জ্বলদর্চি

বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন - ১২

বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন

● পর্ব ― ১২

ব্রম্ভাণ্ডের তিন সম্ভাবনা :

লড়াই জারি আছে। জন্ম থেকেই। ক্ষমতা প্রদর্শনের একমাত্র উপায় তো যুদ্ধ। এছাড়া অন্য পথ খোলা নেই আর। শক্তির বড়াই করে সে, যার সামর্থ্য আছে। তাই যুদ্ধ অনিবার্য। যুযুধান এ হেন দুই কঠিন প্রতিপক্ষ অবশ্য পার্থিব কোন প্রাণী বা বস্তু নয়, বরং দুই রকম বল। প্রসারণ ও আকর্ষণ। এক বল চায় এই সুন্দর বিশ্বকে চুইংগামের মতো টেনে প্রসারিত করতে। অন্য বলের তীব্র ইচ্ছা ব্রম্ভাণ্ডের দৃশ্যমান জগতকে সংকুচিত করে সিঙ্গুলারিটি প্রদান করা। প্রথম বল চায় বিশ্বের ভরঘনত্ব কমাতে; দ্বিতীয়টির বাসনা ঘনত্ব বাড়িয়ে সবকিছু একত্রিত করা। আজ পর্যন্ত এ হেন সংঘর্ষ বিরতির লক্ষণ কারও নেই। তাহলে কতদিন স্থায়ী হবে এ যুদ্ধ? কে জিতবে এ মহারণ? 

জন্মের পর থেকে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ওই প্রসারণকে রোধ করার জন্য নিরবে অথচ ধীরে সারাক্ষণ পরিশ্রম করে চলেছে একটি আকর্ষণ বল। সে-বল হল মহাকর্ষ। যার ক্রিয়ায় গ্রহ, তারা, নক্ষত্র বা গ্যালাক্সিগুলো একে অন্যকে পিছু টানছে। পরস্পরের কাছাকাছি আসতে চাইছে তারা। হয়তো বা প্রথম পর্বে বাজিমাত করেছে প্রসারণ বল; কিন্তু কতদিন ছুটবে তার অশ্বমেধের ঘোড়া? টান টান উত্তেজনায় ম্যারাথন রেস এই তো সবে শুরু হয়েছে। ব্রম্ভাণ্ড সবে শৈশব থেকে কৈশোরে পা রেখেছে। অন্তিম ফলাফলের এখনও অনেক দেরি।

তবে প্রসারণশীল বিশ্বের চূড়ান্ত সম্ভাবনা নির্ভর করে একটি সূচকের উপর। তা মহাজাগতিক তুল্য ভরঘনত্ব। এখন প্রশ্ন হল, মহাজাগতিক তুল্য ভরঘনত্ব কী? ঘনত্বের এ হেন সূচককে আমরা একটি এককহীন রাশিতে সংজ্ঞায়িত করি ও Ω (ওমেগা) চিহ্ন দিয়ে প্রকাশ করি। যদি ঘনত্বের সংকট মান d° হয় তাহলে তুল্য ঘনত্বের স্থিতিমাপ Ω হল নিম্নরূপ :-
              
               Ω = d / d°
           
যেখানে d হল বিশ্বের পদার্থ-শক্তির গড় ঘনত্ব।
সংকট ঘনত্ব (d°) কী? সংকট ঘনত্ব হল পদার্থ-শক্তির এমন এক ঘনত্বের মান যখন ব্রম্ভাণ্ডের প্রসারণ বন্ধ হয়ে যাবে। 

সোজা কথায়, সংকট ঘনত্বের সাপেক্ষে ব্রম্ভাণ্ডের মোট পদার্থ ও শক্তির গড় ঘনত্বের মাত্রাহীন রাশিকে ঘনত্বের স্থিতিমাপ Ω হিসাবে সংজ্ঞাত করা হয়। এই ওমেগার মানের উপর নির্ভর করে ভবিষ্যৎ ব্রম্ভাণ্ডের তিনটি উজ্জ্বল সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছেন পণ্ডিতগণ।

যদি Ω-এর মান ১-এর বেশি হয়, তাহলে মহাকর্ষ বল প্রসারণের চাইতে বেশি হবে। এখন প্রসারণ চালু থাকলেও তার হার ক্রমশ কমবে ও একদিন তা বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর শুরু হবে সংকোচন। সমস্ত গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সি একটি আরেকটির ঘাড়ে গিয়ে পড়বে। শেষমেশ মহাবিশ্ব ব্ল্যাকহোল যুগ পেরিয়ে বিগব্যাঙের অনুরূপ বিগক্রানচ দশায় পৌঁছবে। এরকম বদ্ধ বিশ্ব হবে পজিটিভ বক্রতার গোলকের মতো।
                                   
                          
অপরপক্ষে Ω-এর মান ১-এর সমান হলে মহাকর্ষ বল প্রসারণজনিত বলের সমান হবে। তখন ব্রম্ভাণ্ডের প্রসারণ অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবে। হয়তো বা প্রসারণের হার অতি ক্ষুদ্র পরিমাণে একটু একটু করে কমবে। তবে তা কখনওই শূন্য হবে না। সেক্ষেত্রে দেশের বক্রতা ঋনাত্মক হবে।

শেষমেশ Ω-এর মান ১-এর কম হলে প্রসারণ বল মহাকর্ষের চাইতে বেশি হবে। ব্রম্ভাণ্ডের আয়তন বাড়তে বাড়তে এমন এক অবস্থায় পৌঁছবে যে মহাকর্ষ বল আর কখনও তার গতি কমাতে পারবে না। তখন দেশের জ্যামিতি হবে পরাবৃত্তীয়। ঘোড়ার জিনের মতো তার বক্রতা অসীম হবে। প্রসারণশীল ব্রম্ভাণ্ড তখন সমতল (flat) আকার ধারণ করবে।
                              

এই তিন সম্ভাবনার কোনটি সত্যি হবার আশঙ্কা প্রবল? এমন গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন থেকেও বিজ্ঞানীগণ জোর দিচ্ছেন একটা বিষয়ে। আর তা হল বিশ্বে পদার্থের মোট পরিমাণ। সকলে অবগত আছি, এই মহাজাগতিক বিশ্বে দৃশ্যমান পদার্থের (barionic matter) 
          মোট ভর ১.৫ × ১০^৫৩ কেজি, 
          গড় ঘনত্ব ৯.৯ × ১০^(–২৭) কেজি/ঘনমিটার, 
          ব্যাস ৮.৮ × ১০^২৬ মিটার, 
          আয়তন ৪ × ১০^৮০ ঘনমিটার, 
          বয়েস (১৩.৭৯৯ +/– ০.০২১) বিলিয়ন বছর, 
          গড় তাপমাত্রা ২.৭২৫৪৮ °K

আকর্ষণ বল (মহাকর্ষ) যেহেতু দুটি বস্তুর ভরের গুণফলের ওপর নির্ভর করে, তাই তাদের হ্রাস-বৃদ্ধির ওপরে নির্ভর করছে ব্রম্ভাণ্ডের সত্যিকারের ভবিতব্য ― সংকোচন, নাকি প্রসারণ। কিন্তু ব্রম্ভাণ্ডের প্রসারণ হার যে আলোকের চেয়ে দ্রুত গতিতে বাড়ছে, তার ইঙ্গিত বিজ্ঞানীগণ আলোকের 'ডপলার বিচ্যুতি'র লাল-সরণ (Red Shift) থেকে গণনা করে পেয়েছেন। এতদসত্ত্বেও পণ্ডিতগণ নিশ্চিত হতে পারছেন না, প্রসারণই ব্রম্ভাণ্ডের একমাত্র ভবিতব্য কি-না। যেহেতু ব্রম্ভাণ্ড এখনও তার শিশুকালে রয়েছে, তাই তার প্রসারণ বেগ এখন বাড়লেও পরে তা আবার কমতে পারে ― এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর এখানেই আশঙ্কার কালো মেঘ দানা বাঁধছে বিজ্ঞানীদের মনে। তেমন আশঙ্কা থেকে পরিত্রাণের শেষতম সংযোজন বুঝি কসমোলোজীক্যাল ধ্রুবক। সে আবার কী জিনিস?

যদিও সোভিয়েত ফিজিসিস্ট আলেকজান্ডার ফ্রায়েডম্যান (১৮৮৮ – ১৯২৫)-এর মত প্রসারণের পক্ষে। শুধু তাই নয়, ১৯২৭ সালে জর্জ লেমেইটার (১৮৯৪ – ১৯৬৬) সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে দেখান ― বিশ্ব প্রসারণশীল। পৃথিবীর সাপেক্ষে কোন মহাজাগতিক বস্তুর মন্দা গতির সঙ্গে দূরের বস্তুসমূহের দূরত্বের সরল সম্পর্ক অনুধাবন করেন তিনি। পরে ১৯২৯ সালে আমেরিকান নভশ্চর এডুইন হাবল (১৮৮৯ – ১৯৫৩) উক্ত সম্পর্কটি সংশোধন করে তার সত্যতা প্রমাণ করেন। সেই সরল সমানুপাত সম্পর্কটি 'হাবল-লেমেইটার সূত্র' বা সংক্ষেপে 'হাবলের সূত্র' নামে পরিচিত হয়। সে-সূত্রের মতে ― নাক্ষত্রিক বস্তুরাজির মধ্যবর্তী দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে এবং তাই ব্রম্ভাণ্ড প্রসারণশীল। বস্তুসমূহের মাঝের দূরত্ব (D) তাদের লাল-সরণ থেকে প্রাপ্ত মন্দা গতি(v)-র সমানুপাতিক। এই সম্পর্কটি হল 
                            v = HoD

এক্ষেত্রে সমানুপাতি ধ্রুবক (Ho)-কে হাবলস ধ্রুবক বলা হয়। দূরত্ব D-কে মেগাপারসেক (১ MPc = ৩.০৯ × ১০^১৩ কিলোমিটার) এককে এবং v-কে কিলোমিটার/সেকেন্ড এককে প্রকাশ করলে হাবলস ধ্রুবকের একক দাঁড়াবে কিলোমিটার/সেকেন্ড-মেগাপারসেক। এই হাবলস ধ্রুবকই কসমোলোজীক্যাল ধ্রুবক। হাবলস ধ্রুবকের অন্যোন্যক হল হাবলস টাইম। হাবল স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে এই ধ্রুবকের মান পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করে পূর্বের তুলনায় ব্রম্ভাণ্ডের প্রসারণ বেগের হ্রাস-বৃদ্ধি বুঝতে পারবেন পণ্ডিতগণ। তারপর গণনার মাধ্যমে উঠে আসে তার সম্ভাব্য পরিণতি।
                                  

সুতরাং বলা যায়, হাবলের সূত্র ধরে প্রসারণশীল ব্রম্ভাণ্ডের প্রসারণশীলতার স্বপক্ষে অন্যতম দলিলের হদিস পায় পণ্ডিতগণ। কিন্তু প্রসারণশীল বিশ্ব আমাদের পক্ষে নিরাপদ তো? সম্ভবত না। বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম (১৯৩৯ – ২০১৩) প্রসারণশীল বিশ্বের বিপদের কথা প্রথম বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি একটি প্রবন্ধ লেখেন। 'পসিবল আলটিমেট ফেট অফ দ্য ইউনিভার্স'। রয়াল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি'র জার্নাল-এ। এর সূত্র ধরে বিজ্ঞানী ফ্রীম্যান ডাইসন (১৯২৩ – ২০২০) এক দীর্ঘ আলোচনা করেন 'রিভিউজ অব মডার্ন ফিজিক্স'-এ। ১৯৭৯ সালে। সেখানে তিনি ব্রম্ভাণ্ডের প্রসারণের বিপদ বিশদভাবে তুলে ধরেন।

প্রসারণের অর্থ ব্রম্ভাণ্ডের আকারে বেড়ে যাওয়া। পদার্থ কিংবা শক্তির যে কোন উৎস ― শূন্যস্থানে আলোকের থেকে বেশি দ্রুততায় সবকিছু পরস্পর থেকে ক্রমশ দূরে, আরও দূরে সরে যায়। ফলে তাদের থেকে শক্তি সংগ্রহ করা খুব কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে ভবিষ্যতে। লক্ষ কোটি যোজন দূর থেকে অতি ক্ষীণ আলো এসে পৌঁছবে পৃথিবীতে। পর্যাপ্ত শক্তির অভাবে কেমন করে টিকবে ভবিষ্যতের সভ্যতা? সে পৃথিবীতে হোক বা অন্য কোথাও।

Post a Comment

1 Comments