জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত - ১০


শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত  

পর্ব -১০

সু দ র্শ ন  ন ন্দী

পরের একাধিক গান নরেন্দ্রনাথের গাওয়া ১৮৮৩, ৭ই এপ্রিল তারিখে।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরামের বাড়িতে ভক্তসঙ্গে বসে আছেন বৈঠকখানার উত্তর-পূর্বের ঘরে। বেলা একটা হবে। নরেন্দ্র, ভবনাথ, রাখাল, বলরাম, মাস্টার ঘরে তাঁর সঙ্গে বসে আছেন।
এখানেই ঠাকুর মধ্যাহ্নে সেবা করেছেন। নরেন্দ্রের শরীর তত সুস্থ নয়, কিন্তু তাঁর গান শুনতে ঠাকুরের খুব ইচ্ছা। তিনি বললেন, “নরেন্দ্র, এরা বলছে একটু গা না।”
নরেন্দ্র তানপুরা নিয়ে গাইতে শুরু করলেন:

আমার প্রাণপিঞ্জরের পাখি, গাও না রে।
ব্রহ্মকল্পতরুপরে বসে রে পাখি, বিভুগুণ গাও দেখি......
  
(রচয়িতা পুণ্ডরীকাক্ষ মুখোপাধ্যায় )

গান   --   বিশ্বভুবনরঞ্জন ব্রহ্ম পরম জ্যোতিঃ ৷
      অনাদিদেব জগৎপতি প্রাণের প্রাণ ৷৷
( রচয়িতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর)

গান   --   ওহে রাজরাজেশ্বর, দেখা দাও ।
চরণে উৎসর্গ দান, করিতেছি এই প্রাণ......
 
( রচয়িতা স্বর্ণকুমারী ঘোষাল)

গান   --   গগনের থালে রবিচন্দ্র দীপক জ্বলে।
তারকামণ্ডল চমকে মোতি রে......
   
( রচয়িতা গুরু নানক)

গান   --   চিদাকাশে হল পূর্ণ প্রেমচন্দ্রোদয় হে।

নরেন্দ্রের গান শেষ হলে ঠাকুর এবার ভবনাথকে বললেন গান গাইতে । ভবনাথ গাইলেন:

দয়াঘন তোমা হেন কে হিতকারী!
সুখে-দুঃখে সব, বন্ধু এমন কে, পাপ-তাপ-ভয়হারী।
(রচয়িতা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর)

 ৮ই এপ্রিল ১৮৮৩। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর তার ছোট খাটে বসে আছেন।কলকাতা থেকে কয়েকজন পুরানো ব্রাহ্মভক্ত উপস্থিত । তার মধ্যে একজন — শ্রীযুক্ত ঠাকুরদাস সেন। ঘরে অনেকগুলি ভক্তের সমাগম হয়েছে।  ভক্তদের সঙ্গে আনন্দে আলাপ করছেন ঠাকুর।
বললেন- তাঁর নাম কললে সব পাপ কেটে যায়! কাম, ক্রোধ, শরীরে সুখ-ইচ্ছা এ-সব পালিয়ে যায়।ব্যাকুল হয়ে তাঁকে প্রার্থনা কর, যাতে তাঁর নামে রুচি হয়। তিনিই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবেন ।

এই বলে ঠাকুর গান শুরু করলেন-  

দোষ কারু নয় গো মা, আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা ৷
ষড়রিপু হল কোদণ্ডস্বরূপ, পুণ্যক্ষেত্র মাঝে কাটিলাম কূপ...... 
 
( দাশরথি রায়ের রচনা গানটি)
আবার গান গাইছেন ঠাকুর। বললেন, জীবের বিকাররোগ! তাঁর নামে রুচি হলে বিকার কাটবে:
এ কি বিকার শঙ্করী, কৃপা-চরণতরী পেলে ধন্বন্তরি!
অনিত্য গৌরব হল অঙ্গদাহ, আমার আমার একি হল পাপ মোহ;
(তায়) ধনজনতৃষ্ণা না হয় বিরহ, কিসে জীবন ধরি ৷৷
অনিত্য আলাপ, কি পাপ প্রলাপ, সতত সর্বমঙ্গলে;...
 
( দাশরথি রায়ের রচনা এই গানটি)

গান শেষ হলে ঠাকুর এবার বললেন , ত্বন্নামে অরুচি! বিকারে যদি অরুচি হল, তাহলে আর বাঁচবার পথ থাকে না। যদি একটু রুচি থাকে, তবে বাঁচবার খুব আশা। তাই নামে রুচি। ঈশ্বরের নাম করতে হয়; দুর্গানাম, কৃষ্ণনাম, শিবনাম, যে নাম বলে ঈশ্বরকে ডাক না কেন? যদি নাম করতে অনুরাগ দিন দিন বাড়ে, যদি আনন্দ হয় তাহলে আর কোন ভয় নাই, বিকার কাটবেই কাটবে। তাঁর কৃপা হবেই হবে।
 
ঐদিন ( ৮ই এপ্রিল ১৮৮৩) রামলাল ও কালীবাড়ির একটি ব্রাহ্মণ কর্মচারী গাইছেন-

(১)    --    হৃদি-বৃন্দাবনে বাস যদি কর কমলাপতি ৷
ওহে ভক্তিপ্রিয়, আমার ভক্তি হবে রাধাসতী ...
 
(২)    --    নবনীরদবরণ কিসে গণ্য শ্যামচাঁদ রূপ হেরে,
করেতে বাঁশি অধরে হাসি, রূপে ভুবন আলো রে...
  
( গানটির রচয়িতা গঙ্গানারায়ণ)
ঠাকুর অনুরাগের কথা বলছেন। গোপীদের অনুরাগের কথা। আবার গান হতে লাগল। রামলাল গাইছেন:
নাথ! তিমি সর্বস্ব আমার। প্রাণাধার সারাৎসার;
নাহি তোমা বিনে কেহ ত্রিভুবনে, বলিবার আপনার......

(গানটির রচয়িতা ত্রৈলোক্যনাথ স্যান্যাল)
শ্রীরামকৃষ্ণদেব গান শুনে বিভোর। বললেন,  আহা কি গান! “তুমি সর্বস্ব আমার!” গোপীরা অক্রুর আসবার পর শ্রীমতীকে বললে, রাধে! তোর সর্বস্ব ধন হরে নিতে এসেছে! এই ভালবাসা। ভগবানের জন্য এই ব্যাকুলতা।
আবার গান চলতে লাগল:

(১)    --    ধোরো না ধোরো না রথচক্র রথ কি চক্রে চলে,
যে চক্রের চক্রের চক্রী হরি যার চক্রে জগৎ চলে।
( এই গানটির রচয়িতা গোবিন্দ অধিকারী)

(২)    --    প্যারী! কার তরে আর, গাঁথ হার যতনে।...
(এই গানটির রচয়িতা দাশরথি রায়)

গান শুনতে শুনতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গভীর সমাধিসিন্ধুমধ্যে মগ্ন হলেন! ভক্তেরা একদৃষ্টে ঠাকুরের দিকে অবাক্‌ হয়ে দেখছেন। আর সাড়াশব্দ নেই। ঠাকুর সমাধিস্থ।
পরে ঠাকুর ঈশ্বরের প্রকাশ নিয়ে আলোচনা করছেন। বললেন,   
 
“তিনিই সব হয়েছেন। তবে মানুষে তিনি বেশি প্রকাশ। যেখানে শুদ্ধসত্ত্ব বালকের স্বভাব - হাসে, কাঁদে, নাচে, গায় - সেখানে তিনি সাক্ষাৎ বর্তমান।এবার গান শুরু করলেন ঠাকুর-

জীব সাজ সমরে, রণবেশে কাল প্রবেশ তোর ঘরে।
ভক্তিরথে চড়ি, লয়ে জ্ঞানতূণ, রসনাধনুকে দিয়ে প্রেমগুণ......
 
(এই গানটির রচয়িতা দাশরথি রায়)
ভক্তদের এবার বললেন, কি করবে? এই কালের জন্য প্রস্তুত হও। কাল ঘরে প্রবেশ করেছে, তাঁর নামরূপ অস্ত্র লয়ে যুদ্ধ করতে হবে, তিনিই কর্তা। আমি বলি, যেমন করাও, তেমনি করি; যেমন বলাও তেমনি বলি; আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী; আমি ঘর, তুমি ঘরণী; আমি গাড়ি, তুমি ইঞ্জিনিয়ার।

Post a Comment

0 Comments