কথাসাহিত্যিক প্রচেত গুপ্ত-র সাক্ষাৎকার নিয়েছেন
সন্দীপ দত্ত
সন্দীপ দত্ত: নমস্কার প্রচেতদা, 'জ্বলদর্চি'পত্রিকার পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত। আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের জগতে আপনার উজ্জ্বল অবদানের জন্য ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও অনেকখানি ভালবাসা।
প্রচেত গুপ্ত: আপনাকেও আমার তরফ থেকে অনেক শুভেচ্ছা ও ভালবাসা।
সন্দীপ: প্রচেতদা,আগে বলুন কেমন আছেন?
প্রচেত: এই ভাল মন্দ মিশিয়ে চলে যাচ্ছে। আপনি ভাল আছেন তো?
সন্দীপ: এই আছি। ভালই। আপনার ছোটবেলা কোথায় কেটেছে ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে।
প্রচেত: ছেলেবেলা তো অনেকদিন আগের ঘটনা। পরিস্কার মনে নেই, তবে কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটের দিনগুলো আবছা আবছা মনে পড়ে। সেখান থেকে বাঙ্গুর অ্যাভিনিউ। বাঙ্গুরে দীর্ঘ চল্লিশ বছর ছিলাম আমরা।
সন্দীপ: ছেলেবেলার কোনও স্মৃতি মনে পড়ে কি?
প্রচেত: স্মৃতি তো অনেক থেকে যায়। সেইভাবে মনে পড়ে না, তবে কিছু কিছু মনে আছে। আমার বাবা ছিলেন পণ্ডিত মানুষ। ক্ষেত্র গুপ্ত। মা ছিলেন কলেজের অধ্যাপিকা। নাম জ্যোৎস্না গুপ্ত। আমরা তিন ভাই ছিলাম। পুষ্কর,পুষণ আর আমি,এই প্রচেত। আমার স্কুল ছিল বাঙ্গুর বয়েজ। আমরা যেখানে থাকতাম, সেখানে প্রচুর গাছ ছিল। স্কুলের সামনে একটা বড় খেলার মাঠ ছিল। সেখানে আমরা বিকেলে ফুটবল খেলতাম। স্কুলটা খুব বেশি বড় ছিল না। ওই স্কুলে অনেকেই পড়াশুনো করেছেন। ব্রাত্য বসু, দেবশঙ্কর হালদারও পড়তেন। আমরা যেখানটাতে থাকতাম, সামনাসামনিই ছিল নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বাড়ি। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে আমি জেঠু বলতাম। শুধু নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নন, সামনাসামনি আরও অনেকেই থাকতেন। বিমল কর,পূর্ণেন্দু পত্রীর মতো প্রথিতযশাদের নাম মনে পড়ছে। আমাদের পাড়ায় মঞ্চ বেঁধে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করা হত। অনেকেই অংশগ্রহণ করতেন সেখানে। কলেজ থেকে ফিরে এসে মাও যেতেন। পূর্ণেন্দুকাকু সাদা কাগজের টুকরো ছোট ছোট করে কেটে কুচি কুচি করে বৃষ্টিধারা তৈরি করতেন। আমরা ছোটরা মুগ্ধ হয়ে দেখতাম সব।
সন্দীপ: ছোট থেকেই কি বাংলা সাহিত্যের প্রতি আপনার আগ্রহ ছিল?
প্রচেত: বাবা মা পড়াশুনোর জগতের মানুষ হওয়ার জন্য বাড়িতে বই ছিল প্রচুর। পড়ার নেশাটা বাবা মা'র কাছ থেকেই শেখা। আগ্রহটা বোধহয় আস্তে আস্তে এইভাবেই তৈরি হয়ে যায়। বাংলা বই তো অবশ্যই ছিল। বিদেশী ভাষার বেশ কিছু বইও ছিল বাড়িতে।
সন্দীপ: কোন বয়েস থেকে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করলেন? কেন মনে হল লিখতে হবে?
প্রচেত: সে ভারি মজার ঘটনা! ক্লাস ফোর,ফাইভ কি সিক্স তখন। মনে হল,আমারও কিছু বলার আছে। কিন্তু ওইটুকুন বয়েসের ছেলের কাছ থেকে কে কী শুনতে চায়? বাবা মাকে বলতে গেলে বাবা মা দেবে পিটুনি! তাই নিজের ভেতরের কথাগুলো চুপিচুপি খাতায় লিখতাম। যা দেখতাম,সেটাই। লিখতাম আর পাঠাতাম বিভিন্ন পত্রিকা দপ্তরে। একটাও ছাপা হত না। মনে আছে,'সন্দেশ'পত্রিকার পঞ্চাশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের বেশ কিছুদিন পর আমাকে পত্রিকা দপ্তর থেকে বলা হয়,পঞ্চাশ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান নিয়ে কিছু লিখতে। ওসব না লিখে আমি লিখলাম,'সন্দেশ'পত্রিকার দপ্তরে আমি অনেক লেখা পাঠিয়েছি। সেসবের একটিও ছাপা হল না কেন? আজ ভাবলে নিজের মনেই হাসি। মনে পড়লে মজা লাগে।
সন্দীপ: আপনার প্রকাশিত প্রথম গল্প কোনটি? গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার পর আপনার মনে তার কী প্রভাব পড়েছিল?
প্রচেত: এই রে,ওটা তো এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না! গল্প কি হয়েছিল আদৌ? কে জানে! প্রকাশিত হলে আনন্দ পেয়েছিলাম,এই আর কি! এটাকে প্রভাব বললে প্রভাব।
সন্দীপ: আপনার অনেক উপন্যাসই আমি পড়েছি। 'ঝিল ডাঙার কন্যা','নুড়ি পাথরের দিনগুলি','শরীরের ভিতর শরীর',আর বেশ কয়েকটা। সবগুলোই অসাধারণ লেগেছে আমার। মন ছুঁয়ে গেছে।
প্রচেত: ধন্যবাদ।
সন্দীপ: আপনার এই বিপুল সৃষ্টিসম্ভারে 'সাগর'একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র। 'সাগর' নিয়ে আপনার পাঠকদের কৌতূহল অসীম। এখন আমার প্রশ্ন, 'সাগর'- এর জন্ম হল কীভাবে?
প্রচেত: সেভাবে ভেবে তো কিছু লিখিনি। জীবনবোধ থেকেই 'সাগর' -এর জন্ম। সেটা বলাই ভাল। জীবনদর্শন থেকে উঠে আসা এই চরিত্র। আপনি সন্ধেবেলা চাঁদের দিকে তাকান, কিংবা ঝড়ের সময় উন্মত্ত দামাল বাতাসের দিকে, যে জীবন খুঁজে পাবেন,'সাগর' -এর জন্ম সেখান থেকেই। যে প্রতিনিয়ত লড়াই করে। লড়াই করতে করতে জীবনকে দেখে।
সন্দীপ: আপনার 'অনাবৃত'উপন্যাসটি গোয়েন্দাধর্মী। যেটি 'অভিযান' পাবলিশার্স বের করে। আজকের যাঁরা তরুণ গোয়েন্দা লেখক, গোয়েন্দাধর্মী কাহিনি লেখার ক্ষেত্রে আপনি তাঁদের কী পরামর্শ দেবেন?
প্রচেত: আমি পরামর্শ দেওয়ার কেউ নই। প্রত্যেকেই নিজের মতো করে লেখেন। লিখছেন। তাঁদের নিজস্ব স্টাইলে আমি ব্যাঘাত সৃষ্টি করব কেন? আমি শুধু আমার নিজেরটা নিয়ে বলতে পারি।
সন্দীপ: রবীন্দ্রসাহিত্য থেকে সুনীলসাহিত্য, দীর্ঘ এই পথ চলার পর বাংলা কথাসাহিত্য এখন কতখানি আধুনিক?
প্রচেত: প্রশ্নটার ধরন আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।রবীন্দ্রসাহিত্যের আগেও বাংলা সাহিত্য ছিল। সুনীলসাহিত্যের পরেও বাংলা সাহিত্য এগিয়েছে। এই এগিয়ে চলাটাই তো আধুনিকতা। 'আধুনিক'শব্দটাকে ওভাবে বাঁধা যায় না। রবীন্দ্রসাহিত্যের মতো আধুনিক সাহিত্য কখনও হয় নাকি? আবার সুনীল গাঙ্গুলির সাহিত্য বা শীর্ষেন্দুদার সাহিত্যে আধুনিকতার কোনটা নেই? জীবনানন্দ বা শেক্সপীয়র আধুনিক নয়? সাহিত্য আধুনিকতার স্রোত বেয়েই চলে। আজকের বেশ কয়েকজন লেখক বা কবির নাম আমি এই মুহূর্তে বলতে পারি,যাঁরা খুব ভাল লিখছেন। তাঁদের লেখায় আধুনিকতার নিত্যনতুন স্টাইল কত স্পষ্ট! কী অসাধারণ তাঁদের দেখার চোখ!
সন্দীপ: বড়দের পাশাপাশি আপনি ছোটদের জন্যও অনেক লিখেছেন এবং লিখছেন। লেখক লেখেন পাঠকদের জন্য। আপনার কি মনে হয়,আজকের কিশোররা বাংলা সাহিত্য পড়া ও জানার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে?
প্রচেত: যারা পড়ে,তারা ঠিকই পড়ে। আগেও পড়েছে,এখনও পড়ে। চাহিদা না থাকলে শিশু কিশোরদের জন্য এত লেখা হবে কেন? আপনার সঙ্গে কথা বলার আগে এই তো আজ দুপুর বিকেলে আমি একটা ছোটদের লেখা শেষ করলাম। কোনও কিশোর যদি মনে করে সে বই পড়বে না, তাকে তো জোর করার কিছু নেই। জোর করে কখনও বই পড়ানো যায় না। বই সবার জন্য নয়। বিজ্ঞানী কিংবা জ্ঞানী পণ্ডিত মানুষদের মিছিল হয় কখনও শুনেছেন? ছোট বড় সকলের জন্যই কথাটা বলছি। যারা টিভি দেখতে চায়, তারা টিভি দেখবে। যারা মোবাইল ঘাঁটতে চায়, তারা মোবাইল ঘাঁটবে। যারা বই পড়তে চায়, তারা বই পড়বে। এটাই তো স্বাভাবিক।
সন্দীপ: আজকের আধুনিক সমাজ ই বুকের প্রতি ভীষণভাবে আসক্ত। ছাপা বইয়ের ভবিষ্যত কি তাহলে অন্ধকারের দিকে চলে যাচ্ছে?
প্রচেত: সম্পূর্ণ ভুল তথ্য। ভুল,ভুল,ভুল! পরিসংখ্যান দেখতে চাইলে আমি আপনাকে দেখিয়ে দিতে পারি। ই বুকের পাঠকসংখ্যা ছাপা বইয়ের পাঠকসংখ্যার চেয়ে অনেক পিছিয়ে। ছাপা বইয়ের ভবিষ্যত কখনই অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে না। ছাপা বই বরাবরই আলোকে ছিল। ভবিষ্যতেও আলোকেই থাকবে।
সন্দীপ: লেখকের সৃষ্টি কোনও গল্প বা উপন্যাস যখন পর্দায় আসে, সে ছোট পর্দাই হোক বা বড় পর্দা,অনেক সময়ই পরিচালক সেখানে কম বেশি কাটাছেঁড়া করেন। তাতে লেখকের কলমে ধরা পরিবেশ ও চরিত্রের খানিকটা হলেও রদবদল ঘটে যায়। একজন কথাসাহিত্যিক হিসেবে আপনি এটাকে কোন চোখে দেখবেন?
প্রচেত: লেখক লেখেন কলম দিয়ে। পরিচালক কাজ করেন ক্যামেরা দিয়ে। আসল হচ্ছে,চরিত্রের জীবনদর্শন। পরিচালক লেখকের সৃষ্ট চরিত্রের নাম শ্যামল পাল্টে কমল রাখতেই পারেন। ওটা দোষের নয়। কিন্তু শ্যামলের জীবনবোধ যদি বদলে ফেলেন,সেটা অপরাধ।
সন্দীপ: ৩২ বছরের 'জ্বলদর্চি' পত্রিকা আপনার সুপরামর্শ চায়। লিটল ম্যাগাজিনের এই অক্লান্ত,নির্ভীক পথ চলা দেখে আপনার কী মনে হয়?
প্রচেত: আবারও বলি,আমি পরামর্শ দেওয়ার কেউ নই। সবাই যে যার নিজের ছন্দে এগিয়ে চলে। এত বছর ধরে লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন ঋত্বিকবাবু। তাঁর এই অসীম ধৈর্য, নিষ্ঠা এবং ছোট কাগজের প্রতি ভালবাসা শুধু আমাকেই নয়,অনেককেই অবাক করেছে। 'লিটল'মানে যে 'ছোট' বলা হয়, কাগজ তো সেই অর্থে ছোট নয়। ছোট কাগজ বলে কিছু হয় না। আসলে এইসব কাগজগুলো সম্পাদকেরা নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে বার করেন। প্রচারটাও অনেক সময় তেমন পায় না। কিন্তু আমি জানি,অনেক ভাল ভাল লেখাই লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশ পাচ্ছে আজ। এতটাই ভাল,পড়ে চমকে যেতে হয়। ঠিক একইরকমভাবে বড় পত্রিকাতে খারাপ কিছু লেখা ইদানিং ছাপা হয়ে যাচ্ছে। এতটাই খারাপ,বলার নয়। 'জ্বলদর্চি'কে ঋত্বিকবাবু এত সুন্দরভাবে পরিবেশন করেন পাঠকের কাছে,যা প্রশংসার দাবি রাখে। আমি ভালবাসা জানাই ঋত্বিকবাবুকে।
সন্দীপ: এতক্ষণ সময় ধরে আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ প্রচেতদা। ভাল থাকবেন সবসময়। আরও অনেক লিখুন আপনি। আমরা পড়ে মুগ্ধ হই।
প্রচেত: আপনিও ভাল থাকবেন। অনেক শুভেচ্ছা রইল আপনার জন্য।
0 Comments