জ্বলদর্চি

প্রয়াত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

প্রয়াত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় 

দ্বিজ দাস
    
আজ রবিবার (১৫ নভেম্বর ২০২০) প্রয়াত হলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। গত বেশ কিছুদিন ধরেই শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। 

নিঃসন্দেহে কিংবদন্তি অভিনেতা। অন্যতম সেরা আবৃত্তি শিল্পীও। কবি, অনুবাদক। সিনেমার পাশাপাশি যাত্রা, নাটক, দূরদর্শন ধারাবাহিকেও করেছেন অভিনয়। সম্পাদনা করেছেন 'এক্ষণ' নামে একটি লিটল ম্যাগাজিনও। কবিতাচর্চা, রবীন্দ্রপাঠ, সম্পাদনা, নাট্যসংগঠন তাঁর বহুমুখী প্রতিভা-বৈচিত্রের এক একটি দিক। প্রতি ক্ষেত্রেই তিনি স্বপ্রতিভ, উজ্জ্বল। আর এই সব কিছু নিয়েই বাঙালি এই ব্যক্তিত্ব কেবল বাঙালির গণ্ডিতে আটকে থাকেননি। 

১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি জন্ম। সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা। পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ৩৪টি সিনেমার ভিতর ১৪টিতেই অভিনয় করেছেন। সত্যজিৎ রায় ছাড়াও মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অজয় কর প্রমুখ পরিচালকের সিনেমাতেও দেখিয়েছেন তাঁর অভিনয় দক্ষতা। 

এই উপমহাদেশে যে ক’জন অভিনেতা মেধায় আর সাবলীলতায় অভিনয়কে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন চির তরুণ নায়কের নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নিজের অভিনয় সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য, "সেই শৈশবকাল থেকে আজ অবধি অভিনয় ছাড়া আমি অন্য কিছু ভাবিনি। অভিনয়টা সবসময় বুকের মধ্যে লালন করতাম। অন্য যা কিছু করেছি সবই ছিল ভালো লাগার বহিঃপ্রকাশ।" অবশ্য এক্ষেত্রে তিনি প্রেরণা পান বাবার কাছ থেকে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে সৌমিত্র-র পিতা ওকালতি পেশায় নিযুক্ত থাকলেও বাল্যকালে তিনি দেখেছিলেন কী একাগ্র নিমগ্নতায় তাঁর পিতা অভিনয় ও আবৃত্তি  করতেন--- যা তাঁকে উৎসাহ দিয়েছিল। আর পরবর্তীতে শিশির কুমার ভাদুড়ীর অভিনয় দেখে অভিনয়ের আগ্রহ জন্মায়। সিনেমায় আসার পূর্বে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কর্মরত। সত্যজিৎ রায় তাঁর অপরাজিত ছবির জন্য এক বন্ধু মারফত ডেকে পাঠান। যদিও সত্যজিতের সৌমিত্রকে দেখামাত্র প্রতিক্রিয়া ছিল, তোমার বয়সটা একটু বেশি মনে হচ্ছে। কারণ অপরাজিত-র অপুর চরিত্রের বয়সের হিসেবে সৌমিত্র সেই সময় কিছুটা লম্বা ছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর চেহারা স্মরণে রেখে দিয়েছিলেন। এরপর যখন অপুর সংসার সিনেমা শুরু করেন তখন সৌমিত্রকে ডেকে নেন মূল চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে। বাংলা সিনেমা জগতের আর এক কিংবদন্তি অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের কাছে সৌমিত্রকে সত্যজিৎ পরিচয় করিয়েছিলেন অনেকটা এইভাবে, “এই হলো সৌমিত্র। আমার পরবর্তী ছবি অপুর সংসারে ও অপু করছে।” ১৯৫৮ সালে অপুর সংসার ছবিতে নায়ক চরিত্রে এই ভার্সেটাইল প্রতিভাসম্পন্ন মানুষটির আত্মপ্রকাশ। ছবিতে ‘খাওয়ার পর একটা করে, কথা দিয়েছ'--তাঁর আর শর্মিলার সেই সংলাপের কেমিস্ট্রি এখনও বাঙালি মননে অমলীন।

তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তাঁর সমসাময়িক  প্রায় সব নায়িকার বিপরীতে ও সেই সময় থেকে বর্তমান কাল অব্দি মননশীল পরিচালকের সাথে কাজ করে তিনি অভিনয়ে সাফল্য পেয়েছেন। ২০০৭ সালে 'পদক্ষেপ' ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতা হিসাবে জাতীয়  চলচ্চিত্র পুরস্কার ও ২০১১ সালে পেয়েছেন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। পেয়েছেন ফ্রান্স সরকারের 'লিজিওন অফ অনার' পুরস্কার। পেয়েছেন ভারত সরকারের পদ্মভূষণ সম্মান। এছাড়াও আরও আনুষঙ্গিক কিছু পুরস্কার তো আছেই। ২০২০ তে  এসেও একই প্রাণশক্তি নিয়ে কাজ করে চলছিলেন তিনি।


সিনেমা ও সাহিত্য সংস্কৃতিতে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়েই থাকবে।    

বিশেষ সংযোজন --হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়  জ্বলদর্চিতে নিয়মিত লেখা দিতে ভুলতেন না। অধিকাংশ সময়ই তিনি ডাক/ কুরিয়ারে লেখা পাঠিয়েছেন, যথাসময়ে। চরম 
ব্যস্ত ছিলেন তাই ২০১৮ সালে তাঁর বাড়ি থেকে সংগ্রহ করতে বললেন লেখা। নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে জ্বলদর্চির শুভানুধ্যায়ী অনীক নন্দী  তাঁর বাড়িতে পৌঁছালে,  মুচকি হেসে সৌজন্যবিনিময় করে লেখা দিলেন। নিজের হাতে লেখা কবিতাটি আগে থাকে খামে ভরেই রেখেছিলেন। লেখার প্রতি, লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি গভীর ভালোবাসা ছিল। আক্ষেপ করতেন, যেবার শুটিং- এর ব্যস্ততার জন্য লেখা দিতে পারতেন না। নিয়মিত জ্বলদর্চি পেতেন। পত্রিকা পেয়ে পাঠপ্রতিক্রিয়া জানাতেও তাঁর ভুল হতো না! 

জ্বলদর্চিতে প্রকাশিত তাঁর তিনটি  কবিতা  পড়ে নেওয়া যাক।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় 

এক এক দিন

এক এক দিন
একটা নদী জেগে ওঠে এই দেহটার মধ্যে 
কূল ভেঙে দেয় 
নিরাপদ যা কিছু ছিল খরস্রোতে ভাসে

এক এক দিন
ভালোবাসার জন্যে মনে এত ঢেউ ওঠে
সেই সুনামিতে
হাট বাজার কাছারি দপ্তর সব ভেসে যায়

এক এক দিন
সুন্দরের জন্যে হাহাকার
আকাশ বাতাস বসন্তের গানে ভরিয়ে দেয়

এক এক দিন
নদী জেগে ওঠে ডমরু বাজিয়ে 
তােমারও ঘুম ভাঙাতে চায়
বসন্তের গানও সেদিন বুঝি বলতে চায় 
যেদিন থাকবাে না সেদিনও ভালোবেসো

স্মৃতিও এক এক দিন সত্যি হয়ে ওঠে

(জ্বলদর্চি উৎসব ২০১৫) 

উৎসব থেকে ফেরা

এ জীবন রাজ্যের জন্যে
মাত্র একটি বারের মত ভিসা পাওয়া যায় 
মালটিপল ডিজিট লেখা থাকে না ছাড়পত্রে

শুধু নিসর্গই যা সাজিয়ে রেখেছে
তার দিকে চোখ মেলে তাকাতে তাকাতেই 
পলকে সময় শেষ
অন্ধকার ঘন হয়ে আসতে থাকে

কবি দেখেছে
অপরূপা নদীকে
জপমালার মত ধরে রেখেছে প্রান্তর
কত সৌধ ভাস্কর আর স্থপতির উপাসনার উপলক্ষ্য হয়ে
গির্জা মন্দির মসজিদ হয়ে চিরস্থির হয়ে আছে।

এমনকি ধ্বংসের সামনে
ঘাড় শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে।
অহংকারী বিজয়-তােরণ

সব কিছুর ওপর
অন্ধকার ঘন হয়ে আসছে

তার থেকে ভালাে হবে
বাউল বৃক্ষের নীচে বসে
এ ভ্রমণে যত সুর শােনা গেল
তার একটা কোনাে তােমার দোতারায় তুলে নেওয়া

হয়ত এখনই
ফেরার ফ্লাইটের ঘােষণা শােনা যাবে
বারবার আসার অনুমতি
ছাপ মারা নেই ছাড়পত্রে

শুধু ভালোবাসবার জন্যে কোনাে ছাড়পত্র লাগে না 
তুমি না হয় আর একবার ভালােবেসাে 
একবার নয় সহস্রবার বাজিও তােমার দোতারায় 
যৌবনের অসমাপ্ত গান

(জ্বলদর্চি উৎসব ২০১৬)  

সাড়া দেয় না কি

তােমার জন্যে লেখার সময় এখনি 
অথচ এমন বিরূপ সাঁজোয়া রাতে 
কোনাে লেখনীর রাশ নেই তার হাতে 
অনিঃশেষ এই রাত্রিকে তুমি দ্যাখোনি?

তার কাছে দিন পরাহত আর প্রহৃত
তার পদসঞ্চার যে অতর্কিত

তবু বসন্ত তােমারই তাে প্রিয়কালে 
অন্ধকারের পাহাড় সরিয়ে হীরকচূর্ণ ছড়ালে 
তােমার কাছে কি উপেক্ষা পাবে সে সবই 
বলাে একবার সাড়া দেবে না কি ও কবি?

(জ্বলদর্চি উৎসব ২০১৮)
-------------------------------------
আরও পড়ুন 
চলে গেলেন আবৃত্তিশিল্পী প্রদীপ ঘোষ। 
শ্রদ্ধা ও স্মরণে কবি রতনতনু ঘাটী।


জ্বলদর্চি পেজ-এ লাইক দিন।👇


Post a Comment

3 Comments

  1. সঠিক সময়ে সঠিক শ্রদ্ধার্ঘ এই মহাপ্রাণের মহাপ্রয়ানকে মহিমান্বিত করবে আর সাহিত‍্য সংস্কৃতির সমাজে সম্মানের ভারাক্রান্ত পরিবেশকে প্রম্বিত করবে !

    ReplyDelete
  2. খুব সুন্দর লেখা।শ্রদ্ধা-

    ReplyDelete