জ্বলদর্চি

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল-৩০/ সন্দীপ কাঞ্জিলাল

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল
পর্ব--৩০

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

বুদ্ধিজীবী ও সমাজ- ৫

এখন প্রশ্ন হল বুদ্ধিজীবী হবেন কারা? কোন ছকে মিললে তাদের বুদ্ধিজীবী বলা হবে, বা কোন মাপকাঠিতে তাদের মাপা হয়। শিক্ষা মাপকাঠি হবে? না যারা একটা আধ-টা সিরিয়ালে অভিনয় করেছে, বা কয়েকটি সিনেমা পরিচালনা করেছেন, কিংবা দু একটা কবিতা লেখা, সাহিত্য করা ইত্যাদি। দেখেছি আমাদের পাড়ায়, যদি কেউ একটু শিক্ষিত বা শিক্ষক থাকেন, বা ছোট মাঝারি বড় নেতা হলেই কোন সমস্যা দেখা দিলে তাঁদের ডাকা হয় সমস্যা সমাধানের জন্য। তাহলে প্রশ্ন শিক্ষিত, বিদ্বান নেতা বিভিন্ন সংস্কৃতি জগতের কর্মী --এরা কি বুদ্ধিজীবী? না বুদ্ধিজীবী হওয়ার যোগ্য? 

এ প্রসঙ্গে দার্শনিক 'মিচেলস'এর কথা অনুধাবন যোগ্য। তিনি বলেছেন-"Intellectuals are persons possessing knowledge or in a narrower sense those whose judgement, based on reflection and knowledge, derives less directly and exclusively from sensory perception then in the case of non-intellectuals." অর্থাৎ যাঁরা বিচার-বিশ্লেষণে, চিন্তাশীলতা ও মননশীলতার পরিচয় দেন বেশি। যাঁরা অন্যান্য ব্যক্তির তুলনায় প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়গোচর জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল অনেক কম, পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে যাঁরা জ্ঞানলাভ করেন, তাঁরা অত্যন্ত সাধারণ স্থুল ব্যক্তি। আগুনে হাত দিলে হাত পুড়বে, যাঁরা বুদ্ধিজীবী তাঁরা আগুনে হাত দিয়ে পরীক্ষা করেন না। তাঁরা নিজের বিচার বুদ্ধি দিয়ে তা বিশ্লেষণ করতে পারেন। ঘরোয়া কথায়, "চোর পালালে যাদের বুদ্ধি বাড়ে" তাঁরা বুদ্ধিমান নন। চোর আসতে পারে, তাকে ঠেকানোর জন্য যাঁরা উপায় বের করেন তাঁরা বুদ্ধিমান। 

আবার 'কার্ল ম্যানহাইম' বলেন- "In every society there are social groups whose special task it is to provide an interpretation of the world for that society. We can these the intelligentsia."
তার মানে সমাজে এমন কিছু লোক থাকেন, যাদের কাজ হল সেই সমাজের জীবনদর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি রচনা করা এবং ব্যাখ্যা করা। যাঁরা সমাজের এই জীবনদর্শন ব্যাখ্যা করেন, তারাই বুদ্ধিজীবী। 

তাহলে বোঝা গেল বড় বড় ডিগ্রিধারী কিংবা বিরাট অফিসার বা কোনো নেতা কিংবা শিল্পী তাদের যদি জীবনদর্শন ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা না থাকে, তাঁকে বুদ্ধিজীবী বলা যাবে না। কেবল বিদ্যার মানদণ্ড দিয়ে বুদ্ধিজীবী বিচার করলে চলবে না। প্রাবন্ধিক বিনয় ঘোষের ভাষায়, "অ্যাকাডেমিসিয়ান, অধ্যাপক, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা রত্ন, এরা টিপিক্যাল বিদ্বৎজন বলে গণ্য হলেও, বুদ্ধিজীবী বলে গণ্য হতে পারেন না।আবার দার্শনিক "মিচেল'র ভাষায়- "It would be wrong to define intellectuals in terms of academic examinations।" অর্থাৎ প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরা জ্ঞানের অধিকার হতে হবে। দার্শনিকরা বলেন, মানুষের মধ্যে এই জ্ঞানের উৎস চার প্রকার। যেমন- (১) অভিজ্ঞতা, (২) বুদ্ধি, (৩) বিচারবাদ, (৪) স্বজ্ঞাবাদ। 

অভিজ্ঞতাবাদীদের মতে, যথার্থ জ্ঞান অবশ্যই কিছু নতুন সংবাদ দিবে। যা আগে থেকে জানা আছে, শুধু ভাষা পরিবর্তন করে বললে বা পুনরুক্তি করলে তাকে যথার্থ জ্ঞান বলা যাবে না। দার্শনিক 'লক' বলেন, "মানুষ জন্মের সময় কোনো ধারণা নিয়ে জন্মায় না। শিশুর মন একেবারে সাদা পাতা। যখন তার ইন্দ্রিয় বাইরের বস্তুর সংস্পর্শে আসে, তখন সেই সব জিনিসের ছাপ তার মনের মধ্যে পড়ে, এই ছাপ থেকে জ্ঞানের জন্ম হয়।"  আবার ইন্দ্রিয়ের প্রত্যক্ষের মাধ্যমে যে জ্ঞন, তা যদি বুদ্ধি দ্বারা সংশ্লেষিত না হয়, তাহলে তা প্রকৃত জ্ঞান হতে পারে না। যেমন জলে ডোবানো কাঠ বাঁকা দেখায়, কিন্তু তা যে প্রকৃত বাঁকা নয় আমরা বুদ্ধির সাহায্য না নিলে বুঝতে পারবো না। আবার অনেক দার্শনিকের মতে- ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যা পাওয়া যায় তা জ্ঞান নয়, তাকে মত বলাই ভালো। যে বিশ্বাস আবশ্যিক ও সর্বজনগ্রাহ্য সত্য নয়, তাকে জ্ঞান বলা যায় না। তারা বলেন গণিতের জ্ঞানই জ্ঞানের আদর্শ। ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অর্জিত জ্ঞানের দ্বারা কাজ চলতে পারে, কিন্তু তাত্ত্বিক আলোচনা চলতে পারে না। ইন্দ্রিয় আমাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে প্রতারণা করে। যেমন দড়িকে অনেক সময় সাপ বলে মনে হয়। 
দার্শনিক 'লিবনিজ' বলেন, "সমস্ত আবশ্যিক সর্বজনগ্রাহ্য জ্ঞানই বুদ্ধিলব্ধ।"

বিচারবাদে বলা হলো, শুধু অভিজ্ঞতা ও শুধু বুদ্ধির দ্বারা প্রকৃত জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। তাঁরা বলেন, এই দুই মতের মিশ্রণে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। দার্শনিক 'কান্ট' বলেন- "বুদ্ধি জ্ঞানের আকার দিতে পারে, তাতে নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। কিন্তু তা জ্ঞানের বিষয় দিতে পারে না। অথচ নতুনত্ব ও নিশ্চয়তা প্রকৃত জ্ঞানের জন্য প্রয়োজন।" জ্ঞানের নিশ্চয়তা আসে বুদ্ধির আকার থেকে। স্বজ্ঞাবাদের মাধ্যমে যে জ্ঞান লাভের পদ্ধতি তা আবিষ্কার করেন দার্শনিক 'বার্গসোঁর'। স্বজ্ঞাবাদের মূল কথা হলো, বুদ্ধি বা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যথার্থ জ্ঞান সম্ভব নয়। স্বজ্ঞা হলো কোন প্রকার বুদ্ধির সাহায্য না নিয়ে একটি বস্তুকে সোজাসুজি মন দিয়ে প্রত্যক্ষ করা। স্বজ্ঞা হলো সেই বুদ্ধি সঞ্জাত সহানুভূতি, যার সাহায্যে কেউ কোন বস্তুর অন্তরে প্রবেশ করে এই উদ্দেশ্যে যে, বস্তুর মধ্যে যা কিছু অসাধারণ ও অনির্বচনীয় তার সাথে একাত্মতা লাভ করা। আবার গীতায় জ্ঞানযোগের ১৯নং অধ্যায়ে বলা হলো, যাঁর সমস্ত কর্ম প্রচেষ্টা কাম ও সংকল্প রহিত, তিনি পূর্ণ জ্ঞানী। 

তাহলে বোঝা গেল, শুধু মাত্র শিক্ষিত হলে কিংবা বড় চাকুরে হলে, বা কোন নেতা, শিল্পী লেখক সাংবাদিক হলেই বুদ্ধিজীবী হবেন একথা বলা যাবে না। 'মিচেল' এর ভাষায় আবার বলি- 'It would be wrong to define intellectuals interms of academic examinations"। কেউ যদি বলেন যে কোনো বড় অফিসার তিনি বুদ্ধিজীবী নন, তবে চমকে উঠতে হয়। মোদ্দাকথা কেউ যদি পড়াশুনা করেন, চিন্তাশীল হন, এবং সমাজে তাঁর প্রয়োগ করেন, তবেই তিনি বুদ্ধিজীবী। এবং তাঁর সেই চিন্তা ভাবনা যদি সমাজের পরিবর্তন ঘটতে সাহায্য করে।এবং যা তিনি করবেন নিজের স্বার্থের জন্য বা ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয়। তবেই তিনি বুদ্ধিজীবী হবেন। যদি কোনো অল্প শিক্ষিত ব্যক্তি তাঁর চিন্তা ভাবনা দ্বারা সমাজে আদর্শগত সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন, তাহলে নিষ্ক্রিয় হেডমাস্টারের চেয়ে তিনিই বুদ্ধিজীবী। আবার কোনো উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি যদি তিনি ভূষিমাল দোকান করেন, তাহলে তিনি চেনা পরিচিতদের কাছে বুদ্ধিজীবী বলে পরিগণিত হলেও, সমাজের কাছে তিনি বুদ্ধিজীবী হওয়ার যোগ্য নন। পড়াশুনা থাকলেই তিনি বুদ্ধিজীবী তা কিন্তু নয়। কেউ যদি আবার জ্ঞানসমুদ্রের অধিকারী হয়ে, সেই সমুদ্রের তলায় ভূড়ভূড়ি কাটেন, যদি সমাজে তাকে দেখা না যায় কিংবা তাঁর চিন্তাভাবনার কথা না জানা যায়, তিনি জ্ঞানতপস্বী হলেও বুদ্ধিজীবী নন। পড়াশুনা শিখে 'স্কলার' হওয়া যায় কিন্তু বুদ্ধিজীবী হওয়া যায় না, যেমন পুরোহিতরা মর্ত্য থেকে স্বর্গ পর্যন্ত একটা হাইওয়ে নির্মাণ করেছেন। যারা স্বর্গে যেতে চান, তারা ঐ হাইওয়ে দিয়ে যাবেন। ঐ হাইওয়ের সিগনাল, প্রহরা সব কিছু সেই পুরোহিতরা করেন। যদি কোনো ব্রাহ্মণ ঐ রাস্তা মেরামত প্রহরার জন্য আদবকায়দা না জেনে কেবল ঘরে বসে অধ্যয়ন করেন, তবে তিনি বুদ্ধিজীবী নন। একালে বুদ্ধিজীবীদের কাজ আগেকার বা বর্তমানের পুরোহিতদের কাজের অনুরূপ। 
সমাজের চিন্তাধারাকে যিনি পরিচালিত করতে চেষ্টা করেন, নিজে চিন্তা করে অন্যের চিন্তার উদ্রেক করেন এবং তার জন্য বিদ্যা বুদ্ধি জ্ঞান অর্জন করেন তিনিই বুদ্ধিজীবী। প্রকৃত জ্ঞানীরা কোনোকিছু পাওয়ার আশায় কারোর উপকার করে না। তাঁরা জানে যা কিছু সুন্দর ও ভালো তা নিজস্ব নিয়মে ফিরে আসে। প্রতিদান পাওয়ার আশায় ভালো করার প্রয়োজন হয় না। প্রতিদান এমনি পাওয়া যায়। আর জীবনের সুন্দরতম প্রাপ্তি হচ্ছে, আন্তরিক ভাবে অপরকে সাহায্য করা। তার ফলে নিজেদের সাহায্য করা বোঝায়। সাধারণ মানুষের সাথে বুদ্ধিজীবীর মূল পার্থক্য হল, বুদ্ধিজীবী প্রকৃত অবস্থা দেখে, আর সাধারণ মানুষ নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে দেখে। 
একবার একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে অপর গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ জিজ্ঞাসা করলেন, দেখুন, আমি আপনাদের গ্রামে চলে আসতে চাই। তখন বুদ্ধিমান মানুষটি প্রশ্ন করলেন, কেন? সাধারণ মানুষটি বললেন- আমাদের গ্রামের মানুষজন ভালো নয়। ওখানকার সকলেই নীচ, নিষ্ঠুর, দুর্ব্যবহারকারী। বুদ্ধিমান ব্যক্তিটি বললেন, এই গ্রামেও সেইরুপ মানুষ দেখতে পাবেন। ব্যাপার হলো যে, সাধারণ মানুষ তার নিজের মতো করে অবস্থা দ্যাখে। প্রকৃত অবস্থা বোঝার চেষ্টা করে না। 

'মিচেলস্' বলেছিলেন- "Vocationally concerned with things of the mind."- যিনি, তিনি-ই  বুদ্ধিজীবী। সমাজে যিনি নিজের মনন ও মানুষের মন নিয়ে কারবার করেন, তিনিই বুদ্ধিজীবী। আর এ কাজ যিনি করেন না, তিনি বিদ্বান, সাহিত্যিক শিল্পী, হলেও বুদ্ধিজীবী হওয়ার যোগ্য নন।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 
প্রতি পাঁচজন মানুষের মধ্যে একজন জীবনের কোনও না কোনও সময়ে আত্মহননের কথা ভাবেন। আত্মহত্যা কোনও অপরাধ নয় -মনের এক গভীর থেকে গভীরতর অসুখ।
☹️
গৌতম বাড়ই- র বিশ্লেষণ। পড়ুন।

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব সুন্দর মনস্তাত্ত্বিক একটি লেখা পড়লাম।

    ReplyDelete