জ্বলদর্চি

গুচ্ছ কবিতা/ বিকাশ চন্দ

ফোটোগ্রাফি - সৈয়দ স্নেহাংশু 


গুচ্ছ কবিতা 

বিকাশ চন্দ

নীল চাঁদে অরূপ নির্মিতি

বালিয়াড়ি চেনে না সমুদ্র চেনে ফণি মনসা ঝোপ
কতকাল টেনেছে শরীর কামটের দাঁত
কালো কাঠ ছড়িয়ে শ্মশান চিতা সম্পর্ক পরম্পরা
নিভু নিভু গ্রহ নক্ষত্র জানে হৃদয় জোড়া
এ সময় ঘিরে আছে পাষান প্রাচীর
তবুও কি সুখে জোনাকি নাচে প্রেম রোষে
প্রতি রাত ভাষালোকে কাঁপে জলজ বাতাস
ছদ্মবেশ হীন সময়ে এ কেমন আত্মার বিবশ বিশ্রাম। 

অবিনশ্বর মহাকাল জানে জীবন আর মুক্তি
ঘিরে আছে অপূর্ণ প্রেমালাপ মগ্ন অবসাদ
পাখি ফুল গাছেদের অলৌকিক প্রার্থনা আজও
জীবন মরণ পাশাপাশি মধ্যে ব্যাকুল চরাচর
মুক্তি খোঁজে সমুদ্র শালিক গাঙচিল আকাশ মহিমায়
মোহনার ভাঙ্গা সেতু শরীর ছুঁয়েছে জন্ম সাঁকো 
মরা স্রোত গা ভেজায় আত্মমগ্ন চাতক পরিহাস
নদী নারী উচ্ছলতা যদিও জানে এ সময়ের নীল নির্মমতা। 

সকল নারীর শরীরে বেড়ে ওঠে সকল অধিষ্ঠাত্রী
উৎস মুখের জারিত গল্পে কেন হবে মন্দ স্রোতা সুর
চিরন্তন আত্ম কৃতি ডাকে পূর্ণিমার নীল চাঁদে অরূপ নির্মিতি।          


বোধন ডহর শালুকের মা

এদিক ওদিক মাথা তুলে গ্রাম দেখেছিল
মাংসাশী পশু আর মুখ বাঁধা মানুষের বেয়াড়া হিম্মত
কেউ কেউ বলেছিল শেখাবো রাজনীতি সহবত
কতটা ছিন্নমূলে বিষ মাখা তীর দেহে নক্সি কাঁথা বোনে
গর্ভ মুখ ছিন্ন হলে ক্ষতি নেই
কতগুলো নিভৃত কষ্ট রক্ত মাখবে
অনুগত রক্ত বীজ পায়ে পায়ে হেঁটে রাজ সিংহাসন
হা হা উল্লাসে কাঁপে থর থর দুর্গম প্রাসাদ। 

আরও কতটা কেনা বেচা হ'লে
পুনর্দখলে আসবে প্রজাপতি পরাগ মুকুর
প্রেরণা হীন হলে থমকে যাবে শেকড়ে জন্মকাল
সাজানো সংসারে আলো অক্ষরে
বেমানান চালচিত্র মুখচ্ছবি দোমড়ানো প্রচ্ছদ
ঠিক আছে সময় হাত তুলে দাঁড়িয়ে মুখোশ
সমানে চোখ মুখে বীভৎসতা সতর্ক বশংবদ
বাধক সময়ে দীর্ঘ বৃক্ষ কাল শেকড়ে মাটি জল খোঁজে। 

পোড়া কপালির উজ্জ্বল সিঁথি রঙ দেখে সূর্য---
প্রতি দিন জন্ম সূর্য মাখে নুন বন ঘরে পান্তা মাখে সুখ
পাতা পত্র ঘাস মাটি ধরে রাখে শ্বাপদের শ্বাস---
কতটা প্রয়োজন নিরাপদ সে জানে বারুদ বিলাস
জননী যন্ত্রণা বোঝে বোধন ডহর শালুকের মা। 


শ্যাওলা রঙের গায়ে

সে কোন মানবী তার অন্তর পুড়ে শব্দ আলোময়
অনেকবার বেদনা যত বুক ভেজায় হৃদয় পোড়ায়,
গোনাগুনতি সময়ে পরিযায়ী পাখি প্রেম---
ছড়িয়ে ফেলেছে পালক এ কেমন স্বজন হত্যা লীলা, 
কাগজে কলমে সকরুণ জন্ম গোলক অরূপ রিক্ত বিলাপ
কত ফুল কত মৃত্যু হিসেব কাগজ কলমে হরিণী সংলাপ। 

ছিন্ন শরীর হাড় মাংস মজ্জা বক্ষ কুসুমে অমৃত ঢেউ
প্রত্ন মর্মর ভাঙেনি ক্ষত বিক্ষত আমার ভায়েদের প্রিয় হাসি
শ্যামল শরীর কোথায় লুকিয়ে চরাচরে চৈতন্য লীলা,
আজন্ম সকল জননী জানে নম্র অশ্রুদান
ছড়িয়ে ছিটিয়ে কত না জীবন অহরহ নিঃসাড় দেহ
প্রেম নেই কান্না নেই যন্ত্র গণক জানে আবহমান সাম গান। 

প্রিয় সময়ের পাখি শিস দিয়ে দেখে ছিল আকাশের নীল
সবুজ গাছেদের কথা ছিল ফিরে যাওয়া ছায়া ছায়া গ্রামে,
রাতে পাড়ার উঠোনে কেরোসিন লণ্ঠন হাতে কোজাগর পুরুষ   
কোটরগত চোখ উজ্জ্বলতায় সহস্র কালের ভাষা, 
রম্য রোষে কেঁদে ছিল শরীর থেকে খসে পড়ে গোপন সংলাপ
ছায়াময় কোমল আলো মিশে যায় শ্যাওলা রঙের গায়ে। 


লালন গানের শ্লোকে

কেমন জ্বালা চোখ পুড়ছে মুখ পুড়ছে---
উঠোন দালান সাত বস্তি উঠোন পুড়ছে, 
মানব জমিন ঘাস কুটো খড় সরিয়ে নিজের জন্য---
তাও আবার ভারী বাতাস অসময় বৃষ্টি,
কার ঘর কার উঠোন ছিন্নভিন্ন জীবন্মৃত সাধ---
জাত বিজাতের খোল নলচে নামছে পাতাল গহ্বরে
রঙ লেগেছে নিখুঁত হিসেব পছন্দ সই বৃত্তে। 

চিতা খাচ্ছে আগুন আগুন মৃত মুখ---
কিছু মৃত্যু লৌহ শলাকা জানে কিছু মৃত্যু আশ্চর্য কৌতুক, 
কিছু ঘাতক পাহারাদারের কক্ষে
কিছু মৃত্যু নিঃসংকোচে আড়াল ধর্ষক ধর্ষিতা বয়ান,
সব বোঝে পৃথিবী মানুষ জল মাটি ঘাস
অসময় জানে না বিপন্মুক্ত নাভিশ্বাস---
রামলালা আঁতুড় ঘরে ব্যস্ত সাধু সন্ত শুভ্র প্রস্তর কক্ষে।

কোথাও থমকে জানে অবধূত সে ঝড়ের প্রহর---
পদ্মমণির লোভে ব্যস্ত যত মেলামেশা অনুরাগ,               
হৃদয়পুরের বাসিন্দা বোঝে কেউ নেই মৃত গ্রহ লোকে     
আদি সে জনক জননীর চোখে অভিমান যদি দেখে কেউ---
পাথর ফাটলে জাগে জন্মকালের আলো। 
একতারায় তরঙ্গ তোলে জীবন জাগানিয়া
পদ্মা মেঘনা গঙ্গা জল তরঙ্গে সুর লালন গানের শ্লোকে। 


বন্য বিদায় বেলা

হেমন্ত শীতের মাঠে লুকিয়ে ছিল ভাত পরবের গান
পৃথিবীর বাসনা স্থির শোক মগ্ন অন্তর্গত কথা, 
মেঘ জানে গর্ভ ভারে কোথাও নেই বৃষ্টির অন্তর দাগ
কোন রাতে জাগে দহন বেলা ঘরময় বিষ্ময় বাগান। 

মানুষের ইন্দ্রিয় রোষ এদিক ওদিক অন্যতর কিছু
ময়াল পিঁড়ি পিষে দেয় মায়াময় খরগোশ শরীর, 
তখন গোধূলি আকাশে চমৎকার রামধনু আলো সিঁড়ি
শূন্য সোঁতা নদী বুকে খেলেছে একা চকমকি ভিখিরী আলো। 

শূন্য ঘাট মরা গলি শেষে বিসর্জন দেখেছিল একা যোগিনী বেলা
গোপন ঘরে বন্দী ছড়িয়ে ছিটিয়ে লোপাট সংসার রিক্ত ব্রজবুলি,
কোথাও ময়ূরপুচ্ছ এক ছড়া নুপূর চিটচিটে রক্ত বসন    
গাছেদের ছায়া তখন জলের গভীরে শ্বাসহীন লজ্জা নিশ্চুপ। 

কত না সংযম জানে এলোমেলো বৃষ্টি বাতাস ছিন্ন পাতা ফুল
শরীরে তোর চিতার আগুন আপনি জ্বলে অন্যে পোড়ে, 
নিজের শরীর আপিনি দেখে বিষের মতো গাত্র দ্রোহ নীল
হঠাৎ দু’কুল জোড়া বন্য বিদায় বেলা পৃথিবীর রঙ খেলা।       

   


Post a Comment

0 Comments