জ্বলদর্চি

মহিষমর্দিনীর উৎস সন্ধানে / মুক্তি দাশ


মহিষমর্দিনীর উৎস সন্ধানে


মু ক্তি  দা শ

দেবী দুর্গা মহাশক্তিরূপিনী বিশ্বপ্রকৃতি। এই বিশ্বব্রহ্মান্ড অতিলৌকিক শক্তির আধার। এবং সেই অতিলৌকিক শক্তির প্রকৃত স্বরূপটি বিধৃত হয়ে আছে দুর্গার মূর্তিকল্পে। তিনি একাধারে অসুরমর্দিনী ও দুর্গতিনাশিনী। অবশ্য দুর্গতিনাশিনী হিসেবে তিনি এ-যুগের মানুষের সীমাহীন দুর্গতি কতখানি বিনাশ করে উঠতে পেরেছেন বা পারছেন – তা রীতিমতো তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু দেবীদুর্গার এই অসুরমর্দিনী বা অসুরঘাতিনী রূপটি যে শুভ ও দৈবশক্তির দ্বারা অশুভ দানবিক শক্তির ধ্বংসের প্রতীক ও দ্যোতক – তা সহজেই বোধগম্য।

কিন্তু কে এই দুর্গা? ‘দুর্গতিনাশিনী’ কথাটি থেকেই ‘দুর্গা’ নামের উৎপত্তি – সাধারণভাবে এরকম মনে হতে পারে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আসলে ‘দুর্গা’ ও ‘দুর্গতিনাশিনী’ শব্দদুটির মধ্যে ধ্বনিগত মিল ছাড়া আর কোনো ব্যুৎপত্তিগত রহস্য নিহিত আছে বলে মনে করার যুক্তিগ্রাহ্য কোনো কারণ নেই। কোনো কোনো পন্ডিতের মতে, ‘দুর্গা’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ‘দুর্গরক্ষাকারিণী’ বা ‘দুর্গের অধিষ্ঠাত্রী দেবী’। তার মানে, দুর্গাদেবীর নামের জন্মলগ্ন থেকেই তাঁর চরিত্রে একটা যুদ্ধংদেহি ভাব বেশ উপলব্ধি করা যায়। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় একসময় লাইসীয় বা লিসীয় শব্দ ‘তর্‌ক্‌কস’ (Trqqas)-এর সংগে ‘দুর্গা’ নামটির তুলনা করেছিলেন। ‘তর্‌ক্‌কস’ শব্দের অর্থ দেবতা। অবশ্য ‘দেবতা’ অর্থবহনকারী এই ‘তর্‌ক্‌কস’ শব্দটির সংগে ‘দুর্গা’ নামক দেবীর সত্যিই কোনো যোগ আছে কিনা, সে বিষয়ে শেষদিকে সুনীতিকুমার নিজেই সংশয়ান্বিত হয়ে পড়েছিলেন।

মতান্তরে, দুর্গা আসলে হলেন ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের এক দেবী, যাঁর নাম ‘বাইর্গো’(Virgo)। ইনি সমরাভিলাষিনী। অর্থাৎ, যুদ্ধ-টুদ্ধ করতে খুব ভালোবাসেন। ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে ‘মন-খেম্‌র’ নামে এক বর্বর জাতি বাস করতো। তারা মহিষকে খুব পবিত্র জ্ঞান করতো। সেই দুর্ধর্ষ, অসংস্কৃত জাতিকে পরাস্ত করার কাহিনীই নাকি দেবী ‘বাইর্গো’ বা ‘দুর্গা’র অসুরমর্দিনী রূপকল্পের মূলকথা। যদিও এরকম মতের স্বপক্ষে কোনো জোরালো প্রমাণ বা পুরাতাত্বিক তথ্য উপস্থাপন করা আজও সম্ভব হয়নি।

প্রাগৈতিহাসিক যুগে মহেঞ্জোদাড়োতে প্রাপ্ত একটি সীলমোহরে উৎকীর্ণ এক মনুষ্য মূর্তিকে একটি দন্ডায়মান মহিষের মুখে পা রেখে এবং একটি হাত দ্বারা পশুটিকে বর্শাবিদ্ধ করার যে ভাস্কর্য-শিল্প – কে জানে, সেটাই দেবী দুর্গার মহিষমর্দিনী সম্পর্কিত ধারণার সর্বাপেক্ষা প্রাচীন উৎস কিনা।

সুপ্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষে দুর্গা-আরাধনা চলে আসছে। এমনকি, বৈদিকযুগেও এই মহাদেবীকে উপাসনার রীতি প্রচলন ছিল। তবে তার ধরণধারণ একেবারে আলাদা। বৈদিকযুগে দুর্গার মূর্তি বা প্রতিমাপূজার চল ছিল না। সেযুগে বিভিন্ন যজ্ঞবেদীতে প্রজ্জলিত আগুনে আহূত দেবদেবীদের উদ্দেশে সামগ-ব্রাহ্মণরা স্তোত্রগান ও সামগান করতেন। গানের সংগে নাচ-বাজনার ব্যবস্থাও থাকতো। এ সম্পর্কে স্বামী অভেদানন্দ লিখেছেন –

“যজ্ঞের অগ্নিতে সেইসময়ে সমস্ত দেবদেবীদের আহ্বান করা হইত এবং যে-দেবতার উদ্দেশ্যে আহূতি দেওয়া হইত সেই দেবতার নামে যজ্ঞীয় অগ্নির নামকরণ করা হইত…বৈদিকযুগে দুর্গার প্রতিমা ছিল না, হব্যবাহনী অগ্নিশিখাই তাহার রূপ। পরে যখন প্রতিমার প্রচলন হইল তখন সেই অগ্নিশিখার রূপই দেবীগাত্রের পীতাভ রঙ হইয়া দাঁড়াইল।” 

তৈত্তিরীয় আরণ্যকে দেবী কখনও ‘দুর্গা’ আবার কখনও ‘দুর্গি’ নামেও অভিহিতা হয়েছেন। পরবর্তীকালে তিনি ‘অম্বা’ বা ‘অম্বিকা’ নামেও পরিচিতা হন। ‘অম্বা’ বা ‘অম্বিকা’ শব্দের অর্থ মাতা। সুতরাং দুর্গাকে মাতৃরূপে কল্পনার উন্মেষও সম্ভবত এই বৈদিক যুগ থেকেই।
চিত্র - পবিত্র দাস 

আবার দুর্গা নামের ব্যুৎপত্তি হিসেবে বলা হয়ে থাকে -

“দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্ত্তিতঃ।
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মতঃ।।
রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।
ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্ত্তিতঃ।।
স্মত্যুক্তিশ্রবণাদ্‌ যস্যা এতে নশ্যন্তি নিশ্চিতম্‌।
ততো দুর্গা হরেঃ শক্তির্হরিণা পরিকীর্ত্তিতা।।
দুর্গেতি দৈত্যবচনোহপ্যাকারো নাশবাচকঃ।
দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্ত্তিতা।।
বিপত্তিবাচকো দুর্গশ্চাকারো নাশবাচকঃ।
তং ননাশ পুরা তেন বুধৈদুর্গা প্রকীর্ত্তিতা।।”

অর্থাৎ, স্বামী নির্ম্মলানন্দের কথায়, “ ‘দ’ শব্দটি দৈত্যনাশক, ‘উ’-কার বিঘ্ননাশক,  রেফ্‌ রোগঘ্ন, ‘গ’-কার পাপঘ্ন এবং ‘আ’-কার ভয়শত্রুঘ্ন – দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ এবং ভয় ও শত্রু হতে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। অথবা, ‘দুর্গ’ শব্দটি দৈত্যবাচক এবং ‘আ’কার নাশবাচক, যিনি দুর্গ নামক অসুরকে নাশ করেন তিনিই নিত্য দুর্গা নামে প্রকীর্ত্তিতা। অথবা, ‘দুর্গ’ শব্দটি বিপত্তিবাচক, ‘আ’কার নাশবাচক, যিনি বিপত্তারিণী, তাঁকেই দুর্গা নামে অভিহিত করেন জ্ঞানীরা।”

স্কন্দপুরাণে আছে, রুরুদৈত্যের পুত্র দুর্গাসুরকে বধ করার জন্যে দেবী বিশ্বলোকে পরিচিতা হয়েছেন ‘দুর্গা’ নামে। শরণাগত দেবতাদের আকুল প্রার্থনায় থাকতে না পেরে দেবাদিদেব মহাদেবের অনুরোধে দেবী এই অসুরকে বধ করেছিলেন।

শ্রীশ্রীচন্ডীতে দেবী নিজের মুখেই বলছেন –

“তত্রৈব চ বধিষ্যামি দুর্গমাখ্যং মহাসুরম।
দুর্গাদেবীতি বিখ্যাতং তন্মে নাম ভবিষ্যতি।।”

অর্থাৎ দেবী বলছেন, দুর্গম নামক মহাসুরকে বিনাশ করে আমি প্রসিদ্ধা হবো।

ব্যাকরণসম্মত সূত্র অনুযায়ী ‘দুর্গা’ শব্দের ব্যুৎপত্তি হলো এইরকম – দেবীর তত্ত্ব অতি অগম্য বা দুর্জ্ঞেয়, তাই তিনি দুর্গা। দুর+গম্‌ (কর্মবাচ্যে)+ড (স্ত্রীলিঙ্গে) আপ্‌ প্রত্যয় করে নিষ্পন্ন হয় ‘দুর্গা’ শব্দটি।  

পৌরাণিক যুগেও আমরা দুর্গাকে নানারূপে ও নানা ভূমিকায় দেখতে পাবো। মার্কন্ডেয় পুরাণে দেবীদুর্গা ‘চন্ডী’ নামে অভিহিতা। সেখানে তিনি শুধু মহিষমর্দিনীই নয়, বরদায়িনীও বটে। মহিষাসুর যথারীতি ত্রিশূলাঘাতে দেবী কর্তৃক নিহত হয়েছেন। অতিবীর্য দানবশক্তি বিধ্বস্ত। এবার সমগ্র দেবকুল প্রশান্তচিত্তে দেবীর স্তুতিগানে মুখর। দেবী তখন প্রসন্নবদনে প্রণতিনম্র দেবতাদের উদ্দেশে বলছেন –

“ব্রিয়তাং ত্রিদশাঃ সর্বে যদস্মত্তোহভিবাঞ্ছিতম্। 
দদাম্যহমিতি প্রীত্যা স্তবৈরেভিঃ সুপূজিতা।।”

অর্থাৎ তোমরা, সকল দেবতারা, যার যা মনের বাঞ্ছা সেই মতো বর চেয়ে নাও। তোমাদের এই স্তবময়ী পূজায় খুশি হয়ে আমি প্রীতিভরে তোমাদের বরদান করবো।

কালিকাপুরাণ থেকে জানা যায়, দেবীদুর্গা অনার্য শবরজাতির দ্বারা পূজিতা ছিলেন। বিন্ধ্যাচলের অধিবাসী অনার্য শবরজাতি শক্তির পূজক ছিল এবং তাদের আরাধ্যা দেবী ছিলেন ‘শবরী’। এই ‘শবরী’ই আসলে দুর্গা। হরিবংশ-এর ৫৯নং শ্লোকে এবং বায়ুপুরাণে ৩০৫ নং শ্লোকে দেবীদুর্গা আবার ‘কিরাতিনী’ নামেও আখ্যাত হয়েছেন। কেন না, অরণ্যচারী কিরাতজাতি শক্তির উপাসক ছিল এবং, স্বাভাবিক কারণেই, দুর্গা তাদের কাছে ‘কিরাতিনী’।

যা বলছিলাম। কালিকাপুরাণে শবরজাতির শবরোৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায়। সেখানে একজায়গায় বলা আছে –

“ইতি বৃত্তং পুরাকল্পে মনোঃ স্বায়ম্ভুবেহন্তরে।
প্রাদুর্ভূতা দশভূজা দেবী দেবহিতায় বৈ।।”

অর্থাৎ পূর্বকল্পে স্বয়ম্ভু মনুর সময়ে দেবী ভগবতী দেবগণের কল্যাণের জন্যে দশভূজা রূপে আবির্ভূতা হয়েছিলেন। লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো এই যে, কালিকাপুরাণে দুর্গা ‘শবরী’ হলেও দশভূজা। এখানে একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন, বিভিন্ন যুগের মহিষমর্দিনী মূর্তির ও বিভিন্ন গ্রন্থে দেবীর ওই রূপের পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, দেবী সবক্ষেত্রেই কিন্তু দশভূজা নন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি দ্বিভূজা বা চতুর্ভূজা। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি বিংশতিভূজা, অষ্টবিংশতিভূজা এমনকি, দ্বাত্রিংশতিভূজাও। চন্ডীতে আবার দেবীর সহস্রভুজা মূর্তির প্রসংগও আছে। 

কোনো কোনো পুরাণগ্রন্থে দেবীদুর্গাকে ‘শাকম্ভরী’ ও ‘কাত্যায়নী’ রূপেও দেখানো হয়েছে। তবে রামায়নের দুর্গার নির্দিষ্ট রূপের কোনো উল্লেখ নেই। না থাক। কিন্তু এই রামায়নেই আমরা পেয়ে যাই অকালবোধন বা শরৎকালে দুর্গাপূজার প্রসংগ। মার্কন্ডেয় পুরাণেও অবশ্য শরৎকালীন পূজা-উৎসবের কথা আছে। কিন্তু একটি কথা - অকালবোধনের কথা আছে শুধুমাত্র কৃত্তিবাসী রামায়নে, বাল্মীকি বিরচিত সংস্কৃত রামায়নে নয়। কৃত্তিবাসী রামায়নে বেশ ঘটা করে বলা হয়েছে, সীতা উদ্ধারের জন্যে উদ্বেগাকুল শ্রীরামচন্দ্র অকালবোধন করে শরৎকালে দুর্গাদেবীর আবাহন করেছিলেন। এমনকি, একটি নীলপদ্মের অভাব পূরণের জন্যে সত্যসন্ধ সীতাপতি নাকি তাঁর নীলোৎপলতুল্য চক্ষু উৎপাটনেও উদ্যত হয়েছিলেন। বাল্মীকি রামায়নে এরকম কাহিনীর আভাসমাত্রও নেই। বাল্মীকি রামায়নের যুদ্ধকান্ডে ১০৫ সর্গে স্পষ্টই বলা আছে, রাবণবধের জন্যে সূর্যবংশজাত রামচন্দ্র অকালে, মানে শরৎকালে পূজা করেছিলেন ঠিকই, তবে তা সূর্যপূজা, দুর্গাপূজা কদাচ নয় –

“রশ্মিমন্তং সমুদ্যন্তং দেবপুরাণসস্কৃতম।
পূজায়থ বিবস্বন্তং ভাস্করং ভুবনেশ্বরম।।
আদিত্যঃ সবিতা সূর্যঃ ঋগঃ পুষা গভস্তিমান।
সুবর্ণসদৃশো ভানুহির্রণ্যরেতা দিবাকরঃ।।

তবুও আজ অনেক সাধারণ মানুষ মনে করেন, কৃত্তিবাসী রামায়নের মতো বাল্মীকি-রামায়নেও বুঝি রাম কর্তৃক শরৎকালে দেবীর অকালবোধনের কথা আছে। আসলে “রাবণস্য বধার্থায় রামস্যানুগ্রহায় চ অকালে বোধিতা দেবী…” এই শ্লোকটি বাল্মীকি-রামায়নের অন্তর্ভুক্ত – এরকম ধারণা থেকেই এই বিভ্রান্তির সৃষ্টি। প্রকৃতপক্ষে এই শ্লোকটি প্রক্ষিপ্ত, বাল্মীকির রচনা বলে চালানো হয়েছে। ঐতিহাসিক-গবেষক রমাপ্রসাদ চন্দ তাঁর ‘Indo-Aryan Races’ গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন – “According to Ramayana, VI. 105, Rama worshipped Surya, the Sun-God and not Durga…”

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রামায়নের সংকলন-কাল মোটামুটিভাবে ৪০০ খৃষ্টপূর্বাব্দ। আর মহাভারতের রচনাকাল খৃষ্টপূর্ব চতুর্থশতাব্দী থেকে খৃষ্টীয় চতুর্থশতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত। মহাভারতে আবার দুর্গাকে সরাসরি ‘মহিষাসুরনাশিনী’ রূপে দেখানো হয়েছে। বিরাটপর্বে দুর্গাস্তবের উল্লেখও রয়েছে। কিন্তু এই দুর্গা শিবের পত্নী নন, ইনি কুমারী।

আগেই বলেছি, দুর্গা কোনো কোনো পুরাণে ‘শাকম্ভরী’ রূপে দেখা দিয়েছেন। বিশেষত, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বা শ্রীশ্রীচন্ডীদেবী মাহাত্ম্যে দেবী শাকম্ভরীকে প্রতিবৎসর শরৎকালে শস্যের শ্রীবৃদ্ধি কামনা করে পুজো করা হতো। তার মানে, দুর্গাই সময়বিশেষে শাকম্ভরী বা শস্যাধিষ্ঠাত্রী দেবী। সোজা বাংলায়, ‘শালিধানের দেবী’। এবং যেহেতু শরৎকালে পূজিতা, সেইহেতু তিনি শারদা।

আমাদের বঙ্গদেশে দুর্গাপূজার প্রথম প্রবর্তক নিঃসন্দেহে তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ন। তবে তিনি প্রবর্তকই কেবল। আড়ম্বর ও জাঁকজমক সহকারে পূজার শুরু কিন্তু সেই নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের হাতেই।

যাইহোক, এতক্ষণ তো শুধু দেবীদুর্গার প্রসংগই আলোচিত হলো। এবার তাঁর পরিবার-পরিজন সম্পর্কেও কিছু বলতে হয়।

প্রাচীনকালে মহিষমর্দিনী বা অসুরমর্দিনীরূপে দেবীকে সাধারণত এককভাবেই, অর্থাৎ পরিবারবর্গ ছাড়াই, পুজো করার রেওয়াজ ছিল। এমনকি, সেসময় দেবীর বাহন পশুরাজ সিংহেরও কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সিংহের সংগে দুর্গার প্রথম যোগাযোগ ঘটে সম্ভবত খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী নাগাদ। তারও পরে, নবম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে, অর্থাৎ মধ্যযুগের প্রথমদিকে নির্মিত কিছু ভাস্কর্যে দুর্গাকে তাঁর পুত্রকন্যা – গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিকসহ প্রথম দেখা যায়। সেইথেকে বহু বিবর্তনের পথ অতিক্রম করে এসে আজও দুর্গা সপরিবারে পুজো পেয়ে আসছেন।

পরিশেষে বলি, দুর্গাপূজা যে বাঙালির মনন, ধর্ম ও সংস্কৃতির সংগেই শুধু ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা-ই নয়, এই পূজা-উৎসবের মধ্যে বঙ্গদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি, রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও যে কতখানি প্রতিফলিত – তারই একটি অকিঞ্চিৎকর নমুনা দিয়ে বর্তমান আলোচনায় ছেদ টানবো।

বিগত শতাব্দীর তিন-চার দশক পর্যন্তও শারদোৎসবে দেবীদুর্গা এবং তাঁর পরিবার-পরিজনদের মূর্তিস্থাপন একচালা চালচিত্রের মধ্যেই সীমাবব্ধ ছিল। অর্থাৎ একটাই মাত্র চালচিত্রের মধ্যে দুর্গা ও তাঁর দু’দিকে পুত্রকন্যারা – গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী ও কার্তিক। মাথার ওপর শিবের মূর্তি। যেন অসম্ভব সুখী একটি একান্নবর্তী পরিবার। এ যেন আমাদেরই তখনকার একান্নবর্তী পরিবারের একখানি অত্যন্ত সুখদায়ক মনোরম প্রতীকী-চিত্র। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিষাক্ত আবহাওয়ার পটভূমিকায় মানুষ ক্রমে হয়ে উঠলো একাধারে স্বার্থান্বেষী ও আত্মকেন্দ্রিক, হিংসাপরায়ণ ও পরশ্রীকাতর, অসহিষ্ণু ও আবেগবর্জিত। ধীরে ধীরে একান্নবর্তী পরিবারের সুখস্মৃতিও ভেঙে হলো টুকরো টুকরো। একই ছাদের নিচে একই পরিবারভুক্ত জেঠা, জেঠিমা, কাকা, কাকিমা, পিসিমা, দাদা, বৌদি, ঠাকুমা-ঠাকুর্দার নিকট স্নেহ-সান্নিধ্য থেকে বেরিয়ে এসে চূড়ান্ত আত্মকেন্দ্রিকতার পরাকাষ্ঠা হিসেবে মানুষ যেন একফালি চৌকো ঘরের মধ্যে কেবল স্বামী-স্ত্রী ও একটি বা দুটি পুত্রকন্যাকে নিয়ে সুখী সংসার পাতার মাঝে খুঁজে পেল জীবনের চরম সার্থকতা। অথচ এখন যাঁদের বয়েস ষাট/সত্তর ছুঁই ছুঁই, তাঁদের কেউ কেউ যে ক্ষয়ে যাওয়া একান্নবর্তী পরিবারের তলানিটুকুর স্বাদ ও মাধুর্য উপভোগ করেছেন - একথা হলপ করে বলা যায়। 
চিত্র - পবিত্র দাস 

আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে তাই যখন উত্তর কলকাতার কোনো এক পুজো মন্ডপে সর্বপ্রথম এক-চালচিত্র থেকে সরিয়ে এনে ভিন্ন ভিন্ন চালচিত্রে কার্তিক-গণেশ-লক্ষ্মী-সরস্বতীকে বিন্যাস করা হলো, তখন এক নাম-না-জানা কবি তাঁর আগমনী ছড়ায় এই মর্মস্পর্শী সামাজিক অবক্ষয়ের অমোঘ সম্ভাবনাকে ব্যক্ত করলেন এইভাবে - 

"দেবদেবী স্বর্গে থাকেন শুনেছে ছেলে-বুড়ো, 
স্বর্গের ঠিকানা কোথায় জানে না কোন খুড়ো। 
ঘট পট-প্রতিমা প্রতীক দেবতার চিহ্ন, 
ইঙ্গিত ছিল একতা আজ ভেঙ্গে ছিন্নভিন্ন। 
একচালা চালচিত্র ভেঙ্গে দেবী ছন্নছাড়া,
একান্নবর্তী এবার ভেঙ্গে হবে লক্ষ্মীহারা। 
বাংলার শিল্পধারায় পড়ে মুগুর জোরে, 
দেখ দেবীর চোখে জল আগমনীর ভোরে।"

এবার দুর্গাপুজোর মণ্ডপগুলির দিকে এখন আর একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখুন। দেখবেন, স্বয়ং দেবীদুর্গাও তাঁর বিশাল পরিবাবর্গ নিয়ে আর একচালা চালচিত্রে আগের মতো ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে নেই। তাঁর একান্নবর্তী পরিবারেও আজ বুঝি ভাঙন! তাই দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ – সবারই এখন আলাদা আলাদা চালচিত্র। এটা কি আমাদের অবক্ষয়ী সমাজের তথা মানবিক দৈন্যদশার মর্মান্তিক প্রতিফলন নয়?
------------------------------------------------------------
নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।    


              

Post a Comment

1 Comments

  1. ভালো লাগলো, কিছু নতুন কথা জানা গেল।

    ReplyDelete