জ্বলদর্চি

তিনটি অণুগল্প/ উদিত কোনার



তিনটি অণুগল্প 

উদিত কোনার
    ফোটোগ্রাফি - সৈয়দ স্নেহাংশু 

বিচ্ছেদ

ছোট্ট একটা বস্তির দুটি ছেলে জামাল ও সুরেশ।ছোটো থেকেই তাদের মধ্যে একটা গভীর বন্ধুত্ব ছিল।তারা দুজনে সমবয়সী।তাদের দুজনের পরিবারেই নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।তাদের মা, বাবারা সকালেই কাজের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।বাবারা দিনমজুরের কাজ করেন, আর মায়েরা লোকের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন।খাবারের বড়ই অভাব।বস্তি থেকে কিছুটা দুরেই একটা স্কুল ছিল।সেখানেই তারা পড়ত।তবে তারা পড়াশোনা করার আশায় যত না স্কুলে যেত, তার থেকে বেশি যেত মিড্ ডে মিলের দুটি খানি খাবারের আশায়।অভুক্ত পেটটাকে ভরাতে।বাড়িতে রান্না বলতে শুধু রাতের বেলায় দুমুঠো ভাতের সঙ্গে কিছু একটা পদ।জামালের মন মেজাজটা কয়েকদিন ধরেই ভালো যাচ্ছিল না।মহামারীর আবহে এবারের ঈদের আনন্দটাই তার মাটি হয়ে গেছে।সে ঠিক করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সুরেশের সঙ্গে এবারের পুজোতে খুব মজা করবে।এবার ঈদের নতুন জামাটাও সে পড়েনি।পুজোতে পড়ার জন্য সে জামাটা তুলে রেখে দিয়েছিল।তবে পুজোর প্রত্যেকটা দিন আলাদা আলাদা জামা পড়ার সামর্থ তাদের ছিল না।ওই একটা জামাই তাদের কাছে পরম পাওয়া।সেদিন নিম্নচাপের প্রভাবে অনবরত বৃষ্টি পড়ছিল।শরতের এই প্রখর রৌদ্রে কয়েকদিনের ঠান্ডা আবহাওয়া, চারিপাশে থইথই করা জল, সোঁদা মাটির গন্ধে দুটো নিষ্পাপ, তরতাজা, বাঁধনহারা প্রাণ ঘরে থাকতে না পেরে বেরিয়ে পড়ে প্রকৃতির মাঝখানে মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে একটু শ্বাস নেওয়ার জন্য।বস্তি থেকে কিছুটা দুরেই একটা মিউনিসিপ্যালিটি স্টোর ছিল।সেখান থেকে তারা দুটো টায়ার আর দুটো লাঠি নিয়ে, সেই লাঠির সাহায্যে টায়ারগুলো ঘোরাতে ঘোরাতে ছুটে চলে বৃষ্টির মধ্যেই।বৃষ্টিতে ভিজে, কাদা মেখে, টায়ার ঘোরাতে ঘোরাতে ছুটে চলে দুটো উৎফুল্ল হৃদয়।কোনো বাধাই যেন  আজ আর তাদের আটকাতে পারবে না।এই রাস্তা ওই রাস্তা করে তারা শেষ পর্যন্ত বড় রাস্তায় গিয়ে পৌঁছায়।জামালের টায়ারটা বড় রাস্তার মাঝে গিয়ে পড়ে যায়।জামাল সুরেশকে বলে "তুই এগো, আমি টায়ারটা নিয়ে আসছি।"সুরেশ আবার ছোটা শুরু করে।কিন্তু হঠাৎ একটা বিকট্ শব্দ।সে পিছনে তাকায়।দেখে একটা বড় গাড়ির সামনে জামালের নিথর দেহটা পড়ে রয়েছে।আর গোটা রাস্তা রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

ফোটোগ্রাফি - সৈয়দ স্নেহাংশু 

স্বাগতম

"উর্মি কেমন আছ?", এক চেনা গলার স্বরের আওয়াজ পেয়ে উর্মি পিছনে তাকিয়ে দেখে অংশু।

" তু, তু, তুমি", উর্মির গলা কেঁপে উঠল।

"কি ভাবলে মরে গেছি।না ডার্লিং অত সহজে যে আমি মরব না।আর তোমার প্রিয়তম অভীকের ক্ষমতা নেই আমাকে মারার।কিন্তু তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন ডার্লিং?"

"কিন্তু আমি যে তোমার দেহটা নিজের চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে দেখেছি।"

"দেহটা পুড়লেও মনটা কি আর পোড়ে ডার্লিং।আর আমার মনের মধ্যে যে তুমি আছ ডার্লিং, সেই মন কি আর পোড়ে।আর আমার মন থেকে তোমাকে মুছে ফেলার সাধ্য যে কারুর নেই ডার্লিং।"

অংশুর চোখ মুখ থেকে অনবরত ভয় পেতে থেকে উর্মি।অংশু ধীরে ধীরে উর্মির দিকে এগোতে থাকে।আর উর্মি ভয়ে পেয়ে পিছতে থাকে।

"কি হল ডার্লিং তুমি কি ভয় পাচ্ছ?পিছিয়ে যাচ্ছ কেন?", অংশু বলে উঠল।

"না মানে, আমাকে ক্ষমা করে দাও অংশু, আমার ভুল হয়ে গেছে।আসলে সমস্তটাই অভীকের প্ল্যান।ওই অভীক তোমাকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিল।আমি কিছু করিনি বিশ্বাস করো।", হাত জোর করে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল উর্মি।

"এ মা ছিঃ ছিঃ আমি কি তোমাকে কখনো ভুল বুঝতে পারি ডার্লিং!কিন্তু অভীক যে গত পড়শুদিন আমায় পুরো উল্টো কথা বলল।ও বলল তুমি নাকি ওকে বলেছিলে আমাকে মারার জন্য।"

"না, তুমি বিশ্বাস করো, না", অনবরত আকুতি মিনতি করতে থাকল উর্মি। 

"দেখ ডার্লিং, আমি জানি তোমার অভীকের প্রতি একটা ভালোলাগা আছে।আর আমি জানি না অভীকের তোমার প্রতি কোনো ভালোলাগা ছিল কিনা, কিন্তু যদি থেকেও থাকে, তাহলে ভালোবাসার মিলনে আবদ্ধ দুটো মানুষ একে অপরকে দায়ী করে কি করে?আর আমার সঙ্গেই এই ভালোবাসা ভালোবাসা খেলাটার কি মানে ছিল?আমার দিক থেকে যে ভালোবাসাটা নিখাদ ছিল ডার্লিং।"

"আমার ভুল হয়ে গেছে অংশু।আমাকে ক্ষমা করে দাও।", অনবরত কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে উর্মি।"

"কিন্তু অংশু তুমি যে বললে গত পড়শু দিন অভীকের সাথে তোমার কথা হয়েছে, কিন্তু অভীককে তো গত পড়শুদিন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।", উর্মি  বলে উঠল।

"অভীক কোথায় আছে আমি জানি।চলো তোমাকে সেখানে নিয়ে যাই।", অংশু বলল।

অংশু উর্মিকে নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে একটা পুকুরের পারে নিয়ে গেল।ওই জায়গায় প্রায় কেউ যায় না।সেখানে গিয়ে দেখে পুকুরের পারটাতে অভীকের ক্ষতবিক্ষত দেহটা কয়েকটুকরো হয়ে পড়ে রয়েছে।

" তুমি অভীককে খুন করেছো?", উর্মি বলে উঠল।

"হ্যাঁ ডার্লিং, শোধবোধ।তবে ডার্লিং আজ যে আর একটা খুন হবে।" অংশু বলল।

"মানে?"

ধীরে ধীরে অংশু উর্মির কাছে গিয়ে উর্মির চুলগুলোকে নিয়ে খেলতে খেলতে আস্তে আস্তে উর্মির গলায় জড়িয়ে শ্বাসরোধ করে উর্মিকে হত্যা করে।তারপরে অংশু একটাই কথা বলে, "welcome to both of you in my world"।

      ফোটোগ্রাফি - সৈয়দ স্নেহাংশু 

ভাগ্যহারা

প্রায় ১৫ বছর বিবাহিত এক নিঃসন্তান দম্পতি তাদের জীবনের সন্তানের চাহিদা মেটানোর জন্য একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান অ্যাডপট্ করলেন।শারীরিক কারণে উনারা সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিত হলেও সামাজিক কারণে উনারা সন্তানের মুখ দেখলেন।আর সেই হতভাগা ফুটফুটে মেয়েটিও জীবনের শুরুতেই পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হওয়ার পরে দ্বিতীয়বারের জন্য আবার তা অনুভব করার সুযোগ পেল।

তিনটে তরতাজা প্রাণ দ্বারা পরিচালিত পরিবারটির উৎফুল্লতা যেন জীবনের সমস্ত টানাপোড়েনকে উত্তীর্ণ করে এগিয়ে চলছিল।কিন্তু বিপর্যয় আসতে তো আর বেশি সময় লাগে না।যেমন আলোর পরে অন্ধকার নেমে আসে, যেমন দিনের পরে রাত নেমে আসে, ঠিক তেমনিই সুখের পরেও বোধহয় দুঃখই লেখা থাকে।

অল্প কিছুদিনের মাতৃত্বের সাধ পাওয়া সেই মহিলার হঠাৎ করেই দুটো কিডনিই ড্যামেজ হয়ে গেল।যেকোনো উপায়ে কিডনি ডোনেট করতেই হবে, নাহলে নাকি বাঁচানো খুবই রিস্ক।উনার স্বামীর সঙ্গে উনার মেডিক্যাল রিপোর্ট অনুযায়ী সমস্ত কিছুই ম্যাচ করায় তিনিই উনাকে উনার একটি কিডনি ডোনেট করলেন।কিন্তু প্রায় ছয়মাস পরে দুজনেরই শারীরিক অবনতি শুরু হয়।তীব্র শ্বাসকষ্ট এবং অন্যান্য আরও কারণে দুজনকেই নার্সিংহোমে অ্যডমিট্ করা হয়।ডায়ালিসিস চলতে থাকে।কিন্তু তাদের দুজনের শারীরিক অবনতি এতোটাই হতে শুরু করে যে মাল্টি অর্গান ফেল করতে থাকে।এবং সেখানাকার ফিজিশিয়ান জানান আর দু'মাসের মধ্যেই হয়তো দুটো জ্বলন্ত প্রদীপই নিভতে চলেছে।আর সেই দম্পতি আবার যেন সন্তান হারা হতে চলেছেন আর সেই ফুটফুটে বাচ্ছা মেয়েটিও দ্বিতীয়বারের জন্য পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে চলেছে।

জ্বলদর্চি পেজ-এ লাইক দিন।👇





Post a Comment

0 Comments