বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৭৮
লাল ভেরেন্ডা
ভাস্করব্রত পতি
'আদরের কুটুম ভেরেণ্ডার কাঠি
ইঁদুরে নিয়ে গেল আধখান কাটি'।
বাংলা প্রবাদের এই ভেরেণ্ডা গ্রামবাংলার অতি পরিচিত একটি গাছ। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ উদ্ভিদ হলেও এর বীজ খুব বিষাক্ত। তাই এই গাছ ব্যবহারের আগে এই গাছ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও সতর্কতা রাখতে হবে। ভারতের বিভিন্ন এলাকায় এটি পাওয়া যায়। তবে এটি পুয়ের্তো রিকোতে ক্ষতিকারক আগাছা হিসেবেই চিহ্নিত। ডেরেন্ডা গাছ সাধারণত তিন প্রকারের হয়। সাদা ভেরেণ্ডা, বাঘ ভেরেণ্ডা এবং লাল ভেরেণ্ডা। ভারতের বিভিন্ন এলাকায় পাওয়া যায় লাল ভেরেণ্ডা। এখানে একে শম্ভু, Jarak Merah, Sibidigua নামেও চেনা যায়।
আমরা কথাচ্ছলে বলে থাকি 'ভেরেণ্ডা ভাজা'। অর্থাৎ কর্মহীন জীবনযাপন করা। এই গাছটি নিতান্তই অপাংক্তেয়। তাই লোকমুখে প্রচলিত আছে 'তেলাপোকা আবার পাখি, ভেরেণ্ডা আবার গাছ'! অর্থাৎ ভেরেণ্ডাকে গাছের মর্যাদা দিতেও রাজি নয় অনেকেই। অতি গুরুত্বহীন বোঝাতে এই প্রবাদ উচ্চারিত হয়। আবার অসম লড়াই বা পার্থক্য বোঝাতে বলতে শোনা যায় 'হাতির সঙ্গে ভেরেণ্ডা গাছের লড়াই'।
লাল ভেরেন্ডা গাছের ফুল ও ফল
এই লাল ভেরেণ্ডার বিজ্ঞানসম্মত নাম Jatropha gossypiifolia। এটি Euphorbiaceae পরিবারের অন্তর্গত। রাঢ় এলাকায় একে বলে স্বয়ম্বর। ভেরেণ্ডাকে সংস্কৃতে এণ্ড, গালব এবং ওড়িয়াতে গব বলে। কেউ কেউ বলে বিলাতি বাইগব, Bellyache Bush, Black Physicnut, Cotton Leaf Physicnut ইত্যাদি। ইংরেজিতে একে বলে Pinon Negro, Pinon Colorado। এটির আদিনিবাস দক্ষিন আমেরিকা, মেক্সিকো, ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ও ব্রাজিল। লাল ভেরেণ্ডা ব্রাজিলে Mamoninha, Peao Roxo, ফ্রান্সে Medicinier Noir, Medicinier Rouge, থাইল্যান্ডে Jarak Ulung, স্পেনে Tua Tua নামে পরিচিত।
লাল ভেরেন্ডার ফল
লাল ভেরেন্ডা মোটামুটি ২.৫ - ৪ মিটার উচ্চতার হতে পারে। নদীর পাড়ে কিংবা রাস্তার ধারে জন্মায়। দেখতে খুব সুন্দর লাগে। পাতাগুলি তিনটি লবযুক্ত। কচি অবস্থায় লালচে বেগুনি বর্ণের হয় এবং আঠালো হয়। তবে একটু পরিনত হলে উজ্জ্বল সবুজ রঙের হয়ে যায়। গুচ্ছাকার লাল বর্ণের ফুল ফোটে। এর কেন্দ্র হলুদ রঙের হয়। আর ফলের মধ্যে চেরি আকারের বীজের শুঁটি থাকে। এটি খুব বিষাক্ত। এই বীজ প্রায় দশ বছর পর্যন্ত অঙ্কুরোদগমের জন্য সক্রিয় থাকতে পারে।
পথের ধারে লাল ভেরেন্ডা গাছের ঝোপ
লাল ভেরেণ্ডার কিছু ভেষজ গুণ রয়েছে। দাঁতের ব্যাথায় ভেরেণ্ডার রস লাগানোর রেওয়াজ রয়েছে। এটি বাতব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য, ফোলা বা ঘা নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। এর পাতা এবং বীজ থেকে তেল নিষ্কাশন করে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যায়। বিশেষ করে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। ভেরেন্ডা পাতা ঘিয়ে ভেজে খেলে রাতকানা রোগ নিরাময় করে। এর পাতা বেটে ফোঁড়া বা ঘা এর স্থানে লাগালেও উপকার পাওয়া যায়। এছাড়াও স্বল্প প্রস্রাব এবং পেটের ব্যথাতেও এটি ব্যবহার করা হয়। মহিলাদের গর্ভপাত করতেও ব্যবহারের কথা শোনা যায়। লাল ভেরেণ্ডার পাতা গরম করে ব্যথার স্থানে লাগালে বাত ব্যথায় আরাম পাওয়া যায়। গবাদিপশুর চিকিৎসায় এর ব্যবহারের কথা জানা যায়। বায়োডিজেল তৈরিতে এই গাছ কাজে লাগানো হচ্ছে ইদানীং। ছোটবেলায় ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা এই গাছের ডাল ভেঙে রস বের করে সেই রস ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে বাবল তৈরি করত। এখন বেশিরভাগই গাছটির পরিচিতিটুকুও জানেনা।
🍂
0 Comments