটোগ্রাফি কিংবা লুডউইগ গোরানসনের মিউজিক- সবই ছিল মনোমুগ্ধকর। ব্ল্যাক প্যান্থার ২০১৯ সালে সাতটি একাডেমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়, যার মধ্যে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ পরিচ্ছদ নকশা, শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা পরিকল্পনা, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র সুর, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র গান ("অল দ্য স্টার্স"-এর জন্য), শ্রেষ্ঠ শব্দ সম্পাদনা এবং শ্রেষ্ঠ শব্দ মিশ্রণ। অবশেষে মার্ভেলের জন্য প্রথম অস্কার নিয়ে আসে ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ তার মুগ্ধকর কস্টিউম ডিজাইনের জন্য। এছাড়াও চলচ্চিত্রটি ছিল শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগের জন্য সর্বপ্রথম সুপারহিরো চলচ্চিত্র। অন্যদিকে, শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা পরিকল্পনা বিভাগের জন্য বিচলার-এর মনোনয়ন ছিল একজন আফ্রিকান-আমেরিকান এর জন্য সর্বপ্রথম। অল্পবয়সী অ্যাফ্রো-আমেরিকান পরিচালক রায়ান কুগলার তার সিনেমাকে সাজিয়েছেন আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। ইতিহাস আর বাস্তবের মিশেলে ওয়াকান্ডিয়ান রূপকথাকে তুলে ধরেছেন অনিন্দ্য সুন্দর এক রূপে। রায়ান কুগলার সহস্র বছরের উপনিবেশিক শাসন অধ্যুষিতদেরকে কতটা শুষে নিয়েছে তা-ও দেখিয়েছেন ওয়াকান্ডার মাধ্যমে। সভ্যতার শুরু হয় আফ্রিকায়। শিল্প-সংস্কৃতি-সম্পদে পরিপূর্ণ আফ্রিকাতে বসতি গাড়ে সাম্রাজ্যবাদীরা। লুট হয় তাদের সব সম্পদ, নিগৃহীত হয় তাদের সংস্কৃতির। কল্পিত আফ্রিকান রাজ্য ওয়াকান্দা সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য নিজেদের তৃতীয় বিশ্বের চাদরে লুকিয়ে রেখেছে এবং শুধু নিজেদের সম্পদ ব্যবহার করেই তারা বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত জাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এর মাধ্যমে পরিচালক স্পষ্টভাবে এই বার্তা দিতে চেয়েছেন সাম্রাজ্যবাদীরা সবকিছু শুষে না নিলে আজকে আফ্রিকাও হয়তো ওয়াকান্ডার মতো চোখ ধাঁধানো কিছুতে রূপান্তরিত হতে পারতো।
রায়ান কুগলারের ভিশনে ধরা পড়েছে এই সময়ের সবচেয়ে নিখুঁত ইউটোপিয়ান ছবি। এই সিনেমায় সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন বিষয়টি হল নারী শক্তির  কল্পনা। ব্ল্যাক প্যান্থারের আশেপাশে যত শক্তিমান চরিত্র তারা সবই নারী। ব্ল্যাক প্যান্থার এর যাবতীয় অস্ত্র এবং টেকনলোজির উদ্ভাবন করে তার সুপার জিনিয়াস বোন সুরি। ব্ল্যাক প্যান্থারের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে তাকে গার্ড অব অনারও দেয় তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী নারী সৈনিকদের বিশেষ দল ‘ডোরা মিলাজে’। ওয়াকান্ডার সেনাবাহিনীর সিংহভাগ সদস্যই নারী, এমনকি তাদের জেনারেলও। এত সুন্দরভাবে নারীর ক্ষমতায়ন দেখাতে পারেনি আর কোনো ছবি।
ব্ল্যাক প্যান্থারের চরিত্রায়নও হয়েছে এককথায় অসাধারণ। ব্ল্যাক প্যান্থারের মধ্যে যে রাজকীয় আভিজাত্য, আফ্রিকান উচ্চারণ  দরকার ছিল তা পূরণ করতে শতভাগ সফল হয়েছেন চ্যাডউইক বোসম্যান। ছবিতে ব্ল্যাক প্যান্থারের প্রধান সাহায্যকারী হিসেবে রয়েছে তার সুপার জিনিয়াস বোন রাজকুমারী সুরি। সুরি চরিত্রে লেতিশিয়া রাইট এক অসাধারণ পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন। সকল অভিনেতাই নিজ নিজ চরিত্রে দৃঢ় পারফরম্যান্স উপহার দিলেও প্রশ্নাতীতভাবে সবাইকে ছাপিয়ে সেরা পারফরম্যান্সটি উপহার দিয়েছেন মাইকেল বি জর্ডান। ব্ল্যাক প্যান্থারের খুড়তুতো ভাই এবং প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী কিলমঙ্গার চরিত্রে মাইকেল বি জর্ডান এতটাই অসাধারণ অভিনয় করেছেন যে, প্রতিটি নায়ক-ভিলেন এনকাউন্টারে দর্শকদের দৃষ্টি ব্ল্যাক প্যান্থারের থেকে সরিয়ে নিজের দিকে নিতে সক্ষম হয়েছেন। ডি সি সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের হিথ লেজার অভিনীত জোকারের পর সর্বশ্রেষ্ঠ সুপারভিলেন হিসেবে দেখা হচ্ছে মারভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের মাইকেল বি জর্ডানের কিলমঙ্গারকে। একজন ভিলেন তখনই শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে যখন তাকে দেখে দর্শকের মনে এই প্রশ্ন জাগে যে, সে তো নায়কও হতে পারতো। কিলমঙ্গারের লক্ষ্য খুবই স্পষ্ট এবং যৌক্তিক। সে ওয়াকান্ডার অন্তর্মুখী নীতির ঘোর বিরোধী। উন্নত প্রযুক্তি ও ভাইব্রেনিয়াম দিয়ে সে বিশ্বজুড়ে ২০০ কোটি নিপীড়িত আফ্রিকান বংশোদ্ভূতকে সাহায্য করতে চায়। হাজার বছরের নিপীড়নের প্রতিশোধ নিতে চায়। ক্ষণিকের জন্য আপনার মনেও হতে পারে কিলমঙ্গারের চিন্তাধারায় দোষের কী আছে? কিন্তু একটু গভীরে চিন্তা করলে দেখবেন, সকল সাম্রাজ্যবাদী এবং মৌলবাদীদের চিন্তার কাঠামো একই রকম ছিল। ঔপনিবেশিক ব্রিটেন থেকে হিটলার, কিংবা এই সময়ের আইএস (IS), সবাই কিলমঙ্গারের মতো করেই চেয়েছে তাদের রাজত্ব ও মতাদর্শ প্রসারিত হোক। এই সময়ে একটি সুপারহিরো ফিল্মের কাছে আমরা যতটা চাইতে পারি তার সবটুকুই দিয়েছে ব্ল্যাক প্যান্থার। কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতির পুঙ্খানুপুঙ্খ উপস্থাপনা যেমন দেখেছি, তেমনি বর্তমান বিশ্ব-নীতির কালো দিকগুলোকে প্রতীকীরূপে তুলে ধরেছে। বিশ্বনীতি-সাম্রাজ্যবাদ-মৌলবাদকে ভাবাদর্শিকভাবে চপেটাঘাত যেমন করেছে, তেমনি তা থেকে উত্তরণের উপায়ও বাতলে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশ্বনেতাদের কাছে এই মুহূর্তে যে বার্তাটি সবাই শুনতে চাইছে, সম্রাট টি’চালা যেন ছবি শেষে বিশ্ব জাতিপুঞ্জের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাই বলে-

… in times of crisis the wise build bridges, while the foolish build barriers”

(“… সংকটের সময় বুদ্ধিমানরা সেতু তৈরি করে, আর বোকারা তৈরি করে বেষ্টনী”)
এই মুভি স্বপ্ন দেখায়, স্বপ্ন দেখায় এক পৃথিবীর। ভূখণ্ড বিভাজিত হলেও আকাশ অভিন্ন। তার তারার ছায়ায় সবাই সমান। দেখা না হয়ে থাকলে আপনার বাড়ির ছোটদের নিয়ে সপরিবারে অবশ্যই দেখে ফেলতে পারেন এই মুভি। এই মুভি মিস করলে বাকী থেকে যাবে আপনার ভালো সিনেমার তালিকা। আর দেখে থাকলে আবার দেখুন কারণ  মহারাজ টি’চালা চিরকালের জন্য চলে গেছেন অ্যানসেস্ট্রাল প্লেইনে (Ancestral Plane)।
 

5 অসাধারণ
4 বেশ ভালো
3 ভালো
2 দেখতে পারেন
1 না দেখলেও চলবে 
 

Post a Comment

0 Comments