জ্বলদর্চি

আগে বলুন, সুবোধ সরকারের কবিতা কেন কবিতা নয় !


সেমিকোলনের আত্মজীবনী - ৮

আগে বলুন, সুবোধ সরকারের কবিতা কেন কবিতা নয় !

 সা য় ন


মরীচিকা সেন কালো কফিতে চুমুক দিয়ে বলল- " সুবোধ সরকার আবার কবিতা লিখতে পারে নাকি? ও কবিতা গুলো কি কবিতা হয়? ওগুলো তো গল্প! "
আমি - আজ আপনার থেকেই শুরু হোক আমাদের কথা - "সুবোধ সরকারের কবিতা তাহলে শুনি কেন কবিতা নয়?"

ফ্ল্যাশব্যক:

সুবোধ সরকারের একটা বই পড়ছি। কি বই? এক মিনিট, বলছি .. চায়ে চুমুকটা দিয়ে নি। এমন সময়, সামনে টেবিলের ওপারে হঠাৎ - পরনে খাদির শাড়ি, চোখে মোটা কাজল, পেনোলিপ ক্রুজ কাট চুলের তীক্ষ্ণ নারী। দেখে অবশ্য তীক্ষ্ণ মনে হচ্ছে, ভিতরটা কি আছে জানি না। 
পাশে বসে আছেন কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান, নন্দন কিংবা কফি হাউস যাওয়ার জন্য -পাঞ্জাবি গায়ে চাপানো পুরুষ।
হাতে কড়কড় করছে রবীন্দ্রনাথের 'খেযা়' আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের 'শ্রেষ্ঠ কবিতা'। দেখলাম.. এবার পা থেকে মাথা অবধি দেখলাম, " আমি দেখলাম চেয়ার চলেছে রাস্তা দিয়ে, পথ দিয়ে/গলি দিয়ে তস্য গলি দিয়ে .. /ভাই চেয়ার তুমি কোথায় চলেছ? অতীতের দিকে?" (ভাই চেয়ার) 

চুল ঠিক করতে করতে তীক্ষ্ণ কাজল বলল - এটা কি বুকস্কির কবিতা, আই মিন চার্লস বুকস্কি? 
পাঞ্জাবির হাত গুটিয়ে পুরুষ বলল - ইয়েস, ও মাই গড, তুমি ঠিক ঠিক  - দেখ এই যে "রাস্তার" মেটাফরের dynamics আর 'চেয়ারের' static  ইলিউশান যে বাইনারি তৈরি করেছে, আই মিন - এই দ্বান্দ্বিক ইকুয়েশনটা জাস্ট মিল কর .. বুকস্কি সত্যি আমার ...

হাসতে হাসতে আমি টেবিল কাঁপিয়ে চা ফেলে দিলাম অর্ধেক। তাও হাসি আমার থামছে না। এবার খেয়াল হলো আমার সামনে এখন নতুন বাংলা কবিতার স্ত্রী লিঙ্গ ও পুংলিঙ্গ বসে আছেন। 

কাজল চোখ গম্ভীর ভাবে বলল - অ্যাম আই রঙ, এতে এত হাসির কি হল? কবিতা নিয়ে হাসাহাসি জাস্ট মেনে নিতে পারিনা। 
পুরুষ কন্ঠ সজাগ হয়ে বলল - তাহলে কবিতাটা কার? 
আমার চোখে তখন হাসি আর আগুন। বললাম - একজন বাঙালি কবি - সুবোধ সরকার । 

নারীর ভিতর থেকে বেরিয়ে এল আর একটি নারী । এই নারী কি মরীচিকা? ওর নাম দিলাম মরীচিকা সেন। পাশের দাদার চাঁদুবাবু। ওদের হাত ও ঠোঁটে লেগে থাকে চমস্কির নাম ( হ্যাঁ শুধু নাম)।
" দশ মাস বাদে এক বৃষ্টির রাতে একটি সন্তানের জন্ম হল/ লোকে তার নাম দিল- বাংরেজি" (বাংলা না ইংরেজি)

মরীচিকা সেন তার এথনিক ব্যাগ থেকে ধিরে , কিন্তু অকস্মাৎ একটি বই বের করল। তার নিজেরই কবিতার বই। পুংলিঙ্গ বলল - ওর কবিতাগুলো পড়লে বুঝতে পারবেন পোষ্ট মর্ডান কাকে বলে। 

বর্তমান:

এই হচ্ছে বাংলা কবিতা ও তার সামাজিক প্রাণী। সময়টা ভালো করে চিনতে হবে। বাংলা কবিতার ২০টা বছরের বিবর্তন পথঘাট, প্রেম সপিং মল, কিভাবে যেন একটা সময়ের অবয়ব তৈরি করে। এই দেখা আর ছেঁটে ফেলার মধ্যেই লেখা থাকে - একটা কবিতা, কিংবা গল্প ও উপন্যাস। 
চাঁদুবাবুকে শুধু হাত দেখিয়ে বললাম - শুনুন কবিতার ছন্দ আর তত্ত্ব নিয়ে আঁতলামোর যুগটা ডাস্টবিনে মারা গেছে, আর "এ সব  চিন্তা আগে করতাম, আর করি না / ছোট মুখে একটা বড় কথা বলি : /কবিতাকে শেষ অবধি কবিতাই হতে হবে / তা সে বেশ্যার দেওয়ালেই ছাপা হোক / অথবা পুরোহিতের উঠোনে। /আপনি রবীন্দ্রসদনে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়বেন / না জাহান্নামে সেটা আপনি ঠিক করুন / আমি বুঝে গেছি আমি কবি নই / আমি আরশোলা। " ( ছোট মুখে ছোট কথা) 
এখন আমার কন্ঠস্বর আপনি চিনতে পারবেন, আমার ভাষা আপনি বা আপনার স্তাবকবৃন্দরা আমাকে চিনতে পারবেন মরীচিকা সেন। দুদিন রূপ দেখিয়ে, দাদাদের সঙ্গে ফুকো আর কফি সাঁটিয়ে প্রকাশক ধরে বই হয়ে গেলেই সুবোধ সরকারের কবিতা আর কবিতা থাকে না আপনাদের কাছে। 

আসলে কবিরা বেঁচে থাকেন - পৃথিবীর ওপর এমন স্বার্থপর অমানুষেরা বেঁচে আছে তাই। যদি কোনোদিন পৃথিবীর সাত সমুদ্র পাড়ে দাঁড়িয়ে তাদের স্বার্থগুলো বিসর্জন দিয়ে দেয় - সেই দিন সমস্ত কবি অন্য কোনো পৃথিবীতে চলে যাবে ডানা মেলে। কিন্তু তা কি আর হবেহবে,  তবুও "আজ পরিষ্কার বুঝি / আমি মারা না গেলে, মরে পচে গলে/ একটা নুনের হ্রদে পরিণত না হলে / তোমরা তিনজন নুন পেতে না ! / খেতে কী করে? " ( মৃত সমুদ্র)

মরীচিকা সেন উবাচ : ১

কবিতা কি একটা গল্প নাকি? কতগুলো সাম্প্রতিক খবরের কাগজের তথ্য? কবিতার অনুভূতি আর রহস্য কবিতাকে অলৌকিক করে তোলে। 
আপনি মা'কে ভালোবাসেন না মামদো ভূতকে? .. মা'কেই তো। লৌকিক পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার মতো স্পাইসজেট কিংবা ইচ্ছা কোনোটাই নেই । কবিতাকে আমরা মাটির পৃথিবী থেকে আকাশে তুলেছি তো, তাই সেটা বিশ্বজুড়ে নগন্যের চেয়েও নগন্য  আপনজন । মানুষ পেরেছে কি কবিতার পাশে বসে, কোলে মাথা রেখে কিংবা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। আপনাকে বলি "তিস্তা সেন, আপনার মাথায় ব্যাঙ ঢুকেছে /তিস্তা ঘোষ, আপনি টিকটিকি হয়ে গেছেন / তিস্তা রায়, আপনি খাটের সাথে বেঁধে রেখেছেন/ তিনটে পুরুষ/ আর তাদের খেতে দিয়েছেন কাঁঠাল পাতা। " (তিস্তা) 
- গল্প লেখার ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলেন কিন্তু। 
- এড়িয়ে যাইনি। সময় দেখাচ্ছি। অবশ্য সময় দেখানো মতো কোনো মহাকাল বা হরিদাস পাল নই। তবুও দেখার জন্য আছে - ভাষা, মন আর চোখ। সমস্ত ভাবনা ও ভাষা কেন .. কেন আমাদের নিজস্ব কলোনির মধ্যে আবদ্ধ রাখব বলে ঠোঁট ফোলাই? আপনারা জানেন " রাজস্থানে হাতকাটা ব্লাউজ পরা বারন/ মেয়েরা পা দেখাতে পারবেন না। / মধ্যপ্রদেশে কবিতা নিষিদ্ধ হবে/ রামায়ণ পাঠ করুন, পয়সা পাবেন / হিমাচলে কিট্স আর কার্ল মার্কসের / অসভ্য চিঠি পোড়ানো হবে। " ( কী কী হবে) কিংবা আরও একটা প্রশ্ন করি " আমাকে যখন রাশিয়া থেকে পিটিয়ে /বের করে দিয়েছিল ওরা /আমি বলেছিলাম, ওরা উন্নতি করবে / আমাকে যখন মেক্সিকো থেকে / পুলিশ দিয়ে তুলে দিয়েছিল/ তখনও মজা পেয়েছিলাম। / কিন্তু এরা এখন আমাকে বেচে যা তুলে নিচ্ছে / তাতে আমার কষ্ট হয় আজকাল। / আমি গরিবকে  আর মুখ দেখাব কী করে /গরিবরাই বা আমার মুখ দেখবে কেন? " ( ভগবান) 
সব কবিরাই তো অনেক রহস্য নিয়ে ভাবল, না হয় পৃথিবীর কয়েকজন লিখুক গরিবকে নিয়ে,  বঞ্চিত মানুষদের কথা। মানুষের জন্য নতুন ভাষা তৈরি করলে যদি অ-কবি হতে হয়, তাহলে তাকেই না হয় মুকুট হিসেবে মাথায় তুলে নেওয়া যাক।

মরীচিকা সেন উবাচ : ২

 কতগুলো তথ্য বা গল্প নিয়ে চটক তৈরি করা যায়, কিন্তু 'লিখন' তাকে কিভাবে আয়ত্ত্ব করবে। রাজনীতি কবিতায় কি করছে আর কেনই বা থাকবে! আর প্রতিটা কেমন ব্যঙ্গ করছে যেন ... 
- কটা লেখা পড়েছেন? 
- হ্যাঁ? মানে .... হ্যাঁ পড়েছি বেশ কিছু .. 
- 'বেশ কিছু' দিয়ে কিন্তু এত বেশি জ্ঞান দেওয়া যায় না। রূপের ঠাঁট আর দাড়ির ছাঁট দেখিয়ে আঁতলামি করা যায়,কবিতা পড়া যায় না। 

কবিতায় ব্যঙ্গ, রাগ, রাজনীতিটাই দেখতে পেলেন কিন্তু একজন প্রেমিকের ভালোবাসা, একজন পিতার অসহায়তা, একজন শিক্ষকের ছাত্রছাত্রীর জন্য দুশ্চিন্তা দেখতে পেলেন না। আমার কাছে মানুষের ক্লান্তি, প্রেম, রাষ্ট্রের অনাচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠাকেই আধুনিক ছন্দ বলে। এই পাতাটা একটু দেখুন প্লিজ - " এরপর থেকে মোটরবাইকে বসা দুটো ছাত্রের বয়সি ছেলেমেয়ে / দেখলেই ভেতরটা ছ্যাৎ করে ওঠে /নতুন হেলমেট। হেলমেট দিয়ে ঢেকে রাখা চোখের জল। / শোনো, আমরা যারা মাস্টারমশাই তাঁদেরও চোখে জল থাকে / হেলমেট নয়, বই দিয়ে ঢেকে রাখি। " (রাসবিহারী থেকে সল্টলেক)

তত্ত্ব কথার মকসো তৈরি করতে সাহিত্যের কাছে আসি নি । এসেছি এমন একটা কবিতার খোঁজ করতে , যে কবিতা আমাকে চেনাবে অনাথ ছেলেমেয়েদের মুখের ভাষা যারা " আপনাকে কিছু বলতে চায়/ এই তো সময়, শুনুন ওদের ভাষা/ পৃথিবীর যে কোনও শ্রেষ্ঠ কবিতার থেকেও/ সে ভাষা সুন্দর ।" ( আটটা পঁয়তাল্লিশ)
- কি বুঝলেন ? থাক, আবার পরের সপ্তাহে হবে কথা। নিন মাস্কটা পড়ে নিন!
- বাই দ্য ওযে় আমার নাম কিন্তু ....
- জানি .... বইটা তুলে দেখালাম "ধন্যবাদ, মরীচিকা সেন"।

Post a Comment

0 Comments