জ্বলদর্চি

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল-১৯

অলংংকরণ - প্রান্তিকা মাইতি

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল
পর্ব --১৯

সন্দীপ কাঞ্জিলাল 

বেপথু বুদ্ধি-

বুদ্ধি ও জ্ঞান সমার্থক নয়। বুদ্ধি হচ্ছে মানুষের সহজাত প্রকৃতি। আর জ্ঞান হচ্ছে বুদ্ধি দ্বারা অর্জিত গুণাবলী। আমাদের মধ্যে মন ও বুদ্ধি দুইই আছে। যাতে মানুষ বুদ্ধির সাহায্যে সঠিক শিক্ষা লাভ করতে পারে, আর তা থেকে মানুষের বহুমুখী জ্ঞান অর্জিত হয়। সেই জ্ঞান দিয়ে মানুষ কল্যাণ করে মানুষ ও মানবতার। বুদ্ধিজীবী আর জ্ঞানজীবী এক কথা নয়। যারা জ্ঞান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে তাঁরা জ্ঞানজীবী, আর যারা বুদ্ধি দিয়ে করে তাঁরা বুদ্ধিজীবী। মানুষ ও তার কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় বুদ্ধিকে দুর্বুদ্ধি বানিয়ে মানবদ্রোহী জ্ঞান অর্জন করে, অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করে। মানুষকে বিপথগামী করে দেয়। সৃষ্টি করে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, হিংসা কলহ। পৃথিবীকে বসবাসের অযোগ্য করে তোলে। বুদ্ধি যখন বিকারহীন হয়, তখন তা স্থিত হয়। স্থিত মানে এখানে সোজা দাঁড়িয়ে থাকা। সে বুদ্ধি কখনো হেলে না দোলে না। অর্থাৎ তাতে কোনো কাঁপুনি থাকে না। গীতায় কৃষ্ণ বলেছেন, "এতাং বিভূতিং যোগং চ মম যো বেত্তি তত্ত্বতঃ/ সোহবিকল্পেন যোগেন যুজ্যতে নাত্র সংশয়ঃ।" (দশম অধ্যায়, ৭নং শ্লোক) অর্থাৎ কৃষ্ণ বলেছেন, "যিনি আমার এই বিভূতিও যোগ যথার্থ রুপে জানেন, তিনি অবিচলিত ভাবে ভক্তিযোগে যুক্ত হন। সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।" যদি ভগবান কেউ বিশ্বাস করে, তবে তাঁর ভক্তির মধ্যে কোনরূপ বক্রতা থাকবে না। যদি বুদ্ধির মধ্যে এইরূপ অনিশ্চয়তা না থাকে তবে তার মধ্যে হেলদোল বা ইতঃস্তত ভাব থাকবে না। তবেই সেই বুদ্ধি মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হতে পারে। তবেই তাকে প্রকৃত অর্থে বুদ্ধি বলা যাবে। বুদ্ধি একেবারে সরল হওয়া চাই। তাতে বক্রতার লেশমাত্র থাকবে না। যেমন সাইকেলের পেছনে ছোট গিয়ার এবং সামনে বড় গিয়ার এক সরলরেখায় থাকলে তবে তা মানুষের উপকারে আসে, নচেৎ ঘন ঘন চেন পড়বে। তাহলে যে উদ্দেশ্যে সাইকেল প্রয়োজন, তবে সেই উদ্দেশ্য সাধিত হবে না।

যদি আমরা গভীরভাবে চিন্তা করি, তবে বুঝতে পারবো এই যে কাঁপন তা কিন্তু বুদ্ধির দোষ। এই দোষ সৃষ্টি হয় মনের বক্রতা থেকে।যেমন এক বনমুরগীর বাসাতে ঈগলের ডিম রাখা হয়েছিল। বনমুরগী ডিমে তা দিয়ে যে বাচ্চা বেরুলো, সে বনমুরগী বলেই পালিত হোল।ক্রমে ক্রমে সে ঈগল হলেও, সে কিন্তু বনমুরগীর স্বভাব পেল।

সে খাবারের জন্য আস্তাকুঁড় আঁচড়াত,বনমুরগীর মত ডাক ছাড়ত, এবং কয়েক ফুটের বেশি উড়তে পারতো না।একদিন একটি ঈগলকে উঁচুতে উড়তে দেখে সে বলল,দেখ কি সুন্দর একটা পাখি কত উঁচুতে উড়ছে। তখন তার সঙ্গীরা বললো ওটা ঈগল,তা বলে তুই উড়তে পারবি না।কারণ তুই আমাদের সঙ্গে থেকে বনমোরগ হয়ে গেছিস। সেও তাদের কথা বিশ্বাস করে আর উড়ার চেষ্টা করলো না। এটাই হচ্ছে মনের বক্রতা। ঈগলটি বুদ্ধিকে সোজা না রেখে, বাঁকা ভাবে দেখছে। একদিক থেকে মন যদিও বুদ্ধির অংশ, তবু বিচার বোধের সময় মনকে বুদ্ধি থেকে আলাদা করে নিতে হয়। শিশুদের মন একদম সরল।তাই তারা তাড়াতাড়ি জ্ঞান গ্রহণ করতে পারে, তাই মনের দৃঢ়তা এবং নিষ্কম্প ছাড়া জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। বুদ্ধি কিন্তু সাধারণ। মনোবিকার অনুসারে বুদ্ধি বদলায়। মানুষের মানসিক কল্পনার রঙে তার বুদ্ধি ও রঙিন হয়ে উঠে। আর এই রঙিন বুদ্ধি নির্ভুল বিচার করতে অক্ষম।যে বুদ্ধি নানা চিন্তায়, বিকারে রঙিন হয় না, যে বুদ্ধি কেবল জ্ঞানের নির্দেশে পরিচালিত হয়, তাই প্রজ্ঞা। বুদ্ধিতে যখন রঙ লাগে, তখন এক বুদ্ধি অনেক বুদ্ধি হয়ে যায়, দয়ার রঙ লাগলে দয়া বুদ্ধি, হিংসার রঙ লাগলে হিংসার বুদ্ধি। এইভাবে বহু বুদ্ধি মানুষকে বহুদিকে টলাতে থাকে, হয়রান করতে থাকে, দিশেহারা করে তোলে। এইরকম হাজার বুদ্ধি সঠিক পথের দিশা দিতে অক্ষম। একমাত্র শুভবুদ্ধি অর্থাৎ প্রজ্ঞাই মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। কারণ প্রজ্ঞাকে কোনো রঙে রাঙানো যায় না, তা ঠিক থার্মোমিটারের মতো। থার্মোমিটারের নিজের জ্বর হয় না, তাই সে অন্যের তাপ মাপতে পারে। 
বুদ্ধি কারোর কম, কারোর বেশি। গুরুত্ব কিন্তু কমবেশির নয়, গুরুত্ব স্বচ্ছ বুদ্ধির। হোক না আগুনের ফুলকি ক্ষুদ্র, তবু তা কার্যকরী হতে পারে। তুলার পাহাড়কে ছাই করে দিতে পারে, উল্টো দিকে বিরাট একটা কয়লা তুলায় রাখলে, তা তুলার মধ্যে ডুবে যাবে। 'প্রশ্ন' কমবেশি বুদ্ধির নয়। শুভবুদ্ধির এক ছোট ফুলকি, ক্ষুদ্র এক শিখা, ব্যাস তাই যথেষ্ট। এখানেই বুদ্ধির শক্তির বিশেষত্ব। অল্প বুদ্ধি কোন লোকের পক্ষে দেশশাসনের উপযোগী নেতৃত্ব অর্জন করা সম্ভব নয়। দিগগজ বুদ্ধির লোকেরা বিরাট ব্যবসা আর পয়সার জোরে ওলট-পালট করতে পারে, কিন্তু ত্রিভুবনকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে, একমাত্র প্রজ্ঞার স্ফুলিঙ্গ। 

প্রজ্ঞা সাধারণ বুদ্ধি নয়। সঠিক বিচারের দিকে গতি যে বুদ্ধির-- তাই প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞা হচ্ছে নিশ্চিন্ত,সরল, সোজা খাড়া। আমি মনে করি মানুষের কেবল বুদ্ধিই থাকা উচিত, মন না থাকাই ভালো। বুদ্ধিতে তার লীন হওয়া চাই।  মন মানে সংকল্প-বিকল্প। মন নয় তা কামনার পুটলি।  সংকল্পবিকল্প কিংবা কামনা এসবের বুদ্ধির আজ্ঞাধীনে চলা চাই। মন ও বুদ্ধিতে যেন আড়াআড়ি, রেষারেষি না চলে। বুদ্ধি বলবে, মন করবে। নির্ণয়ের কাজ বুদ্ধির।  বুদ্ধি আইন-প্রণয়নকারী বিভাগ। মন তালিমকারী বিভাগ। বুদ্ধির ক্ষেত্রে আদপে, মন নাক ঢোকাতে যাবে না। যে যার কাজ করবে। নাড়ু মিঠে কি তেতো, খাওয়ার যোগ্য কি অযোগ্য, জিভ একমাত্র দেখবে। কতটা নাড়ু খাওয়া হবে তা ঠিক করা তার কাজ নয়। তাতে অযথা নাক গলাতে যেন সে না যায়। মনকে এভাবে বুদ্ধির অনুসরণ করে চলতে হবে। আস্তে আস্তে বুদ্ধিতে তার লীন হয়ে যেতে হবে। মনরূপী পুটলি থেকে এক টুকরো করে নেকড়া বার করে নিলে পুটলি আর থাকে না। অর্থাৎ মন তখন জীর্ণ হয়ে গেছে।  মিলিয়ে গেছে, শান্ত হয়েছে, বুদ্ধির সঙ্গে এক রূপ হয়ে গেছে। একে বলে যথার্থ মনোনাশ। মনোনাশ মানে মনের শক্তির নাশ নয়। মনোনাশের অর্থ মন বুদ্ধির অনুগামী হবে। বিনা তর্কে বুদ্ধির নির্ণয় অনুসারে কাজ করবে। মনের কর্মশক্তি নাশ করার কথাই ওঠে না। সে শক্তি সদা অক্ষয় রাখতে হবে। হাঁ, তবে মনের কামনামাত্র সমূলে নাশ করতে হবে। এভাবে মনের সবকিছু কামনার পরিপূর্ণ ত্যাগ করা হচ্ছে প্রজ্ঞার লক্ষ্মণ। 

কামনাতে আনন্দ বা সন্তোষ আছে কিনা তা বিচার করে দেখার মতো। কামনা থেকে শান্তি শীতলতা, সন্তোষ মেলে অনুভব একথা বলে না। উল্টো, কামনার দরুন মন সতত টলমল করতে থাকে। টলমলতা মানুষকে ব্যাকুল করে। টলমলতা আগুন জ্বালায়। অতএব কামনা গেলে আনন্দ কমে যাবে এরুপ আশঙ্কা একেবারেই অমূলক। কামনা হতে সন্তোষ মেলে এরুপ মনে হয় বটে, আসলে তা নয়। আনন্দ আসে কামনার তৃপ্তি অর্থাৎ কামনার অভাব থেকে। কামনা পূর্ণ হওয়া মানে একপ্রকারের তা শান্ত হওয়া, নাশ হওয়া। বিচার করে দেখলে দেখা যাবে যে আনন্দের স্থান কামনা নয়, কামনা হতে মুক্তিতেই আনন্দ।

কামনা বস্তুটা ব্যক্তিগত। তাকে সামাজিক রূপ দেওয়া কামনা নাশের এক উপায়। মনে করুন গ্রামের কোন লোক তার ছেলেকে পড়াতে চায়। সে গ্রামে ইস্কুল প্রতিষ্ঠা করতে পারে, নিজের ছেলের লেখাপড়ার সাথে অন্য ছেলেদের পড়ার সুবিধা করে দিতে পারে। এভাবে নিজের কামনাকে সামাজিক রুপ দেওয়া যায়। প্রাচীন যুগের একটি উদাহরণই দিই। কারো মাংস খাওয়ার ইচ্ছে হলে তাকে বলা হত মাংস যদি খাবেই ত যজ্ঞের  রুপ দিয়ে খাও৷ যজ্ঞ কর মানে অন্যকে খাইয়ে যজ্ঞশিষ্ট হও। মেয়েরা ঘরে এরুপই করে। পিঠা-পায়েস খাওয়ার ইচ্ছে সবারই। পিঠা বানায়, সকলকে আগে পরিতৃপ্ত করে খাওয়ায়। অবশিষ্ট যা থাকে তা নিজেরা খায়। বলতে গেলে তাদের ভাগে পড়ে খাটুনি। মেয়েরা এভাবে নিজ বাসনাকে পরিবারব্যাপী রূপ দেয়। কর্মযোগে এই হচ্ছে কামনা নাশের উপায়। ব্যক্তিগত বাসনাকে সামাজিক রুপ দিতে হবে, তার মানে ব্যাপক হতে হতে তা মিলিয়ে যাবে। এই হচ্ছে এই প্রক্রিয়ার লক্ষ্য। 
মনের নানা বাসনার মধ্যে কোন বাসনা সকলের চাইতে প্রবল তা দেখে নিতে হবে। অন্য সব বাসনা ত্যাগ করে এই একটিতে মগ্ন হতে হবে। মন তাই নিয়ে একাগ্রতা আনতে হবে। ধরুন কোন বিদ্যার্থীর নানা বাসনার মধ্যে বেদাধ্যয়নের ইচ্ছা একটি। অপর সকল বাসনা হতে তা তার প্রবল। সে গুরুগৃহে গিয়ে থাকবে, যা জোটে খাবে আর বেদাধ্যয়ন করবে। ফলে মিষ্টি খাওয়ার বাসনা তাঁর মরে যাবে। এভাবে নিজের প্রধান বাসনা যে কি তা নির্ণয় করে সেভাবে সমগ্র জীবন রচনা করা হচ্ছে মূল উপায়। বিদ্যার ইচ্ছা যার তীব্র এমন বিদ্যার্থীতে আমরা তা দেখতে পাই। অন্য সকল বাসনা নিগ্রহ করে বিদ্যার জন্য সে কষ্ট সহ্য করে। "সুখার্থিনঃ কুতো বিদ্যা, কুতো বিদ্যার্থিনঃ সুখম্" এরুপ কথাই ব্যাসদেব বলেছেন। আমরা কিন্তু বিজ্ঞাপন দিয়ে বলি যে আমাদের ছাত্রাবাসে সুখ সুবিধা ও বিদ্যা দুইয়ের ব্যবস্থা আছে। এই কথাটাই ভুল। সুখের দিকে মন দৌড়ায় ত বিদ্যায় মন বসবে না। নিজ বাসনাসমূহের বাছ-বিচার কর। তার মধ্যে যেটি সর্বাপেক্ষা প্রবল তাতে একাগ্র হও। ভৌতিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে আজকের বিজ্ঞানীরা তাই করেন৷ নিজ নিজ পরীক্ষায় তারা সমস্ত শক্তি ও অভিনিবেশ করেন৷ এরই নাম ধ্যান-যোগ। অন্য সকল বাসনা সরিয়ে দিয়ে মন এক বাসনায় কেন্দ্রিত করতে হবে, পরে তা থেকেও উঠিয়ে নিতে হবে, এরুপই এই উপায়। একাগ্রতা লাভ পরে সেই বাসনাও ত্যাগ করে মুক্ত হতে হবে। (ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments