জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত - ৮


শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত  

পর্ব-৮   

সু দ র্শ ন  ন ন্দী


পরের গান ১৯শে মভেম্বর ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দ। ৺জগদ্ধাত্রীপূজা, সুরেন্দ্র নিমন্ত্রণ করেছেন।কাছে মনোমোহনের বাড়ি, ঠাকুর প্রথমে সেখানে নামলেন, সেখানে একটু বিশ্রাম করে সুরেন্দ্রের বাড়িতে আসবেন।
মনোমোহনের বৈঠকখানায় ঠাকুর বলছেন, “যে অকিঞ্চন, যে দীন, তার ভক্তি ঈশ্বরের প্রিয় জিনিস। খোল মাখানো জাব যেমন গরুর প্রিয়! দুর্যোধন অত টাকা অত ঐশ্বর্য দেখাতে লাগল; কিন্তু তার বাটীতে ঠাকুর গেলেন না। তিনি বিদুরের বাটী গেলেন। তিনি ভক্তবৎসল, বৎসের পাছে যেমন গাভী ধায় সেইরূপ তিনি ভক্তের পাছে পাছে যান।”
এই বলে ঠাকুর গান গাইলেন:

যে ভাব লাগি পরম যোগী, যোগ করে যুগ-যুগান্তরে।
হলে ভাবের উদয় লয় সে যেমন লোহাকে চুম্বক ধরে।

বললেন, চৈতন্যদেবের কৃষ্ণনামে অশ্রু পড়ত। ঈশ্বরই বস্তু, আর সব অবস্তু। মানুষ মনে করলে ঈশ্বরলাভ করতে পারে। কিন্তু কামিনী-কাঞ্চন ভোগ করতেও মত্ত। মাথায় মাণিক রয়েছে তবু সাপ ব্যাঙ খেয়ে মরে!   
 
২৬শে নভেম্বর ১৮৮২। ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজের উৎসবে মণিলাল মল্লিকের বাড়িতে এসেছেন। সঙ্গে মাস্টার, বিজয়কৃষ্ণ,প্রেমচাঁদ বড়াল ও মণিলালের অন্যান্য বন্ধুরা। কথা প্রসঙ্গে বললেন- “চিত্তশুদ্ধির পর ভক্তিলাভ করলে, তবে তাঁর কৃপায় তাঁকে দর্শন হয়। দর্শনের পর আদেশ পেলে তবে লোকশিক্ষা দেওয়া যায়। আগে থাকতে লেকচার দেওয়া ভাল নয়।
একটা গান গাইলেন এবার:
ভাবছো কি মন একলা বসে,
অনুরাগ বিনে কি চাঁদ গৌর মিলে......

গানটির রচয়িতা পদ্মলোচন। গানটি একবারই গাইতে দেখি কথামৃতে।
 
পরের গানের উল্লেখ ১৮৮২, ১৪ই ডিসেম্বর তারিখে পাই। দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী এবং অন্যান্য ব্রাহ্মভক্তরা এসেছেন। রয়েছেন মাস্টার, বলরাম বসু। ঠাকুর বলছেন বিচারের পথেও তাঁকে পাওয়া যায়। বলে একটি রামপ্রসাদ সেনের গানের একটি অংশ গাইলেন-
আর চিনি হতে চাই না, চিনি খেটে ভালবাসি। সেদিন আলোচনা প্রসঙ্গে বললেন ভক্তি দ্বারা  তাঁকে দর্শন করতে হয়। বলে আরেকটি গানের (রচয়িতা অজ্ঞাত) অংশ বললেন- 
প্রভু বিনে অনুরাগ, করে যজ্ঞ যাগ, তোমারে কি যায় জানা!
এই অংশের উল্লেখ তিনি সিঁথির ব্রাহ্মসমাজেও একবার করেছিলেন। রচয়িতা অজ্ঞাত।
সেদিন বিজয়কৃষ্ণ  জিজ্ঞাসা করলেন ঠাকুরকে, ঈশ্বর দর্শন কেমন করে হয়? ঠাকুর বললেন কৃপা হলেই দর্শন হয়। বলে এই গানটির অংশ উল্লেখ করলেন- জ্ঞানদীপ জেলে ঘরে, ব্রহ্মময়ীর মুখ দেণ  না । ঠাকুর বোঝাচ্ছেন হৃদয়ের মধ্যে জ্ঞানের আলো জ্বালতে হয়। এই অংশটি কথা মৃতে তিনবার উল্লেখ পাই।
ঐ দিনই, ১৪ইডিসেম্বর, ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে বিকাল বেলা নিজের ঘরে পশ্চিমের বারান্দায় কথা বলছেন। সঙ্গে বাবুরাম, মাস্টার, রামদয়াল প্রভৃতি।  
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)- ঈশ্বর সব করছেন এ-জ্ঞান হলে তো জীবন্মুক্ত। কেশব সেন শম্ভু মল্লিকের সঙ্গে এসেছিল, আমি তাকে বললাম, গাছের পাতাটি পর্যন্ত ঈশ্বরের ইচ্ছা ভিন্ন নড়ে না। স্বাধীন ইচ্ছা (Free will) কোথায়? সকলই ঈশ্বরাধীন। ...।আমার একবার খুব বাতিক বৃদ্ধি হয়েছিল, তাই গলায় ছুরি দিতে গিছলুম। তাই বলি, “মা, আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী; আমি রথ, তুমি রথী; যেমন চালাও তেমনি চলি -- যেমন করাও তেমনি করি।”
এসময় ঠাকুরের ঘরের মধ্যে গান হল। ভক্তেরা দুটি গান গাইলেন:

১।           হৃদি-বৃন্দাবনে বাস যদি কর কমলাপতি।
ওহে ভক্তিপ্রিয়, আমার ভক্তি হবে রাধাসতী......
 

২।           আমার প্রাণ-পিঞ্জরের পাখি গাওনারে।
ব্রহ্ম-কল্পতরুমূলে বসেরে পাখি,...

ঠাকুর বললেন, ব্রহ্মজ্ঞানের পর -- সমাধির পর -- কেহ কেহ নেমে এসে ‘বিদ্যার আমি’, ‘ভক্তির আমি’ লয়ে থাকে। বাজার চুকে গেলে কেউ কেউ আপনার খুশি বাজারে থাকে। যেমন নারদাদি। তাঁরা লোকশিক্ষার জন্য ‘ভক্তির আমি’ লয়ে থাকেন। শঙ্করাচার্য লোকশিক্ষার জন্য ‘বিদ্যার আমি’ রেখেছিলেন।
প্রথম গানটি দাশরথি রায়ের রচনা এবং দ্বিতীয় গানটি পুণ্ডরীকাক্ষ মুখোপাধ্যায় লিখিত।দুটি গানই কথামৃতে দুবার করে উল্লেখ পাই।

Post a Comment

0 Comments