গুচ্ছ কবিতা
অমিতরূপ চক্রবর্তী
আকন্দ
স্বপ্নে একটি উঁচু টিলা থেকে তুমি নেমে আস। হেঁটে আস অত্যন্ত ধীরে। গোদ ধরলে মানুষের পা যেমন ফুলে যায়, তোমার পা দুটোও তেমনি ফোলা। হাঁটার গতি দেখে মনে হয় তারা প্রচণ্ড ভারী-ও। স্বপ্নের ভেতরে কাকভোরের রঙ। হিঁ হিঁ করা গাছগুলোর ডালে কচ্চিৎ দু-একটি নিরালম্ব পাখি। তারা ঠোঁট গরম চুল্লির মতো ফাঁক করে ডাকে। গোটা স্বপ্নে কেমন একটা স্বাদহীন কুয়াশা। ইউরিনালের ঝাঁঝ। সাবেক সিনেমাহলের মতো কয়েকটি ছন্নছাড়া বাড়ি। তাদের দরজা– জানালা বন্ধ।তুমি হেঁটে একটা লক্ষণরেখার মতো রেলপথ পেরোও।তারপর সাদা, শিথিল একটা পঞ্চাশোর্ধ মাঠ। চোরকাটা তখনই লেগে যায় তোমার অদৃষ্টে। সেফটিপিন দিয়ে আটকানো চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে ফিনকি দিয়ে বেরোয় রক্ত।
চুল্লির মতো ঠোঁট ফাঁক করে যে পাখিগুলো ডাকে কীসের একটা শব্দ পেয়ে যেন উড়ে যায়। তখন একটি পুরুষ তোমার ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে পাজামার গিঁট খুলে সেইসব গাছের একটার গোড়ায় দাঁড়ায়। ছাদ থেকে ম্যাস্টিকের রাস্তায় জল পড়ার শব্দ হয়। দীর্ঘ একটা সময় কেটে যায় অথচ সেই জল পড়ার শব্দ ফুরোয় না। পুরুষটি সে-সময় ঘাড় ভাঁজ করে আকাশে তাকিয়ে থাকে। আকাশে ময়লা থানের মতো মেঘ। মাঝে মাঝে তাদের ঘূর্ণীর মতো জরায়ু। এইসময় আমি তোমার ভেতরের অনেকটা দেখতে পাই। লাল সিন্থেটিক কাপড় দিয়ে ঢাকা নিলয়ের একপাশ, মোম রেখে রেখে ক্ষতবিক্ষত খাদ্যনালী বা পিঠের দিকের চাপা প্যাসেজ। শুধু দেখতে পাই না কোনও আলোর উৎস কোথাও প্রয়োজনের মতো ঝোলানো রয়েছে, কোনও আলোর উৎস অথবা সংশ্লিস্ট একসেসরিজ।
চাদরের আড়াল থেকে আমার পা বেরিয়ে আছে এমন স্বপ্ন দেখার সময়। আমার কষাটে দুটো পা। এই দুই পায়ের সংযোগস্থলে যে ক্ষুদ্র জন্তুটি সেও আমার গলার নীচ দিয়ে উঠে এসে এই স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিব্রত বোধকরে গাছের গোড়ায় দাঁড়ানো পুরুষটিকে দেখে। হাতে ভর দিয়ে রাখা অনিন্দিত মাংসটি দেখে। আমি টের পাই ও লজ্জাবতী পাতার মতো কুঁকড়ে যাচ্ছে আর ওর ভেতরে কটর কটর করে ডাকতে শুরু করেছে ব্রহ্মাণ্ডের ঘূণপোকা। স্বপ্নে তুমি আমার দিকে আরও এগিয়ে আস। এইসময় তোমার শাড়ির কলকাগুলো বোঝা যায়। স্টিলের পাতের ওপর বড় বড় কানপাশার মতো কলকা, যার বেশি আমি আর কোনওদিন দেখতে পারি নি। কুমীরের মুখ থেকে মাটিতে উঠে আসার জন্য কত ছটফট করেছি– তাও পারি নি। একসময় সব জলস্তর শান্ত করে পুরনো লোহার সিন্দুকের মতো তলিয়ে গেছি।
কলাপ
কিছু লোক থাকে, তাঁদের পাঁপড়ের মতো জামা। একটা শতাব্দীর মৃত্যু হবার পর আরেকটা কোমল শতাব্দীরও মৃত্যু হয়। অথচ পাঁপড়ের মতো জামা পরা লোকগুলো অবিক্ষত থাকেন। এই লোকগুলো খাড়া পাহাড়ে ওঠেন। একটা পামগাছের গায়ে তাঁদের দৈব করতল রেখে বুক ভরে শ্বাস নেন। দেশ আবিষ্কারের যুগ থেকে প্রচ্ছন্ন বাতাস এসে ওঁদের চুলের ঘাম শুকিয়ে দেয়।তাঁরা দেখেন কী ন্যাক্কারজনক ভাবে ঈশ্বরের লোমশ লেজটি ধবধবে আকাশের ফুটো গলে বেরিয়ে এসে ঝুলছে।তাঁরা মনে মনে একটা স্ত্রী গুরুজঙ্ঘাকে কোমরে চাপর দিয়ে নিরীহ ছাগলের পালের মতো তাঁদের ইপ্সিত পথে ছুটিয়ে দেন। এইসব ছাগলগুলো একটা বলশালী গাড়ির সম্মুখে পড়ে ছত্রাখান হয়ে ব্যা ব্যা করে ডাকতে থাকে। সূর্য তখন টুক করে নেমে যায়।বর্তমান শতাব্দীর অসমান ঘরবাড়িগুলোয় নানারকমের আলো জ্বলে উঠতে থাকে।সরু, আয়ত কিম্বা তেরছা সব আলো। খাবারের তীব্র সুগন্ধ বোমারু বিমানের মতো দল বেঁধে উড়ে যায় কোনও শুকনো নদীর দিকে, পরলৌকিক খিদের দিকে অথবা অবাস্তব সব ভাসমান কল্পবিশ্বের দিকে বা কাসপেরিয়ান গণপতিতে বিশ্বাসী এমন এক সমাজ বা দেশ বা সভ্যতার দিকে।
এই লোকগুলো তখন তাদের লাইটহাউসের মতো মাথাটা খুলে নামিয়ে আনেন। সযত্নে ফুঁ দিয়ে দিয়ে পরিষ্কার করেন চোখের কোণ, কপালের ভাঁজ অথবা অবতল গালে লেগে থাকা ধুলোবালি কিম্বা ছাইয়ের কণা।স্কন্ধকালীন থাকার সময়ই তাঁরা বোঝেন স্ত্রী-নিতম্ব আসলে একটা নির্বোধ বেলুন।কোনও প্রজ্ঞা নেই তার। কোনও মস্তিষ্কও নেই। তারা কিছু রূপকথা ভালবাসে। অলীক চাঁদের জ্যোৎস্নায় স্বেচ্ছায় উলঙ্গ হয়। বললে আলম্ব থেকে তাদের তণ্বী একটা পা-ও তুলে দেবে কার্নিসের বাইরে নমনীয় শূন্যতায়। লোকগুলোর দৈব করতলে পাম গাছের রক্ত শুকিয়ে আসে।পাতাগুলো সিগারেট খোলের মতো গুটিয়ে যায়। লোকগুলো নিজের আত্মার দিকে চেয়ে দেখেন আর ভাবেন তাঁদের পূর্বপুরুষেরা কিরকম শুধু ছেলে ভোলানো খেলনার অন্তর খুঁটিয়ে দেখতেই দেখতেই ঢিবি হয়ে গেলেন। লোকগুলোর নিম্নাংশ, প্যান্টের ফোল্ড বাতাসে আত্মগোপন করে দোলে। লোকগুলোর পোড়া কাঠের মতো শরীরে ঘন সাদা সাদা আঠা চুঁইয়ে বেরিয়ে আসে। তাঁরা আরও একবার আন্দাজে দেখে নেন একটি নগ্ন সরল বেলুনের মতো স্ত্রী-নিতম্ব একটা সোনালি জালকে প্রশ্রয় দিয়ে ক্রমশ বড়, আরও বড় হতে দিচ্ছে।
হাউই
তোমার হাতার নকশায় একটা মাছি বুঁদ হয়ে বসে আছে। বিচিত্র মাথা, চুলের স্থাপত্য আর অদৃশ্য মস্তিষ্কের চলাচলের ফাঁক দিয়ে নজর করলাম। মনে হল মাছিটি তোমার মর্বিডিটির সংকেত। তোমার যে পটলাকার মাংস, যাতে হাত দিলে হাত ম্যাগেলানের জাহাজের মতো ঘুরে তার পূর্বের বন্দরে ফিরে আসে– তা একদিন কোথাও না কোথাও গিয়ে করজোরে আত্মসমর্পণ করবে। মাছিটি যেন তারই সংকেত হয়ে উড়ে এসে তোমার সুতোর নকশা করা হাতায় বসে আছে। তার নীচেই তোমার জলের মতো প্রবহমান ত্বক। খাদ অনেকটা বেশী দেখে সেই জল খরস্রোতা নয়। তুমি মানুষের সঙ্গে খানিকটা পাথরের মিশ্রণ হয়ে বসে আছ। গ্রীবাদেশ বেশ টান। থুতনি পেরলে ঠোঁট, তপ্ত নাক এবং আরও সব অন্য রূপকথা। যেদিকে তুমি দেখছ সেদিকে একটি হাউই-এ আগুন ধরানো হচ্ছে। যাঁরা ধরাচ্ছে বা ধরাচ্ছেন তাঁদের আমরা চিনি। আজ তাঁদের পরনে সাদার মধ্যে অভ্রের রেখা বসানো পোশাক। মৌন শিশ্নের ওপরে জলপাই রঙের প্যান্ট ও ঋজু জিপার। হাউইটি এখন উড়ে যাবে, এই হাউইয়ের আগে যে আরও একটি হাউই– সেও উড়ে যাবে। যদিও দুটোই একসঙ্গে উড়বে কিন্তু সমবেত এই মাথা, চোখ আর মস্তিষ্কের কার্যকারিতা একটি হাউইকেই মাত্র দেখবে।
যেমন তুমিও দেখবে, যেমন আমিও দেখব। একটিই হাউই বাতাস দিয়ে আলোর প্রতিসরণ ধরে উড়তে উড়তে কোথায় যেন উঠে যাচ্ছে। এই সময়টা যদি কৃষ্ণাঙ্গ হতো তাহলে ওই উড়তে থাকা হাউইটিকে মনে হতো একটি চলমান নক্ষত্র। এই যে একসঙ্গে করতালি ঝরে ঝরে মাটিতে পড়ছে– তাদের মনে হত ওই হাউইটির রেখে যাওয়া আপামর ছাই। কিন্তু দিনের প্রভা তার হাতের মশাল উঁচু করে ধরে রাখায় তেমন কিছু মনে হচ্ছে না। আরে! তোমার হাতায় বসা মাছিটি কোথায় গেল? চারপাশে তাকালাম। দৃশ্যমান মানুষের সুবিদিত মর্ত্যলোক। চতুষ্পদ সরীসৃপের জিভের মতো সব টু-লেন রাস্তা। তাদের ওপরে কর্মমুখর মানুষ। যৌবন বহন করতে করতে ক্ষয়ে যাওয়া, ডেবে যাওয়া সব স্যান্ডেল। ঘামের পেছনে এক একটা নিজেদের মতো দেহ। তাদের জানালা, উঠে বা নেমে আসার আলাদা আলাদা সিঁড়ি বা রাসায়নিক ঘর। এরাও তো আমাদেরই মতো। তোমার আমার মতো গ্রীবার ওপরে ফুটে থাকা কেউ। এদের আকাশও কি আলোড়িত নয়? হাউই কি এরাও ছাড়ে না? একটি গোচর এবং একটি অগোচর হাউই? তোমার ঈষৎ ঢিলে ত্বকে এখন নদীর মর্বিডিটি। পটলাকার মাংসের ভেতর হয়তো অন্য চিন্তা, হয়তো দূরতম বাঘের সুমিষ্ট শিস। হাইউ উড়ে যাচ্ছে এখনও আলোর প্রতিসরণ বরাবর। অভ্রের রেখা বসানো পোশাক পরা মানুষদের কেউ তাঁর নিজেকে নিয়ে পালিয়ে আসার স্মৃতিচারণ করছেন।
হাউইটির অনেক ওপরে অথবা হাউইটির অনেক নীচে।
0 Comments