জ্বলদর্চি

মা/ শুভ্রাশ্রী মাইতি

ফোটোগ্রাফি - সৈয়দ স্নেহাংশু  


মা

শু ভ্রা শ্রী  মা ই তি

প্ল্যাটফর্মের এক কোণে নিজের ছেঁড়া চটপাতা বিছানাটার ওপর কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে একথালা গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের স্বপ্ন দেখছিল ফুলি। হঠাৎ করে একটা কুচকুচে কালো সাপ যেন উঠে এল নর্দমা থেকে।হিসহিসে শব্দে স্বপ্নে পাওয়া গরম ভাতের চারিদিকে বেড় দিয়ে ফণা উঁচিয়ে বসলো সে। একটা ঠান্ডা শিরশিরানি স্পর্শ নিজের শরীরের এখানে ওখানে অনুভব করে ঘুমের ভেতরই চমকে উঠল সে।
           চোখ খুলে গরম ভাতের চিহ্নমাত্র কোথাও দেখতে পায়না ফুলি। বরং দেখে একটা কালো ঝাঁকড়াচুলওয়ালা মুখ তার মুখের ওপর ঝুঁকে আছে কিসের খোঁজে। লোকটার গরম নিঃশ্বাস এসে পড়ছে তার গায়ে। মদের কটু গন্ধে শরীরটা গুলিয়ে উঠল ফুলির। লোকটার মুখে কেমন যেন দাঁত এঁটো করা হাসি। তার চটচটে হাতটা ঘুরে বেড়াচ্ছে ফুলির দশ বছরের নরম শরীরটার এখানে ওখানে। চিৎকার করে ওঠার আগেই গামছা দিয়ে ফুলির মুখটা পেঁচিয়ে বেঁধে দিল লোকটা।নিজের শতছিন্ন জামাটাকে কোনমতে ঠিক করে একলাফে উঠে বসলো ফুলি চটের উপর।
               স্টেশন এখন প্রায় জনশূন্য।যে কজন আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক, ওদিক, তারাও গভীর ঘুমে মগ্ন।পালানোর চেষ্টা করতেই খপ্ করে ফুলির নরম হাতটা ধরে সজোরে মুচড়ে দিল অসুরের মতো দেখতে লোকটা। প্রচন্ড যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলেও গামছা ভেদ করে তার আওয়াজ পৌঁছালো না ঘুমন্ত মানুষগুলোর কানে।ছোট,ছোট পা ছুঁড়ে বাধা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে ফুলি।সে বুঝতে পারছে না,লোকটা কি চায় তার কাছে।টাকাপয়সা তো কিছুই নেই তার কাছে।পেটের ভাত জোটে না একমুঠো,তার আবার টাকাপয়সা! লোকটা কিসের জন্য তবে তাকে আক্রমণ করছে, তা সঠিক ভাবে বুঝতে না পারলেও একটা ভয়ংকর কিছু একটা যে তার সাথে ঘটতে চলেছে,এটা সে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝতে পারছিল। তার সমস্ত প্রতিরোধ ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছিল লোকটির আসুরিক শক্তির কাছে।স্বপ্নে দেখা কালো সাপটাকে আবার যেন চোখের সামনে দেখতে পেল ফুলি।একটা ব্যাঙ শিকার করেছে সে। ব্যাঙটা প্রাণের দায়ে তার মুখে আটকে ছটফট করে চলেছে ক্রমাগত। চোখটা জলে ভরে ওঠে ফুলির।
               কদিন আগে ভাইরাস জ্বরে মরে যাওয়া মায়ের মুখটা ভেসে উঠলো তার চোখের সামনে। গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করলো ফুলির। কতদিন ভিক্ষে না পেলে মা ঠিক কোথাও না কোথাও থেকে তার জন্য খাবার জোগাড় করে আনত। তাকে বেশিটা খাইয়ে অল্প একটু খাবার তৃপ্তি করে খেয়ে বলত মা---
---দেখবি ফুলি, একদিন আমাদেরও পেটে দুবেলা গরম ভাত পড়বে...মাথার ওপর একটা ছাদ হবে।ওপরে মা আছেন তো,তিনি সব দেখছেন।সুবিচের ঠিক হবেই...দেখিস।
    মার কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করত ফুলি। আর করবে নাই-বা কেন, মা ছাড়া আর কেই-বা আছে তার এ জগতে।বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেই কেমন করে একটা হাসত মা। আঙুল দিয়ে দেখাত আকাশের তারাগুলোর দিকে।মার চোখে তখন জল চিকচিক করত।কতবার দেখেছে ফুলি। যদিও মা বলত, বালি পড়েছে রে বোকা মেয়ে।
         এখন আর মার এই কথাটা সেভাবে বিশ্বাস করতে পারে না ফুলি। মা মারা যাওয়ার পর এই সবে এক সপ্তাহ হল, কিন্তু ফুলির মনে হয় যেন এক বছর পার হয়ে গেছে। কতদিন পেট ভরে খায় নি সে।আজ দুদিন হলো ভাত পেটে পড়ে নি একটুও। পেটের জ্বালা সইতে না পেরে ডাস্টবিনের দিকেও আজ গিয়েছিল খাবার খুঁজতে। মা যদিও একদম পছন্দ করত না এটা।কিন্তু কি করবে ফুলি? তার যে তখন আগুন জ্বলছে পেটে।কিন্তু তিনটে কুকুর এমন তার দিকে তেড়ে এল, ভয়ে কোনমতে পালিয়ে বেঁচেছে সে। তাহলে কোথায় সেই মার আকাশে লুকিয়ে থাকা মা,সে কি দেখতে পায় না, ফুলির কত কষ্ট!মার প্রতি অভিমানে চোখ ফেটে জল আসে ফুলির।কেন মা ছেড়ে চলে গেল তাকে? কার ভরসায়! আজ মা থাকলে কি ওই দুষ্টু লোকটা এমন করতে পারত তাকে...।
             মার চিন্তায় কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল ফুলি। হঠাৎ একটা প্রচন্ড চিৎকারে অসুরের মতো দেখতে লোকটা তার গায়ের ওপর থেকে ছিটকে পড়ে চিৎকার করতে শুরু করল। মাথাটা ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে উঠল ফুলি।তার জলভরা চোখের সামনে তখন দাঁড়িয়ে আছে প্ল্যাটফর্মের শেষপ্রান্তে থাকা মাঝবয়সী পাগলীটা। কখন উঠে এসেছে নিঃশব্দে কে জানে! তার হাতে একটা ফাটা বাঁশের লম্বা টুকরো। চোখগুলো ধকধক করছে প্রচন্ড রাগে।কপালের শিরা এমনভাবে ঠেলে বেরিয়ে এসেছে যে জলেভেজা চোখে ফুলির মনে হল একটা আশ্চর্য চোখ যেন জেগে উঠছে তার এই পাগলী মার ধুলোমাখা কপাল জুড়ে। 
            হ্যাঁ,মা--ই তো,মা ছাড়া কেউ কি তার সন্তানকে এমন ভাবে বাঁচায়।ফুলি অবাক বিস্ময়ে ভাবে,তার মা তাহলে ঠিকই বলেছিল, ওপরের মা তবে ঠিকই আছেন কোথাও না কোথাও।দূরে কোথাও থেকে মাইকে ভেসে আসছে দেবীপক্ষের সুরেলা মন্ত্রপাঠ---
যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্হিতা...
    হাওয়ায় ভেসে আসছে মৃদু ঢাকের বোল... মাইকের সুরেলা গলার সাথে গলা মেলাতে গিয়ে ফুলির চোখের জলে ভেজা ঠোঁটগুলো তির তির করে কেঁপে উঠল বার বার...।


Post a Comment

2 Comments