জ্বলদর্চি

রজনীকান্ত সেন - শ্রদ্ধা ও স্মরণে সোহম সেন


রজনীকান্ত সেনের  প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা ও স্মরণ   

বিবেকবিমলজ্যোতিঃ

সো হ ম  সে ন


বাংলা গানের ’পারে যে অনিন্দ্যসুন্দর জগৎ আছে, পঞ্চগুণে ধনী পৃথিবীর নন্দনতত্ত্ব যেখানে অরূপের পদতলে, নিখিলশায়ী বীণার ঝঙ্কারে, বিমূর্ত ভাবলোকের উপকণ্ঠে আমাদের রসোত্তীর্ণতার আশায় প্রতীক্ষমাণ, সেই গানদরিয়ার তরীর নেয়ে রবীন্দ্রনাথ-দ্বিজেন্দ্রলাল-অতুলপ্রসাদ-রজনীকান্ত-নজরুল। মধ্যযুগীয় শ্লথতা, পুরনো নির্মাণ, রক্ষণশীলতা সব কিছুকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বাংলা গানের ‘অমল ধবল পালে’ সুদূর সাগরপার হ’তে হাওয়া এনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ আর দ্বিজেন্দ্রলাল, নিত্য নতুন সৃষ্টিবৈঠায় তাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত আর নজরুল। বাংলা গানভুবনের এই পঞ্চসাধকের মধ্যে স্বল্পায়ুতম ছিলেন রজনীকান্ত সেন। দুরারোগ্য কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সেই, ১৯১০ সালে অমৃতলোকের পথে যাত্রা করেন এই সাধক কবি। রজনীকান্ত জীবনদর্শনে আস্তিক্যবাদী। পরম করুণাময় দয়ালের চরণতলে নিজেকে সঁপে দিয়ে, জীবন-মণ-প্রাণ সর্বস্ব আহুতি দিয়ে ভক্তির শান্ত অথচ সতেজ হোমানলে পার্থিব বাসনা, বেদনা, সুখ ও দুঃখরাজিকে দগ্ধ করে, সে ভস্মাধারকে আশ্রয় করে কী এক অতীন্দ্রিয় চেতনার অকূল পাথারে তিনি কেবল ভাসছেন-- ভাসছেন আর সেই চেতনাসমুদ্র মন্থন করে তুলে আনছেন প্রেমের অমৃতধারা। কিন্তু মানুষের মাঝারে, মানবহৃদয়ে অধিষ্ঠিত দেবতার পূজাদেউলের পূজারী হয়ে এসেছিলেন বলেই এই পৃথিবী ছেড়ে নক্ষত্রলোকের পথে পা ফেলবার আগে তাঁর কষ্টই হয়েছে। জীবনের শেষ কটা দিনে, মেডিকেল কলেজের কটেজে লেখা দিনলিপিতে তিনি লিখেছেন, “বড় মায়ায় জড়িত হয়ে পড়েছি। এই সুখের হাটে দুঃখও অনেক আছে, তবু সুখগুলো তো মিষ্টি,-- দুঃখগুলোও মিষ্টি লাগত। সেই হাট ভেঙে চলে যেতে ক্লেশ হয়। কিন্তু তা শুনে কে?” 

শ্রদ্ধেয় শ্রীসুধীর চক্রবর্তী মহাশয় তাঁর ‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে’ প্রবন্ধে লিখেছেন, 
“তাঁর গান তাঁর আত্মজীবনেরই অংশ। নিজে আইনজীবী ছিলেন বলেই নিজের মর্মান্তিক রোগযন্ত্রণার মধ্যে দেখলেন বিচারকর্তার দৈবী বিচার, তাই লিখলেন:
আমি যে বিচার দেখেছি-- Splendid; এমন আর হয় না। Subjudge, মুন্সেফের সাধ্য নেই এমন বিচার করে। আমার সম্বন্ধে যে-বিচার হচ্ছে, আমার কথাটি বলবার জো রাখেনি যে, Punishment is untimely or too severe, এ বড়-জবর Penal Code-- অভ্রান্ত, নির্দোষ। 
রজনীকান্তের গানে ঈশ্বরের এই এক আশ্চর্য প্রতিমা ঘুরে ঘুরে আসে। মর্ত্যপাপের বিচারকর্তার প্রতিমা। গীতিকার যেতে চান সেইখানটায়, ‘যেখানে সে দয়াল আমার, বসে আছে সিংহাসনে’। ঈশ্বরের এই বিচারক মূর্তি এবং ভক্ত গীতিকারের পাপী বিগ্রহ বাংলা গানে একটু নতুন।” 

অন্য কথা বলবার আগে একটা কথা বলা আবশ্যক বলে মনে করি। সুধীরবাবু রজনীকান্ত সেনের লেখার যেটুকু অংশ উদ্ধৃত করেছেন, তা লক্ষ্য করুন। বাংলা শব্দের সাথে সাথে কী সুন্দর ভাবে তিনি বসিয়ে দিচ্ছেন একেকটা আস্ত ইংরেজি শব্দ, কখনো বা একটা গোটা ইংরেজি বাক্য। তাতে কোনোভাবেই বাংলা সিনট্যাক্সের মাঝে ইংরেজির ব্যবহারটিকে alienated বলে মনে হচ্ছে না। সে দৈবী বিচার সম্বন্ধে Splendid এর চাইতে অধিকোপযোগী বিশেষণ আর কী-ই বা আছে? এই যে-একটা গোটা বাংলা অনুচ্ছেদের মধ্যে একেবারে সঠিক জায়গায় খুব সুচারুভাবে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার, এটা রজনীকান্তের দিনলিপির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য। অধুনাতন কালে বাংলা ভাষায় বিদেশি ও অন্যান্য দেশীয় ভাষার অধিকতর প্রভাব নিয়ে বেশ একটা শোরগোল পড়েছে। বস্তুত, অপরাপর ভাষার অনুপ্রবেশ আর প্রযত্নশীল আত্তীকরণের মাধ্যমে সতত বিবর্তনশীল একটা ভাষা ক্রমে পুষ্টতর ও শক্তিশালী হয়। এই গ্রহণ-লালনের প্রক্রিয়াটা ততক্ষণই অনুমোদনযোগ্য যতক্ষণ মূল ভাষাটির সৌন্দর্যহানি না ঘটে। রজনীকান্ত কোথাও বাংলা ভাষাকে ফুলেল আঘাতটুকু অবধি দেননি। আইনজীবী ছিলেন বলেই হয়ত, যেটা তাঁর একান্ত নিজের বলার জায়গা, সেই রোজনামচায় দুটি ভাষাকে তিনি হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের সেবক হিসেবে যখন অবতীর্ণ হয়েছেন, সংস্কৃত-প্রতিচ্ছায়ায় কী সুললিত বাংলা যে তিনি লিখেছেন! 

রজনীকান্ত সেনের গ্রন্থের সংখ্যা মোট আটটি; ‘বাণী’, ‘কল্যাণী’, ‘অমৃত’ (রবীন্দ্রনাথের ‘কণিকা’র আদর্শে রচিত), ‘আনন্দময়ী’, ‘বিশ্রাম’ (হাসির গান, দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গান শুনে অনুপ্রাণিত), ‘অভয়া’, ‘সদ্ভাব-কুসুম’ ও ‘শেষদান’। ‘বাণী’ ও ‘কল্যাণী’ মূলত ভক্তিগীতির সঙ্কলন। রজনীকান্ত আসলে ভক্তকবি। ভগবানের পাদপদ্মে আপনাকে সমর্পণ করে তিনি গেয়ে চলেছেন তাঁরই গান। কবির জীবনীকার শ্রীনলিনীরঞ্জন পণ্ডিত তাঁর ‘কান্তকবি রজনীকান্ত’ বইতে তাঁর বিভিন্ন গান রচনার পশ্চাতে কিছু কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। তার সবগুলির পুনরালোচনা এখানে সম্ভবপর নয়, তবে এটা বেশ বোঝা যায়, গান রচনার ক্ষেত্রে রজনীকান্তের সহজাত প্রতিভা ছিল। গান সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে লিরিক্স ও সুর এ দুইয়েরই একটা যুগপৎ আলোচনা প্রয়োজন এবং আলোচনার আঙ্গিকই হোক বা প্রেক্ষিতই হোক, সেটা যদি সুরের সৃজন, মিশ্রণ আর নব নব নিরীক্ষা হয়ে থাকে, তাহলে এটা আমাদের মানতেই হবে যে, সুরের তেমন বৈচিত্র্য কিংবা সুরের খেলাঘর ভাঙাগড়ার ব্যাপারটা কান্তগীতিতে নিতান্তই অপ্রতুল। সুতরাং রজনীকান্তের গানভুবনে অদেখা লোকের সন্ধানে খেয়া পাড়ি দিতে হলে আমাদের গন্তব্য হবে গানের কথা। এর আগে দু’-একটি কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। সঙ্গীতচর্চার যে Schooling টা রবীন্দ্রনাথ কিংবা দ্বিজেন্দ্রলাল পেয়েছিলেন পারিবারিক সূত্রে এবং প্রবাসজীবনের ফলে, বা যে-পাশ্চাত্যসঙ্গীত ও হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল মিউজিকের ঘরানার সাহচর্য অতুলপ্রসাদ পেয়েছিলেন প্রবাস ও কর্মজীবন সূত্রে, তার কোনোটিই রজনীকান্তের জীবনে ঘটেনি। রাজশাহীর উকিল ছিলেন, বিদেশি সঙ্গীতের বা স্পষ্ট করে বললে, ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যালের সাথে সে অর্থে পরিচয় তাঁর ঘটেনি। তাই তাঁর গানের সুরে দেশীয় রাগরাগিণীর প্রভাবটাই লক্ষিত হয়। আবার সেটার মধ্যেও যে একটা বিপুল বৈচিত্র্যের ভুবন আছে এমনটাও নয়। কারণ দেশীয় সঙ্গীতের যে বিবিধ ধারা-উপধারার সাথে পরিচয়ের সুযোগ নজরুলের ভাগ্যে ঘটেছিল, সেটা কান্তকবির ক্ষেত্রে ঘটেনি। ফলত এটা দেখা যাচ্ছে যে, বৈচিত্র্যের দিক থেকে কান্তগীতি যে খুব ধনী একথা বলা যায় না। তাহলে তাঁর গানের বিশেষত্বখানি কোথায়? বিশেষত্বটা এইখানেই যে, ব্যক্তি রজনীকান্তই আসলে গীতিকার হয়ে বারবার দয়ালের কাছে করুণাপ্রার্থী হয়েছেন, আবার সেই ভগবদ্ধনে ধনী হয়েই গীতিকার রজনীকান্ত ব্যক্তি রজনীকান্তের জীবনকে একটা সুনির্দিষ্ট আদর্শদিশায়িত পথে চালনা করেছেন। তাঁর স্রষ্টাসত্তা, যেটা আসলে তৈরি হচ্ছে তাঁর ভক্তমন থেকে, সেটা আর মাটির পৃথিবীর রজনীকান্ত একেবারেই অভিন্ন। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, সুপরিচিত যে-কান্তগীতিগুলি রয়েছে, তাতে অনেকগুলিতেই কোমল সুরের লীলাবিসারী ভৈরব্যাদি রাগের প্রাধান্য রয়েছে। যেহেতু ভগবানভক্তিসমুদ্রের তলে তলে বারবার তিনি ডুবেছেন আর উঠেছেন, তাই আত্মমগ্ন ভক্তিচিত্ততার প্রকাশে করুণ সুরের অধিকারী মাইনর নোটসের প্রতি তাঁর আগ্রহ স্বাভাবিক কারণেই ধাবিত হয়েছে। 

সে যাই হোক, ‘বাণী’র প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন কবিবন্ধু অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়। প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন, “কাহারও বাণী গদ্যে, কাহারও পদ্যে, কাহারও বা সঙ্গীতে অভিব্যক্ত। রজনীকান্তের কান্ত পদাবলী কেবল সঙ্গীত।” এই ‘কেবল’ শব্দটায় আমাদের বিশেষ আপত্তি আছে। ‘সঙ্গীত ও কবিতা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “…ভাবপ্রকাশের অঙ্গের মধ্যে কথা ও সুর উভয়কেই পাশাপাশি ধরা যাইতে পারে। সুরের ভাষা ও কথার ভাষা উভয় ভাষায় মিশিয়া আমাদের ভাবের ভাষা নির্মাণ করে। কবিতায় আমরা কথার ভাষাকে প্রাধান্য দিই ও সঙ্গীতে সুরের ভাষাকে প্রাধান্য দিই।” সুরারোপ সম্বন্ধে রজনীকান্ত যতটা না পরিশীলন ও মনোযোগের পরিচয় দিয়েছেন, তার চাইতে অনেক বেশি যত্ন নিয়ে গানের কথা সাজিয়েছেন। শ্রীচক্রবর্তী লিখেছেন, “গানের…ভাববৈচিত্র্যের অভাব হয়ত তিনি ঢাকতে পারতেন সুরবিন্যাসের চাতুর্যে, তালের বিভাজনে, সুরমিশ্রণের দক্ষতায়। কিন্তু গীতরূপায়ণে তিনি সুরের চটকের চেয়ে প্রাধান্য দিয়েছেন বাচনের আন্তরিকতার প্রতি;…তাঁর গানের মূল আবেদন তাই ভাবের ও আত্মস্থ উচ্চারণের।” যেখানে কথা, বাচনই প্রধান, সুরের আলোছায়ার খেলা সেভাবে ঘটেনি, আমাদের মত, সেটা যতটা না সঙ্গীত, তার চাইতে অনেক বেশি করে কবিতা। অক্ষয়বাবুর ‘কেবল’ শব্দের ব্যবহারের সাথে তাই একমত হতে পারিনি। 
আজকের দিনে কান্তগীতির কতখানিই বা প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে, সে সম্পর্কেও প্রশ্ন উঠতেই পারে। তা উঠলে, অন্তত দেশাত্মবোধক গানগুলির ক্ষেত্রে আমাদের এটা মেনে নিতে হবে যে, সেগুলির বেশিরভাগের সৃষ্টিই Contemporality র তাড়নাজাত আর আজকের কালে আমদের হয়ে বলবার মতো সে গানগুলিতে তেমন আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ সে সময়কার একটি বিখ্যাত গান, স্বদেশীযুগে মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। কিন্তু বাস্তব এটাই যে, আজকে সে গান আমাদের হয়ে আর কিছু বলে না। কাল বদলেছে বলে সেও যেন অতীতগর্ভে তলিয়ে গিয়েছে। আর ঠিক এই জায়গাটিতেই সমসাময়িক সকলকে পিছনে ফেলে শাশ্বত কালের মেডেলটি জিতে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। সৃষ্টি যে-কালেই কেননা হয়ে থাকুক, ভাবীকালের বলবার মতো কিছু কথা যে, সে তার গর্ভে নিয়েই ভূমিষ্ঠ হবে, এমনটাই তিনি চাইতেন। করেওছেন তা। সৃষ্টির চিরায়ত দাবি সম্পর্কে রজনীকান্ত সচেতন ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ বা দ্বিজেন্দ্রলাল উভয়েই জীবনে প্রচুর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। কিন্তু রজনীকান্ত জীবনে পেয়েছেন কেবল প্রশংসা, শ্রদ্ধা আর জনপ্রিয়তা। যে সুরেশ্চন্দ্র সমাজপতির ভয়ে তখনকার বঙ্গকবিকুল সর্বদা তটস্থ, স্বয়ং তিনিই কান্তকবিকে গ্রন্থ প্রকাশের জন্য উৎসাহ দিয়েছিলেন। সুতরাং সমালোচনার ক্ষুরধার শরবৃষ্টির সাথে যুঝতে তাঁকে হয়নি। আর তা হয়নি বলেই হয়ত আপন প্রতিভার তলাতল কর্ষণ করে নব নব বিচিত্র সৃষ্টিপ্রবাহ তিনি বয়ে আনতে পারেননি। 

তবে, আমরা যদি বলি, সমাজ তাঁকে সেভাবে স্পর্শ করেনি, লিখে রেখে তিনি যাননি সমাজমানুষের ছোট ছোট হাসি-দুঃখ-ব্যথা, তা আন্যায় হবে। যা দেখেছেন, তাও লিখেছেন। ‘অভয়া’য় লিখেছেন, 
“না যেতে বাসি বিয়ে, মেয়ের যায় সব ফুরিয়ে,
মোছে কপালের সিঁদুর, ভাঙে হাতের শাঁখা;
(তখন) মিলে সব শাস্ত্রীবর্গ, হেসে করান বৃষোৎসর্গ,
মেয়েটির একাদশীর সুব্যবস্থা করেন পাকা।
সে একাদশীর রেতে, মরে জল পিপাসেতে,
বোকা বাপ দাঁড়িয়ে দেখে, মাথায় হাঁকায় পাখা;
(আবার) বসে সেই মেয়ের পাশে, অন্ন গেলে গ্রাসে গ্রাসে,
সমাজে নাই চেতনা, অন্ধ, বধির, মিথ্যে ডাকা।” 

এমন আরও অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। তবে অন্তরে তিনি ভগবানের দাস। কান্ত পদাবলীর ভক্তিরসে দাস্য ভাবটা কিছু অধিক বটে। সন্তানের মৃত্যুর পর কোন পিতা বলতে পারেন, যাঁর দান, তিনিই নিয়েছেন! গাইতে পারেন, 
“তোমারি দেওয়া প্রাণে, তোমারি দেওয়া দুখ,
তোমারি দেওয়া বুকে তোমারি অনুভব।
তোমারি দু’-নয়নে তোমারি শোকবারি,
তোমারি ব্যাকুলতা, তোমারি হা-হা রব।” 
রোগশয্যায় শায়িত কান্তকবিকে কবীশ দেখতে এলে ‘রাজা ও রাণী’ নাটক থেকে রজনীকান্ত প্রসঙ্গক্রমে নিম্নলিখিত কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃত করেন, 
“                             এ রাজ্যতে
যত সৈন্য, যত দুর্গ, যত কারাগার,
যত লোহার শৃঙ্খল আছে, সব দিয়ে 
পারে না কি বাঁধিয়া রাখিতে দৃঢ়বলে
ক্ষুদ্র এক নারীর হৃদয়!” 
রবীন্দ্রনাথ পরে চিঠিতে লেখেন, “ঐ কথা হইতে আমার মনে হইতেছিল, সুখ-দুঃখ-বেদনায় পরিপূর্ণ সংসারের প্রভূত শক্তির দ্বারাও কি ছোট এই মানুষটির আত্মাকে বাঁধিয়া রাখিতে পারিতেছে না? শরীর হার মানিয়াছে, কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাই-- কণ্ঠ বিদীর্ণ হইয়াছে, কিন্তু সঙ্গীতকে নিবৃত্ত করিতে পারে নাই-- পৃথিবীর সমস্ত আরাম ও আশা ধূলিসাৎ হইয়াছে, কিন্তু ভূমার প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাসকে ম্লান করিতে পারে নাই। কাঠ যত পুড়িতেছে, অগ্নি আরো তত বেশি করিয়াই জ্বলিতেছে। আত্মার এই মুক্তস্বরূপ দেখিবার সুযোগ কি সহজে ঘটে?” ঘটে না। সত্যসুন্দরের পূজারী কান্তকবিকে আমরা শ্রদ্ধালুচিত্তে স্মরণ করি।

Post a Comment

0 Comments