বাইশে শ্রাবণ
অ নু ত্ত ম ভ ট্টা চা র্য
পঁচিশে বৈশাখ ও বাইশে শ্রাবণের মধ্যে মাস তিনেকের তফাৎ। পঁচিশে বৈশাখের মতো বাইশে শ্রাবণও আজ বাঙালির সংস্কৃতিচেতনায় এক স্মরণীয় দিন। ১৩৪৮ এর বাইশে শ্রাবণ শুধু বাঙালি বা ভারতীয় নয়, সারা বিশ্ববাসীর কাছে এক সুগভীর শোকাবহ দিন।
বেলা দ্বিপ্রহর। বিশ্বকবির পা'গুলো ঠাণ্ডা হয়ে এল, হৃদস্পন্দন থামল বলে। ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় বারোটা দশ মিনিট। ঠিক শেষ মুহূর্তের আগে ডান হাতখানা কাঁপতে কাঁপতে উপরে তুলে কপালে ঠেকাতেই হাত পড়ে গেল। স্তব্ধ হয়ে গেল হৃদস্পন্দন।
এ কী চৈতন্যলোক থেকে স্বতোৎসারিত 'জীবনদেবতা'র উদ্দেশে মর্ত্যজীবনের শেষ প্রণতি নিবেদন, না কি 'স্বর্গের উপর আড়ি করে' একান্তভাবে ভালোবাসা এই দরিদ্র মায়ের ঘরের মানুষগুলির প্রতি অন্তরের শেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন--
'যে কেহ মোরে দিয়েছ সুখ, দিয়েছ তাঁরি পরিচয় / সবারে আমি নমি।'
অস্বাভাবিক হলেও বাইশে শ্রাবণের আকাশে তখন প্রখর দীপ্তিমান মধ্যাহ্নসূর্য। গগনের রবির সঙ্গে মর্ত্যের রবির বোধহয় মহামিলন, 'গগনের রবি তুমি, গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কে বা!'
দিনটিকে কেন্দ্র করে সে-সময় বেশ কিছুদিন ধরে যে শোকোচ্ছ্বাস প্রবাহিত হয়েছিল সারা বিশ্বজুড়ে তা তুলনারহিত। আজ সারা বিশ্ববাসীর কাছে পঁচিশে বৈশাখের মতো বাইশে শ্রাবণ দিনটিও সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত।
ইহজগৎ ত্যাগ করবার পূর্বে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন--
"সমুখে শান্তিপারাবার
ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।
তুমি হবে চিরসাথী,
লও লও হে ক্রোড় পাতি-
অসীমের পথে জ্বলিবে
জ্যোতি ধ্রুবতারা
মুক্তিদাতা, তোমার ক্ষমা, তোমার দয়া,
হবে চির পাথেয় চিরযাত্রার
হয় যেন মর্ত্যের বন্ধনক্ষয়,
বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি লয়
পায় অন্তরে নির্ভয় পরিচয়
মহা অজানার।"
বিশ্বকবির মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে আর প্রান্ত পর্যন্ত হাজার হাজার শোকবার্তা বিশ্বকবির বাড়িতে আসতে থাকে।
তাঁর জনপ্রিয়তা যে কতদূর বিস্তৃত হয়েছিল এ তার এক অবিসংবাদী উদাহরণ। সারা বিশ্ব ছিল তাঁর জীবনের আঙিনা। তাঁর প্রেমের বাণী, মৈত্রীর বাণী সারা বিশ্বকে আজও উজ্জীবিত রেখেছে।
অবিনশ্বর ভারতের ব্যাস, বাল্মীকি, কালিদাস যেমন অমর হয়ে রয়েছেন, বিদেশের শেক্সপীয়র, মিল্টন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রমুখ মহামনীষীগণ যেমন স্মরণীয় হয়ে আছেন, তেমনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও অমর হয়ে থাকবেন চিরকাল। বিশ্বমানবের মনোমন্দিরে যুগে যুগে রবীন্দ্রনাথের বন্দনাগীতি উঠবে। সেই সঙ্গে পঁচিশে বৈশাখের ন্যায় বাইশে শ্রাবণও বিশ্বমানবের পূজা তিনি পাবেন। আমরা ভারতীয়রা আমাদের হৃদয়কন্দরে রবীন্দ্রনাথের পূজাবেদী প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্বের কাছে রবীন্দ্রনাথের জন্য গৌরব করতে চাই, দেখাতে চাই সারা বিশ্বকে যে এ জাতি তুচ্ছ নয়, সামান্য নয়। ভারতীয় ভাবধারার বাণীমূর্তি রবীন্দ্রনাথ শুধু ভারতের নয়, তিনি সারা বিশ্বের।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের শেষ কবিতাটি উদ্ধৃত করে, এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা এখানেই শেষ হোক-
"তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে,
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;
তার তরে রাখনি গোপন রাত্রি।
তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে পথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ,
সে যে চিরস্বচ্ছ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তারে চিরসমুজ্জ্বল।
বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু,
এই নিয়ে তাহার গৌরব।
লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত।
সত্যেরে সে পায়
আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে।
কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে,
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে
আপন ভাণ্ডারে।
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।
('মৃত্যু': শেষলেখা)
( কবির শরীরে অস্ত্রোপচারের পর কবি
ঐ দিন সন্ধ্যায় পরিচর্যাকারীদের সামনে কবিতাটি মুখে মুখে বলেন।)
0 Comments