প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান
প্রথম পর্ব
অনিন্দ্যসুন্দর পাল
অলংকরণ - শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য
ইতিহাস চর্চা ও প্রেরণা
ভারতীয় ইতিহাস নিয়ে আলাপালোচনা, কাটাছেঁড়া এবং তর্কবিতর্ক কোনোটাই কম হয়নি, তবুও এই উপমহাদেশের প্রাচীন মধ্য ও আধুনিককালের যে বৃত্তান্ত, লক্ষ লক্ষ বছর আগে থেকে উক্ত ভূখণ্ডের উপর গড়ে ওঠা জনবসতির আদব-কায়দা, ব্রোঞ্জ থেকে শুরু করে লৌহ যুগ পর্যন্ত বৈদিক ও বেদ-উত্তর যুগের যে ইতিবৃত্ত, একদিকে যেমন বৌদ্ধ-শিক্ষা সাথে জৈন ধর্মতত্ত্ব ও তার নির্বাণতত্ত্ব আবার অন্যদিকে গ্রিক-পারসিকদের ভারত আক্রমণের যে অভীপ্সা দেখা দিয়েছিল তা নিয়ে আজীবন মনের ভিতর বিভিন্ন পরীক্ষা, নিরীক্ষা ও সমালোচনার মতো উৎকণ্ঠা বা অভিপ্রায় চললেও, এর উত্তর যে চিরঅমীমাংসিত এবং এর গতি-প্রগতি যে অসীম এটা বলার কোনো অপেক্ষা রাখে না।
তাই আমরা যদি সভ্যতা উত্থানের অগ্রভাগ থেকে এই আধুনিক কালের একবারে পাদদেশ পর্যন্ত চোখ রাখি তবে দেখতে পাব এই প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান বিকাশ নিয়ে যে ভিন্ন ভিন্ন অসম্ভব অকল্পনীয় অভাবনীয় তত্ত্ব যুক্তি প্রমাণ উদঘাটন হয়েছে তার শিকড় অনুসন্ধানের অনেক গভীরে নিমজ্জিত আছে, তার চাক্ষুস প্রমাণ বোধ হয় এই কোয়ান্টাম তত্ত্ব, বিবর্তন তত্ত্ব, প্লাস্টিক সার্জারি, রকেট উত্থাপন এবং মার্ক্সবাদ ইত্যাদির মতো বিষয়। এরপরেও অনেক প্রশ্ন অথবা দ্বিমত আসতেই পারে হয়তবা আসবেও, সত্যি সত্যি কি সভ্যতার অমিত লগ্নে মহাকর্ষ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, প্লাস্টিক সার্জারির মতো সূক্ষ্ম কাজ চরক ও সুশ্রুত সংহিতায় আদৌ বর্ণিত আছে, কণাদের বৈশেষিক সূত্র কতটুকুইবা দর্শনের দাবি রাখে, আর্যভট্টের শূন্য আবিষ্কারের পিছনেই বা গাণিতিক সাফল্য কতটুকু, এছাড়াও বরাহমিহিরের পঞ্চসিদ্ধান্তিকা গ্রন্থে উল্লেখিত জ্যোতিষচর্চার সাথে সমুদ্র প্রসঙ্গ কতটা সঠিক, শুধু তাই নয় কালিদাস, পাণিনি, বানভট্ট প্রমুখের গ্রন্থে সাহিত্য দর্শন সমাজ ও বিজ্ঞান কতটা প্রাসঙ্গিকতা পেয়েছে,তা নিয়ে বিশ্লেষণ ঘাত প্রতিঘাত ইত্যাদি আসতেই থাকবে। এরপরেও আমাদের এই সমস্ত আঘাতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কঠিন সত্যের উন্মোচন করতে হবে, তবেই না সন্ধান মিলবে বর্তমান অতীত ও ইতিহাসের অন্তর্নিহিত সাযুজ্যের!
যাই হোক, আমি এই সমস্ত বিষয় নিয়ে ধীরে ধীরে আলোচনায় আসব। তবে এই আলোচনার একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আমি দৃষ্টিপাত করব এই প্রাচীন ভারতের দুটি খুবই ঘনিষ্ট বিষয়- "ইতিহাস চর্চা ও প্রেরণা"।
এই ইতিহাস শব্দটা আমরা প্রথম পাই অথর্ববেদ থেকে। যেখানে উল্লেখ আছে-
"তমিতিহাসশ্চ পুরাণংচ গাধাশ্চ নারাশংসীশ্চনু ব্যচলন্"
যা থেকে আমরা প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুরাণ গাধা ও নারাশংসী এই চারপ্রকার লৌকিক বিষয় সম্পর্কে অবগত হতে পারি।
আবার পরবর্তীকালে এই ইতিহাস কথাটা পাই মহাভারতে যেখানে বলা আছে-
"পুরাণ সংহিতাঃ পুণ্যাঃ কথা ধর্মার্থ সংশ্রিতা
ইতিবৃত্তং নরেন্দ্রাণাম ঋষিনাথ মহাত্মনাম"
যা স্পষ্ট ভাবে বললে ইতিবৃত্ত আলোচ্যে উল্লেখ আছে রাজা ও ঋষির বিবরণ আর পুরাণে উল্লেখিত প্রাচীন ধর্মবিষয়ক কাহিনী।
এরও পরবর্তীতে ইতিহাস ও পুরাণকে পঞ্চমবেদে নামাঙ্কন করা হয়েছে, যা আরো স্পষ্ট হয়েছে এই বাক্যে -
"ঋগ্বেদঃ যজুর্বেদঃ সামবেদঃ অথর্বণশ্চতুর্থ
ইতিহাসপুরাণঃ পঞ্চমঃ"
এছাড়াও ইতিহাসের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা আমরা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রতেও পেয়ে থাকি-
"পুরাণমিতিবৃত্তমাখ্যায়িকোদাহরণং
ধর্মশাস্ত্রয়র্থশাস্ত্রং চেতীতিহাসঃ"
প্রাচীন ভারতে শুধু ইতিহাস শব্দের চর্চার কথাই শুধু বলা নেই সেখানে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তার বিশ্লেষণ ও লেখন প্রণালীটা নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে দীর্ঘ বিস্তার জুড়ে। এর নিদর্শন পাওয়া যায় কাশ্মীরের ইতিহাস প্রণেতা কলহনের একাদশ শতাব্দীর শেষভাগে রচিত "রাজতরঙ্গিনী"তেও। তিনি সেখানে স্পষ্ট ভাবে বলছেন ইতিহাস শুধুমাত্র সত্য নয় ও সত্যকাহনও বটে। তাই হয়ত স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন-
"শ্লাঘ্যঃ স এব গুণবান্ রাগদ্বেষ - বহিষ্কৃতা।
ভৃতার্থকথনে যস্য স্থেয়স্যেব সরস্বতী।"
তবে দুর্ভাগ্য এটাই যে আমাদের কলহনের রচনা ছাড়া তেমন কোনো কংক্রিট রচনা পাওয়া যায়নি যেখান থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে বিশদ জানতে ও ধারণা জ্ঞাপন করতে পারি।
যদিও এই বিশদ অজানা সম্পর্কে অনেকে অনেক মত পোষণ করেছেন তার মধ্যে ম্যাকডোলেন নিজস্ব কিছু অভিমত বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। সেখানে কারণসমূহ হিসাবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র এর ব্যক্তিগত কয়েকটি উক্তিকে তুলে ধরেছেন ইতিহাসের এই সাহিত্য ভাবের অভাব এবং ব্যর্থতার নিদর্শন হিসাবে।
ভারতবর্ষের ইতিহাসহীনতা ও ইতিহাসহীনতার কারণ প্রসঙ্গ আলোকপাত করতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন- "যাহা ভারতের কলঙ্ক, তাহা বাংলারও কলঙ্ক, এ কলঙ্ক আরো গাঢ়। এখানে আরও দুর্ভেদ্য অন্ধকার"। এমন কথা বলতে বলতে তিনি প্রাচীন বাংলা তথা সমগ্র বাংলাকেও একবারে মুক্তি দেননি। তিনি বলছেন - "এমন দুই একজন হতভাগ্য আছে যে পিতৃপিতামহের নাম জানে না, এবং এমন দুই এক হতভাগ্য জাতি আছে যে কীর্তিমন্ত পূর্বপুরুষগণের কীর্তি অবগত নহে। সেই হতভাগ্য জাতিদিগের মধ্যে অগ্রগণ্য বাঙালী"।
এ কথা স্বীকার করে নিতে বাধ্য কারণ আমরা জানি কলহনের রাজতরঙ্গিনী তে কাশ্মীরের ইতিহাস বর্ণিত থাকলেও সন্ধ্যাকর নন্দীর "রামচরিতম্" কাব্যে সেরকম বাংলাদেশের ইতিহাসের উল্লেখ নেই। এরপরও একটু কলঙ্ক মোচনের চেষ্টা করাই যায় এই ভেবে যে- এই কলঙ্কময়, ইতিহাসহীন বাংলার ইতিহাসকে সর্বমানসে ছড়িয়ে দিতে সর্বপ্রথম সন্ধ্যাকর নন্দী'র সাধনা যেভাবে সমগ্র প্রাচীন তথা আধুনিক কালের ইতিহাসে গৃহীত হয়েছিল বা হয়েছে তা কি নিঃসন্দেহে একপ্রকার প্রলেপ বা ব্যথার উপশমের অধ্যায় নয়?
(ক্রমশ)
--------------------------------------------------------------
প্রতি শনিবার প্রকাশ পাবে এই ধারাবাহিকটি।
অভিমত জানাতে পারেন।
jaladarchi@yahoo.in
5 Comments
Darun.! Excellent. Amar khub kaje lagbe. Karon ami akta project e jukto hoechi . Astronomy in ancient India.
ReplyDeleteUGC project.
ধন্যবাদ।
DeleteIdea ta outstanding. Wait korbo.
ReplyDeleteDarun bisoy, sundor uposthapona, ami history sikhok hoye bolchi, darun suru hoyeche. Lekhok k kurnish
ReplyDeleteOsombhob bhalo hocche, porer tar jonyo opekhkhae achi
ReplyDelete