জ্বলদর্চি

অবশেষে, কোভিড থেকে ফিরে/ রমণীকান্ত পাত্র

অবশেষে, কোভিড থেকে ফিরে

অবশেষে, ফিরে এলাম। ফিরে এলাম মৃত্যুর চৌকাঠ থেকে। প্রায় এগারো দিন সরকারি কোভিড হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। অদৃশ্য শত্রুর সাথে অনবরত যুদ্ধ করে করোনা জয় করে এখন আমি বাড়িতে। 

ধন্যবাদ ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব, ও সংশ্লিষ্ট সকলকে যারা প্রতিনিয়ত আমার পাশে থেকে আন্তরিকভাবে সেবা, শুশ্রুষা, সহযোগিতা, ও সাহস দিয়েছেন।

বৃহস্পতিবারের বারবেলা। সেঞ্চুরির উপরে শরীরের তাপমাত্রা, কাশি, সর্দি ইত্যাদি শরীরকে বিধ্বস্ত করছে।গত 6 ই নভেম্বর শুক্রবার গেলাম কাঁথি মহকুমা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে করোনা পরীক্ষার জন্য। এন্টিজেন পরীক্ষা, ট্রু নাট পরীক্ষা, আর টি পি সি র পরীক্ষা মধ্যে আমি দ্বিতীয় পরীক্ষার জন্য সম্মতি প্রকাশ করি ।

সকাল থেকে মনটা কু গাইছে। ঠাকুরকে ডাকছি, 'হে ঠাকুর! আমি যেন করোনা আক্রান্ত না হই'। কিন্তু আশঙ্কা সত্যি করে ওই দিন বিকেল চারটায় দুরাভাসে বার্তা আসে 'আমি positive।'

সকাল থেকে মনের কোণে জমাট বাঁধা দুঃখগুলো দিনের শেষে আমার ও আমার পরিবারের চোখ দিয়ে ঝর্নার জলের মতো ঝরে পড়ছে। অগত্যা, এক প্রাক্তন ডাক্তার ছাত্রকে ফোন করলে উত্তর আসে -' বাড়িতে থেকে চিকিৎসা করা সব চেয়ে ভালো।' করোনা আক্রান্ত হয়ে  হাসপাতালে ভর্তি হবেন তখনই যদি দেখেন যে -১. পালস অক্সি মিটারে আপনার শরীরের অক্সিজেন সাচুরেশন লেবেল ৯২ এর কম হচ্ছে।২. এক নিশ্বাসে ১,২,৩, ডাকুন। যদি দেখেন যে ২০ এর বেশি আর ডাকতে পারছেন না। ৩. ছয় মিনিট একনাগাড়ে হাঁটুন। যদি দেখেন যে নির্ধারিত সময়ের আগে আপনি হাঁপিয়ে উড়ছেন। ৪.আপনার যদি সহ - অসুস্থতা ( comorbidity) থাকে তাহলে হাসপাতালে ভর্ত্তি হওয়া ভালো। করোনা comorbidity বলতে হাইপারটেনশন, সুগার, হার্টের অসুখ, ফুসফুস সংক্রান্ত সমস্যা, কিডনি সমস্যা, ক্যান্সার ইত্যাদি।
আমি সদ্য হার্টের অপারেশন হয়েছি, নিয়মিত সুগার ও প্রেসারের ঔষধ খাই অর্থাৎ অনেকগুলো উপসর্গ থাকায় সরকারি হাসপাতালে ভর্তির জন্য একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। আমার পরিবার ও আত্মীয় স্বজন কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তির পক্ষে মত পোষণ করলেও ঘটি বাটি বিক্রি হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমি আমার নিজ সিদ্ধান্তে অটুট থাকি।

পশ্চিম দিগন্তে রক্তিম আভা সূর্য অস্তগামী। বাড়ির গেটের সামনে অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ। চোখের জলে পরিবারকে বিদায় দিয়ে আম্বুলান্সের দরজায়। একী দেখছি! আমুলান্সের মধ্যে আরো দুজন । একজন অশীতিপর বৃদ্ধ অক্সিজেন নল লাগিয়ে শুয়ে আছে।অপরজন বিপরীত শিটে বসে অনবরত খুশখুশে কাশি কেশেই চলেছে। আমি ভয়ে ভয়ে দ্বিতীয়জনের পাশে বসলাম। নির্বাক, নিশ্চুপ, প্রতিবাদী কন্ঠস্বর আজ রুদ্ধ। মনে হলো  - অনিয়মের এই শুরু ।

পরিবারের চোখের জল, গাছ গাছালি, সেতু, নদী প্রভৃতি দৃশ্য পিছনে ফেলে পৌঁছলাম ঝাঁ- চকচকে চন্ডিপুর সুপার স্পেশালিটি করোনা হাসপাতালে। অ্যাম্বুলেনস থেকে নামা মাত্রই চালক প্রায় জোর করেই প্রত্যেকের পকেট থেকে তিনশত টাকা বের করে নিল। অবাক হলাম। ভাবলাম, সরকারি নিয়মের পর্দার আড়ালে রাহাজানির ট্র্যাডিশন এখনও সমানে চলেছে । 

ঠাঁই পেলাম একটি বেড়ে। সারা রাত ঘুম হয়নি। ঘরের মধ্যে রোগীরা বিভিন্ন অস্পষ্ট স্বরে তাদের ব্যথা জানান দিচ্ছে। কেউবা যেন মৃত্যুর দেবতার সাথে মিতালি করছে।

শনিবারের সকাল। সোনালি রোদের ছটা জানলা দিয়ে উঁকি মারছে। নার্সিং হোমের মালিক তথা হাসপাতালে ডাক্তার জানা এসে আমার সব খোঁজ খবর নিলেন।উনার সাথে আমার সামান্য পরিচয় ছিল। মরচে ধরা পরিচয় নতুন করে ঝালাই হল। ডাক্তারবাবু আমার পিঠে হাত রেখে বললেন -'এখানে সব রকম পরিষেবা ও পথ্য দিয়ে আপনাকে সুস্থ করার দায়িত্ব আমার।' ডাক্তার বাবুর কথায় অভিভূত হয়ে গেলাম। দু চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। আবেগে বলেই ফেললাম, ' আপনি আমার ভগবান।'

এরপর ডাক্তার বাবু প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলার জন্য বাড়ির লোকের ফোন নাম্বার চাইলেন। আমি আমার শ্যালকের ফোন নাম্বার দিলাম। এরপর আমার মোবাইল টা নিয়ে সুইচ অফ করে নিজেদের কাছে রেখে দেয়।

পড়ন্ত বিকেলে মনটা কি রকম করছে। আমি আমার মোবাইলটা জোর করে নিই। মোবাইলে whatts app এ বার্তা দেখে আমি অবাক! আমার শ্যালক ম্যাসেজ করেছে,' আমাকে এক বিশেষ ধরনের ইনজেকশন দিতে হবে। মোট তেত্রিশ হাজার টাকা লাগবে। আজ তেরো হাজার টাকা জমা জমা দেওয়া হয়েছে। বাকি কুড়ি হাজার টাকা জমা দিতে হবে।'
 
সন্দেহের উদ্রেক হলো। সত্যাসত্য যাচাইয়ের জন্য পূর্বমেদিনীপুর জেলার মুখ্য সাস্থ্য আধিকারিক ডাক্তার নিতাই চন্দ্র মণ্ডলকে (আমাদের বিদ্যালয়ের অর্থাৎ বনমালীচট্টা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ) ফোনে বিষয়টি জনাই। উত্তর আসে - (ওই ধরনের ঔষধের কোনো কার্যকারিতা নেই। তাছাড়া সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ও ঔষধের জন্য কোনো টাকা লাগে না। সব কিছু বিনে পয়সায় চিকিৎসা করা হয়।আপনি টাকা ফেরত নিন এবং পাঁশকুড়া বড়মা হাসপাতালে চলে আসুন। অনেক বাকবিতণ্ডা পর অবশেষে সন্ধ্যা সাতটার সময় অ্যাম্বুলেন্সের করে বড়মা উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সকাল বেলায় যে ডাক্তারকে ভগবানের আসনে বসিয়েছিলাম, সন্ধ্যাবেলায় মনে হলো ও যেন কসাইখানার কসাই ছাড়া আর কিছু নয়। সকালের ভগবান পরিণত হলো চিরকালের শয়তান।

বড়মা-তে ছিলাম দশ দিন। পরিষেবা সন্তোষজনক।একটা সময় আমার অবস্থা সংকটজনক ছিল। ডাক্তারবাবুরা আপ্রাণ চেষ্টা করে আমাকে এ যাত্রা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। এখানকার ডাক্তাররা আমার কাছে ভগবান।

আমি এখন হোম আইসোলেশনে।
অপেক্ষায়- ভ্যাকসিনের।
---------------
লেখক - সহকারী প্রধানশিক্ষক - বনমালীচট্টা হাইস্কুল(উঃমাঃ)। কবি, প্রাবন্ধিক।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

2 Comments