জ্বলদর্চি

বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন -১১



বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন

পূ র্ণ চ ন্দ্র  ভূ ঞ্যা  

পর্ব ― ১১

মহাকর্ষ তরঙ্গ ও আইনস্টাইন :

                                 (এক)

"কী কী করতে পারবে ?"
"আমি একজন মাইক্রোওয়েভ ইঞ্জিনিয়ার। মাইক্রোত‍রঙ্গ নিয়ে কাজে হাত পাকিয়েছি। আপনার অধীনে পি এইচ ডি করতে ইচ্ছুক।"
"না, তা সম্ভব নয়" ― মুখের উপর কড়া জবাব ছুঁড়ে দিলেন প্রফেসর জর্জ গ্যামো। ইন্টারভিউয়ের উল্টোদিকে অধোবদনে তখন বছর উনত্রিশের নেভি অফিসার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়  রাডার এক্সপার্ট হিসাবে নেভিতে যোগদান। তারপর যুদ্ধশেষে ১৯৪৮ সালে উঁচু র‍্যাঙ্কের নৌ-অফিসারের পদ ছেড়ে সদ্য মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি জয়েন করেছেন তরুণ অধ্যাপক হয়ে। শর্ত এই ― যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি পি এইচ ডি ডিগ্রি আয়ত্ত করবেন। কিন্তু হায় ! বিধি বাম।

সেদিন (১৯৪৯ সাল) লজ্জায় অপমানে বাড়ি ফিরে গেলেন একরাশ হতাশা নিয়ে। তবে হাল ছেড়ে দেবার পাত্র তিনি নন। শেষমেষ ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটির কেইথ লেইডলার-এর অধীনে তিনি পি এইচ ডি সম্পন্ন করেন এবং অধ্যাপনার (১৯৮৭) শেষ দিন পর্যন্ত ওই মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে অতিবাহিত করেন।

                                  (দুই)
'হ্যাঁ, আমরা পেয়ে গেছি। এ যাবৎ কালের বহু চর্চিত বিষয়ের সন্ধান আমরা পেয়েছি' ― মাইক্রোফোনের সামনে উল্লসিত তিন বিজ্ঞানী MIT-এর রাইনার ওয়েইস এবং ক্যালটেক-এর ব্যারি বারিশ ও কিপ থর্ন। সাংবাদিক সম্মেলন চলছে। সময়টা ২০১৬ সালের ১১-ই ফেব্রুয়ারি। স্থান ওয়াশিংটন ডি সি। ভবিষ্যবাণীর একশ বছর পর অনেক কষ্ট করে ধরা পড়েছে এক লিলিপুট। মহাকর্ষ তরঙ্গ। তারই সাংবাদিক বৈঠকে ব্যস্ত বিজ্ঞানীত্রয়। কিন্তু সম্মেলন-কক্ষে দর্শকের প্রথম সারিতে বসে আছেন এক বয়স্কা মহিলা। না, তিনি কোন সাংবাদিক নন। তাহলে কে এই আগন্তুক মহিলা ? কেনই বা উপস্থিত সাংবাদিকদের ভীড়ে ? মহাকর্ষ তরঙ্গের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক ?

                                 (তিন)
সময়টা ১৯১৫ থেকে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ। যুগ যুগ ধরে লালিত ধ্রুপদী চিন্তাভাবনার গোড়ায় আঘাত হানলেন প্রফেসর আইনস্টাইন। তাঁর 'জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি'-তে। নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব ভুল প্রমাণ করে। হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন। নিউটনের মহাকর্ষ বলের ধারণা ঠিক নয়। অন্তত আর পাঁচটা বলের মতো নয়। গ্রহ, তারা, নক্ষত্র ― এ-ওকে লাট্টুর মতো পরিক্রমণের পেছনে মহাকর্ষের কোন হাত নেই। এর জন্য দায়ী শূন্যস্থানে স্থান-কালের এক জটিল গণিত। সে-নিয়ম হল স্থান-কালের বক্রতা, অবশ্যই পদার্থের ভরের জন্য। ভর বেশি হলে শূন্যস্থানের বঙ্কিমতা বেড়ে যায়। এই দোমড়ানো-মোচড়ানো শূন্যস্থানে বস্তুর গতির জন্য একটি বিশেষ ঘটনা ঘটে। কী সেই বিশেষ ঘটনা ?
                         

ধরা যাক, একটি পুকুরের পরিস্কার শান্ত জলে আপনি একখণ্ড পাথর ফেললেন। কী দেখতে পাবেন ? জলের উপরিতলে একটি নির্দিষ্ট স্থানের জলরাশি এই উপরে উঠছে তো পরক্ষণেই নীচে নামছে। অর্থাৎ একটি তরঙ্গ তৈরি হয়েছে যাকে আমরা ঢেউ বলি। এ হেন ঢেউ ঘটনা-বর্তমানের জায়গা থেকে বৃত্তাকারে চার দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ঢেউ যত দূরে সরে, অমনি জলের ওঠানামা আরও কমে। এখানে জলকে শূন্যস্থান কল্পনা করে নিলে জলে পাথরখণ্ডের অবস্থান তারকার আবর্তন বা পরিক্রমণের সমতুল্য। সংঘর্ষের জন্য মাধ্যমের (জল কিংবা শূন্যস্থান ― যাই হোক না কেন) এই ওঠানামা কেমন হবে যদি দুটি ঢেউ পরস্পর মিশে যায় ? অর্থাৎ পুকুরের শান্ত জলে দুটি পাথ‍রখণ্ডের আঘাতে উৎপন্ন তরঙ্গের উপরিপাতন কল্পনা করুন, প্রিয় পাঠক। 
                                

একই ধরনের আলোড়ন শূন্যস্থানের ভেতরেও ঘটবে যখন প্রচণ্ড ভারী বস্তুর ভর বা অবস্থানের আকষ্মিক পরিবর্তন ঘটে। কোনও তারকার হঠাৎ বিস্ফোরণ, প্রচণ্ড ভারী নক্ষত্রের নিজের অক্ষের চার দিকে আবর্তন, দুই ব্ল্যাকহোলের চরকিবাজি এবং পরিণামে সংঘর্ষে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে শূন্যস্থানে যে আলোড়ন তৈরি হয়, তা ঢেউ-আকারে সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ হেন আলোড়নই মহাকর্ষ তরঙ্গ নামে পরিচিত। শূন্যস্থানের এই ফুলে ওঠা ও চুপসে যাওয়া বস্তুর সাইজ ও অবস্থানের উপর নির্ভর করে বস্তু থেকে যত দূরে যাওয়া যায় তত কমতে থাকে।

এমনই এক তরঙ্গের ক্ষীণ অথচ স্পষ্ট ঢেউ পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। তিন বিজ্ঞানী ওয়েইস, বারিশ ও থর্ন সেই অতি ক্ষীণ আলোড়ন শনাক্ত করেন পেল্লাই সাইজের 'লাইগো' (LIGO ― Laser Interferometer Gravitational wave Observatory) যন্ত্রে। এ হেন তরঙ্গের উৎস পৃথিবী থেকে ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে। ১৩০ কোটি বছর আগে দুটো ব্ল্যাকহোল পরস্পরকে চক্কর কাটতে কাটতে মিশে যায় ও বনে যায় একটাই বড় ব্ল্যাকহোলে। 
                             

সেজন্য মহাকর্ষ তরঙ্গ তৈরি হয়। সেই তরঙ্গের কারণে শূন্যস্থানের ভাইব্রেশন ধরা পড়ে লাইগো মেশিনে। ওঠানামার পরিমাণ কতটা ? চার কিলোমিটারে ১ মিলিমিটারের ১,০০০,০০০,০০০,০০০ ভাগের এক ভাগেরও কম ! তাই এ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তারা পেলেন ২০১৭ সালের নোবেল প্রাইজ।

কিন্তু সাফল্য ও ব্যর্থতা, রেষারেষি কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেখানে হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটে, সেখানে এ হেন সাফলতার এক করুণ ইতিহাস আছে বই কী ! আর সে বঞ্চনার নাম জোসেফ ওয়েবার। জন্ম ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে। লিথুনিয়া থেকে আমেরিকায় পালিয়ে আসা হতদরিদ্র ইহুদি পরিবারে। স্কুলে যাওয়ার আর্থিক সামর্থ্য নেই। নিজের পড়ার খরচ নিজে উপার্জন করতে কিশোর বয়স থেকে পথে পথে। কখনও গল্ফ খেলোয়াড়ের ক্যাডি তো কখনও রেডিও মেকানিক। এভাবে পড়াশোনা চালিয়ে মাধ্যমিকে প্রথম স্থান। তারপর বৃত্তি নিয়ে চলে লেখাপড়া। এর মাঝে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। এবার যুদ্ধে তিনি মার্কিন নৌবাহিনীর রাডার এক্সপার্ট। যুদ্ধ জাহাজে রাডার সামলানোর গুরু দায়িত্ব বর্তায় তার ওপর। জাপানি বোমায় জাহাজ ডুবলেও অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচেন। সেই তিনি যুদ্ধশেষে নৌ-সেনা অফিসারের মোটা অংকের বেতন ছেড়ে বেছে নেন প্রফেসরের নিরাপদ চাকরি। মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান বিভাগে। কিন্তু পি এইচ ডি নেই। দৌড়লেন বিজ্ঞানী গ্যামোর কাছে। ততদিনে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন প্রফেসর গ্যামো ১৯৪৮ সালে কসমিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমি বিকিরণের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছেন। এ হেন তরঙ্গের সন্ধান পেলে নোবেল বাঁধা। আর ওয়েবার অলরেডি মাইক্রোতরঙ্গে হাত পাকিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু প্রসন্ন হলেন না ভাগ্যদেবতা। 

ওয়েবার সেই ভাগ্যহত তরুণ নৌ-অফিসার যাকে বিজ্ঞানী গ্যামো সেদিন অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। যদি গ্যামো তাকে ফিরিয়ে না দিতেন, তাহলে হয়তো বা বিজ্ঞানের ইতিহাস অন্য ভাবে লেখা হতো এবং নোবেল জয়ী পণ্ডিতদের সঙ্গে আজ একাসনে উচ্চারিত হত বিজ্ঞানী গ্যামো এবং যোসেফ ওয়েবার-এর নাম। কিন্তু হল না স্বপ্ন পূরণ। অগত্যা MASER ও LASER (আলো আরও সূক্ষ্ম বানানোর দুটো কৌশল) নিয়ে তার গবেষণা শুরু। সাফল্য এবার দোরগোড়ায়। ১৯৬৪ সালে LASER আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার প্রাপকের নাম ঘোষণা হয়, অদ্ভুতভাবে বাদ পড়লেন তিনি। 

যদিও এর অনেক আগে ১৯৫০ দশকের শেষদিকে সামান্য উপকরণ দিয়ে তিনি বানিয়ে ফেলেছেন পেল্লাই সাইজের এক যন্ত্র। অ্যালুমিনিয়ামের নিরেট সিলিন্ডার।
                              

মহাকর্ষ তরঙ্গ ধরতে। এল সাফল্য। এক মিলিমিটারের ১০,০০০,০০০,০০০,০০০ ভাগের একভাগ মাত্র সূক্ষ্মতায় অ্যালুমিনিয়াম সিলিন্ডার ধরে ফেলেছে মহাকর্ষ তরঙ্গ। ১৯৬৯ সালে। বিভিন্ন জার্নালে ছাপা হল তার সফল হওয়ার কাহিনী। ধন্য ধন্য রব। সুখ্যাতি উপচে পড়ছে চারিদিকে। এমন সময় হঠাৎ ছন্দপতন। আসলে ভাগ্য যার সহায় নয়, সে কি পারে সামান্য ব্যর্থতার আকাশ-প্রাচীর বেড়া টপকাতে ? বোধহয় পারে না। আর তাই সামান্য ভুলের ছিদ্র দিয়ে তার অজান্তে কখন যে ঢুকে পড়েছে কালনাগিনী, ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। গণনায় খুব সামান্য ত্রুটি থেকে গেছে। তারপর তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে তার নাম-যশ-খ্যাতি-মনোবল। অন্ধকারে ঢাকা পড়ে তার উজ্জ্বল আকাশ। হিরো থেকে রাতারাতি বিগ জিরো। অথচ তার চিন্তাভাবনার ফসল ও উদ্ভাবিত যন্ত্রের সামান্য ত্রুটি সংশোধন করে বিজ্ঞানীত্রয় ওয়েইস, বারিশ ও থর্ন বানিয়ে ফেললেন খুব সংবেদনশীল যন্ত্র 'লাইগো'। ওয়েবারের মৃত্যুর পনের বছর পর তারা ধরে ফেললেন মহাকাশের অতি ক্ষীণ আলোড়ন ― মহাকর্ষ তরঙ্গ। পেয়ে গেলেন নোবেল। আর তিনি থেকে গেলেন বঞ্চিতের, হতাশের দলে।

কিন্তু না, প্রিয় পাঠক ; ব্যর্থতা বোধহয় সর্বদা অন্ধকারে হারিয়ে যায় না। কখনো-কখনো কালোদৈত্যের মতো তারও উজ্জ্বল উপস্থিতি ধরা পড়ে যায়। এর জ্বলন্ত বাস্তব প্রতিচ্ছবি ২০১৬ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটন ডি সি-র সাংবাদিক বৈঠকে উপস্থিত সেই অজ্ঞাত মহিলা। সেদিন সংবাদ-কক্ষে উপস্থিত সেই মহিলা আর কেউ নয়, বরং জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভার্জিনিয়া ট্রিম্বল, পরলোকগত বিজ্ঞানী জোসেফ ওয়েবার-এর ধর্মপত্নী। প্রয়াত বিজ্ঞানীর ঋণ পরিশোধ করতে, তার কৃতিত্বকে সম্মান জানাতে তিন বিজ্ঞানী ওয়েইস, বারিশ ও থর্ন সেদিন সাংবাদিক কক্ষে হাজির করেছিলেন তাঁর পত্নী ট্রিম্বলকে। আর এখানেই বোধহয় মানবতার কাছে হেরে গেলেন ঈশ্বর-নিয়তি-বিজ্ঞান।

Post a Comment

1 Comments

  1. অত্যন্ত মনোগ্রাহী ও গুরুত্বপূর্ণ রচনা / পার্থপ্রতিম আচার্য

    ReplyDelete