জ্বলদর্চি

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান-৪/ অনিন্দ্যসুন্দর পাল

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান
(Ancient India, History & Science)           


চতুর্থ পর্ব- "ঐতিহাসিক উৎস, প্রকারভেদ ও ধারণা"

সাহিত্য ও ইতিহাস শব্দ দুটিই আমাদের আলাপ-আলোচনায় এতটাই সহজসিদ্ধ ও শিষ্টজনোচিতভাবে আলোচিত হয় যে তার বারংবার আগমন ও গমন দুটোই ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তি বলে মনে হয়। এরপরেও, সাহিত্য ও ইতিহাস দুজন দুজনকে স্পর্শ করে এমন বাধ্যবাধকতা কিন্তু কোথাও নেই। তবুও, এই সত্যতা স্বীকার করে নিলেও তা সংক্রান্তি হোক বা অতিক্রান্তি, উভয়ের মধ্যে দৃশ্যমান, অপ্রকাশিত, সমধর্মিত্ব সম্পর্ক থাকে এবং থাকবেও, এমন কথা আমরা পূর্বের বিস্তারিত আলোচনা থেকে ধারণা করতে পারি, শুধু তাই নয় এটাও অনুমান করতে পারি যে সমাজচেতনা উভয়ের মধ্যেই যে নারীস্পন্দনতার কাজ করে যাচ্ছে এমন ধারণাও চিরন্তন।
  
  প্রসঙ্গতই, সমাজের একটি প্রকাশ যেমন ইতিহাস যা প্রত্যক্ষ, আরেকটি সাহিত্য যা পরোক্ষ। কারণ পূর্বেই বলা হয়েছে ইতিহাসে যেমন সামাজিক সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব স্পষ্ট ও বাস্তব তেমনই সাহিত্যে সাহিত্য রচয়িতার নিজস্ব মন, ভাবনা ও তার ক্রিয়াকলাপ কল্পিত মিশ্রণের বিষয়ভূত। স্বভাবতই, ঐতিহাসিক হোক বা সাহিত্যিক উভয়কেই ইতিহাস অথবা সমাজবিজ্ঞান চর্চার জন্য প্রচলিত শিলালিপি, মুদ্রা বা তাম্রলেখ অথবা মহাফেজখানা বা অভিলেখগারের প্রত্ন-সামগ্রীকের উপরই নির্ভরশীল হতে হয়, তা লিখিত-ই হোক বা অলিখিত।
   
    তাই, আমার নিজস্ব অভিমত, সাহিত্য ইতিহাস সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা, উৎপত্তি ও ইতিহাস এবং তার নিজস্ব তর্ক-বিতর্কের বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হওয়া যতটা প্রয়োজন ঠিক ততটাই প্রয়োজন এইসব আলোচনা যেসব তথ্য বা বিষয়ের উপর নির্ভর করে যুগের পর যুগ দিনের পর দিন ধরে আলোচ্যের মূল সুর পেয়ে  আসছে তার সম্পর্কেও সমভাবে অবলোকিত হওয়া। তাই এই পর্যায়ে তথ্য বা বিষয় উৎস সম্পর্কে কিছু আলোকপাত রাখব বলে মনস্থির করেছি।
   সাধারণত, ঐতিহাসিক উৎস প্রধানত লিখিত ও অলিখিত দুটি বিষয় নিয়ে গঠিত। যেমন, সমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক উৎসকে অলিখিত উৎসের মধ্যেই ধরা হয়। উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্য, চিত্রকলা, এবং অধুনা আবিষ্কৃত কার্বন^১৪ পদ্ধতিটিকে অলিখিত উৎসেরই অন্তর্ভুক্ত। ঠিক তেমন লিখিত উৎস প্রত্নক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন লিখিত সূত্রাদি, যা অতীতের সাথে সম্পর্কিত, এবং পুঁথি বা গ্রন্থাদি, যা দেশীয় ও বিদেশীয়, এটুকুর মধ্যেই কেন্দ্রীভূত।

     প্রসঙ্গত, অনুসন্ধান ও খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত এবং মাটির তলা থেকে প্রাপ্ত যা ইতিহাস বিজড়িত, এই সমস্ত বিষয় হলো প্রত্নতত্ত্ব। তার থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ দ্বারা প্রত্নতাত্ত্বিকবিদ ঐতিহাসিকদের মতামতকে ভিন্ন ভিন্ন অতীত ধারণার সাথে মিলিয়ে তর্কবিতর্কের মাধ্যমে ইতিহাস গড়ে তুলতে অগ্রসর হন। কার্যত, প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে এবং ইতিহাস রচনার উভয় ক্ষেত্রেই প্রত্নতত্ত্বের ভূমিকা অনস্বীকার্য। 

     বস্তুত, অলিখিত উৎস মধ্যে উল্লেখিত ঐতিহ্য সমন্বিত হয়- স্থাপত্য/ ভাস্কর্য্য ইত্যাদির ধ্বংসাবশেষ, প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের দ্বারা প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্নবস্তু/প্রত্নক্ষেত্র এবং স্তম্ভ ইত্যাদি দ্বারা। তবে স্থাপত্য/ভাস্কর্য এবং মাটির তলা থেকে প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষকে আমরা বাস্তবভিত্তিক উপাদান বলতে পারি, কারণ এখানে কোনো কৃত্রিমতা বা কল্পনাসূত্রের অবকাশ নেই। বলে রাখা ভালো, ১৮৬১ সালে "স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম" ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সমীক্ষা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করলে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে প্রত্নবস্তু উদ্ধারের কাজ সূচনা হয়। পুনরায়, ১৯০২  সালে "স্যার জন মার্শালের" নেতৃত্বে প্রত্নবস্তু উদ্ধার ও বিশ্লেষণের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। সাঁচী, তক্ষশীলা, সারনাথ ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ স্তম্ভ, ভাস্কর্য আবিষ্কৃত হয়। পরবর্তীতে ১৯২২ সালে আবিষ্কৃত হয় হরপ্পা সভ্যতা, যা ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম কোনো নাগরিক সভ্যতা। অনুরূপভাবে খ্রিষ্টপূর্ব নবম থেকে পঞ্চম শতাব্দীতে প্রাপ্ত ধূসর রঙের চিত্রিত পাত্রগুলি ভারতবর্ষের লৌহ যুগ  এবং আর্যদের গাঙ্গেয় উপত্যকায় সংস্কৃতি বিস্তারের ক্ষেত্রে সমীকরণ ঘটাতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তাই বলা যেতে পারে, ভারত সমন্ধে আধুনিককালে যতই আলোচনা, তর্কবিতর্ক হোক না কেন তাতে পুরাস্তু প্রমাণ ও উল্লেখ মুখ্য হয়ে পড়ছে। 

     তবে, মুদ্রার ব্যাপারে অধ্যাপক 'রমেশচন্দ্র মজুমদার' ও অধ্যাপক 'পি.এল.গুপ্ত' ভিন্ন ভিন্ন অভিমত রেখেছেন। কারণ মানব সভ্যতার সূচনার  সময় থেকে পণ্য-বিনিময় এবং সংশ্লিষ্ট সমস্যা নিরাময়ের কারণে মুদ্রার প্রচলন হয়েছিল বলে মনে করা হয়, সাধারণত ধাতব খণ্ডকে মূল্যমানের একক হিসাবে প্রচলনের নিদর্শন ভারতে খ্রিঃপূঃ সপ্তম-ষষ্ঠ শতকের পূর্বে পাওয়া যায় না। বলাবাহুল্য, হরপ্পা সভ্যতাতেও শস্যকেই মুদ্রার বিকল্প হিসেবে ভাবা হত। তাই মুদ্রাকে প্রত্নতত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসাবে অধ্যাপক আর.সি.মজুমদার মনে করতেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর সেই ধারণাকে অধ্যাপক পি.এল.গুপ্ত উপরিক্ত আলোচিত কারণহেতুই বোধ হয় সম্পূর্ণ মানতে পারেননি। 

    তারপরও, কেউ কেউ শিলমোহরকে মুদ্রা হিসাবে ব্যবহার করা হত কিনা সেই বিষয়ে প্রশ্ন তুললেছেন ঠিকই; তবে জ্ঞাতব্য, ঋগ্বৈদিক যুগে গরু ছিল অন্যতম বিনিময়ের মাধ্যম। যদিও তার পিছনে বহু কারণ ছিল, তারমধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ গরুর স্থায়িত্ব তুলনামূলক অনেক অধিক। কিন্তু ছোটখাটো ক্রয়-বিক্রয়ে গরুর দ্বারা মূল্য নির্ধারণ অসুবিধা হয়ে পড়ায়, পরবর্তী বৈদিক যুগে "নিষ্ক" নামে এক অলংকারের প্রচলন শুরু হয়। প্রসঙ্গত, সেই সময় পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্যে চাক্ষুস প্রমাণের অভাবে এই "নিষ্ক"কে স্বর্ণমুদ্রা হিসাবে আদৌ গণ্য  করা হবে কিনা সেই বিষয়ে বেশ দ্বিমত আছে। তবে, পরবর্তী বৈদিক যুগের অধ্যায়ে 'কৃষল' নামে এক তৈলরীতির সন্ধান মেলে। উল্লেখ্য, (১.৮ x ১০০ = ১৮০ গ্রেণ-এর একটি তৈলরীতি) অর্থাৎ একশ'টি কৃষলের সমান ছিল 'শতমান'।
তাই হয়ত নিশ্চিতভাবে বলা যায় এইরীতির কিছুকাল পর থেকেই ধাতবমুদ্রার ব্যবহার শুরু হয় কারণ যে দুটি জায়গায় (তক্ষশীলা ও চমা-ই-হুজুরী) সর্বপ্রথম প্রাচীন ভারতীয় মুদ্রাভাণ্ডারের সন্ধান পাওয়া যায়, সেই দুটি স্থানে ওইসব মুদ্রাভান্ডারের প্রাচীনত্বের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করা খ্রিঃপূঃ ষষ্ঠ-শতকের পূর্বে অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ। সুতরাং, ১৫০০ খ্রিঃপূঃ থেকে ৮০০ খ্রিঃপূঃ অবধি ভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে একটি নিরেট সিদ্ধান্তে আসন্ন হওয়ার পরই মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়েছে ধরে নেওয়া হলেও, অধ্যাপক "গুপ্তের" মতে, প্রাচ্য দেশের চীন ও পশ্চিমের লিবিয়ার অনেক আগে থেকেই ভারতে মুদ্রার ব্যবহার ও তা যে ক্রয়-বিক্রয়ের অন্যতম মূল্যমানের একক হয়ে উঠেছিল তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ রাখে না।।
     (ক্রমশ)
-----------------------
আরও  পড়ুন 

ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ- এই চতুর্বর্গ লাভের উপায়স্বরূপ উপদেশ যে পুরাবৃত্ত, তাহাকেই আর্যেরা বলতেন ইতিহাস।


Post a Comment

0 Comments