জ্বলদর্চি

প্রয়াত ফুটবলের নায়ক মারাদোনা / অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়

গ্যালারি থেকে Arena-5

প্রয়াত ফুটবলের নায়ক মারাদোনা

অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়

বিদ্রোহ, বিপ্লব ও একটি বাম পা

১৯৯৪ সাল। আমার বয়স তখন মাত্র আট। কিন্তু খেলার পোকা। ক্রিকেট তো আছেই, অথচ ফুটবলের প্রতি আলাদা টান। অল্প অল্প প্লেয়ার চিনছি। চেনাচ্ছে বাবা। ভোরবেলা উঠে বাবার কোলে বসে বিশ্বকাপ দেখছি। দেখি ঝাঁকড়া চুলের একটা লোক মাঠে বল নিয়ে ছুটছে। বাবা টিভির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলছে ওই দেখ ভালদারামা। কলম্বিয়া টিমে খেলে। ওই দেখ বাজ্জিও। ওই দেখ রোমারিও, বেবেতো। ওই তো সোনালি চুল নিয়ে ক্লিনসম্যান। কিন্তু সামান্য জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই যার কথা অনবরত শুনে চলেছি বাবার মুখে তার নাম মারাদোনা। বাবা বলেছে, পৃথিবীতে যত ফুটবল প্লেয়ার আছে তাদের সবার সেরা মারাদোনা। গল্প শুনেছি কীভাবে একা হাতে ৮৬ সালের বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিল আর্জেন্টিনাকে। কীভাবে ৯০ সালে ফাইনালে বিতর্কিত পেনাল্টিতে হেরে গিয়েছিল লোকটা। আর যখনই এই কথাটা বাবা বলে এখনও উত্তেজিত হয়ে ওঠে- 'ওটা ইচ্ছে করে পেনাল্টি দিয়ে ছিল শুধু জার্মানদের সম্মান রক্ষা করতে'। 

সেই আবেগের মানুষটার ছবি আগেই দেখে নিয়েছি। এবার আসল খেলা দেখার পালা। বিশ্বকাপ চলছে আমেরিকায়। তখন এখানে বোধহয় রাত দুটো। একটা ছোট্ট সাদা কালো টিভিতে ছোট কাকুর সাথে বসে দেখছি সেই স্বপ্নের মানুষটাকে। গ্রিসের সাথে খেলা। দেখছি মানুষটার চেহারাটা একটু ভারি হয়ে গেছে। ছোট ছোট চুল। কিন্তু পায়ের কাজ যেন ভ্যান গখের তুলি। পেনাল্টি বক্সের সামনে ডান পায়ে একটা গড়ানো ক্রস ধরলো। সামনে পাঁচ জন প্লেয়ার প্রায় দুর্ভেদ্য মানব প্রাচীর গড়ে তুলেছে। কিন্তু কী যে হলো। বলটি ডান থেকে বাঁ পায়ে নিয়েই একটি শট, না শট বলবো না, একটি নিখুঁত তুলির আঁচড়। গোটা বিশ্ব মুগ্ধ হয়ে দেখলো পাখির মতো ডানা ঝাপটে বল গিয়ে নিশ্চিন্তে আশ্রয় নিয়েছে জালে। আমি যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। মনে হলো ছুটে গিয়ে একটা চুমু খাই টিভিতেই। চোখের সামনে দিয়ে উড়ে গেল অজস্র রোশনাই। 

সকাল সকাল খুব হইচই। বাবা খুব উত্তেজিত। 'অন্যায় হচ্ছে লোকটার সাথে। প্রচন্ড অন্যায়। এভাবে মারাদোনাকে থামিয়ে রাখা যাবে না।' কথাবার্তায় যা বুঝলাম, সেবারের মতো মারাদোনাকে ডোপ টেস্টের দায়ে বিশ্বকাপ থেকে নির্বাসিত করা হয়েছে। টিভিতে ভেসে উঠলো মারাদোনা হাউহাউ করে কাঁদছে আর বোঝাতে চাইছে তাকে ফাঁসানো হয়েছে। সেদিন সারা বিশ্ব নিশ্চিত কেঁদেছিল। কেঁদেছিল এই পৃথিবীর প্রতিটি মাঠের প্রতি ঘাস। প্রতিটি গোলপোস্ট। ষড়যন্ত্রের যে দাবী তুলে ছিল মারাদোনা তাকে কি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায়? হয়তো যায় না। আদ্যন্ত বামপন্থী এই মানুষটি চিরকাল অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে এসেছে। চিরটাকাল ঠোঁট কাটা মানুষ হিসেবেই পরিচয় পেয়েছে। আর সেই কারণেই পেয়েছে দুর্বিনীত আখ্যা। নাপোলিতে খেলার সময় হঠাৎই মনে হয়ে ছিল 'আমি কেন বেশি টাকা পাবো! বাকি প্লেয়াররা কেন আমার সমান টাকা পাবে না!' সেই দাবিতে ক্লাবে বিক্ষোভ শুরু করে ছিল। কেউ একজন বলেছিল 'পেলেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সাথে বসিয়ে দিলে পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক- রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ১৫ মিনিট আলোচনা করে নিতে পারবে। আর মারাদোনা হয়তো ৫ মিনিট বাদে এক চড়ই বসিয়ে দেবে'। সেই মানুষটা বারংবার আমেরিকার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে, বিদ্রোহের ফুল ফুটিয়েছে, নির্দ্বিধায় বলতে পেরেছে  "I hate everything that comes from the United States. I hate it with all my strength." তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ আমেরিকা ছেড়ে দেবে এটা বিশ্বাস হয় না। কোথাও হয়তো ফিদেল কাস্ত্রোর এই শিষ্যটির বিরুদ্ধে গোপন রাগটি অন্যভাবেই পুষিয়ে নিয়েছিল। এই ঘটনার পর কেউ একজন বলেছিল ' আমি যে কোনো প্লেয়ারকে ড্রাগ খাইয়ে মাঠে নামাচ্ছি। মারাদোনার মতো খেলে দেখাক'।

১৯৭৮ এ মারিও কেম্পেস-এর নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ ফুটবল জেতার পর ৮২ সালে ছোট্ট মারাদোনাকে নিয়ে প্রবল আবেগ তৈরী হয়ে ছিল আর্জেন্টিনা জনমানসে। কিন্তু মারাদোনা ৮২তে তুমুল ব্যর্থ হয়। ছোটখাটো চেহারা এবং কমবয়েসী মারাদোনাকে মাঠে প্রবল ট্যাকলের সামনে প্রায় দাঁড়াতেই দেয়নি। সারা দেশ জুড়ে এই প্রতিভার বিরুদ্ধে লেখা হতে থাকে বহু কথা। বরাবরের আবেগী মানুষটা রাগে দুঃখে বুয়েনস এয়ারস ছেড়ে দূরে গ্রামে চলে যায়। সেখানে তার কাজ তখন সারাদিন মাছ ধরা। সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন যে ফুটবল আর খেলবেন না।  কিন্তু কোচ কার্লোস বিলার্দো বুঝে ছিলেন এই আবেগী ছেলেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বোঝাতে হবে সমালোচনাও খেলার একটা অংশ। সেটিকে পজিটিভ ভাবে গ্রহণ করতে হবে। এই প্রতিভাকে এত সহজে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। বিলার্দো খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে যান সেই গ্রামের বাড়িতে। মারাদোনা কাঁদতে কাঁদতে বললো ' ওরা খেলতেই দেয় না মাঠে। খালি মারে। দেশের মানুষও বোঝে না। আমি কি ইচ্ছে করে এমন করেছি। আমি আর ফুটবল খেলবো না'। বিলার্দো বুঝিয়ে মাঠে ফেরালেন মারাদোনাকে৷ বাকিটা ইতিহাসের পাতায় উঠে গেল চিরকালের জন্য। 

পৃথিবীর ফুটবল পাগল মানুষদের একটি চিরকালীন প্রশ্ন, ফুটবলার হিসেবে কে বড়ো পেলে না মারাদোনা? এই প্রশ্নে আড়াআড়ি দুভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে ফুটবল সমাজ। কিন্তু এই প্রশ্নের সোজাসাপটা জবাব মারাদোনার মুখ দিয়ে বেরিয়েছে " "There would be no debate about who was the best footballer the world had ever seen - me or Pele. Everyone would say me." নিজের যোগ্যতা এবং দক্ষতা সম্পর্কে কতটা আত্মবিশ্বাস থাকলে এ কথা বলা যায় স্পষ্ট ভাবে৷ আর বাস্তবিকই, পেলের বিশ্বকাপ জয়গুলির সময় তার পাশে ছিল ভাভা, ডিডি, গ্যারিঞ্চা সহ বিশ্বের আরো সব শ্রেষ্ঠ 
নামকরা প্লেয়ার। কিন্তু মারাদোনার সময়? মনে করতে পারেন পাঠক আর ঠিক কে ছিল সেই ৮৬ কিংবা ৯০ এর টিমে একটা বুরুচাগা কিংবা একটা ক্যানিজিয়া ছাড়া। নাপোলির মতো একটা ছোট্ট ক্লাবকে একার পায়ে সেরি-আ জিতিয়ে দিতে পারে যে লোকটা তাকে শ্রেষ্ঠত্বের তকমা দিতে বাধা কোথায়! পেলে সম্ভবত একবার বলে ছিল ' ওকে আগে তিনবার বিশ্বকাপ জিততে বলো তারপর আমার সাথে নিজের তুলনা করতে আসবে'। মারাদোনার দ্রুত প্রত্যুত্তর ছিল 'ওকে আগে নাপোলিতে এসে সেরি-আ জিততে বলো তারপর আমার সাথে নিজের তুলনা করতে আসবে।' 

পশ্চিমবঙ্গে এসে মানুষটি একজনের সাথেই ব্যক্তিগত আলাপচারিতার ইচ্ছা প্রকাশ করে ছিল। তার নাম জ্যোতি বসু। মানুষের প্রবল উন্মাদনায় বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল 'আমি ভাবতেই পারিনি ভারতে আমার এত ফ্যান আছে।' সেদিনের সেই দৃশ্য মনে পড়ে পাঠক। সাক্ষাৎ ফুটবল ভগবানের দর্শন পাওয়ার আবেগে ব্যাকুল হয়ে পড়ে ছিল আমাদের বঙ্গদেশ। 

একটি প্রজন্ম ফুটবলপ্রেমী হয়ে উঠছে কোনো একজন মানুষের জন্য এরকম দৃষ্টান্ত ফুটবলের ইতিহাসে আর নেই। এখনও কত প্রৌঢ়ের ট্রাঙ্ক খুললে দেখা যাবে তাতে ন্যাপথালিন দিয়ে রাখা রয়েছে একটা ফিকে হয়ে যাওয়া নীল সাদা ১০ নং জার্সি। তার ভেতরে মুড়ে রাখা কিছু না ফুরোনো আবেগ, কিছু নিখাদ ভালোবাসা আর অমর হয়ে যাওয়া একটা উক্তি "I am Maradona, who makes goals, who makes mistakes. I can take it all, I have shoulders big enough to fight with everybody."।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments