জ্বলদর্চি

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান-৬/ অনিন্দ্যসুন্দর পাল


প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান
(Ancient India, History & Science)   

অনিন্দ্যসুন্দর পাল
অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য          

ষষ্ঠ পর্ব

ঐতিহাসিক উৎস, প্রকারভেদ ও ধারণা- ৩

লেখমালার প্রয়োজন ও গুরুত্বের প্রসঙ্গটি আরো ভালো করে স্পষ্ট হবে যখন পরবর্তী পর্যায়ে ইতিহাসের পুনর্গঠন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব। তবে এটুকু স্মরণে রাখা ভালো ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ স্থায়ী এবং অপরিবর্তনশীল। এরপরও  ভিন্ন ভিন্ন ঘটনাসমূহকে ব্যাখ্যা ও আলোচনার মাধ্যমে তার সত্যতা ও সেই ঘটে যাওয়া কান্ডসমূহের পশ্চাৎ-এ যে বিজ্ঞান, যুক্তি ও নানান চিন্তা-ভাবনার উপস্থিতি রয়েছে তা নিয়ে কাটাছেঁড়ার দ্বারা বহু জিনিসের সংযোজন ও বর্জন ঘটানো হয়েছে বা হচ্ছে, আশা করি এ নিয়ে কারোর কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয়।

    যদিও আমি পূর্ব আলোচনায় উল্লেখ করেছিলাম যে- কে, কিভাবে ইতিহাস ও সাহিত্যের মধ্যে শুধুই পারস্পরিক সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছেন তাই নয় কেনই'বা তাদের  অন্তর্বতী  মেলবন্ধনের সন্ধান করতেই হলো বা ঘটাতেই হলো, এনিয়েও বিস্তারিত ব্যাখ্যা রেখেছিলাম। এখানেই শেষ নয়, এত তর্ক, এত ব্যাখ্যা এবং এর উপস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার প্রয়োজনীয়তাই'বা কি, এবং এর সহিত কিভাবে তথ্যেগুলির অভিব্যক্তির দ্বারা ঐতিহাসিক ঘটনাপুঞ্জের উপর মানুষের আস্থা ও অনাস্থা'র প্রকাশ ঘটেছে তা নিয়েও দু'য়েক কলম আলোচনা করেছি। 

     তাই এবিষয়ে এইটুকু স্মরণ করিয়ে দেওয়া ভালো বলে মনে করি যে, যে ঘটনা নিয়ে তৈরি হয় ইতিহাস, সেই ইতিহাসের উপর নির্ভর করেই কিন্তু তৈরি হয় সাহিত্য, আর এই সাহিত্য পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যুগের প্রতিপাদ্য ধরে যেন জেগে ওঠে নবজাগরণে। যা দেখে আমার বুঝতে শিখি, ভাবতে শিখি, সর্বোপরি জ্ঞাত হতে পারি এই জ্ঞানে- অতীত বর্তমান ও ভবিষৎ তিনটিই কাল ও স্থানের একটি অবয়ব মাত্র। তা সে ইতিহাস কিংবা সাহিত্য যতই অপরিবর্তনশীল হোক।
      
    এই কারনেই বোধ করি , অধ্যাপক "দিনেশচন্দ্র সরকার", "রোমিলা থাপার" এর মত প্রমুখ জনৈক ঐতিহাসিকেরা উদাহরণ সহযোগে এইসমস্ত ভিন্ন ভিন্ন ঘটনাকে স্পষ্টভাবে মেলে ধরতে চেয়েছেন যুক্তি ও প্রতিযুক্তির নিরিখে। তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। 
 
   যেমন, আমরা জানি গুপ্ত বংশের বিনাশ ঘটেছিল স্কন্ধগুপ্তের পরবর্তী ধাপে, কিন্তু আদৌ তা সম্পূর্ণ সত্য নয়। প্রসঙ্গত, বিষয়ে কিছু জিনিসের প্রতি দৃষ্টি রাখা যাক। সর্বপ্রথম ১৮৩৮ সালে মধ্যপ্রদেশের এরান অঞ্চলে একটি ধ্বজস্তম্ভ পাওয়া যায়, যাতে বৃহৎ রাজা বুধগুপ্ত  নামে অধীনস্থ দুইজন ক্ষুদ্র রাজার পরিচয় মেলে, এরই সাথে ১৮৯৪ সালে বুধগুপ্ত (৪৯৪-৪৯৫ খ্রিস্টাব্দের) কিছু প্রচলিত মুদ্রার সহিত ১৯১৪-১৫ সালে বারাণসীর নিকটবর্তী সারনাথে দুটি বৌদ্ধ মূর্তির (৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ) সন্ধান পাওয়া যায়, যা থেকে স্পষ্ট ধারণা মেলে যে বুধগুপ্তের কেবল সময় ও এলাকা সম্পর্কে অনুমান নয়, তার রাজত্বসীমা যে পশ্চিমে মালব থেকে পূর্বে বারাণসী পর্যন্ত প্রসারিত ছিল, তার এই দীর্ঘ রাজত্বকাল (৪৭৬-৪৯৫ খ্রিস্টাব্দ) ও সীমা সম্পর্কে ধারণা নিশ্চিত করা গেল।
 
   উল্লেখ্য, এরপরও কিন্তু বুধগুপ্তের ব্যাপারে যেমন সম্পূর্ণটা নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছিল না ঠিক তেমন তাঁকে কোন যুগের ইতিহাসে পর্যায়ভুক্ত করা হবে, তা নিয়ে চলছিল ঐতিহাসিকদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব। তবে এটি খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। পুনরায়, ১৯১৯ সালে অধুনা বাংলদেশের দিনাজপুরের দামোদর অঞ্চলে দুটি তাম্রপাত্র আবিষ্কারের ফলে খানিকটা স্বচ্ছ হলো বুধগুপ্তের সার্বভৌমকত্বের স্বীকৃতি। স্মরণে রাখতে হবে নর্মদা থেকে পুন্ড্রবর্ধনভুক্তি অবধি কোনো স্থানীয় রাজার বিস্তার প্রায় অসম্ভব, তাই তখনও ঐতিহাসিকরা প্রায় অনিশ্চিত।

    উল্লেখ্য, পূর্বে উল্লেখিত  বহুপূর্বে মধ্যপ্রদেশে ইরাণ নামক স্থানে আবিষ্কৃত শিলালিপি থেকে জানা গিয়াছিল যে, ১৬৫ গৌপ্তাব্দে বুধগুপ্ত নামক একজন রাজা উক্ত ভূভাগের অধিপতি ছিলেন এবং তাঁর অধীনে মহারাজা উপাধিধারী সুরশ্মিচন্দ্র নামক একজন সামন্তরাজা কালিন্দী ও নর্ম্মদার মধ্যবর্ত্তী ভূভাগ শাসন করতেন। দুঃখের বিষয় এই যে দামোদরপুরে আবিষ্কৃত বুধগুপ্তের রাজ্যকালের তাম্রলিপিগুলিতে যে অংশে তারিখ ছিল তা ভেঙে যাওয়ার দরুণ গৌড়দেশে কতকাল পর্য্যন্ত বুধগুপ্তের অধিকার অক্ষুণ্ণ ছিল তা সঠিকভাবে বলতে পারা যায়নি। তবে সারনাথে আবিষ্কৃত শিলালিপি থেকে ১৫৭ গৌপ্তাব্দে (৪৭৬ খৃঃ অব্দ) বারাণসীতে অর্থাৎ মধ্যদেশে বুধগুপ্তের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও দামোদরপুরের তাম্রলিপিতে যেহেতু তারিখের উল্লেখ নেই, সেহেতু এ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে যে পুণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তি কিছুকাল বুধগুপ্তের রাজ্যভুক্ত ছিল। অতএব এটা অনুমান করা যেতেই পারে যে, যে সময়ে মধ্যদেশ বুধগুপ্তের রাজ্যভুক্ত ছিল সেই সময়ে অথবা তাঁর অব্যবহিত পূর্ব্বে বা পরে গৌড়দেশও তাঁর রাজ্যভুক্তই ছিল। 

  তবে পন্ডিতরা নিরুপায় হয়ে আশ্রয় নেন হিউ-এন-সাং এর। কারণ তিনি বর্ণনা দিয়েছিলেন যে, বুদ্ধগুপ্ত শক্র্যাদিত্যের পুত্র। তবে বলাইবাহুল্য, এই বুধগুপ্ত/বুদ্ধগুপ্ত এক ও অভিন্ন দুই হতে পারেন, যেমন পারেন কুমারগুপ্ত/মহেন্দ্রগুপ্ত/শক্র্যাদিত্যের সঙ্গে। তাই এ ব্যাপারে ঐতিহাসিকরা নিশ্চিত হলেন বুধগুপ্ত সম্পূর্ণভাবেই গুপ্তবংশভূত। প্রমাণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৪৩ সালে নালন্দা থেকে পাওয়া একটি ভগ্ন মৃত্তিকালিপি থেকে স্পষ্ট ধারণা করা যায়, যেখানে পরিষ্কারভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে বুধগুপ্ত শুধু গুপ্তবংশের রাজাই নন, উনি সমুদ্রগুপ্ত থেকে আরম্ভ করে ক্রমানুসারে অন্যান্য গুপ্ত রাজার সঙ্গে সমকক্ষে নিশ্চিতভাবে স্থানাধিকৃত।

 যদিও এই আলোচনায় গুপ্তবংশের তালিকা অপ্রাসঙ্গিক, তবুও, এই দীর্ঘ আলোচনার পর গুপ্তধিকার কালের তালিকা না প্রকাশ ঘটালে আমার ধারণা পাঠকদের নিকট বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বচ্ছই রয়ে যাবে। তাই নিম্নে গুপ্তপর্যায়টি উল্লেখ করলাম- 

গুপ্তরাজবংশের অভ্যুদয়—(প্রথম) চন্দ্রগুপ্ত—গৌপ্তাব্দের প্রারম্ভ—সাম্রাজ্যের সূত্রপাত—বর্দ্ধমানে আবিষ্কৃত প্রথম চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রা—সমুদ্রগুপ্ত—তাঁহার দিগ্বিজয় ও অশ্বমেধ—এলাহাবাদ স্তম্ভলিপি—দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত—মালব ও সৌরাষ্ট্র অধিকার—সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরীণ অবস্থা—চীন পরিব্রাজক ফা-হিয়েন্‌—প্রথম কুমারগুপ্ত—অশ্বমেধ—নাটোরে আবিষ্কৃত তাম্রশাসন—পুষ্যমিত্রীয় ও হূণজাতির আক্রমণ—অর্থাভাবে নিকৃষ্ট মুদ্রার প্রচলন—স্কন্দগুপ্ত—হূণসমস্যা-অন্তর্বিদ্রোহ ও বহিঃশত্রুর আক্রমণ—গুপ্ত সাম্রাজ্যের ধ্বংসসূচনা—পুরগুপ্ত—সাম্রাজ্য মগধ ও বঙ্গে সীমাবদ্ধ—নরসিংহগুপ্ত—দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত—বুধগুপ্ত—ভানুগুপ্ত—তৃতীয় চন্দ্রগুপ্ত (দ্বাদশাদিত্য)—বিষ্ণুগুপ্ত (চন্দ্রাদিত্য)—মুরশিদাবাদে বিষ্ণুগুপ্ত ও জয়গুপ্তের সুবর্ণমুদ্রাবিষ্কার।
 উপরিক্ত আলোচনার বিষয়বস্তুটির উপস্থিতি সত্যিই প্রয়োজন ছিল কারণ লেখমালার গুরুত্বটুকুর অনস্বীকার্যতা বোঝানোর জন্য। বিষয়টি স্মরণে রাখা প্রয়োজন, গুপ্তবংশের ইতিহাস স্থাপন করা একমাত্র লেখমালার দ্বারাই সম্ভব হয়েছিল। ঠিক যেমনভাবে স্থাপন করা গিয়েছিল চন্দ্রবংশের ইতিহাস, পান্ডববংশের ইতিহাস এবং চোলদের ইতিহাস। বিশেষভাবে উল্লেখ্য শুধু ইতিহাস নয়, লেখমালার সাহায্যে সম্পূর্ণটুকুর পুনর্গঠন করা সম্ভবপর হয়। তাই আমার বিশ্বাস লেখমালার ভূমিকা শুধু ইতিহাসে নয় সাহিত্যও সমানভাবে অনস্বীকার্য। যদিও, এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে সমুদ্রগুপ্তের সামরিক অভিযান সম্পর্কে জানা গেলেও, বর্তমান বিবরণী এ বিষয়ে প্রায় নীরব এটুকু বলা যায় নিঃসন্দেহে।

(ক্রমশ..)
-------------------
আরও পড়ুন

ঐতিহাসিক হোক বা সাহিত্যিক উভয়কেই ইতিহাস অথবা সমাজবিজ্ঞান চর্চার জন্য প্রচলিত শিলালিপি, মুদ্রা বা তাম্রলেখ অথবা মহাফেজখানা বা অভিলেখগারের প্রত্ন-সামগ্রীকের উপরই নির্ভরশীল হতে হয়, তা লিখিত-ই হোক বা অলিখিত।

Post a Comment

0 Comments