জ্বলদর্চি

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান-১৩/ অনিন্দ্যসুন্দর পাল

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান
(Ancient India, History & Science)

অনিন্দ্যসুন্দর পাল
অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য


ত্রয়োদশ পর্ব- "সাহিত্য ২"

মূল বাল্মীকি-রামায়ণে রামচন্দ্রের অযোধ্যা প্রত্যাবর্তনের পরেই রামায়ণের সমাপ্তির ঘটনা প্ৰক্ষিপ্ত আছে ঠিকই, একথা স্মরণে রাখা প্রয়োজন উত্তরকাণ্ডটি রামায়ণের অংশ হলে কাব্যাংশেও রামায়ণ খর্ব হত না একথার কেউ গ্রহণযোগ্যতা দিতে পারবে না। মনে করা হয় হিন্দুপ্রাণ সেই দুঃখকেই স্বীকৃতি দেয় যে দুঃখ বা বিরহ আনন্দ বা বিরহ মিলনের পূর্ণতাকে মধুর করে তোলে। এই সনির্বন্ধ দুঃখের ব্যাখ্যাই জোর গলায় উচ্চারিত হয়েছে উপনিষদে-

" আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে
আনন্দেনজাতানি জীবন্তি
আনন্দং প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি।।"

অর্থাৎ, আনন্দ থেকেই জীবের জন্ম, আনন্দেই জীবনের পরিভ্রমণ, এবং সর্বশেষে আনন্দেই পরিসমাপ্তি। তাই হয়ত কৃত্তিবাস ফুটিয়ে তুললেন সীতার জীবন দুঃখেরই অনিবার্য রূপ। এতদপরেও প্রশ্ন থেকেই যায়- সীতা, সাবিত্রী, দয়মন্তী নারীজাতির আদর্শ হওয়া সত্ত্বেও বাঙালী মেয়েদের এমন নাম রাখার প্রবৃত্তি নেই কেন? তবে কি দয়মন্তীর সঙ্গে নলের পুনর্মিলন, সাবিত্রীর সাথে যেমন সত্যবানের পুনর্জীবন লাভ এবং সীতার সাথে রামের পুনর্বাসন শুধুই দুঃখ নিবারণের অলংকরণ নাকি নিতান্ত খাপছাড়া ও কিছু আকস্মিক ঘটনার প্রক্ষিপ্তকরণের মাধ্যমে সমগ্র নারীজাতির ধৈর্য্য, প্রেম, জীবনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়ে বাঙালী মহাকাব্যকে অধিক মহৎ করার চেষ্টা, কোনোটারই সদুত্তর  তর্কের ঊর্ধ্বে মেনে না।


এটা ঠিক যে সর্বজনপ্রিয় মহাভারত কিংবা রামায়ণের মতো মহাকাব্যে কিছু কিছু প্ৰক্ষিপ্ত ঘটনা থাকবেই। তাই কি উত্তরকাণ্ডের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় নির্দিষ্ট পর্যায়ে পর্যায়ে রাম অবতারের মতো ঘটনাগুলো প্ৰক্ষিপ্ত হয়েছে? এই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে উঠে যদি দেখি শ্রীচৈতন্যদেবের সন্ন্যাস গ্রহণের প্রধান অভীপ্সা, এবং রাম লক্ষণ বিষ্ণু ভরত এদের জন্মগ্রহণের বিশ্লেষণ তাহলেই স্পষ্ট ধারণা করতে কোনো অসুবিধা হয় না যে কেউ একজন দূত বা ভক্ত হয়েই এই প্রচারের কাজ বা সংযোজন যাই বলি না কেন সেটা নির্বিঘ্নে করে থাকেন। জেনে রাখা ভালো রামায়ণ লিপিবদ্ধ হওয়ার পূর্বে কুশলীদের দিয়ে মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য গীত আকারে সেটা লোকেদের মাঝে প্রতিস্থাপন করা হত, তাই এটাও মনে করা হয় কুশলীদের কিছু কথা হয়ত এইভাবেও প্ৰক্ষিপ্ত হয়েছে মহাকাব্যের মধ্যে।

তবে আমরা বলতে পারি না রামায়ণের আসল কিছুই অন্তর্ভুক্তি ঘটেনি, এর পরেও ভিন্ন ধর্মী ঋষি জাবালী রামকে বনবাস থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য সমস্ত যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে "বৌদ্ধমতানুসারী নাস্তিকগণ চোরের ন্যায় দণ্ডার্হ" এমন কথা রামের মুখে বসিয়ে ধর্ম সহিষ্ণুতার ইঙ্গিত দুর্দান্ত ভাবে স্পষ্ট করেছেন। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে বৌদ্ধ বিদ্বেষবশতঃ পরবর্তীকালে রামের মুখে স্থান পেয়েছে। রামের সমস্ত যুক্তি প্রায় শেষদিকে অশোভন ভাবে চিহ্নিত হলেও কয়েকটি কথা বাদ দিলে আপাদমস্তক রামের সমগ্র যুক্তির অধিকতর সামঞ্জস্যতা আছে। তবে বৌদ্ধদের প্রতিপত্তির খর্ব করার দরুণ এইরূপ ভাবকে কথা আকারে রামের মুখে যে বসানো হয়েছিল এই বিষয়েও কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই। তাই, নিশ্চিত ভাবে এখন বলা যায় রামায়ণের মহিমাকে খর্ব করার উদ্দেশ্য নিয়ে এমন কিছু কথোপকথনের উৎপত্তি। সেহেতু কারো বুঝতে অসুবিধা হয় না বাল্মীকি-রামায়ণ ও কৃত্তিবাসী-রামায়ণের দিকে নজর রাখলে, কি প্রকার কাহিনীর অদল-বদল ঘটেছে পুস্তকের অন্দরে অন্দরে।
বাল্মীকি রামায়ণে রামচন্দ্রের দুর্গোৎসবের উল্লেখ নেই যেমন তার পাশাপাশি মহিরাবন কিংবা তরণীসেনের কাটামুন্ডু 'রাম' 'রাম' করা তো দূরহস্ত, তরণীসেনেরই কোনোরকম উল্লেখ মেলে না। মাইকেলের মেঘনাদ বধ কাব্যে উল্লেখিত বীরবাহু বধ বা তার সম্মুখ সংগ্রামের কোনো বিবরণ বাল্মীকি রামায়ণে নেই। রত্নাকর দস্যুর কোনোপ্রকারে 'মরা' 'মরা' বলতে বলতে একবার রাম উচ্চারণ করতেই পুন্যাত্মা হয়ে গেলেন এমন কোথাও কিন্তু বাল্মীকি রামায়ণে নেই। এরপর ছোটখাটো অনেক প্রার্থক্য আছে। যেমন- হনুমান কর্তৃক মন্দোদরীর কাছে রাবণের মৃত্যুবাণ অপহরণের কথা বা রাবণ কতৃক রামচন্দ্রকে রাজনীতি শিক্ষারও উল্লেখ নেই। ধারণা করা হয় মহাকাব্যের মহিমা মহিমান্বিত করার উদ্দেশ্যেই এমন এমন মহৎ প্রবৃত্তির জন্ম দেওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল।

এর আরো একটি প্রমাণ মেলে যদি লক্ষ্য করি সীতা হরণের পরে সাধারণ মানুষের মতো রামের বিলাপ। গবেষকদের মতে, এই ঘটনা রামকে সাধারণ মানুষের সাথে তুলনা করে একটা নায়ক রূপ দেওয়ার প্রবল প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে। কেননা, প্রথম সর্গে বাল্মীকি নরচন্দ্রমা প্রসঙ্গে যখন নারদকে জিজ্ঞাসা করলেন- "কোন একটি মাত্র নরকে আশ্রয় করে সমগ্র লক্ষ্মী রূপ গ্রহণ করছেন?" তখন প্রত্যুত্তরে নারদ বলেন- "দেবতাদের মধ্যেও এরূপ গুণযুক্ত পুরুষ দেখি না, কিন্তু যে নরচন্দ্রমার মধ্যে এই সকল গুণ আছে তাঁর কথা শোন।" বলাবাহুল্য রামায়ণ সেই নরচন্দ্রমারই ইতিবৃত্ত। তাই বলা হয়, রামায়ণে রামচন্দ্র অবতার নন, নরচন্দ্রমা। এই সমগ্র উত্তরকান্ডটিই প্ৰক্ষিপ্ত। কেননা উত্তরখণ্ডটি রামায়ণের আঙ্গিক হলে কাব্যাংশেও রামায়ণ খর্ব হয়ে যেত এটা নিশ্চিত। সংস্কৃত সাহিত্যে বিয়োগান্ত কোনো নাটক নেই, তাই হয়ত বলা হয়, হিন্দুপ্রাণ সেই দুঃখই বোঝে যে দুঃখ আনন্দকে আরো মধুর করে তোলে।

( ক্রমশ)
জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments