জ্বলদর্চি

নরকের এক ঈশ্বর /আশিস সরকার

ভেরলেন এবং র‍্যাঁবো

নরকের এক ঈশ্বর 

আশিস সরকার 


নরকের দরজায় বিদ্ধ লুব্ধক। টপ্ টপ্ করে পড়ছে রজতশুভ্র শ্বেতশোণিত। ফসফরাসের মতো জ্বলছে মাটির শিরা উপশিরা। গোড়ালির ওপরে উঠে আছে নোংরা তেলচিটে প্যান্ট। চুল যেন ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া পাখির বুকের পালক। দুটো চোখে স্বচ্ছ নীল সমুদ্র, যেন একরাশ জায়মান লাভা গিলে জলের সে কি হাহাকার। পাপ পুণ্যকে চিতায় জ্বালিয়ে তার অস্থিভষ্মে দাপাদাপি করছে এক বালক, তার আঙুলগুলো খুঁজছে এক অশরীরী শুদ্ধতা যাকে দেখা যায় না। ঝিম ধরা চেতনায় তৃতীয় নয়ন খুলছে। আয়নার দিকে তাকিয়ে সে দেখছে মহাকালের ছায়া। এই আয়নাও সে ভেঙে ফেলতে চায়। ভাঙতে ভাঙতে সে পৌঁছতে চায় এমন এক বিন্দুতে যেখানে নরকের স্বাদ পাওয়া যায় জিভের স্বাদকোরকে, যেখানে তার স্নায়ুর শেষ প্রান্তগুলো ছুঁয়ে যায় কোনো সর্বনাশী আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ। 

চরস আর আবসাঁথ খেয়ে মাতাল ঘুমে আচ্ছন্ন যে দেহটি পড়ে রয়েছে ব্রিটানির বিস্তীর্ণ বালুতটে সে কি কোনো দেবতা না দানব? জীবন মৃত্যুর মাঝে এক সান্দ্রচেতনা বলছে গলিত ধাতুর মতো তীব্র সুরা পান করে অগ্নিপিণ্ডের মধ্যে দিয়ে সে ফিরে আসবে লোহার শরীর নিয়ে, তার চোখ জ্বলবে উন্মত্তের মতো, নারকীয় তৃষ্ণায় সে হবে পাশবিক। 

গভীর রাতে নীলাভ কুয়াশার মতো জানালার পর্দা উড়ছে। এ কোন দেশের বাতাস! ২০ অক্টোবর ১৮৫৪। সুদূর শার্লভিল থেকে ভেসে আসছে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট মেঘের মতো জলছবি। এক অভিশপ্ত হৃদয় আর খোলা চোখ নিয়ে জন্মেছে এক বিষ্ময় শিশু, বিশ্ব তাঁকে চিনবে আর্ত্যুর র‍্যাঁবো নামে। সমাধিস্থ রাত আর কৃষ্ণগহ্বরের নৈঃশব্দ্যকেও যিনি বেঁধে ফেলেছেন শব্দের শরীরে, ভাষার পোশাকে যে কথার দেখা মেলে না, কোনো এক অপার্থিব অবচেতনে সে কথা ফুটে উঠেছে যাঁর জাদু আয়নায়, পৃথিবীর ঘূর্ণনগতিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্তব্ধ করতে পারে যাঁর তীক্ষ্ণ কাব্যকিরণ, সেই র‍্যাঁবোকে আমরা দেখছি কালো আগ্নেয় পাথরের ফাঁকে ফাঁকে উত্তপ্ত রক্তিম লাভার মতো গড়িয়ে আসতে। কার সাধ্য এই গলিত পৃথিবীকে ধারণ করে! 

তিনি নিজেই খুঁজে নিয়েছেন তাঁর আধার। ১৮৭১ সাল। র‍্যাঁবো এখন কবি, কবিতার ঈশ্বর, দ্রষ্টা। শার্লভিলে তাঁর তিন বন্ধুর উপদেশ মতো তিনি তাঁর কয়েকটি কবিতা পাঠিয়ে দিয়েছেন কবি পল ভেরলেনকে। প্যারিস থেকে আমন্ত্রণ এসেছে সাথে সাথেই। ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৭১। প্রথম বার প্যারিসে পা রাখলেন র‍্যাঁবো। নোংরা জুতো, তার থেকেও বেশি অপরিষ্কার জামাকাপড়, মুখে পাইপের উগ্র গন্ধ এবং তার সাথে মানানসই বিশ্রী ভাষা। পকেটে একটি লম্বা কবিতা, ভেরলেনের জন্য উপহার। কবিতার শিরোনাম 'দ্য ড্রাঙ্কেন বোট'।
র‍্যাঁবো

ভেরলেনের শ্বশুরবাড়িতে র‍্যাঁবো নামের যে ছেলেটির আগমন হলো সে যেন নরক থেকে উঠে আসা এক কলঙ্কিত জীব, যদিও  ভেরলেনের চোখে সে ছিল 'নির্বাসন থেকে ফেরা এক দেবদূত'। তাঁকে যে ঘরটি দেওয়া হয়েছিল একদিনের মধ্যেই সেই ঘরের অবস্থা অবর্ণনীয় হয়ে উঠেছে। যীশুর ছোট ক্রস ভেঙ্গে চুরমার। বাড়ির বাইরে বাগানে উলঙ্গ হয়ে রোদ পোহায় র‍্যাঁবো।

নরকের রাস্তা দেখাচ্ছেন র‍্যাঁবো। নেশায় চুর হয়ে লিখতে হবে কবিতা। সমস্ত ইন্দ্রিয় গুলোকে তছনছ করে দিতে হবে, তবেই ছুঁয়ে দেওয়া যাবে অ্যাবসোলিউটকে। দেখা যাবে যা তুমি দেখতে চাও কিন্তু দেখতে পাও না। শরীর আর মনের সমস্ত শেকল বাঁধা নিয়ম গলতে শুরু করেছে চরস আর আবসাঁথের নেশায়। তখন শরীরের ভেতরে যেন শুধু সন্ধ্যার হালকা বাতাস আর মাঝে মাঝে কিছু শব্দ ভেসে ওঠে জলের অক্ষরের মতো। আবসাঁথের সবুজ পরীর সাথে এক আচ্ছন্ন সহবাসে র‍্যাঁবো লিখছেন এক আশ্চর্য কবিতা, 'Vowels', স্বরবর্ণ। নেশার ঘোরে একি শুধু শব্দের এক অর্থহীন ভিড় নাকি এক নক্ষত্রের বিস্ফোরণ? এমন বিশুদ্ধ বর্ণ কবিতার পাঠক কবে কোথায় দেখেছেন যেখানে স্বরবর্ণেরও কালো সাদা লাল সবুজ নীল রং হয়!, যেখানে স্বরবর্ণের মাতাল ঠোঁটে অনুশোচনা আর নিঃসঙ্গতার হাসি দেখতে পাওয়া যায়, ভিরিডিয়ান সমুদ্রের দিব্য কম্পন অনুভূত হয় সেই স্বরবর্ণের শরীরে, এক অদ্ভুত কর্কশ শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় 'জগৎ আর দেবদূতে রেখিত নৈঃশব্দে'। পল শ্মিটের অনুবাদে কবিতার শেষ পংক্তিতে দেখছি, ' O...OMEGA... the violet light of His Eyes!' কার চোখের বেগুনি রশ্মি পুড়িয়ে দিচ্ছে র‍্যাঁবোকে? ভেরলেন? 

দুজনে সারারাত নেশা করে শুয়ে থাকতেন। হাশিশের ধোঁয়ায় ভরে উঠতো লেফ্ট ব্যাঙ্কের ভাড়া নেওয়া ছোট্ট ঘর। টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনলের মিস্টিক স্বাদ তখন চেটেপুটে খাচ্ছে র‍্যাঁবোর চেতন। "কি দেখলে?" র‍্যাঁবো উত্তর দিতেন, "কিছুই নয়, শুধু অনেকগুলো সাদা চাঁদ, আর অনেক কালো চাঁদ তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।" স্ত্রী মাতিলদে আর সদ্যোজাত শিশুকে ছেড়ে এসেছেন ভেরলেন। 'নরকের এক ঋতু'র প্রেক্ষাপট শরীর ধারণ করছে ধীরে ধীরে। 

হেমেন্দ্রকুমার রায়ের 'মানুষ-পিশাচ' বইটির কিছু লাইন মনে পড়ছে। 'ওরে আয়, ওরে আয়, ওরে আয় রে আয় জীবনহারা জীবন্তের দল! সূর্যের চোখ কানা হয়েছে, বাদুড়ের ঘুম ভেঙেছে, কালো বিড়াল জেগেছে, কবরের দরজা খুলেছে, - এইবার তোরাও উঠে দাঁড়া, গোরস্থানে আলো জ্বাল, নরকের ফটকে সন্ধ্যাবাতি দে!'  নরকের দরজায় সন্ধ্যাবাতির আলোয় আমরা দেখছি ভেরলেনের সংসারে  আছড়ে পড়ছে র‍্যাঁবোর সর্বগ্রাসী কৃষ্ণগহ্বর। ১৮৭২ সালের সেপ্টেম্বরে ভেরলেন আর র‍্যাঁবো চলে এলেন লন্ডনে। ১৮৮৪ তে মাতিলদের সাথে ভেরলেনের বৈবাহিক সম্পর্কের যবনিকা পতন হলো। ভেরলেনের কাছে র‍্যাঁবো তখন এক 'দীপ্তিময় পাপ', আর র‍্যাঁবোর কাছে ভেরলেন ছিলেন 'ফুলিশ ভার্জিন'।

লোকনাথ ভট্টাচার্যের কিংবদন্তি অনুবাদ র‍্যাঁবোর 'নরকে এক ঋতু'র একটি পরিচ্ছেদ 'নারকী রাত্রি' তে দেখছি র‍্যাঁবোর উন্মত্ত এক রূপ। কবির সংবিৎ যেন অতিক্রম করে গেছে মস্তিষ্কের ৮৬০০ কোটি নিউরনের বিদ্যুৎ তরঙ্গ। "সুস্বাদু গরলের এক ঢোঁক গিলে ফেলেছি। যে-নির্দেশ এল আমার কাছে, তা ধন্য হোক, ধন্য হোক, ধন্য হোক। অন্ত্রের জ্বালায় জ্বলে গেলাম। প্রচন্ড গরলে আমার গা-হাত-পা বেঁকে-চুরে শেষ হ'য়ে গেল, বিকৃত হয়ে গেলাম, কে যেন আমায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে, দম বন্ধ হয়ে এলো, চেঁচাতেও পারি না। এই-ই নরক, এ যন্ত্রণার শেষ নেই! দ্যাখো দ্যাখো, আগুন কি ক'রে মাথা তুলছে! আমাকে জ্বলতেই হবে - জ্বল্ তবে রাক্ষস। .......  সমস্ত রহস্যকে আমি নগ্ন ক'রে দেবো - প্রকৃতির রহস্য, ধর্মের রহস্য, জন্ম-মৃত্যু, অতীত-ভবিষ্যৎ, রহস্য বিশ্ব সৃষ্টির অথবা শূন্যতার। আজগুবিতে আমার সঙ্গে পারবে কে? " ( পৃ : ২২-২৩, এবং মুশায়েরা)   
🍂

লোকনাথ ভট্টাচার্য বলছেন, "পনেরো থেকে উনিশ বছর বয়স পর্যন্ত যে ছেলে কবিতা লিখেছিলো, সে কী ক'রে এইরকম কবিতা লিখতে পারল সে প্রহেলিকার সমাধান কখনো হবে না।" কিন্তু এক হাতের আঙুলের মতো এই সামান্য কটি বছরে তাঁর স্বপ্ন পূর্ণ হলো কি? হলো না হয়তো। হঠাৎ যেন প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে তারাখসার গতিবেগে ছুটে গেল এক ট্রেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ। সাঁকোটা আবার দুলছে। নিজের তৈরি করা কাব্যদর্শনের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন র‍্যাঁবো। ভেরলেনের প্রতিও সেই টান আর নেই। নেশা, দেশি মদ, কবিতা আর সমকামিতার উত্তেজনা কিছু সময়ের জন্য ঘাসের শরীর ভিজিয়ে সকালের কুয়াশার মতো অন্তর্হিত হচ্ছে। এই ভাঙ্গন অসহনীয় হয়ে উঠছে ভেরলেনের কাছে। ১৮৭৩ সাল, ১০ জুলাই। ব্রাসেলসের হোটেল লিজ। একের পর এক আবসাঁথের বোতল খালি করে মাতাল ভেরলেন পরপর দুটো গুলি চালালেন র‍্যাঁবোকে লক্ষ করে। তার একটি লাগলো র‍্যাঁবোর হাতে। আঘাত গুরুতর না হওয়ায় হাসপাতালে ড্রেসিং করে ছেড়ে দেওয়া হলো র‍্যাঁবোকে। ১৮৭৩, ৮ অগাস্ট। ভেরলেনের দু বছরের কারাদণ্ড হলো। র‍্যাঁবো ফিরে এলেন শার্লভিলে। বাড়ি ফিরে শেষ করলেন 'নরকে এক ঋতু'। 

এই ঘটনার কয়েক মাস পরেই কবিতার জগৎ থেকে চির নির্বাসন নিলেন র‍্যাঁবো। কবি অরুণ মিত্র বলছেন, "তিনি কবিতার কাছ থেকে বিদায় নেন যেহেতু তার মাধ্যমে জীবনের রহস্য উন্মোচনের এবং জীবনের রূপান্তর সাধনের যে প্রত্যাশা তাঁর ছিল, তা পূর্ণ হয়নি।" ( 'কবিতা, আমি ও আমরা',  অরুণ মিত্র,  পৃ : ৩৭ ) 

১৮৮০ থেকে টানা ১০ বছর উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায় কখনো হাতির দাঁতের ব্যবসা, কখনো কফি, কখনো বন্দুকের চোরা চালানের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন র‍্যাঁবো। ১৮৯১ তে স্মাগলিং এর কাজ করতে গিয়ে পায়ে গুলি লাগে র‍্যাঁবোর। দেশে ফিরে এলেন। পা কেটে বাদ দিতে হলো। মার্সাইয়ের হাসপাতালে নারকীয় যন্ত্রণার মধ্যে নির্বাপিত হচ্ছেন নরকের লুব্ধক, কবিতার এক ঈশ্বর। পাশে শুধু বোন ইসাবেল। র‍্যাঁবোর বয়স তখন ৩৭। চিরবিদায় নিলেন মুক্তির ফিনিক্স পাখি র‍্যাঁবো।

মনে পড়ছে শ্রীকৃষ্ণের শেষ দিন। রক্তিমাভ শ্রীচরণকে হরিণের মুখ মনে করে জরা ব্যাধ নিক্ষেপ করেছে তার বাণ। অরণ্যে বৃক্ষতলে একাকী বাণবিদ্ধ ভগবান। মৃত্যু, আর অন্ধকার। নেমে আসে আরো গাঢ় অন্ধকার। সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে তাঁর কবিতা ঝলসে উঠছে অরোরা বোরিয়ালিসের মতো।

Post a Comment

0 Comments