জ্বলদর্চি

পুজোর গদ্য / সন্দীপ কাঞ্জিলাল

অলংকরণ - প্রান্তিকা মাইতি


"দেবতারা শত্রুকে মারতে গেলে, মুখে হাসিটি লাগিয়ে রাখে। ঐ হাসি দেখে মজেছিল  নির্বোধ মহিষাসুর। তার পরিণতি সবার জানা। ইন্দ্র ধর্ষণ করলে তাঁর দেবত্ব যায় না। আর ধনঞ্জয়ের হয় ফাঁসি।"

স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল

পুজোর গদ্য 


আমার বাড়ির কাছে একটি একান্ন বছরের ক্লাব। নাম হচ্ছে 'বারো-ইয়ারী' সংঘ। অবশ্য এ নামটি হয়েছিল বারোজন বন্ধু মিলে ক্লাবটি প্রথম তৈরি করেছিল বলে। তাতে আমার বাবাও একজন সদস্য ছিলেন। তাঁরা যে কয়েকজন মিলে ক্লাব করেছিলন, সেটা আর কিছু নয় সন্ধ্যাবেলা কোথায় আর আড্ডা দেবে, একটি নির্দিষ্ট জায়গা থাকলে সন্ধ্যাবেলা বসে তাস খেলা গল্পগুজব আর বিড়ি খাওয়া যাবে। কারণ বাবা মাঝে মাঝে বলতেন- "পঞ্চ ভূতের ফাঁদে পড়ে ব্রহ্মা কাঁদে।" অবশ্য তাদের মধ্যে কেউ এখন বেঁচে নেই। সবাই ভূত হয়ে গেছে। এখন সেই ক্লাব ফুলে ফেঁপে ঢোল। কিছু একটা পেলেই সে ঢোল বেজে উঠবেই। এই ক্লাবের আমি এখন সভাপতি। তার কারণ যেহেতু আমি শিক্ষক, একটু জ্ঞানগম্যি আছে। তাছাড়া মালও বেশ সটকানো যাবে। এখন আর সেদিনের ক্লাব নেই। সে এখন ফ্লাব হয়ে গেছে। যাকে ইংরেজিতে বলে FLABBY. অর্থাৎ চঞ্চল। সংক্ষেপে ফ্ল্যাব। আর এদের কাজকর্ম Flabber gasted। তার মানে স্তম্ভিত, বিস্মিত। 

সেই ক্লাবের কিছু ছেলে এসে বললো, কাকু আপনাকে আজ সন্ধ্যাবেলা একটু ক্লাবে আসতে হবে। আমি তখন বললাম- কেন বলো? 
-কাকু, আমরা এবছর ক্লাবে দুর্গাপূজা করবো। আমি তখন চমকে উঠে বলি, হঠাৎ তোদের এ শখ কেন? তাদের মধ্যে একজন বলল- কাকু আমরা পুরোনো ক্লাব। তাই সরকার ৫০,০০০ টাকা দিয়েছে, পূজা করার জন্য। ----তোদের কি সবাই রাজি?- না, তবে কয়েকজন বলছে এই করোনা কালে না করাই ভালো, তবে সেটা হাতে গোনা কয়েকজন। মনে মনে ভাবলাম-  এ তো তেরশো ন্যাড়া আর বারশো নেড়ীর গল্প। সেই যে নিত্যানন্দ গোস্বামীর ছেলে বীরভদ্রের তেরোশো ন্যাড়া শিষ্য ছিল, তাঁরা সাধনবলে সিদ্ধিলাভ করে সাধন পুরুষ হয়ে উঠলো। লোককে যা বলবে তাই ফলবে। কেউ যদি না জেনে বুঝে অন্যায় করে, তবে তাদের এরা অভিশাপ দেবে। বীরভদ্র তখন তাদের জন্য মেয়েছেলের ব্যবস্থা করলো। একশো জন বিয়ে করতে রাজি হলো না, তাঁরা স্বাধীন থাকতে চাইলো। আর বারশো বিয়ে করে, সংসারী হতেই তাদের বল আর স্বাধীনতা দুই-ই গেল।এ হচ্ছে সেই গল্প। যুবকদের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে তাদের বলবুদ্ধিহীন করে দেওয়া।

আমি তখন তাদের বললাম- দ্যাখো, এই করোনা কালে না করাই ভালো। কারণ এতে সংক্রমণ আরো ছড়াবে। কিন্তু এই যে কথায় আছে না- "চরা না শুনে ধর্মের কাহিনী", তারা পূজা করবেই। শেষে বললাম আচ্ছা বলতো, অকালবোধন রামচন্দ্র না হয় সীতা উদ্ধারের জন্য করেছিল, তোমরা কিসের জন্য করবে।তাদের একজন বললো, কাকু ওসব ছাড়ুন তো, এই পূজার কয়েকদিন সবাই মিলে একটু স্ফূর্তি-ফার্তা হবে আর কি। ফকটিয়া কিছু টাকা পেয়েছি, আর কিছু কালেকশন করে নিলেই হবে। দেখলাম এদের সঙ্গে পারা যাবে না। কারণ এই যে, যারা উঠতি প্রেমিক, যারা এখনও ম্যাচিওর নয়, তারা ভালোবাসতে গিয়ে বলে- I Love You because I need you. এদের দুর্গাপূজার প্রয়োজন কয়েকটাদিন ফূর্তির জন্য, তাই তারা পূজা করবে। 
পৌরাণিক কাহিনির থেকে দুর্গাপূজার শুরু। ক্রমশ যেন আমাদের ঘরের মেয়ে হয়ে উঠছে দুর্গা। তাই বিয়ের জন্য কোনো মেয়ে দেখতে গিয়ে যদি দেখি গড়ন সুন্দর, আমরা কথায় কথায় বলে উঠি একদম দুর্গা প্রতিমার মতো দেখতে। তাছাড়া দুর্গা সুন্দর হবে নাই বা কেন? আমরা যদি চণ্ডীর দেবী নির্মাণের কথা ধরি, তাহলে দেখতে পাবো- একটি বিশেষ কার্যসিদ্ধির জন্য তাঁকে বানানো হয়েছে। দুর্গা একজন নারীবেশী যুদ্ধাস্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। যাতে অসুররা তাকে দেখে প্রলুব্ধ হয়। আর হবে নাই বা কেন! আমরা মানুষেরা কোনো সুন্দরী মেয়ে দেখলে হাঁ করে তাকিয়ে দেখতে ভালোবাসি। আবার কেউ যদি শিক্ষা বা রুচির জন্য বা  লোকে কি বলবে ভেবে না-ও দেখে, পরে আপশোষ করবে। ঈস কী সুযোগটা না হারালাম। আবার তারাই কিন্তু স্মার্টফোনে রাতে শুয়ে শুয়ে নগ্ন নগ্ন ছবি দেখে। কেউ আসছে পায়ের শব্দ শুনলে, খপাস করে বন্ধ করে দেয়। মানুষ একটু পালিশ করা বলে, মেপে জুখে চলে। আর অসুরদের তো কোনো পালিশ নেই। তারা খুল্লাম-খুল্লা,ধর তক্তা মার পেরেক গোছের। 

যাক সে কথা। মোটামুটি যা জানা যায়, দুর্গা সৃষ্টি হয়েছিল, বড় মাছ ধরতে যেমন টোপ লাগে, ঠিক সেভাবে। আবার দেবতারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল। এ যেন অকর্মণ্য পুরুষের একটু ভালোভাবে থাকার জন্য মেয়েদের বাজারে ছেড়ে দেওয়া। যারা অসৎ উপায়ে প্রচুর টাকার মালিক তাদের পকেট ফাঁক করে, যাতে নিরাপদ জীবন কাটানো যায়। 
তবে মা দুর্গা অনেক অসুর মেরেছিলেন, মহিষাসুর, রক্তবীজ, চণ্ড মুণ্ড আরও অনেককে। কোনটা মেয়েখোর, কোনটা অসৎ, চোর ইত্যাদি। কিন্তু দেবতাদের মধ্যে কার এসব দোষ নেই? ইন্দ্র তো গৌতমের বউ অহল্যাকে ধর্ষণ করলো, জগতের কালো দূর করা যে চাঁদ সে তো গুরুপত্নীর বিছানায় সুযোগ পেয়ে সেঁধিয়ে গেল। ব্রহ্মার কথা নাই বা বললাম, তিনি তো নিজের মেয়ের সঙ্গে মিলন সারলেন। আবার কুন্তীর বাল্যকালের কথা বেমালুম চেপে তাকে আমরা সতী বানিয়ে তবেই ছাড়লাম। বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। যাক সে সব কথা। ঐ যে ধর্মের ষাঁড় বলেছিল- ধর্ম জিনিসটা ঐ দু- পেয়েদের জন্য। এখন দেখছি সব দু-পেয়েদের জন্য নয়। 

আসলে দেবতাদের আমরা দু- পেয়েদের দলে ফেলি না। তাদের আলাদা বলে ভেবে এসেছি, তাদের বর্ম করে ভেবেছি এ জীবন কাটিয়ে  দেবো। আরে বাবা যদি পূজা করতে হয় নিজেকে কর। প্রণাম করতে হয় নিজেকে কর। নমস্কার করতে হয় নিজের কর্মকে কর-"তস্মৈ নমঃ কর্মণে।" এই যে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের কথা যদি বলো-- ব্রহ্মা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দেখভাল করতে করতে তিনি গলদঘর্ম। আবার বিষ্ণু নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে, কোনোবার শুয়োর রুপ ধরছেন তো কোন সময় কুর্ম, নয়তো মৎস্য আর কত রুপের ঝামেলা পোহাতে হয়। আর শিব? তাঁকে তো বাড়ি বাড়ি ভিক্ষাবৃত্তি করে পেট চালাতে হয়। আবার দেখুন, সমুদ্রমন্থন হলো, নারায়ণ লাভ করলো লক্ষী, আর শিবের জন্য বিষ। আর বেচারা দানবরা বুদ্ধির অভাবে খালি হাতে বাড়ি ফিরলো৷ তাই প্রণাম কর নিজের বুদ্ধিকে আর কর্মকে। 

দৈত্য দানবদের একটা বড় দোষ, তারা ঐ দেবতা বলে কাউকে মানে না। ধর্মের স্তোকবাক্যে তারা ভোলে না, বা ধর্মকে বর্ম ও করতে চায় না। পুরনো জবর জং প্রথা ভেঙে তারা নতুন কিছু তৈরিতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু এটা করতে গেলে যে বুদ্ধি লাগে তাদের তা ছিল না। ভেবেছিল,শুধু দেবতারা কেন স্বর্গ সুখ ভোগ করবে? আমরাও তার ভাগ চাই। তাই তো মাঝে মাঝে স্বর্গ আক্রমণ করতো। কিন্তু দেবতারা ধুরন্ধর। পাকা মাথার সব। তাদের বয়স ও হাজার হাজার বছর। তারা কৌশলে দানবদের অনেকবার তাড়িয়েছে। যাদের তাড়িয়েছিল অনেকে আর পাতালে যায়নি, তারা পৃথিবীতে থেকে গেছে। কিন্তু কয়েকটা বেয়ারা দানব যাদের সঙ্গে দেবতারা এঁটে উঠতে পারেনি, তাদের জন্য ঐ সুন্দরী মেয়ের টোপ। আর দানবদের সুন্দরী মেয়ে দেখলে জিভ দিয়ে জল ঝরে। এ যে টলস্টয় বলেছেন না, যারা কায়িক শ্রম করে, তাদের সেক্স খুল্লাম খুল্লা, তারা সেক্স নিয়ে আদিখ্যেতা করে না। আর যাদের বয়স বেশি তাদের মধ্যে আলস্য ভাব জন্মে, তা থেকে যত উদ্ভট যৌন চিন্তা। সেই জন্যই তো তারা নিজের মেয়েদের ও বাদ দেয়নি। তারা ভোগে পারভারশানে আর সমকামিতায়। 
যেহেতু সব অসুরদের বধ করে দুর্গা হয়েছেন দুর্গতিনাশিনী, তাই তাকে পুজো অঞ্জলি দিতেই হবে। অঞ্জলির মন্ত্রে এক জায়গায় বলা হয়, "আয়ুর্দ্দেহি যশোদেহি ভাগ্যং ভগবতী দেহি মে। ধনং দেহি পুত্রাণ্ দেহি সর্ব কামংশ্চ দেহি মে।" কি বলা হচ্ছে, ভাগ্য দাও, ধন দাও মানে টাকা পয়সা দাও, আর পুত্র দাও।খবরদার মেয়ে কিন্তু দিও না। সেই বিশ্বাসে তো এখন প্রসবের আগে দেখা হচ্ছে, গর্ভে ছেলে না মেয়ে। যদি মেয়ে হয় মেরে ফেলবো। কারণ আমরা চাইছি পুত্র। সরকারি টাকা পয়সা খরচা করে পুজোর মাধ্যমে মাইক দিয়ে প্রচার করানো হবে 'পুত্রান দেহি'। আর সরকারিভাবে সব ল্যাবরোটরিতে বলা হবে কন্যাভ্রুণ হত্যা আইনত দণ্ডনীয়। পুজোর সময় মা বোনেরা বার- ব্রত রেখে পুষ্পাঞ্জলি দিচ্ছে তারাও বলছে 'পুত্রান্ দেহি।' তারাও ভেবে দেখছে না, তারা জন্মেছিল বলেই তো সৃষ্টি অব্যাহত আছে। ছেলের অনুপাতে মেয়ের সংখ্যা যদি কমে যায়, ধর্ষণ তো বাড়বেই।

এখন এই সিজন চেঞ্জের সময় জ্বরের ধুম পড়েছে। আবার জ্বর হলেই করোনার কথা মনে পড়ে যায়। আমার আদরের নাতির জ্বর, তার বাবা মার যত না চিন্তা, বেশি চিন্তা আমার আর তার ঠাকুমা'র। কথায় বলে না আসলের চাইতে সুদ নিয়ে চিন্তা বেশি। ডাক্তার ডেকে ওষুধের ব্যবস্থা করলাম। তার ঠাকুৃমা থেকে থেকে বলছে জয় মা দুর্গা, দুর্গতিনাশিনী তুমি আমার নাতিকে ভালো করে দাও। আমি তখন মনে মনে বললাম, এই হচ্ছে মনুষ্যজাতি, অসুখ হলে ডাক্তারের কাছেও যাবে আবার শীতলা পূজাও করতে ছাড়বে না। তাছাড়া যে দুর্গা নিজের ছেলের অসুখ সারাতে পারে না, হাতির মাথা কেটে এনে বসায়, সে আবার পরের ছেলের অসুখ সারাবে? গণেশ হচ্ছে নাদুস নুদুস চেহারা, মায়ের আঁচল ধরে ঘোরে, থপথপিয়ে চলে, যাকে আমরা কথায় কথায় বলি গোবর গণেশ। আমরা মানুষ তাকেই আবার বলছি সিদ্ধিদাতা। হরিবোল-হরিবোল।

এবার দেখি কার্ত্তিক ঠাকুরকে। সাধারণতঃ কথায় বলি 'রুপে কার্ত্তিক'। আচ্ছা, যদি তাঁকে দেখতে সুন্দর বললাম, আবার কেন বলবো, 'কেলে কার্ত্তিক' বা 'বাঁকা কার্ত্তিক'। আবার রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র কার্ত্তিককে, বাপের হোটেলে খাওয়া রকবাজ ছেলে করে তবে ছেড়েছে।তাছাড়া কার্ত্তিক চিরকুমার। কেন? যাঁর মা বিপদ-তারিনী, যার বাবা 'সত্য সুন্দর' তাঁর ছেলের জন্য মেয়ে পাওয়া গেল না। আসলে কার্ত্তিক এতো সুন্দর নয়, একে দেবতা সুপুরুষ। চিরকুমার বলে চিরনায়ক হয়ে গেলেন। ঘটনা ঘটলো কি, যেই কার্ত্তিক তারকাসুর বধ করে এলো, মা পার্বতী গদ গদ হয়ে বললেন, বাবা কার্ত্তিক, তুমি যা ইচ্ছা ভোগ কর! কার্ত্তিক তখন, যত সুন্দরী মহিলা ছিল জোর করে ভোগ করা আরম্ভ করলো! ত্রিভুবনে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠলো। মা পার্বতী বুঝিয়ে ও পারলেন না। অবশেষে তিনি অভিশাপ দিলেন, "এবার থেকে যে মেয়েকে ভোগ করতে যাবি, তার মধ্যে আমাকে দেখতে পাবি।" এরপর কার্ত্তিক যে মেয়ের কাছে যায়, মা পার্বতীর মুখ দেখতে লাগলেন, বাধ্য হয়ে কার্ত্তিক মেয়েছেলের কাছে যাওয়া বন্ধ করে দিল। এমনকি বেচারা সারাজীবন বিয়ে করতে পারলেন না। তাইতো কোনো মেয়ে যখন প্রথম বেশ্যার লাইনে আসে, তাদের দিয়ে কার্ত্তিক পূজো করানো হয়, যেন তাদের সারাজীবন বিয়ে না হয়। আবার ছেলে না হলেও কার্ত্তিক পূজো করে অনেকে। যেন কার্ত্তিকের মতো ছেলে হয়। সে যেন মেয়েছেলের পিছনে ঘুর ঘুর না করে। 
এবার লক্ষীকে দেখুন। তিনি কিন্তু আসলে শিব দুর্গার মেয়ে নয়। তা বলে শিব দুর্গা কেউ তাকে ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়েও নিয়ে আসেনি। পুরাণে দেখুন যত বেজন্মা তারা কিন্তু জ্বলজ্বল করছে। ঐতো মহাভারতে কর্ণ বলুন, বা পঞ্চপাণ্ডবকে দেখুন। প্রবাদ আছে না 'বেধুয়ার পো সভায় নাচে।' এখন একটু সমাজের দিকে তাকান। স্পষ্ট বুঝতে পারবেন। থাক সে সব কথা। বিষ্ণু পুরাণে আছে ভৃগু নামে এক ঋষি ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর নাম খ্যাতি। এদেরই সন্তান হলেন লক্ষী। আর দুই ভাই ধাতা ও বিধাতা। এর বেশি আর ব্যাসদেব লেখেননি। লক্ষীকে আমরা লোকসাহিত্যে শিবদূর্গার মেয়ে করে ছেড়েছি। বেদে আবার তাঁর জন্ম বৃতান্ত নেই। পুরাণের যুগে তিনি বাপ-মা পেলেন। আর স্বামী হিসেবে পেলেন নারায়ণকে। তিনি বাস করেন স্বর্গের বৈকুন্ঠ লোকে। তাঁর জন্যই স্বর্গে যত সম্পদ, যত শ্রী, পরাক্রম, যত আনন্দ। 
একবার হলো কি, দেবরাজ ইন্দ্র অসুরদের বিরুদ্ধে জয় করে হাতির পিঠে চড়ে ফিরছেন। এদিকে রাগী ঋষি দুর্বাসা ইন্দ্রকে দেখে, তার গলা লক্ষ্য করে একটা মালা ছুঁড়ে দিলেন। আর সেই মালা হাতির শুঁড় ছুঁয়ে মাটিতে পড়তেই, হাতি তাকে মাড়িয়ে দিল। তাই দেখে রাগী ঋষির পিত্তি গেল জ্বলে। অভিশাপ দিলেন, স্বর্গ লক্ষী ছাড়া হবে। লক্ষী স্বর্গে না থাকাতে ইন্দ্রের গদি গেল, দেবতাদের বাবুয়ানি গেল। তখন দেবতারা নারায়ণের কাছে ছুটলেন। নারায়ণ বললেন লক্ষী সমুদ্রে আছেন। তাই সমুদ্র মন্থন করে তাকে তুলতে হবে। সমুদ্র মন্থন হলো। দেবতারা যা পাওয়ার পেলেন, অসুরদের কপালে কচুর আঁটি। সেই থেকে অসুররা ভাবে, আমরা সর্বহারা, শোষিত, নিপীড়িত। এইজন্য রাগে আন্দোলন করে,স্ট্রাইক ডাকে,আবার তারা যখন খুশি স্বর্গ আক্রমণও করে বসে।

সরস্বতীর জন্ম আবার রহস্যে ভরা। ভাগবত পুরাণ বলছে- শুম্ভ ও নিশুম্ভ দুজন দৈত্য একবার স্বর্গে তাণ্ডব চালায়। তাদের হাত থেকে রক্ষার জন্য চণ্ডীর দেহ থেকে জন্ম হয় এক দেবীর, যার নাম কৌষিকী। তিনিই আবার সরস্বতী। বায়ুপুরাণ বলে মহাদেব একবার পাপে পরিপূর্ণ পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেন। ধ্বংসের পরে ব্রহ্মা সৃষ্টির বীজ বপন করতে গিয়ে দেখেন, পৃথিবীতে জ্ঞান শিক্ষা দরকার। তাই তাঁর অন্তর থেকে জন্ম নিলেন এক দেবী, যার নাম সরস্বতী। পদ্ম পুরাণ মতে, সরস্বতী দক্ষরাজের কন্যা। কাশ্যপ মুনির পত্নী। ব্রহ্মবৈর্ত পুরাণ মতে তিনি আবার নারায়ণের ঘরণী। যার সতীন আবার গঙ্গা। যিনি আবার মহেশ্বরের উপপত্নী। তাহলে তিনি আবার শিবদুর্গার মেয়ে হলেন কি করে? ঐ যে বাবু বলেছেন তাই আমরা মানছি। কারণ বড়োলোকদের দোষত্রুটি ধরা চলবে না। তাঁরা যা বলে বেদবাক্য। মানুষ জন্ম থেকে তাঁরা অপরাধী, এই ভাব ধর্মের মাধ্যমে জাগিয়ে তোলা হয়। জন্ম হয়ে কেউ তো অপরাধ করে না। কিন্তু আমাদের বলা হয়, শেখানো হয়, তুমি যেহেতু মানুষ, তাই তুমি অপরাধী। আর এই অপরাধ সব ক্ষমা করতে পারে একমাত্র দেবতা। তাই দেখেবেন,বড় বড় নেতা হাতে লালডুরী, মাথায় কপালে টিপ। একজন এর মন্দিরে ঢোকেন যদি, অন্যজন ঐ দেবতার মন্দিরে যান। নেতারা বলেই দিচ্ছে তারা অপরাধী। কিন্তু আমরা তা বুঝতে চাইছি না। 
এবার আসি শিবের কথায়। এই আশুতোষ দেবতাটি আত্মভোলা সদানন্দ। যখন তখন তিনি আবার অসুর রাক্ষসদের এমন সব বর দিয়ে ফেলেন, যার কারণে নিজেই পড়ে যান বিপদে। যে শিব দেবতাদের বিপদ থেকে রক্ষা করতে বিষপান করেছিলেন, সেই তিনি নেমতন্ন না পেয়ে দক্ষযজ্ঞ নাশ করেন। আবার স্ত্রীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে পাগলের মতো পৃথিবী ঘুরে বেড়ান। তিনি আবার তপস্যায় বসলে সে তপস্যা ভাঙানো কঠিন। রতিক্রিয়া আরম্ভ হলে তার জের চলে কয়েক হাজার বছর। এই থেকে দেখি তাঁর কখনো নটরাজ মূর্তি, আবার কখনো ভুড়িওয়ালা থপথপে বুড়ো সরল সহজ সদাশিব। আবার তিনি প্রচুর সম্পদের মালিক হওয়ার সত্ত্বেও, ভিক্ষার বাটি হাতে ভিখারি। 

পুরাণ অনুযায়ী ভগীরথ যখন গঙ্গাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসছিলেন, তখন গঙ্গা কিছুতেই আসতে চাইছিলেন না। তখন শিব তাকে মাথায় করে নিয়ে এসেছিলেন। আর এই গঙ্গার জন্য শিবের সংসারে দাম্পত্য কলহ আরো জোরদার হয়েছে। আমরা কথায় কথায় বলি না, লোকটা এমন স্ত্রৈণ, বউকে মাথায় করে রাখে। তখনই শিব তাকে দুর্গার কাছ থেকে আড়াল করার জন্য জটায় লুকিয়ে ফেলেন। শিবের স্ত্রী ভাগ্য এবং পুত্র ভাগ্য দুটোই খারাপ! এক বউ রণচণ্ডী, অন্য বউ যার আবার নিন্মদিকে গতি৷ বড় ছেলেটি হাতির মাথা, ছোটটি আবার মেয়ে দেখলে ভয় করে। কত দেবতার কত সুন্দর সুন্দর বাহন। কার গড়ুর কিংবা হাঁস আরও কত কিছু। শিবের বেলা জুটলো ধর্মের ষাঁড়। মনু বলেছে, "যার গৃহে মাতা নেই, আর ভার্যা অপ্রিয়বাদিনী, তার অরণ্যই শ্রেয়। তাই তো মহাদেব শ্মশানে, বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান। তারপর ছেলে দুটি অকম্মার ঢেঁকি। সে কারণে ঘর ছেড়ে সারা শরীরে ছাই ভস্ম মেখে যেখানে সেখানে শুয়ে থাকেন। সংসার থেকে শিব কে আবার গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে, যার প্রতীক কপালে অর্ধচন্দ্র। তাইতো তিনি সমুদ্র মন্থনে যত বিষ উঠেছিল, তাই খেয়ে আত্মহত্যা করতে গেলেন৷ কিন্তু তাই করতে গিয়ে মনে পড়লো, বউয়ের যাতনা আর সংসারের লাঞ্ছনা না পেলে মানুষের কল্যাণের দিকে মন যায় না। আর তাই করতে পারলে বিশ্বসংসার তাকে ভালোবাসবে। তাই তো তিনি বিষ না গিলে গলায় ধরে রাখলেন। বিশ্বসংসারের দিকে মন দিয়েছেন বলে, তাকে পৃথিবীর মানুষজন বলে,"সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্।"  অবশ্য তিনি যদি মানুষের কাছ থেকে আঘাত পান, তবে আমি নিশ্চিত, গলার বিষ পেটে চালান করে দেবেন। তাই আমাদের উচিত সত্য শিব আর সুন্দরের পূজা করা। যাতে এ জগতে সত্যম শিবম সুন্দরম চিরকাল বেঁচে থাকতে পারে। 

এবার আসি মহিষাসুরের কথায়! দুর্গার পায়ের নীচে শুয়ে ত্রিশূল গাঁথা। পরের ঘরের সুন্দরী মেয়ে দেখলে যার জিভ দিয়ে জল ঝরে, তার এরকমই হওয়ার কথা। এই যে স্যামুয়েল জনসন' বলেছিলেন, "Love is the wisdom of the fool." ব্যাপারটা হলো, মহিষাসুরের দুর্গাকে ভালোবাসার সময় শ্রীমদ্ভাগবতের কথা নিশ্চয় মনে পড়েছিল- "তেজীয়সাং ন দোষায়।" তেজী লোকের কোনো দোষ হয় না। কিন্তু একথা যে দেবতা মুনি ঋষিদের জন্য, সে কথা মূর্খ অসুর বুঝতে পারেনি। ঐ যে রবীন্দ্রনাথ 'লোকহিত' প্রবন্ধে বলেছিলেন, "আমরা ভৃত্যকে অনায়াসে মারিতে পারি, প্রজাকে অনায়াসে অতিষ্ঠ করিতে পারি, গরিব-মূর্খ কে অনায়াসে ঠকাতে পারি- নিন্মতনদের সহিত ন্যায় ব্যবহার করা, মানহীনদের সহিত শিষ্টাচার করা, নিতান্তই আমাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। অপর পক্ষের শক্তির পরে নহে- এই জন্য আমাদের দরকার হইয়াছে নিন্মশ্রেণিয়দের শক্তিশালী করা। সেই শক্তি দিতে গেলেই তাহাদের হাতে এমন একটা উপায় দিতে হইবে যাহাতে ক্রমে তাহারা পরস্পর সম্মিলিত হইতে পারে।" আর সেই কাজটি সব অসুরদের নিয়ে করতে গিয়েই মহিষাসুর  পড়লেন বিপদে। মূর্খ নিন্মশ্রেণীর অসুর তো বোঝে না, দেবতারা শত্রুকে হত্যা করতে গেলে মুখে হাসিটি লাগিয়ে রাখে। দুর্গার ঐ হাসি দেখেই তো মহিষাসুর মজেছিল। যার পরিণতি তাঁর পায়ের তলায় ত্রিশূলবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। দেবতারা অন্যায় করলে, দেবতারা তাদের বাঁচানোর রাস্তা করবেন। যেমন বড় লোকেরা দোষ করলে, এ দেশ থেকে ওদেশে পালানোর রাস্তা একটা হবেই। কারণ তারা তো জানে "যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।" "কাজ ফুরোলে সন্ধ্যাবেলায় মা করিবে কোলে।" কারণ মায়ের জন্য তারা সারাবছর কত টাকা পয়সা সোনা দানা দান করেন। হাতে লালডুরি কপালে লাল টিপ থাকে। ঐ গরীবরা মরে মহিষাসুরের মতো।ইন্দ্র ধর্ষণ করলে দেবতা থেকে যায়, আর ধনঞ্জয়ের হয় ফাঁসি।
না, দুর্গা টুর্গা মানি না। তাই বলে একেবারেই নাস্তিক নই আমি। কোনো ভগবানের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নই তবে পুজো যখন শুধু  ধান,দূর্বা, ফুল না, একটা স্রেফ উৎসব, তখন তাতে সামিল হতে ভালো লাগে স্রেফ আনন্দের জন্য। নানানরকম পোশাক  পরে ঘোরা, ছবি তুলে ফেসবুকে কে কটা লাইকাল/কমেন্টাল দেখা, এসব নির্ভেজাল টাইমপাস। দারুণ উপভোগ্য। কিন্তু দুর্গা বলে একটা দেবী আছে, সে আবার হিমালয়ের মেয়ে। মর্ত্যে আসছে বাপের বাড়িতে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে এসব গাঁজাখুরি গপ্পে মন ভোলানোর ছোটোবেলা গেছে। আামাদের গ‌্যালাক্সির বাইরে কোটি কোটি গ্যালাক্সি আছে।অর্ধেকের খোঁজ আমরা জানি না, পৃথিবী একদিন নিজেই ধ্বংস হবে যখন সূর্যের তেজ চলে যাবে (মানে গোদা বাংলায় হাইড্রোজেন গ্যাসের ফাইনালি পরিসমাপ্তি ঘটবে,শুধু হিলিয়াম লটকাবে)যদি স্টিফেন হকিন্সের কথা মানি তার ও আগেই হয়তো কোনো প্রমাণ সাইজের উল্কা বা মহাকাশের কোনো বাইপ্রোডাক্ট বা ওয়েস্টপ্রোডাক্ট পৃথিবীতে "পথ হারাব বলেই এবার পথে নেমেছি" গাইতে গাইতে চলে আসবে আর সবকিছু শেষ। ভুললে চলবে না,ডাইনোসররা পৃথিবীতে মানুষের (Pliopithecus থেকে আজকের Homo Sapience) চেয়ে অনেক বেশি বছর কাটিয়ে এখন পুরো হাওয়া। 
অতএব কোন এক বিশ্বদেবতা বা  মহাদেবী এই গ্যালাক্সির পর গ্যালাক্সি নিয়ন্ত্রণ করছেন এমন ভাবার কারণ দেখি না।যাঁরা দেখেন, তাঁরা দেখুন...অসুবিধা তো কিছু নেই। সবই কো- এক্সজিসটেন্স, খালি মাঝখান থেকে ভ্যাটিকানের ওপর ভরসা হারাতে শুরু করেছে পশ্চিমের মানুষ। সংখ্যাটা ক্রমশ বাড়ছে। পোপ এখন নিজেই সমাজকল্যাণমূলক কাজ অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছেন ঘাবড়ে গিয়ে।  এদিকে ১৩০ কোটি মানুষের দেশে ৩৩ কোটির দেবতা হয়ে রামরহিম টাইপের বাবাদের শ্রীবৃদ্ধি এবং তাতে আমরা কিন্তু কেউ নাক সিঁটকোবেন না, ও কে? কারণ 'ধর্মই অধর্মের মূলে' এটা আমরা চোখ বন্ধ করে ভুলে যাব। যে বাচ্চাটার গায়ে ঠাকুরের নামকীর্তন করা আজকের অসুর সূঁচ ঢোকাল এতগুলো, তখন দুর্গা কোথায় খড়্গ রেখেছিল সেসব ভাবব না অঞ্জলি দেওয়ার সময়, ও কে? সত্যি কথা বলা দাক্ষিণাত্য দুর্গাকে যখন  আজকের অসুর, চোরের  মতো গুলি করে পালিয়ে যায়, তখন গৌরী লঙ্কেশ  হ্যাশট্যাগ দিয়ে  ধিক্কার জানাবো কিন্তু বিশ্বকর্মার দেওয়া অভেদবর্ম পরে এরপরও আমরা খুঁজবো না, ও কে ?

দুর্গা বাঁচাতে অসেনা সেইসব লক্ষী সরস্বতীদের যাদের পড়াশোনা অকালে বন্ধ হয়ে যায়, পণ বা কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ার অপরাধে পুড়ে যায়, কখনও হেতাল পারেখ কখনও নির্ভয়া কখনও হাথরাসের সেই মেয়েটি বা Mms scandal-এ নিষ্পাপ কৌতূহল বাজারে ঝিঙে আলু বরবটির মতো পণ্যবস্তু হয়ে যায়।

আমার দূর্গা, কর্ণাটকের মস্তানাম্মা যিনি ১০৬বছর বয়সে বিজনেস শুরু করে, রান্না শিখিয়ে ইউটিউবে লক্ষাধিক ফলোয়ার্স পান। অথবা পুরুলিয়ার সেই আদিবাসী মেয়েটা-মালতী মুদি; বা হাথরাসে যে মেয়েটা মারা গেল। অথবা আমার আপনার মা বোন পরিচারিকা, যাঁরা সব দিয়েছেন, কিছু পাননি। আসুন তাঁদের দেবী দুর্গা জ্ঞানে পূজা করি। আর তাদের বুকে বল জুগিয়ে সাহসী করে তুলি। যে সমস্ত অসুরেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে।

Post a Comment

0 Comments