জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত -১৬ / সুদর্শন নন্দী




শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত 

পর্ব-১৬

সু দ র্শ ন  ন ন্দী

৩০শে জুন, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ, ১৭ই আষাঢ়, শুক্লা অষ্টমীর দিন। ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে ঘরের মেঝেতে বসে আছেন। সুরেন্দ্র, বাবুরাম, মাস্টার, হরিশ, লাটু, হাজরা,মণি মল্লিক ভক্তরা উপস্থিত। নিত্য লীলা নিয়ে আলোচনা চলছে। ঠাকুর বলছেন, যার অচল আছে তার চলও আছে। তারপর একের পর এক গান করে যাচ্ছেন ঠাকুর।  
১) মা কি এমনি মায়ের মেয়ে।
যার নাম জপিয়ে মহেশ বাঁচেন হলাহল খাইয়ে...
২) মা কি শুধুই শিবের সতী।
যাঁরে কালের কাল করে প্রণতি...
  
( দুটি গানই রামপ্রসাদের। গান দুটি  একবারই উল্লেখ পাই কথামৃতে।)
গান - শ্যামাধন কি সবাই পায়,
অবোধ মন বোঝে না একি দায়...
 
গানটি কমলাকান্তের। এই গানটির ঠাকুর চারবার গেয়েছেন তার উল্লেখ পাই কথামৃতে।) 
ঠাকুর একটু পরেই আবার গান গাইছেন:
শ্যামাপদ আকাশেতে মন ঘুড়িখান উড়তেছিল, (গানটি পূর্বে উল্লেখ করেছি)
পরের গান রামপ্রসাদের – 
এবার আমি ভাল ভেবেছি।
ভাল ভাবীর কাছে ভাব শিখেছি... 
এছাড়া ঐদিন আর কয়েকটি গান গেয়েছিলেন ঠাকুর যার উল্লেখ পূর্বে করেছি।
৩রা জুলাই, জগন্নাথদেবের পূর্ণযাত্রা। ঠাকুর বলরাম মন্দিরে। বৈঠকখানায় আনন্দের হাট বসেছে।আছেন বালিকারাও। ঠাকুর এক বালিকাকে গান গাইতে বললে সে বলল আমি জানিনা। রসিক ঠাকুর তখন নিজেই মজার কটি কলি গাইলেনঃ 
আয় লো তোর খোঁপা বেঁধে দি, 
তোর ভাতার এলে বলবে কি...

পরের গানটি ঠাকুর ঐদিন (৩রা জুলাই ১৮৮৪) বলরাম মন্দিরে গেয়েছেন। পণ্ডিত শশধরের সাথে ধর্মীয় আলোচনা হতে হতে ঠাকুর বললেন- ...তার নাম করেছি আমার আবার পাপ... বলে গাইলেনঃ 
শিব সঙ্গে সদা রঙ্গে আনন্দে মগনা,
সুধাপানে ঢল ঢল ঢলে কিন্তু পড়ে না (মা)...
গানটি ঠাকুর আরেকদিন (২৮শে সেপ্টেম্বর ১৮৮৪) রামচন্দ্র দত্তের বাড়িতে গেয়েছেন।
এদিন আরেকটি গানের (ব্রহ্মা যারে না পায় ধ্যানে) উল্লেখ পাই কথামৃতে। এটি গোবিন্দ অধিকারীর লেখা।
এছাড়া সেদিন ঠাকুর ও ভক্তেরা নিচের কীর্তনটি গেয়েছিলেন-  
আমার গৌর নাচে
নাচে সংকীর্তনে, শ্রীবাস-অঙ্গনে, ভক্তগণসঙ্গে ৷৷
রচয়িতা অজ্ঞাত।কীর্তনটি ঠাকুর ১৪ই সেপ্টেম্বর ১৮৮৪তে যদু মল্লিকের বাড়িতেও গেয়েছিলেন ।
 

পরের তিনটি গানের উল্লেখ পাই ৩রা আগস্ট ১৮৮৪। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর ভক্তদের সাথে। আলোচনা প্রসঙ্গে “ হরিনাম মদিরায় মত্ত হও”  গানটি উল্লেখ করেন ঠাকুর। আর শিবপুরের ভক্তদের অনুরোধে গাইলেন দুটি গানঃ
কৌপীন দাও কাঙ্গালবেশে ব্রজে যাই হে ভারতী।
এবং
দেখসে আয় গৌরবরণ রূপখানি(গো সজনী)
আলতা গোলা দুধের ছানা মাখা গোরার গায়...।
উপরের কৌপীন দাও... গানটি ঠাকুর ৪ঠা অক্টোবর ১৮৮৪ নবীন চন্দ্র সেনের বাড়িতেও গেয়েছিলেন। 
 
আজ শনিবার, ২২শে ভাদ্র, ১২৯১; ৬ই সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪। কৃষ্ণা প্রতিপদ তিথি।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ অধরের বাটীর বৈঠকখানায় ভক্তসঙ্গে বসে আছেন। বৈঠকখানা দুতলায়।নরেন্দ্র, মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়, ভবনাথ, মাস্টার, চুনিলাল, হাজরা প্রভৃতি ভক্তেরা তাঁর কাছে বসে আছেন। বেলা ৩টা হবে। নরেন্দ্র গান গাইবেন তার আয়োজন হচ্ছে। এদিকে তানপুরা বাঁধতে গিয়ে তার ছিঁড়ে গেল। ঠাকুর বলছেন, ওরে কি করলি। নরেন্দ্র বাঁয়া তবলা বাঁধছেন। ঠাকুর বললেন, তোর বাঁয়া যেন গালে চড় মারছে!
এবার কীর্তনাঙ্গের গান সম্বন্ধে কথা হচ্ছে। নরেন্দ্র বলছেন, “কীর্তনে তাল সম্‌ এ-সব নাই - তাই অত Popular -- লোকে ভালবাসে।”
তা শুনে ঠাকুর বললেন, সে কি বললি! করুণ বলে তাই অত - লোকে ভালবাসে।

এবার নরেন্দ্র কয়েকটি গান গাইলেন:

গান - সুন্দর তোমার নাম দীনশরণ হে।
     বরিষে অমৃতধার, জুড়ায় শ্রবণ ও প্রাণরমণ হে...। 
গানটি পুণ্ডরীকাক্ষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা। কথামৃতে নরেন্দ্র চারবার গেয়েছেন তার উল্লেখ রয়েছে।  

গান - যাবে কি হে দিন আমার বিফলে চলিয়ে।
আছি নাথ দিবানিশি আশাপথে নিরখিয়ে।।
গানটির রচয়িতা বেচারাম চট্টোপাধ্যায়। কথামৃতে নরেন্দ্র তিনবার গেয়েছেন তার উল্লেখ রয়েছে।   

নরেন্দ্র আরও দুই-একটি গান করবার পর বৈষ্ণবচরণ গান গাইতে শুরু করলেন-

চিনিব কেমনে হে তোমায় (হরি),
ওহে বঙ্কুরায়, ভুলে আছ মথুরায়।
হাতিচড়া জোড়াপরা, ভুলেছ কি ধেনুচরা,
ব্রজের মাখন চুরি করা, মনে কিছু হয়।
বৈষ্ণব চরণের এই গানটি তাঁকে আরেকবার গাইতে শুনি বলরাম মন্দিরে ১৪ই জুলাই ১৮৮৫তে। 

শ্রীরামকৃষ্ণদেব এবার বললেন  “হরি হরি বল রে বীণে” ওইটে একবার হোক না।
বৈষ্ণবচরণ ঠাকুরের কথা শুনে শুরু করলেন সেই গানঃ 
         হরি হরি বল রে বীণে!
শ্রীহরির চরণ বিনে পরম তত্ত্ব আর পাবিনে...

গানটির রচয়িতা গোবিন্দ রায়। গানটি গায়ক আর দুবার গেয়েছেন তার উল্লেখ পাই কথামৃতে। এই গানটি কাশীপুর উদ্যানেও দুই কিশোরী ১৩ই এপ্রিল ১৮৮৬ তারিখে গেয়েছিল।
 
গান শুনতে শুনতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট হলেন বললেন- আহা! আহা! হরি হরি বল!
বলতে বলতে ঠাকুর সমাধিস্থ হলেন। ঐদিন বৈষ্ণবচরণ নীচের গানগুলি গেয়েছিলেন- 
হরিনাম বিনে আর কি ধন আছে সংসারে, 
বল মাধাই মধুর স্বরে।...
 
কথা মৃতে গানটির বিশেষ উল্লেখ নেই। রচয়িতা অজ্ঞাত।  
আরেকটি গান – 
হরি বলে আমার গৌর নাচে।
নাচে রে গৌরাঙ্গ আমার হেমগিরির মাঝে...
 
এই গানটি ঠাকুর নিজেও একবার, নবীনচন্দ্র সেনের বাড়িতে ৪ই অক্টোবর ১৮৮৪ গেয়েছেন। 
এছাড়া ভক্তরাও এই গানটি কাশীপুর উদ্যানে (১৮ই এপ্রিল ১৮৮৬) ঠাকুরকে শুনিয়েছিলেন।

ঐদিন অর্থাৎ ৬ই সেপ্টেম্বর ১৮৮৪, অনেক গান শুনতে পাই। এমনকি ঠাকুরও গান গেয়েছিলেন। ঠাকুর বৈষ্ণবচরণের গান শেষ হলে নরেনকে আবার গান গাইতে বলেন। নরেন পূর্বে উল্লেখিত “আমায় দে মা পাগল করে (ব্রহ্মময়ী)..., চিদানন্দ সিন্ধুনীরে প্রেমানন্দের লহরী..., চিদাকাশে হল পূর্ণ প্রেমচন্দ্রোদয় হে..., হরিরস মদিরা পিয়ে মম মানস মাত রে..গানগুলি গাইলেন আর ঠাকুর তা শুনে আখর দিচ্ছেন:
প্রেমে মত্ত হয়ে, হরি হরি বলি কাঁদ রে।
ভাবে মত্ত হয়ে, হরি হরি বলি কাঁদ রে! 
 এবার নরেন্দ্র আস্তে আস্তে ঠাকুরকে বলছেন -- “আপনি সেই গানটি একবার গাইবেন? --”
শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন -- ‘আমার গলাটা একটু ধরে গেছে,  তা ‘কোন্‌টি?’
নরেন্দ্র -- ভুবনরঞ্জনরূপ।
ঠাকুর আস্তে আস্তে গাইলেন:
ভুবনরঞ্জনরূপ নদে গৌর কে আনিল রে (অলকা আবৃত মুখ)
(মেঘের গায়ে বিজলী) (আন হেরিতে শ্যাম হেরি)
এছাড়া ঠাকুর পূর্বে উল্লেখিত আর-একটি গান “শ্যামের নাগাল পেলাম না লো সই...” গাইলেন। 

১৮৮৪, ৭ই সেপ্টেম্বর। ঠাকুর নিজের ঘরের খাটে বসে আছেন। শ্যামদাসের কীর্তন হবে। ভবনাথ, মনোমোহন, চুনিলাল, হরিপদ সব আছেন। মাস্টারকে ঠাকুর বলছেন গতকাল তাঁর পায়ে ব্যাথা হয়েছিল। তারপর গান ধরলেনঃ   
দরবেশে দাঁড়ারে, সাধের করোয়া ধারী,
দাঁড়ারে, তোর রূপ নেহারি!
গানটি গেয়ে বললেন এসব বাউলের গান। এই গানটি আরেকবার ঠাকুর গেয়েছিলেন ৬ই এপ্রিল ১৮৮৫, দেবেন্দ্র মজুমদারের বাড়িতে।  
সেদিনই অর্থাৎ ১৮৮৪, ৭ই সেপ্টেম্বর। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর দুপুরের বিশ্রামের পর কীর্তন শুনছেন কীর্তনিয়া শ্যামদাস ও সম্প্রদায়ের কণ্ঠে। তারা মাথুর কীর্তন গাইছেনঃ “নাথ দরশসুখে ইত্যাদি –
ঠাকুর গাইলেন রামপ্রসাদের গানঃ  
গান - তোদের খ্যাপার হাট বাজার মা (তারা)।
কব গুণের কথা কার মা তোদের ৷৷
গজ বিনে গো আরোহণে ফিরিস কদাচার...
  
এছাড়াও আর কয়েকটি গান গেয়েছিলেন যার উল্লেখ পূর্বে করেছি।
---------------------------------------------------------------
প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার নিয়মিত  প্রকাশিত হচ্ছে এই ধারাবাহিক। আপনারা অভিমত জানাতে পারেন।  jaladarchi@yahoo.in         

Post a Comment

0 Comments