জ্বলদর্চি

পথ যখন সঙ্গী - ৭



পথ যখন সঙ্গী (লামাহাটা) 
পর্ব – ৭ 

ন রে ন  হা ল দা র 

দার্জিলিং  জেলার উত্তর-পুবে অবস্থিত একটি গ্রামের নাম লামাহাটা। ঘুম থেকে দূরত্ব প্রায় পনেরো কিলোমিটার। গ্রামে কয়েকটি মাত্র বাড়ি আছে। তবে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসীম। রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ওই রাস্তা দিয়ে একবার যাওয়ার সময় স্থানটি দেখে তাঁর ভালো লেগে যায়। পরে তাঁরই উদ্যোগে জায়গাটিকে পর্যটন স্থলের রূপ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। তারপর থেকেই জায়গাটি সাজিয়ে তোলা হয়েছে এবং টিকিটেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। 
জায়গাটি রহস্যময় সৌন্দর্যে ঘেরা। এক’শ মিটারের মতো উঁচু লম্বা পাহাড়। পরিবার নিয়ে যখন সেখানে নামলাম, দেখলাম ওই ছোট্ট পাহাড়ের উপর পাইন গাছের গোড়ায় কুয়াশার চাদর জড়িয়ে রয়েছে। ঢাল বরাবর অসংখ্য বড়ো বড়ো প্রাচীন পাইন গাছের সারি। এ গাছ খুব লম্বা হয়। আর যেহেতু অনেক পুরানো তাই অনেক মোটাও। নিচের দিকে কোনো ডালপালা বা পাতা নেই, কেবল গুঁড়ি। তাই বিস্তৃত জায়গা জুড়ে এরকম ঘন পাইন গাছ স্থানটিকে সুন্দর করে তুলেছে। নিচে ঝোপঝাঁড়ে ভর্তি। তার মধ্য দিয়ে পায়ে হাঁটার রাস্তা তৈরি করা আছে পাথর আর ইঁট ফেলে। পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে হেঁটে উপরে ওঠার আকর্ষণ আমাকে চঞ্চল করে তুলেছিল। গাড়ির ড্রাইভারের কাছে শুনেছিলাম উপরে একটা ছোটো পবিত্র লেক আছে। এখানকার বাসিন্দারা এ লেককে খুব মান্য করে। কেউ সে লেকের জলে নামে না বা তার জল ব্যবহার করে না। 
উপরে গিয়ে দেখলাম সত্যি বনরাজি দিয়ে ঘেরা একটি সুন্দর জলাশয়। তার উপরে ছোটো ছোটো পতাকা(ধর্মীয়) দড়িতে লম্বা করে বেঁধে টাঙিয়ে রেখেছে। জলাশয়ের পাশে আগন্তুকদের বসার জন্য তিনটে কংক্রিটের চেয়ারও করা আছে। তবে এর কোনো ধর্মীয় ভিত্তিভূমী আছে কিনা জানি না। এর প্রাকৃতিক অবস্থান আর বনভূমির প্রতি আনুগত্য, যে কোনো মানুষকে মুগ্ধ না করে ছাড়বে না। আর সিনেমায় দেখা হরর সিনের জ্যোস্নালোকিত কুয়াশাময় বনভূমির ছবির মতো আমাকেও কোনো এক মায়ায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছিল। 
নেমে এলাম সেই ঢালু পথ বেয়ে। লামাহাটাকে বিদায় জানিয়ে উঠে বসলাম গাড়িতে। এবারে আমদের গন্তব্য তিস্তা আর রঙ্গট নদীর সংযোগ স্থল। এখান থেকে দূরত্ব প্রায় পঁচিশ কিলোমিটারের মতো। পাহাড়ি পথ বেয়ে যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছুলাম তখন প্রায় বিকেল। এদিকে পর্যটকদের তেমন ভীড় নেই। গড়ে একটা কি দুটো পর্যটকদের গাড়ি উপস্থিত থাকে। আমাদের সঙ্গে আর একটা মাত্র গাড়ি এসেছিল এস্থলে। 
জলের তিনটি রেখার সংযোগস্থলে এসে যখন দাঁড়িয়েছি তখন পশ্চিমের সূর্য পাহাড়ের মাথার উপর অস্ত গেছে। রঙ্গট এসে মিশেছে তিস্তায়। রঙ্গটের গভীরতা তিস্তার তুলনায় কম, তাই খরস্রোতাও বেশি, পাথরও বেশি। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার উল্টোদিকে নদীর ওপাড়ের পাহাড় সিকিম রাজ্যের অন্তর্গত। পাহাড়ের পেট বরাবর একটি রাস্তা লক্ষ করলাম, যে রাস্তাটাই জলপাইগুড়ি থেকে সিকিম চলে গিয়েছে। রাস্তাটি ধসপ্রবন, ক’দিন আগেই বড় একটা ধস নিয়েছিল, যার চিহ্ন এখনও বর্তমান। 
সবচেয়ে মায়াময় এই দুটি নদীর মিলনস্থল। পাহাড়ি উপত্যকার মধ্য দিয়ে প্রবহমান দুটি জলের ধারা এসে একসাথে মিশে আবার বয়ে চলেছে যুগ-যুগান্ত ধরে। আমরা ছিলাম না যখন এ ধারার সৃষ্টি হয়েছে, আমরা থাকবনা তখনও এ ধারা এমনি করে বয়ে চলবে। 

সমাপ্ত

Post a Comment

0 Comments