জ্বলদর্চি

কথাশিল্পী নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়/মধুমিতা মহাপাত্র


কথাশিল্পী নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

মধুমিতা মহাপাত্র

আমার কীর্তিরে আমি করিনা বিশ্বাস
জানি কাল সিন্ধুতীরে
নিহত তরঙ্গাঘাতে
দিনে দিনে দিবে লুপ্ত করি
এ বিশ্বকে ভালোবাসিয়াছি
এ ভালবাসাই সত্য এ জন্মের দান
বিদায় নেবার কালে
এ -সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার।

 কথাশিল্পী নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের নিজের সীমানা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত থেকে কবিগুরুর ভাষায় এই সান্ত্বনা- নিশ্চিত বিনীত আশঙ্কা ছাড়া আর কিছুই নয়। পাঠক মাত্রই জানেন কালসিন্ধু নিয়ত তরঙ্গাঘাতে তাঁর কীর্তিকে লুপ্ত করতে পারেনি বরং সময়ের সাথে সাথে তা নিত্য সমুজ্জ্বল। তাই তাঁর প্রয়াণের অর্ধশতাব্দী পরেও গল্পপ্রেমী পাঠক ও গবেষকগণের ঔৎসুক্যের অন্ত নেই।

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ১৯১৮ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি দিনাজপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা প্রমথনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন পুলিশ অফিসার, আশ্চর্যরকম বইপ্রেমী পড়াশোনাই ছিল তাঁর একমাত্র নেশা। বাড়িতে সমৃদ্ধ লাইব্রেরী ছিল সেই সঙ্গে বাংলাদেশের যতরকম দৈনিক -সাপ্তাহিক -মাসিক পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন তিনি। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্যের প্রতি অনুরক্তি একান্ত ভাবে তাঁর বাবার কাছ থেকে পাওয়া। সেইসঙ্গে বাবার বদলির চাকরি সূত্রে তাঁর শৈশব ও ছাত্র জীবন ছিল বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতায় পূর্ণ ,যা ভবিষ্যতে সাহিত্যিক হওয়ার পথটিকে প্রশস্ত করেছিল।

 ১৯৩৩ সালে দিনাজপুর জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর বরিশাল বি.এম কলেজ থেকে ১৯৩৬ সালে আই.এ এবং ১৯৩৮ সালে বি.এ পাস করেন।১৯৪১সালে অসামান্য ফলাফলের জন্য ব্রহ্মময়ী স্বর্ণপদক পেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাস করেন। বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প নিয়ে গবেষণার জন্য  তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.ফিল ডিগ্রী অর্জন করেন। প্রথমে জলপাইগুড়ির আনন্দচন্দ্র কলেজে ও পরে কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করার পর ১৯৫৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। অধ্যাপনা শুধু তাঁর পেশা নয় অধ্যাপনা ছিল তাঁর জীবন।তিনি তীক্ষ্ণধী ও অসাধারণ স্মৃতি শক্তির অধিকারী ছিলেন। অধ্যাপক হিসেবে কতখানি সমাদৃত ছিলেন তা তাঁর গুণমুগ্ধ কৃতি ছাত্রদের জবানিতে পাওয়া যায়। "তাঁর ক্লাসে এত জনসমাগম হত যে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসতে হতো।"আলোচ্য বিষয়কে করে তুলতেন প্রাণবন্ত অথচ তথ্য সমন্বিত। বিষয়ের প্রতি দুর্নিবার আগ্রহ গড়ে তোলার ব্যাপারে তাঁর জুড়ি ছিল না। তাঁর সৃষ্টিতে অধ্যাপক, স্কুলশিক্ষক ও গৃহশিক্ষক চরিত্র মধ্যবিত্ত  জীবন দর্পণের অঙ্গ হিসেবে তাই প্রতিফলিত হয়েছে বারেবারে।
 রোমান্টিক কবি মন নিয়ে পথ চলা শুরু হলেও কথা সাহিত্যিক হিসেবেই তাঁর সমধিক পরিচিতি। উপনিবেশ, শিলালিপি, বৈতালিক ,স্বর্ণসীতা, অমাবস্যার গান এর মতো বহু খ্যাত উপন্যাসের স্রষ্টা হলেও ছোটগল্পে তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ একথা নিজের মুখে স্বীকার করেছেন-'আমার পরিচয় যদি আপনাদের কাছে কিছু দেবার থাকে তাহলে সে আমার জীবন নয় গল্পে'।

 পরাধীন ভারতের 'দুঃসহ যন্ত্রণার 'সময় তাঁর লেখা শুরু। জীবন ও পেশার সঙ্গে সমানতালে সে ধারা অব্যাহত ছিল আমৃত্যু। জীবনকে, মানুষকে ভালোবাসাই ছিল সে ধারার মূল অনুপ্রেরণা। সময়ের সাথে সাথে তাঁর সৃষ্টিবৃক্ষ শত- সহস্র শাখা-প্রশাখা , পত্র -পুষ্প- ফলে পরিপূর্ণ হয়ে আকীর্ণ করেছে সাহিত্য দিগন্তকে।
 বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নিজস্বতায় সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি একাধারে রোমান্টিক, অন্যদিকে যুগের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নৈরাশ্য বর্ণনায় সিদ্ধহস্ত। কখনও চরিত্র ও ঘটনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন আবার কখনো এসব প্রবণতার বাইরে 'মনস্তত্ত্বের রহস্যময় অন্তর্লোকে যাত্রা করেছেন'- এরকম অসাধারণ ক্ষমতা ছিল বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যাওয়ার। তাঁর গল্প সম্ভার এর মধ্যে সমকালীন লেখকগণের মতো কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়-সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি প্রকৃতি প্রেম ও রোমান্টিকতা মনস্তত্ত্ব সেকাল-একাল এর দ্বন্দ্ব প্রভৃতি। যদিও তাঁর শক্তিশালী লেখনীর গুনে তা সাধারণ থেকে  অসাধারণত্বে উত্তীর্ণ হয়েছে।

  'উত্তাল একযুগ পরিবেশে' নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের আবির্ভাব‌। তাই তাঁর গল্প যেমন 'ক্ষোভ -ঘৃণা-জুগুপ্সার শত সঞ্চারী' প্রতিহিংসার সাতকাহন, তেমনি শুভচেতনা ও আশাবাদের রত্নখনিও।নৈরাশ্য বেদনা দুষ্কর্মের মাঝেও তাঁর সৃষ্টি আশা জাগায়। এসব সত্য হলেও 'শেষ সত্য নয় '-এই শুভ ইঙ্গিত দেয়। দৈনন্দিন অপকর্ম সত্বেও মনুষ্যত্ব বিবেক বিশ্বাস ভালবাসার প্রয়াণ ঘটেনি।'তারা অলক্ষ্যে বেঁচে আছে জীবনের গভীরের তার শেকড়।'

 'সংযম', 'সহিষ্ণুতা' শব্দ দুটি তাঁর রচনায় অনন্য মাত্রা পেয়েছে। তাই তাঁর গল্প যে 'সহে সে রহে' প্রবাদের জীবন্ত চিত্র। তবে চরিত্র রূপায়ণের ক্ষেত্রে সহনশীলতা কোন কোন জায়গায় আরোপিত মনে হলেও তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে। 'সত্য'আর  'শিল্পিত সত্য' দুটোর মধ্যে মিল থাকে কিন্তু বুঝতে না দেওয়া লেখকের মুন্সিয়ানা। লেখক এটি দক্ষতার সঙ্গে করেছেন বলেই চরিত্রগুলো আমাদের জীবনের ও মননের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে গেছে।
  তাঁর লেখায় ধর্মীয় মিথ্যাচার, কুসংস্কারের প্রতি তীব্র কটাক্ষ লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে ভেকধারী তান্ত্রিকের বর্ণনায় লেখক ক্ষমাহীন। তাঁর ভাবনায়- কর্ম আর মানুষের মানবিকতার মধ্যে ধর্ম নিহিত। তিনি তাঁর ধর্মীয় ভাবনা ও  সংস্কার সম্পর্কিত গল্পগুলোতে যেন নান্দনিকতার মোড়কে বিজ্ঞানমনস্কতার পাঠ দিচ্ছেন। নিজের ভাবনাকে উপস্থাপন করেছেন সেই সঙ্গে পাঠকের জন্য রেখে গেছেন ভাবনার অফুরন্ত পরিসর।
জীবনে আধুনিক হয়েও মানুষ যখন মননে মধ্যযুগীয় সংস্কারকে লালন করে চলে সেই দুঃসময়ে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পের পাঠ বিশেষ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।আজ বিজ্ঞানের আনুকূল্যে সভ্যতা যখন উন্নতির শীর্ষ দেশ ছুঁয়েছে, তখনও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁথে থাকা কুসংস্কার ও ধর্মীয় ভন্ডামীর জ্বালায় অতিষ্ঠ প্রাণ। ওঝা ও তান্ত্রিকের নিদানে জীবনহানি, সম্মানহানি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।ধর্মকে হাতিয়ার করে মানুষের চোখে ঠুলি পরিয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে কত কূটকৌশলী মানুষ। ক্ষুদ্র স্বার্থ প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মের নামে সমাজ দেহে প্রবেশ করাচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ। বর্তমানে এই অসহিষ্ণুতার পেক্ষাপটে প্রতিশোধ স্পৃহা যখন দেশ জাতি ও সমাজের চিন্তার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে তখন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প মানুষকে স্থিতধী হওয়ার প্রেরণা দেয়। আমাদের কাছে হয়ে ওঠে পরম আশ্রয়। 

১৯৭০ সালের ৮ নভেম্বর নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
প্রয়াত হন। আজ এই মহান সাহিত্য সাধকের প্রয়াণ দিবসে জানাই বিনম্র প্রণতি।
------
আরও পড়ুন 
জ্বলদর্চি পেজ-এ লাইক দিন।👇


Post a Comment

1 Comments