জ্বলদর্চি

সত্যের পূজারি মহাত্মাজী /মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

Mahatmaji, the worshiper of truth

নাটক
---------
সত্যের পূজারি মহাত্মাজী 
রচনা – মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

চরিত্রলিপি

মোহনদাস --জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী   
পুতলিবাঈ--মোহনদাসের মা 
লক্ষ্মীদাস-- মোহনদাসের দাদা 
মাভজী--গান্ধী পরিবারের হিতাকাঙ্ক্ষী
মি. জাইলস--ইন্সপেক্টর
শিক্ষকমশাই--রাজকোট পাঠশালার শিক্ষক
কনস্টেবল, আশ্রমবাসী, কংগ্রেস কর্মীবৃন্দ


“রঘুপতি রাঘব রাজা রাম পতিত পাবন সীতারাম।
মঙ্গলপরশন রাজা রাম পতিত পাবন সীতারাম।
শুভ শান্তি বিধায়ক রাজা রাম পতিত পাবন সীতারাম
বরাভয়-দানরত রাজা রাম পতিত পাবন সীতারাম।
নির্ভর কর প্রভু রাজা রাম পতিত পাবন সীতারাম।
দীন দয়াল প্রভু রাজা রাম পতিত পাবন সীতারাম।
রাজা রাম জয় সীতা রাম পতিত পাবন সীতারাম।
ঈশ্বর আল্লা তেরে নাম সবকো সম্মতি দে ভগবান।”।

প্রথম দৃশ্য
-------------

[রাজকোটের প্রাথমিক পাঠশালা। মেঝেতে পাতা মাদুরে বসে মোহনদাস ও আরও কয়েকজন ছাত্র। শিক্ষক মহাশয় পড়াচ্ছেন।]
শিক্ষকমশাই :- এই যে ছাত্ররা। তোমরা চুপচাপ বসে মন দিয়ে পড়ে যাও। গোলমাল করবে না। এদিক ওদিক তাকাবে না। শিক্ষা বিভাগের ইনস্পেক্টর জাইলস সাহেব স্কুল পরিদর্শনে এসেছেন। অল্পক্ষণ পরে তিনি এই ক্লাসেও আসবেন। তোমরা তাঁকে যথাযথ সম্মান জানিও। আর তিনি যা বলবেন তা তোমরা করবে। কী মনে থাকবে তো?

ছাত্ররা :- হ্যাঁ, স্যার। মনে থাকবে।

শিক্ষকমশাই :- বেশ-বেশ। ওই তিনি আসছেন। তোমরা উঠে দাঁড়াবে।
(জাইলস সাহেবের প্রবেশ)
জাইলস :- গুড মর্নিং মাস্টারমশাই। আসছি-

শিক্ষকমশাই :- হ্যাঁ স্যার, আসুন-আসুন। গুড মর্নিং।

ছাত্ররা :- (উঠে দাঁড়িয়ে) গুড মর্নিং স্যার।

জাইলস :- মর্নিং। বোস-বোস সকলে।
(ছাত্ররা বসে পড়ে)

শিক্ষকমশাই :- স্যার, স্যার দাঁড়িয়ে কেন? আপনি বসুন স্যার।

জাইলস :- না মাস্টারমশাই, আমি বসবো না। আপনার ছাত্ররা সব কেমন পড়ালেখা করছে তার একটুখানি পরখ করে নিয়েই চলে যাব। বেশি সময় আমি নেব না।

শিক্ষকমশাই : - হ্যাঁ-হ্যাঁ, তাই করুন স্যার। আপনার ইচ্ছেমতন আপনি পরীক্ষা করে নিন।

জাইলস :- না, আমি তেমন কোনো পরীক্ষা নেব না। মাত্র পাঁচটি ইংরেজি শব্দ লিখতে দেব।

শিক্ষকমশাই :- ছাত্ররা, শুনলে তো। ইনস্পেক্টর সাহেব তোমাদের মাত্র পাঁচটা ইংরেজি শব্দ লিখতে দেবেন। নাও, তোমরা কাগজ-কলম বের করো।
(মোহনদাস সহ ছাত্ররা শিক্ষকমশাই-এর নির্দেশে কাগজ-কলম বের করল।)

জাইলস :- কী তোমরা কাগজ-কলম বের করে রেডি তো? ঠিক আছে লেখো তোমরা। প্রথমে লেখো-এডুকেশন। হয়েছে? এর পরে লেখো কেটল। তারপরে লেখো-ইন্ডিয়া, লেখো হিউম্যানিটি। শেষ শব্দ, ওয়েলকাম।

(জাইলস সাহেব ধীরে ধীরে শব্দগুলি বলতে থাকেন। ছাত্ররা লেখে যাচ্ছিল। শিক্ষকমশাই ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। তিনি দেখলেন মোহনদাস ‘কেটল’ শব্দটি ভুল লিখেছে। তাই শিক্ষকমশাই বার বার মোহনদাসের পায়ে খোঁচা মারেন, ইশারায় বলতে চান পাশের ছেলের খাতা দেখে বানানটি ঠিক করে নিতে। মোহনদাস নীরব থাকে।)

জাইলস :- লেখা হয়েছে? এবারে একে একে উঠে এসো। দেখি কেমন লিখেছো তোমরা।

(ছাত্ররা একে একে উঠে আসে। খাতা দেখায়। দেখা যায় মোহনদাস বাদে সকলে সব বানান ঠিক লিখেছে।)
জাইলস :- তোমার নাম কী?

মোহনদাস :- মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।

জাইলস :- সকলেই তো সব বানান ঠিক লিখেছে। তুমিও চারটা বানান ঠিক করেছ। কিন্তু তোমার ‘কেটল’ বানানটি ভুল হয়েছে। না-না, তারজন্যে মাথা নিচু করতে হবে না। ঠিক আছে। তোমরা হলে ছাত্র, ভুল করতেই পারো। মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করো কেমন? মাস্টারমশাই, আমার কাজ আপাতত শেষ হয়েছে। আমি আসছি-

শিক্ষকমশাই :- হ্যাঁ স্যারা, আসুন। নমস্কার –
(জাইলস সাহেব প্রতি নমস্কার জানিয়ে চলে যান। শিক্ষকমশাই একটুখানি পায়চারি করেন গম্ভীরমুখে। তারপর মোহনদাসকে কাছে ডাকেন) মোহনদাস, উঠে এসো। (মোহনদাস উঠে আসে। মাথা নিচু করে দাঁড়ায়।)

মোহনদাস :- ইনস্পেক্টর সাহেব কী বলে গেলেন তোমায়?

মোহনদাস :- আমার ‘কেটল’ শব্দের বানানটা লেখা ভুল হয়েছে।

শিক্ষকমশাই :- আমি তো তোমাকে-

মোহনদাস :- হ্যাঁ, আপনি আমাকে পায়ের বুটের ঠোক্কর লাগিয়ে সচেতন হতে বলেছিলেন। ইশারায় বলতে চেয়েছিলেন পাশের ছেলের খাতা দেখে বানানটা ঠিক করে নিতে।

শিক্ষকমশাই :- বুঝতে পেরেও তা সংশোধন করে নিলে না কেন? ভুল লেখাটাই জমা দিলে?

মোহনদাস :- স্যার, আমি সততায় বিশ্বাসী। সত্‍ থাকাটা আমার ধর্ম।

শিক্ষকমশাই :- মোহনদাস!

মোহনদাস:- স্যার, আমি তো তেমন বুদ্ধিমান নই। আমি একজন অতি সাধারণ মানের ছাত্র। তাই অসদ উপায় অবলম্বন করে আমি ভালো ছাত্র সাজব কেন? আমার বিবেক আমাকে এই কাজটা করতে দেয়নি স্যার। তাই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি কাজটা করতে পারিনি।

শিক্ষকমশাই :- এ তুমি কী বলছ মোহনদাস?

মোহনদাস :- স্যার, আপনি আমার গুরুজন, প্রণম্য। আপনি আমায় ক্ষমা করবেন আপনার নির্দেশ পালল করতে পারিনি বলে। তাই বলে আপনার প্রতি আমার সম্মান কমে গেছে এটা ভাববেন না। আমার মা-বাবা আমায় শিখিয়েছেন বড়োদের দোষ ধরতে নেই। আপনি আমার কাছে আগেও যেমন ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র এখনো তেমনই আছেন। আপনি আমার প্রণাম গ্রহণ করুন।
(প্রণাম করে)
শিক্ষকমশাই :- ওরে মোহনদাস, তোর কাছে আজ একটা বড়ো শিক্ষা পেলাম আমি।  তোকে আমি প্রাণ ঢেলে আশীর্বাদ করছি তোর এই সততা, সত্‍ থাকার প্রচেষ্টা তোর জীবনে অনেক সাফল্য এনে দেবে। আমি বলছি তুই অনেক বড়ো হবি, বড়ো মাপের মানুষ হবি।
(শিক্ষকমশাই মোহনদাসকে বুকে টেনে নেন। অন্য ছাত্ররা মুগ্ধনেত্রে তাকিয়ে থাকে)


দ্বিতীয় দৃশ্য
---------------

(মোহনদাসের বাড়ি। কথা বলছিল পুতলিবাঈ, লক্ষ্মীদাস, মাভজী সাহেব এবং মোহনদাস।)
মাভজী :- মা পুতলিবাঈ, মোহনদাসের পড়াশোনার খবর কী?

পুতলিবাঈ :- এই তো মোহনদাস কাছেই আছে। জিজ্ঞেস করুন না।

মাভজী :- কি মোহনদাস –

মোহনদাস :- এই তো ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে ভাবনগরের শ্যামলাল কলেজে ভর্তি হয়েছি।

মাভজী :- মা পুতলিবাঈ , এটা মনে হয় তোমরা ঠিক করনি।

পুতলিবাঈ :- কোনটা পণ্ডিতমশাই?

মাভজী :- এই মোহনদাসের পড়াশোনার ব্যাপারটা।

পুতলিবাঈ :- কেন?

মাভজী :- দেখো, দিনকাল বদলে গেছে। ভালোভাবে শিক্ষা-দীক্ষা না করলে তোমাদের ছেলেদের মধ্যে কেউ কাবা গান্ধীর গদিতে বসার উপযুক্ত হয়ে উঠবে না। ওর তো বি. এ. পাশ করতেই চার-পাঁচ বছর লেগে যাবে। আর পাশ করলেও বড়োজোর একটা পঞ্চাশ-ষাট টাকার চাকরি জুটবে। তাতে কি আর রাজকোটের গদি সামলানো যাবে?

পুতলিবাঈ :- তাহলে আপনি কি করতে বলছেন?

মাভজী :- মোহনদাসকে আইন পড়তে বিলেত পাঠিয়ে দাও। আমার ছেলে কেবলরাম বলছিল যে বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টারি হয়ে ফিরে আসাটা খুব সহজ। তিন বছরের বেশি সময় লাগবে না। সর্বসাকুল্যে চার-পাঁচ হাজার টাকার মতো খরচ হবে হয়তো।

লক্ষ্মীদাস :- আমিও ভাইয়ের ভবিষ্যত্‍ পড়াশোনার ব্যাপারে এরকমই কিছু একটা ভাবছিলাম। মোহনদাস এখানে এই দেশে না থেকে বিদেশে গিয়ে পড়াশোনাটা করে আসুক।

মাভজী :- তোমার ভাবনা ঠিকই। তাই আমি বলি কি আর কালবিলম্ব না করে এই বছরের মধ্যেই মোহনদাসকে বিলেতে পাঠাও। বিলেতে আমার ছেলে কেবলরামের অনেক চেনা-জানা বন্ধু-বান্ধব আছে। সে যদি তাদের কাছে মোহনদাসের পরিচয় দিয়ে চিঠি পাঠায় তাহলে বিলেতে গিয়ে ওর আর কোনো অসুবিধা হবে না। কি মোহন, তোমার  কি বিলেতে যেতে ইচ্ছে হয়? নাকি এখানেই পড়াশোনা করবে?

মোহনদাস :- আমাকে বিলেতে যদি পাঠানো হয় তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠালেই ভালো। কলেজের পরীক্ষায় চট করে পাশ করতে পারাটা সহজ ব্যাপার নয়। আমার তো মনে হয়েছে কলেজের পড়া বেশ শক্ত। কলেজের প্রফেসররা যে সব লেকচার দেন তা আমার মাথায় ঢোকে না। আমি পড়াশোনায় এমনই কাঁচা পাটিগণিতটাও ঠিকমতো বুঝতে পারি না। কিন্তু বিলেতে গিয়ে তো আমি ডাক্তারিটাও শিখে আসতে পারি।

লক্ষ্মীদাস :- না-না- মোহন, ডাক্তারি না। বাবার ওটা একদমই পছন্দ ছিল না। তোমার কথা মনে রেখেই তিনি বলতেন – আমাদের বৈষ্ণবদের মড়া কাটাকাটি করতে নেই। বাবার ইচ্ছে ছিল তুমি উকিল হও।
মাভজী :- তাহলে মা পুতলিবাঈ, তোমরা সকলে মিলে একটা সিদ্ধান্ত নাও মোহনদাসের ব্যাপারে। আমি তোমাদের সংসারের হিতাকাঙ্ক্ষী, আমি তোমাদের মঙ্গল চাই। ঠিক আছে, আমি আসছি। তবে যাবার আগে এখনো বলে যাচ্ছি মোহনদাসকে তোমরা বিলেতেই পাঠিয়ে দাও। এ ব্যাপারে আমি তোমাদের কোনো কাজে যদি লাগতে পারি আমাকে জানিও। আসছি আমি।
(মাভজী চলে যায়)

লক্ষ্মীদাস:- মা, যোশীজি এই তো বিধান দিয়ে গেলেন আমাদের মোহনদাসকে বিলেতে পাঠানোর জন্য।

পুতলিবাঈ :- যোশীজি বললেও আমার কিন্তু এতে মত নেই।

লক্ষ্মীদাস :- তোমার অমতটা কিসে মা?

পুতলিবাঈ :- একে তো দূর-বিদেশ। তার উপরে আমি অনেকের কাছে খোঁজ নিয়ে জেনেছি বিলেতে গিয়ে ছেলেরা উচ্ছন্নে যায়। সেখানে গিয়ে সবাই মাংস খায়, আর মদ না খেলে নাকি তাদের চলেই না?

মোহনদাস :- আমায় কি তুমি বিশ্বাস করতে পারো না মা? আমি কি মিথ্যে কথা বলে তোমায় ঠকাব? মা আমি তোমার পা ছুঁয়ে শপথ করছি ওসব জিনিস আমি ছোঁব না। তুমি তো জানো মা, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে লুকিয়ে একদিন মাংস খেয়েছিলাম। সে কি আমার লজ্জা! সেকথা তো আমি বাবার কাছে চিঠি লিখে স্বীকার করেছিলাম। মা আবারো বলছি ওসব জিনিস আমি আর ছোঁব না। সত্যি যদি এরকম ভয়ের কারণ থাকতো তাহলে যোশীজি কি আমায় বিলেত যাবার কথা বলতেন?

পুতলিবাঈ :- আমার চোখের উপর যতক্ষণ আছো ততক্ষণ আমি তোমার সব কথা বিশ্বাস করি। কিন্তু দূর দেশে আমার নাগালের বাইরে চলে গেলে আমি বিশ্বাস বাঁচিয়ে রাখব কি করে? না বাপু, আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। যোশীজির মতো বেচারজীও তো এই বাড়ির একজন পরামর্শদাতা। তাকেও তোমার বিলেত যাবার কথাটা একবার বলতে হবে।

মোহনদাস :- ঠিক আছে মা। বেচারজী তো একজন জৈনধর্মে বিশ্বাসী সাধু। আমি না হয় তাঁর কাছেও মদ, মাংস আর স্ত্রী-সংসর্গ থেকে দূরে থাকবো এই তিন সত্যি করে নেব। তাহলে হবে তো?

লক্ষ্মীদাস :- মা, আর তুমি অমত করো না।

পুতলিবাঈ :- আমি না হয় মত দিলাম। কিন্তু একবার ভেবে দেখেছিস তো-মোহনদাস বিলেত গেলে আমাদের পরিবারটাকে কিরকম বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হবে?
লক্ষ্মীদাস :- জানি মা জানি। পাড়া-প্রতিবেশী তো দূরের কথা আমাদের জাতভায়েরা পর্যন্ত ক্ষেপে উঠবে। আর আমি নিশ্চিত আমাদের একঘরে হতে হবে। একটাই কথা উঠবে মোঢ় বেনিয়া সমাজের বিচারে মোহনদাসের বিলেত যাবার প্রস্তাবটা যুক্তিযুক্ত নয়। আমাদের ধর্মে বলে, সমুদ্র পার হওয়া নিষিদ্ধ। ধর্মীয় আচার-বিচার লঙ্ঘন না করে সেখানে বসবাস করা যায় না। সেখানে সাহেবদের সঙ্গে খানা-পিনা করতে হয়।

মোহনদাস :- আমার তো মনে হয় মা, পড়াশোনার ব্যাপারে জাত বা সমাজের হাত দেওয়াটা ঠিক নয়। তাতে যদি কারাও আমাদের একঘরে করে করবে। ভয় দেখিয়ে কেউ আমার বিলেত যাওয়াটা আটকে দিতে পারবে না।

লক্ষ্মীদাস :- সে না হয় হল। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। যোশীজি বলে গেলেন  তোর বিলেতে গেলে কমপক্ষে চার-পাঁচহাজার টাকা খরচ হবে। এই মুহূর্তে আমাদের সংসারের যা অবস্থা তাতে করে অতগুলো টাকা আমি যোগাড় করবো কী করে?

পুতলিবাঈ :- হ্যাঁ, এটাও একটা বড়ো ভাবনা বটে।

মোহনদাস:- দাদা, মা আমি বলি কি – আমার স্ত্রী কস্তুরবার তো কিছু গয়নাগাঁটি আছে সেগুলো বেচে দিলে তো কিছু টাকা চলে আসবে। আর আমি নিশ্চিত কস্তুরবা এতে বাধা দেবে না।

লক্ষ্মীদাস:- ঠিক আছে। আমি না –হয় বাকিটা যেমন করে হোক যোগাড় করে দেব।

পুতলিবাঈ:- শোন, বলি কি – তোদের বাবা নেই। কাকা আছে তো। কাকার কাছে মোহনদাসের বিলেত যাবার খবরটা জানিয়ে দিবি একবার।

মোহনদাস :- জানিনা মা, কাকার কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাব কিনা। সেখান থেকে যা উত্তরই পাই কিনা আমি বিলেত যখন যাব বলে ঠিক করেছি বিলেত আমি যাবই। দাদার মত তো আগেই পেয়েছি। শুধু তোমার সম্মতি ও আশীর্বাদ পেলেই আমি পৃথিবীর আর কাউকেই ডরাই না। মা, তুমি তো আছো আমার-

পুতলিবাঈ :- পাগল ছেলে কোথাকার –
(মোহনদাস মা পুতলিবাঈ-এর বুকে মাথা রাখে।)

গ্রন্থনা পাঠ :- বিভিন্নরকম ঘটনার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে বিলেতে ১৮৯১ সালের ১০ জুন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ব্যারিস্টারি পাশ করলেন। পরের দিন ১১ জুন হাইকোর্টের রেজিস্টারভুক্ত হলেন আড়াই শিলিং ফি জমা দিয়ে। ১৮৯১ সালের ১২ জুন ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ভারতে ফিরে প্রথম কেসটা লড়তে গিয়ে তেমন সুবিধা করতে পারলেন না। কাথিয়াবাড়-এ রানাসাহেবের কাছে হলেন চরম অপমানিত। কাথিয়াবাড় অঞ্চল তাঁর কাছে বিষবত্‍ মনে হল। দাদা লক্ষ্মীদাসের চেষ্টায় তাঁরই এক ব্যবসায়ী বন্ধুর আমন্ত্রণে একটা কেস লড়তে রওনা দিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার পথে। নাটাল থেকে ট্রেনে করে প্রিটোরিয়া যাচ্ছেন। ট্রেনের মধ্যে ঘটল সেই চরম লজ্জাকর ঘটনা। জঘন্যতম বর্ণবৈষম্যবাদের শিকার হলেন তিনি।

তৃতীয় দৃশ্য
--------------

(ট্রেনের কামরা। সিটে বসে আছেন মোহনদাস। সেখানে প্রবেশ করল এক কনস্টেবল।)

কনস্টেবল :- এই যে বাছাধন, সোজা নেমে এসো।

মোহনদাস :- কেন? নামতে হবে কেন?

কনস্টেবল:- এ গাড়ি তো তোমাদের জন্য নয়। তোমাকে যেতে হবে মালগাড়ির সঙ্গে লাগাও একেবারে শেষের দিকের কামরায়।

মোহনদাস :- আমার কাছে তো ফার্স্টক্লাসের টিকিট আছে।

কনস্টেবল :- তা সে যে ক্লাসেরই টিকিটই থাকুক না কেন। নামতে বলছি নেমে যাও। তোমাকে আবার বলছি যেতে হবে মালগাড়ির লাগাও কামরায়।

মোহনদাস :- শুনুন মশাই, ডারবানে এ কামরায় চড়ে যাবার অনুমতি দিয়েছে। সুতরাং আমি এ কামরাতেই যাব।


কনস্টেবল: - কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ, ভালোয় ভালোয় বলছি নেমে যাও। নইলে কানটি মুলে ঘাড়ে ধরে নামিয়ে দেব।

মোহনদাস :- না, আমি নামবো না। এই তো দেখুন না। আমার ফার্স্টক্লাসের টিকিট আছে।

কনস্টেবল:- বলছি তো টিকিট ফিকিট দেখিয়ে কিছু হবে না। নেমে যেতে বলেছি তখন নেমে যাও। উঠো বলছি উঠো-

মোহনদাস :- না, আমি উঠব না।

কনস্টেবল :- বটে! এতবড়ো সাহস। কালা আদমি কোথাকার। কুলি হয়ে সাহেব-সুবোদের সঙ্গে যাত্রা করা। আয় উঠে আয়- ভালো কথায় তো কাজ হল না তখন উঠে আয় এবার-
(কান ধরে)

মোহনদাস :- একি! আপনি আমার কান ধরলেন কেন?

কনস্টেবল:- কান ধরার মতো কাজটা করেছো বলে বাছাধন। কান তো ধরেছি। এবারে ঘাড়ধাক্কা খাও। যাও দূর হটো- কালা আদমি কোথাকার- শালা কুলি -

(কনস্টেবল টেনে হিঁচড়ে মোহনদাসকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ট্রেনের কামরা থেকে জোর করে নামিয়ে দিল। মোহনদাস নিচে পড়ে গেল। ট্রেন ছেড়ে দিল। ট্রেনের বাঁশি বেজে উঠল।)

গ্রন্থনা পাঠ:- অস্বাভাবিক রকমের অত্যাচার, লাঞ্ছনা, অপমান সয়েও মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকাতেই রয়ে গেলেন। সেখানে দীর্ঘ বারো বছর কাটিয়ে ভারতে ফিরে এলেন। যোগ দিলেন ভারতীয় রাজনীতিতে। হলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি।


চতুর্থ দৃশ্য
-------------

[সবরমতী আশ্রম। মোহনদাস সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। হাতে তাদের চরকা কাটা জাতীয় পতাকা।]

মোহনদাস :- বন্দেমাতরম!

সকলে :- বন্দেমাতরম-।

প্রথম ব্যক্তি :- মহাত্মা গান্ধী কী! 

সকলে :- জয়-

মোহনদাস :- না-না, আমার জয়ধ্বনি নয়। তোমরা দেশমাতার জয়ধ্বনি দাও। পরাধীনতার হাত থেকে দেশকে আমরা মুক্ত করতে চাই। আমরা স্বাধীনতা চাই। আর এই স্বাধীনতা আমরা আনতে চাই অহিংসার মাধ্যমে। কোনোরকম রক্তপাত ঘটিয়ে নয়। আমরা ইংরেজদের হাতে নয়, ভাতে মারব। এরজন্য আমরা ইংরেজদের সঙ্গে সবরকম অসহযোগিতা করবো। আমরা স্কুল-কলেজ, আদালত সব বর্জন করবো। বিলাতী দ্রব্য বর্জন করবো। খাজনা বন্ধ 
করবো। এতে করে ইংরেজরা বুঝতে পারবে আমরাও কতটা শক্তিশালী। আগেও বলেছি এখনো বলছি এ আন্দোলন আমাদের অসহযোগ আন্দোলন।

দ্বিতীয় ব্যক্তি :- মহাত্মাজী, আপনার ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে তো ইতিমধ্যেই ব্যাপক সাড়া মিলেছে। তিলক স্বরাজ কাণ্ডে এক কোটি টাকা সংগ্রহ হয়েছে, এক কোটি লোককে কংগ্রেসের সভ্য করা হয়েছে এবং কুড়ি লক্ষ চরকা চালু হয়েছে। এ তো ব্যাপক সাফল্য!

মোহনদাস :- আমরা আরও সাফল্য চাই।

প্রথম ব্যক্তি:- আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে মহাত্মাজী?

মোহনদাস :- আমাদের পরবর্তী আন্দোলন হবে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন।

সকলে :- লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন!

মোহনদাস :- হ্যাঁ, লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন। ব্রিটিশদের লবণ আমরা ব্যবহার করবো না। আমাদের ব্যবহারের লবণ আমরা নিজেরই তৈরি করবো। আমরা চাই সায়ত্ত্বশাসন। এই সায়ত্ত্বশাসন ইংরেজরা মেনে না নিলে এছাড়া আর কোনো পথ নেই। এরজন্য আমরা ডান্ডী অভিযান করবো। আরব সাগরের তীরে ডান্ডীতে গিয়ে সমুদ্রের জল থেকে লবণ তৈরি করায় অংশ নেব।

প্রথম ব্যক্তি :- ডান্ডী, সে তোএই সবরমতী আশ্রম থেকে দীর্ঘ ২০০ মাইল পথ। এতটা পথ যাবেন কী করে?

মোহনদাস :- কেন? আমরা হেঁটে যাব। যাকে বলে পদব্রজে। আর আমরা যাব মৌনদিবস পালন করতে করতে। আমাদের আন্দোলন শান্তির পথে, অহিংসার পথেই চলতে থাকবে। কোনোরকম প্ররোচনায় পা দেবে না।

প্রথম ব্যক্তি : - পুলিশরা তো আমাদের অ্যারেস্ট করতে পারে?

মোহনদাস:- হ্যাঁ, করতেই পারে। তাই বলে আমাদের তো ভয় পেলে চলবে না। আমরা ভয়কে তো জয় করেছি।

দ্বিতীয় ব্যক্তি :- কারা অংশ নেবে এই ডান্ডী অভিযানে?

মোহনদাস :- কেন এই সবরমতী আশ্রমের ৭৯ জন আশ্রমবাসীকে নিয়েই আমরা রওনা দেব। এতে কী তোমাদের কারুর আপত্তি আছে?

প্রথম ব্যক্তি :- না-না, আপত্তি থাকবে কেন? আপনি বলেছেন সেটাই শেষ কথা। বন্দেমাতরম! জয় মহাত্মাজীর জয়-।

মোহনদাস :- আর দেরি নয়। চলো, আমরা ডান্ডির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। বলো বন্দেমাতরম-

সকলে :- বন্দেমাতরম!
(সকলে হাতে লাঠি নিয়ে ডান্ডির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সকলের আগে আগে থাকেন মহাত্মাজী।)


পঞ্চম দৃশ্য
--------------

[গোয়ালিয়রের টাঙ্ক ময়দান। দেখা গেল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী অগণিত কর্মী-সমর্থকদের মাঝে বক্তব্য রাখছেন।]

মোহনদাস :- ভাইসব! আমরা সকলে আজ গোয়ালিয়রের টাঙ্ক ময়দানে উপনীত হয়েছি। আমি আজ এখানে দাঁড়িয়ে ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলনে’র প্রস্তাব রাখছি। ইংরেজরা আমাদের কোনো দাবিই মানছে না। কিন্তু আমরাও পিছিয়ে যেতে চাই না। আমি তাই সগর্বে ঘোষণা করছি – পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুতেই আমি সন্তুষ্ট হব না। হয় লক্ষ্য অর্জন, নয় মৃত্যু। ডু অর ডাই। করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে ।

সকলে :- ডু অর ডাই। করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে।

মোহনদাস :- আমার আশা, এ আন্দোলনে ইংরেজদের ভিত এবারে নড়বেই। রাম মনোহর লোহিয়া, সরোজিনী নাইডু, মহাদেবভাই, কস্তুরবা, সুশীলা নায়ার, বাংলার সুশীল ধাড়া, মাতঙ্গিনী হাজরা সহ কোটি কোটি মানুষকে পাশে পেয়েছি। যতদিন না পর্যন্ত আমরা পূর্ণ স্বাধীনতা পাচ্ছি ততদিন আমাদের এই ভারত ছাড়ো আন্দোলন চলতেই থাকবে। মনে রেখো ভাইসব – যদিও এই আন্দোলন অহিংসার পথে তবু বলবো – ইংরেজদের হিংসার শিকার হয়ে কোনও ভারতীয় শহিদ হলে তাঁর শরীরে একটি পোস্টার সেঁটে দিতে হবে ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’ আর ইনি স্বাধীনতা আন্দোলনে শহিদ হয়েছেন। বলো – বন্দেমাতরম-!
সকলে :-  বন্দেমাতরম! বন্দেমাতরম!! ভারত মাতা কী জয়!
(সকলে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি দিতে থাকবে)

গ্রন্থনা পাঠ:- মহাত্মা গান্ধীর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাকে কেঁপে উঠল আসমুদ্র হিমাচল। ইংরেজদের শক্ত ভিত নড়ে উঠল। ইংরেজ ভারত ছাড়ল। আমরা মুক্ত হলাম। ভারত স্বাধীন হল। আমরা পেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। গান্ধীজীর হাত ধরে যখন নতুন ভারত গড়ার স্বপ্নে মশগুল আপামর ভারতবাসী ঠিক তখনই ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি। বিড়লা নিবাসের প্রাঙ্গণে সান্ধ্য প্রার্থনা সভায় নাথুরাম গডসের হাতে গুলিবিদ্ধ হলেন আমাদের জাতির জনক, ভারতের মুক্তিসূর্য মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, সবার প্রিয় বাপুজি।

[বিড়লা প্রার্থনা সভা। মোহনদাস প্রার্থনা সভায় বসে প্রার্থনা করছেন।]

মোহনদাস :-  রঘুপতি রাঘব রাজা রাম
                     পতিত পাবন সীতা রাম

(নামগান করছেন মোহনদাস। হঠাত্‍ একটি গুলি এসে লাগে তাঁর বুকে। ‘হে রাম’ বলে মোহনদাস লুটিয়ে পড়েন। মৃত্যুবরণ করেন তিনি। আবহসঙ্গীতে বেজে উঠে বিষাদের সুর। মহাত্মাগান্ধীকে ঘিরে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করে অগণিত ভক্ত, কর্মীরা গেয়ে উঠে –

চিরসত্যের পূজারি তুমি বাপুজি মহাত্মাজী
চরণে তোমার জানাই প্রণাম ভক্তির ডালি সাজি।

অহিংসা মন্ত্রে দীক্ষা দিলে
সবারে আপন করে নিলে
তোমার দেখানো আলোর পথে আমরা চলেছি আজই।।
দু’চোখে তোমার স্বপ্ন ছিল ভারতের স্বাধীনতা-
ন্যায়ের সংগ্রামে লড়তে হবে জানালে সেই বারতা।
ভয়হীন চিত্তে এগিয়ে গেলে
ছিল না হিসাব কী তুমি পেলে
বুকের রক্ত দিলে ঢেলে জীবনকে ধরলে বাজি।।


যবনিকা

Post a Comment

0 Comments