জ্বলদর্চি

পুজোর সত্যি/ ঈশানী রায়চৌধুরী

পুজোর সত্যি


ঈশানী রায়চৌধুরী

জানো, এবার আমি ষষ্ঠীতেই চলে যাব... তোমাদের একটু কষ্ট হবে!  ..
'আরে আমি কি তোমায় বারণ করছি... যা খুশি কর।'
এই তো এমন একটা কথা বলছো... যা খুশি কর। মানে তোমার আপত্তি বুঝিয়ে দিচ্ছ! ' আপত্তি আমার? কি যে বলো! আমি কে!
আর কথা না বাড়িয়ে ওখান থেকে চলে এলাম.... এই এক মুশকিল আমার! মনে ঘা লাগলে চোখ শুকনো রাখতে পারি না... এই এতখানি বয়স হল! আচ্ছা কেন এমন হয়.... খুব কি বেশি চেয়েছি জীবনের কাছে ! আমার ঠাকুমা  বলতেন মাটি বাপের নয়, মাটি  দাপের!  তা দাপ কি সবাই দেখাতে পারে? ওটা একটা মনের গঠন.... নিজের ইচ্ছে আদায় করে নিতে জানা! যে একটুতেই ভেঙ্গে যায়, নিজের ভেতর অন্য এক জগতে বাস করে... তার সঙ্গে বাস্তবের তো ঠোকাঠুকি লাগবেই। সারাদিন নিজের মনে অনেক তোলপাড় চলতে লাগল... এবাড়িতে আমি তিনচারদিন না থাকলে যথেষ্ট অসুবিধা হবে সেটা বুঝি, তবে কেউ কি সেটা স্বীকার করে! একবার করে ড্রাইভার দের নাম্বার গুলো সার্চ করছি... আবার বন্ধ করে  দিচ্ছি।
  
যাই হোক দিন কাটতে লাগল নিজের নিয়মে...  তবু মনটা  কিছুতেই  সহজ হচ্ছে না!.. রাতে ঘুমের মধ্যে বাড়ির পুজো আমায় অধিকার করে নিলো... অবচেতন না অধিচেতন কোন স্তরের খেলা চলে স্বপ্নে জানিনা কিন্তু সেই "সময়ে " ঢুকে পড়ে চেতনা। সেদিনের  লোকজন, পরিবেশ সব জ্যান্ত হয়ে কথা বলতে থাকে। কি করে যে বর্তমান সময় হারিয়ে যায়  কে জানে!

সেই অল্প আলোফোটা ভোরে ঝুড়ি নিয়ে ফুল তুলতে যাওয়া... কখনও বাবার টর্চ নিয়ে যেতে হত... শুকনো পাতার  তলায় সরসর করে কিছু হেঁটে যাচ্ছে না তো! আমরা যারা পাখির মত হাল্কা তখন  এ বাগান ও বাগান ঘুরে তুলে আনতাম ঝুড়িভর্তি ফুল বড়োরা মালা গাঁথবে বলে.. সেই আমরাই একদিন বড়োদের দলে  ঢুকলাম। কত দায়িত্ব তখন ১০৮ টা  বেলপাতা দিয়ে  মালা গাঁথা  শিউলির মালা... টগরের মালা তো লাগবেই  সীতারাম আর বাবা শিবের জন্যে...  অর্ঘ্যের জন্যে ১০৮ টা ধান খুঁটে চাল বের করে রাখতে হত... দুব্বো তিন পাতার, তার কোঁক বেছে রাখতে হত। সব কাজ করতে হবে খুব নিষ্ঠাভরে... পায়ে লাগা তো চলবেই না, জামাটাও কাচা হওয়া চাই।

  আর কোন গাছে পঞ্চমুখী  জবা আছে,কার বাড়িতে নীল অপরাজিতা সব আমাদের মুখস্থ ছিল। মোহনকাকা যতদিন বাড়িতে থাকে, ঠাকুর তৈরী করে...তখন এক মুহুর্ত চোখ সরাবার জো থাকে না.. কি করে যে শুধু মাটি চেলে বেছে এমন আশ্চর্য ঠাকুর তৈরী হয়... ভেবে কুল করতে পারতাম না...আর যেদিন চোখ আঁকা হত সেদিন  নাওয়া খাওয়া ভুলে চোখ টানটান করে বসে থাকতাম.. একটুও যেন বাদ না যায়!  প্রায় পাঁচদিনের পুজো... সব ফুল টাটকা গাছ থেকে তোলা.. আর ফুলেরও তো অভাব নেই... সবার বাড়িতেই কিছু না কিছু গাছ আছে। শুধু কি ফুল দোকানের মিষ্টিও আসতো না আমাদের পুজোয়... নারকেলের নাড়ু আর ধবধবে চন্দ্রপুলি ছিল ঠাকুরের খাবার। ক্ষীরের ছাঁচের কি সূক্ষ কারুকাজ... এসব ছিল আমার ছোটঠাকুমার হাতের জাদু! একমাস আগে থেকে সাজসাজ রব চলত!  ষষ্ঠীর দিন সকালেই কাকারা কিছু বেলগাছের ডাল কেটে ঘাসের ওপর ফেলে দিত... আর আমরা বেছে নিতাম অখণ্ড পাতা, মানে তাতে চক্র অর্থাৎ সাদা দাগ বা ছেঁড়া ফাটা চলবে না।

সারাদিন যে কত শাঁখ বাজাতে হত বলা যায় না। ঠোঁটদুটো পুজোর কদিন ফুলেই থাকতো। তা তো হবেই আমরা যে দুগ্গাবাড়ির মেয়ে! বেশ একটা গর্ব ফুটে বেরোত আমাদের চোখমুখ থেকে.... এই কদিন যেন আমরা একটু আলাদা মানুষ অন্য বন্ধুদের থেকে!সবাইকে ফুল চন্দন দেওয়া অবশ্য  সেজকাকাই সব চন্দন ঘষত...বাটি বাটি। শক্তিপুজো তো তাই লাল চন্দন বেশি লাগে। আমাদের ছোট কব্জিতে কতই বা জোর তাই ওই কাজটা  আমাদের নয়। অঞ্জলির সময় সবার মাথায় গঙ্গাজল দিচ্ছি, চন্দনের বাটিতে 
  যতটা চন্দন বেঁচে থাকতো তা ফুলের ঝুড়িতে দিয়ে হাতে হাতে ফুল দিতাম... পাড়া বেপাড়ার ঠাকুমা কাকিমা, কাকা, দাদুরা ভক্তিভরে  আমাদের হাত থেকে ফুল নিত। কেমন একটা পুজো পুজো গন্ধ বেরোতে আমাদের গা দিয়ে। তারপর যারা পুজো দিয়ে যেত তাদের রেকাবি বা বারকোষ  চিনে বের করে দেওয়া... কাজের কি আর শেষ আছে! মা বলেছে চরণামৃত খেতেই হবে আর একটুও মাটিতে পড়া চলবে না। টানা প্রায় ঘন্টাখানেক আরতি হত... বামুনকাকা হাতে পঞ্চপ্রদীপ বা দর্পন ধরে সেই যে আরতি শুরু করতো.... ঢাকিরা হয়রান হয়ে যেত! এই বামুনকাকা মানে শ্রী বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য এক আশ্চর্য মানুষ ছিলেন। সকাল থেকে  ঘট ডোবানো তারপর  একটানা ষোড়শ উপাচারের পুজো শেষ করে তারপর একঘন্টা আরতি। দেড়টা দুটো বেজে গেলেও  খিদেয় পেট চুঁ চুঁ করলেও পুষ্পাঞ্জলি না দিয়ে তো ভাত খাওয়া যাবে না! অঞ্জলি হলে  ঠাকুমার কাছে একটু শরবত খেয়ে বামুনকাকা বসতেন চন্ডীপাঠে! ওনাকে দেখে মনে হত উনি যেন  ওই পাঠের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছেন! 

হঠাৎ মনে হল মাথাটা একটা ইটে ঠুকে আলু হয়ে গেল... উফ কি ব্যথা! দৌড়ে যেতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম... আর সেই ধাক্কায় ফিরে এলাম বর্তমানে!
উঠে বসে  ভাবলাম,এবারে ১১৭ বছর..  আশ্চর্য! ছোটবেলা নাই ফিরে পেলাম এখনও কি  কম আনন্দের আমাদের পুজো! সবাই মিলে মালা গাঁথার ঘরে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায়... কত হাসি , কত গল্প....
সন্ধিপুজোর রঙ্গন ফুলের গোড়ে মালা... সারা রাত শিশির  ভেজা পদ্মগুলো ফুটিয়ে তুলে তবে গাঁথা হয় মায়ের ঘট পর্যন্ত  মালা। ভাইরা বহু দূর থেকে কিনে আনে ফুলগুলো.. প্রচুর ফুল। কেউ মন দিয়ে মালা গাঁথে .... কেউ হেসে গড়াতে থাকে.... কে বাড়ির বউ, কে মেয়ে..... সবাই মালার মত নানা রঙের ফুল! ফুলঝুরির মত আনন্দ ছিটকে ওঠে সেখানে। এ আকর্ষণ কি  কিছুতে এড়ানো  যায় ! খেতে বসে হাসির হুল্লোড় ওঠে... কত সামান্য কারণ, কার পাতে চাটনির আমড়া গড়াগড়ি... কে কাকে অন্যমনস্ক করে রসগোল্লা তুলে নিল.... এর মাথা টপকে পরিবেশন করতে গিয়ে কার টাকে দই পড়লো .... আহা সারা বছরের  সব টক্সিন বেপাত্তা হয়ে যায় এখানে!

কিন্তু এবছর সব হিসেব ভাঙচুর হয়ে গেছে... একশো বছর আগের  বিভীষিকা অধিকার করে নিয়েছে পৃথিবী... আতঙ্ক আজ সহবাস করছে মানুষের সঙ্গে! একটা আণুবীক্ষণিক ভাইরাস  কি অনায়াসে দখল নিয়ে নিয়েছে মানুষের ঠুনকো জীবনের... এত অসংখ্য বার মিউটেট করছে নিজেকে যে  বিজ্ঞান নাগাল পাচ্ছে  না। নিরুপায়  দুনিয়া বলছে তফাৎ যাও... দূর হঠ! হাইকোর্ট  বলছে পুজো হবে কিন্তু লোক ঢুকবে না মণ্ডপে !

আর বাড়ির পুজো! .তার কি হবে! সে তো কিছুতেই বন্ধ করা যাবে না! না সরকার তা বলছেও না... শুধু বিধিনিষেধ মানতে হবে... সে তো নিজেদের প্রাণের দায়েই মানতে হবে! বারকয়েক মিটিং হল গুগল মিটে... আজকাল খুব পপুলার এই মিডিয়া... কি করে সেই সুদূর মেদিনীপুর থেকে ব্রাহ্মণ দের আনা যাবে হাওড়া জেলার বীরশিবপুরে....কারণ চার পুরুষ ধরে এই পরিবার আমাদের পুজোর আসনে বসছেন! এনাদের ছাড়া আমাদের পুজো ভাবাই যায় না! এখন ঠাকুর কোন সাইজের হবে, যাতে বাড়ির ছেলেরাই মাকে বিসর্জন দিতে পারে.. বাইরের লোক ডাকতে না হয়... ইত্যাদি দফায় দফায় আলোচনা! সবচেয়ে বড় চিন্তা, সরকার কি বলবে! পুজো যত এগিয়ে এল  বোনেদের সঙ্গে মাঝে মাঝেই  ফোনে কথা হচ্ছে  হতে লাগল ঘন ঘন . পুজোটা বসুবাড়ির... আমরা কেউ বসু নই.... তাতে কি আমাদের আদর আহ্লাদের কি কিছু কম আছে ও বাড়িতে! আর আমরাও জড়িয়ে আছি ভালোবাসায়, প্রাণের পাতায়!

তাই ছেলে আমস্টারডাম থেকে যখন বলল " মা, এবার পুজোয় তোমার মামাবাড়ি যাওয়া চলবে না। আমি জানি মা তোমার খুব কষ্ট হবে! তবু আমার কথা ভেবে এবার বাদ দাও! "
       কি বলছিস বাবান! পুজোয় যাবো না? না বাবা, তা কি করে হয়... আরে ওটা তো বাড়ির পুজো... বাইরের লোক ঢুকবে না! তুই একটুও চিন্তা করিস না!
দেখবি আমি ঠিক থাকবো!
" মা, ওখানে দূরত্ব বজায় রাখতে পারবে না! মামার মেয়ে তো ছোট.. তোমায় জড়িয়ে ধরবেই... আর এতদিন পর সবাইকে দেখে তুমি নিজেও ঠিক থাকতে পারবে না! তাই please মা!"
       আকাশ ভেঙ্গে পড়লো মাথায়! ছেলের এত কাতর অনুনয় আমি কি করে.... পুজোয় না গিয়েই বা আমি কি করে!   সব গোলমাল লাগছে। আজকের দিনে নেদারল্যান্ড এ সংক্রমণ খুব বেড়ে গেছে... তাই  বারবার ওকে সাবধান করি... বাইরের খাবার খাবে না, যতদূর সম্ভব বাড়িতে থাকো।    মা দুগ্গা, এখন আমি কি করবো!
ছেলের কথা না শুনে জোর করে চলে যাব? তখন দূরদেশে ওর যদি মন খারাপ হয় এতে আমি কিভাবে আটকাবো!
 রাতে ভিডিও কল করতেই বললাম বাবা জানিস মাসিরা ছেলে মেয়ে মেসো সবাইকে নিয়ে আসছে... আমি তো একা যাচ্ছি... দেখিস মা দুগ্গা সবাইকে ভাল রাখবেন!

ছেলে একটু চুপ করে তারপর কেমন অন্যরকম গলায় বলল
   " মাসিদের তো আরও দিদি আছে... আমার যে  আর..... মা নেই ! "


  

Post a Comment

0 Comments