জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহলে কালীপূজা মানেই 'বাঁদনা পরব'/সূর্যকান্ত মাহাতো


জঙ্গলমহলে কালীপূজা মানেই 'বাঁদনা পরব'

সূর্যকান্ত মাহাতো

বাঙালির শ্রেষ্ঠ ও সব থেকে বড় উৎসব দুর্গোৎসবের ঠিক এক পক্ষকাল পরেই অমাবস্যায় অনুষ্ঠিত হয় কালীপূজা। ঘন তিমির বর্ণের ভয়ংকর দেবীর আবাহন হয় একেবারেই বিপরীত ভঙ্গিমাতে। সেখানে থাকে আলোকমালার কারুকার্য, মোমবাতি ও দীপের আলোর বর্ণময় ছটা, তারাবাতির ঝলকানি, শব্দ বাজির চিৎকার, চরকি বাতির উজ্জ্বলতা আর তুবড়ির দৃষ্টি নন্দন ফোয়ারা। সে এক আলোকমালার বর্ণময় খেলা। টুনি বাল্বের টিম টিম আলো যেন দেবীর অলংকার।

জঙ্গলমহলের মাহাতো-কুর্মী সম্প্রদায়ের কাছে আলোর উৎসব এই কালীপূজা তাই "বাঁদনা পরব" নামেই অধিক প্রচলিত। কালীপূজার পাশাপাশি এই সময় তাদের চলে গো-পূজা, গো-ভক্তি আর গো-আরাধনা। কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত সব কিছুকেই এই সময় এই সম্প্রদায়ের মানুষ পুজো করেন। তাই জঙ্গলমহলে বাঁদনা পরবের আভিজাত্য ও আড়ম্বরতা প্রজ্জ্বলিত আলোকমালার  মতোই উজ্জ্বল।

বাঁদনা পরবের অভিনবত্ব এমনই যে শিশু থেকে নারী পুরুষ বৃদ্ধ সকলেই পরবের এমন অপার আনন্দের এক সুতোয় গাঁথা থাকে। সকলেই স্ব স্ব ভাবে সমানে এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে।

তিন দিন ধরে এই বাঁদনা উৎসব পালিত হয়। প্রতিটি দিনই নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য আর বৈচিত্র্যে যেমন ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে থাকে, তেমনি আলাদা আলাদা মাত্রা বহন করে থাকে।
প্রথম দিন অর্থাৎ কালীপূজার রাত্রিতে প্রতিটি বাড়ি সারিবদ্ধ মোমবাতির আলোক শিখায় সেজে উঠে। বিন্দু বিন্দু আলোক শিখাগুলো হাওয়ায় তখন কোমর দোলাতে থাকে। বাঁদনা পরবের এই রাত্রি হল, "গোরু জাগানো"র রাত্রি। "অহিরে", "বাবু হো" এমনি সব গানের সুরে সুর তুলে একদল লোক গান ও বাজনায় ধুম তুলে ঘুমন্ত গোরুগুলোকে জাগিয়ে তুলেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে এভাবেই মাদল ধামসা করতাল ও ঢাকের বাদ্যে ও গীতে তারা গোরু জাগিয়ে চলেন। গোরু জাগানোর কাজে যুক্ত এই দলটিকে আঞ্চলিক ভাষায় বলে "ঝাঙোড়া।"

প্রতিটি বাড়ির গোয়ালঘরও এই সময় উৎসবের কটাদিন আলোয় আলোয় সেজে উঠে। গোরুগুলোর সেবা করার জন্য মাঠ থেকে তাদের জন্য ঘাস কেটে আনা হয়। সযত্নে সেই ঘাস গোরুগুলোকে সময়ে সময়ে পরিবেশন করা হয়। কথিত আছে, এই সময় নাকি শ্রীকৃষ্ণ তাদের দেখতে আসেন, তারা কেমন আছে। যদিও এটা জনশ্রুতি হিসাবেই পরিচিত। তাই বাঁদনা পরব একরকম গোরুদেরও উৎসব। এই পরবে তাদের পূজা করা, বিয়ে দেওয়া, খুঁটানো সব কিছুই মূলত তাদের ঘিরেই ঘটে থাকে। গো-ভক্তির এমনই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দীর্ঘকাল ধরে বহন করে চলেছে এই বাঁদনা পরব।

বাড়ির মহিলারা বিকেল থেকেই নানা ধরণের পিঠা বানানোর কাজে লেগে পড়েন। নিজেরা খায় এবং সেই  সঙ্গে ঝাঙোড়াদেরকেও খেতে দিতে হয়।

দ্বিতীয় দিন তথা পরের দিন হল "গরয়া"। এই দিন অমাবস্যা শেষ হলেই প্রতি বাড়ির একজন পুরুষ মানুষ চাষের কাজে যুক্ত সমস্ত লাঙ্গল, জোয়াল,মই প্রভৃতির পূজা করে থাকেন। শালুক ফুল দিয়ে সাজানো হয় লাঙ্গল জোয়াল ও মই গুলোকে। সেই সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে তিনটি সিঁদুরের টিপও পরানো হয়।

পূজা পদ্ধতিও বেশ বৈচিত্র্যে ভরা। নিকটবর্তী বাঁধ থেকে স্নান করে একটি কাদামাটির গোলা পাকিয়ে সঙ্গে নিয়ে আসতে হয়। সেটাকে গোয়ালঘরে রেখে পূজা করা হয়। গোলাকার কাদামাটির এই গোলাটি হলেন  গিরি গোবর্ধন। পর্বতের প্রতীক রূপেই তাকে পূজা করা হয়। গোরু ও কৃষক যাতে সকলেই সুরক্ষিত থাকে তার জন্যই এই দেবতার পূজা। নারীরাও স্নান সেরে চাল ভিজিয়ে, চালের গুঁড়ি দিয়ে ঘি সহযোগে পিঠা বানানো হয়। ঘি মিশ্রিত এই পিঠাই দেবতাকে ভোগ হিসাবে নিবেদন করা হয়। পরে প্রসাদ হিসাবে সকলেই খায়।

মাঠ থেকে পরে সোনালী ধানের শিস তুলে এনে অপূর্ব কায়দায় "মোড়" বাঁধা হয়। "মোড় বাঁধাটি" আবার কী? তুলে আনা ধানের শিস দিয়ে একটা মালার মতো অলংকার বানানো হয়। অনেকটা মেয়েদের গলায় পরা একটা বড়  স্বর্ণহারের মতো দেখতে। এই বাঁধা "মোড়" গোরুগুলোর মুখে বেঁধে দেওয়া হয় অলংকার হিসাবে। সেই সঙ্গে গোল গোল রঙিন ছাপ দেওয়া হয় গোরুগুলোর সারা শরীর জুড়ে। সুন্দর করে সর্ষের তেল মাখানো হয় শিঙে ও পায়ের ক্ষুরে। চকচক করতে থাকে সেগুলো। সব মিলিয়ে অপূর্ব লাগে দেখতে।  তারপর তাদের পূজা করা হয় এবং বিবাহ দেওয়া হয়। মেয়েরাও চালের গুঁড়ি দিয়ে বাড়ির প্রাঙ্গন উঠোন এবং আঙিনাকে এক বিশেষ ধরণের আলপনার কারুকার্যে ও সৌন্দর্যে ভরিয়ে তুলেন। অপরূপ শোভা বৃদ্ধি করে সেই সব নকশা কাটা আলপণা গুলো।

উৎসবের তৃতীয় দিন হল ভাইফোঁটা। কুর্মী সম্প্রদায়ের মানুষেরা  দিনটিকে ভাইফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে জামাইফোঁটা হিসাবেও পালন করে থাকেন। জামাইয়ের মঙ্গল কামনায় শাশুড়িরা জামাইয়ের কপালে ফোঁটা দেন। ফোঁটা দেওয়ার পর্ব শেষ হলেই দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর শুরু হয় সেই বহু প্রতীক্ষিত "খুঁটান" উৎসব। গোরু ও কাড়া খুঁটান হিসাবে যা বহুল প্রচারিত। জঙ্গলমহলের যেকোন গ্রামে কান পাতলেই একটানা অনুরণন জাগানো আকাশ বাতাস ভেদ করে নাগাড়ার গুম গুম বাজনার শব্দ ভেসে আসবে কানে। খুঁটানের উৎসবকে কেন্দ্র করেই এই বাজনা বেজে থাকে।

কী এই খুঁটান উৎসব? না, গোরু ও কাড়া গুলোকে একটি শক্তপোক্ত লম্বা খুঁটিতে বাঁধা হয়। তারপর ঢাক ঢোল ধামসা মাদল ও 'অহিরে', 'বাবু হো' সুরে গান ধরে একটা চরম উত্তেজনার মুহূর্ত গড়ে তোলা হয়। সেই সঙ্গে একটি মৃত গোরু কিংবা কাড়ার চামড়া বাঁধা গোরু কিংবা কাড়াটির  সম্মুখে তুলে ধরা হয়। চামড়ার গন্ধে এবং গান বাজনার উত্তেজক মুহূর্তে খুঁটিতে বাঁধা গোরু কিংবা কাড়াটি গুঁতো মেরে তখন আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। এবং আক্রমণ করলেই উপস্থিত সকলে প্রবল আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন। তুমুল হাততালি আর গগন ভেদী চিৎকারে ফের গোরু সহ সকলকে ফের উৎসাহ দিতে শুরু করেন। এমনি ভাবেই একটার পর একটা গোরু ও কাড়াকে খুঁটানো হয়ে থাকে। প্রচুর মানুষ প্রবল উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে এমন উৎসবে অংশগ্রহণ করেন এবং আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে সেটা বেশ উপভোগও করেন।
--------
আরও পড়ুন 

গ্যালারি থেকে Arena - 
৪র্থ পর্বে 'আলি সাহেবের ক্রিকেট'/অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়

Post a Comment

0 Comments