জ্বলদর্চি

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় / সন্দীপ কাঞ্জিলাল

"বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection, মানুষের এক টুকরো মানসিক অংশ।" 

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় 
Manik Bandopadhyay 
(১৯/০৫/১৯০৮ - ০৩/১২/১৯৫৬) 

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

লোকটার জ্বলজ্বলে ড্যাবডেবে একজোড়া চোখ। তাঁর ওপর চশমা। চোখের দৃষ্টিতে যেন রঞ্জন রশ্মি লাগানো। যা দেখে, দৃষ্টি পৌঁছে যায় তার ভেতর পর্যন্ত। সে দৃষ্টি যেন বলতে চায়, তুমি বললে আমি মেনে নেবো- এমন ব্যাপার নয়। সব ঘষেমেজে যাচাই করে, তবে বুঝে নেবো- কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল। এই চোখ দুটো তাঁর অস্ত্র, যা দিয়ে একদিন তিনি মেকি গল্প উপন্যাসের কাহিনীকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেবেন। রবীন্দ্রনাথ, জগদীশ গুপ্ত, শরৎচন্দ্রের হাত ধরে বাংলা গল্প উপন্যাসের যে পথ চলা- তার ব্যতিক্রম তিনি। এখন এই দুপুরের গনগনে রোদে চলেছে 'যুগান্তর' পত্রিকার অফিসে পূজা সংখ্যায় গল্প দিতে। রোগা অশক্ত শরীর, ময়লা জামাকাপড়, ঘামে ভেজা, চোখে নিকেলের চশমা। রাস্তায় এক অধ্যাপক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। সেই বন্ধু ডেকে নিয়ে গেল বাড়িতে দুপুরের খাওয়ার জন্য। কারণ সকাল থেকে খাবার জোটেনি। গোগ্রাসে খেলেন। খাওয়া দেখে বন্ধুর মা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। খেতে খেতে বন্ধুটিকে বলছে, "দ্যাখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাঙলা দেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়।" 

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে (১৯০৮-১৯৫৬) কি বলবো? বিশ শতকের সবচেয়ে বিদ্রোহী উপন্যাসিক? এত সাবলীল অবজ্ঞায় প্রথা ভেঙে মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়? 'পুতুলনাচের ইতিকথা'-য় বলেন, "সংসারে  মানুষ চায় এক, হয় আর, চিরকাল এমন দেখে আসছি ডাক্তারবাবু, পুতুল বইতো নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।" তা বলে, তিনি মানুষকে পুতুল বানাননি, বা তাকে 'ভাগ্যের দাস' বলেননি। বিজ্ঞানের ছাত্র প্রগতিবাদী চিন্তার ধারক মানিক ফ্রয়েড ও মার্কসবাদে বিশ্বাসী। তিনি এই উপন্যাসের মধ্যে বলতে চেয়েছেন- মানুষ তার পরিণতির জন্য নিজে দায়ী। ভাগ্য নয় নিয়তি নয়। সামন্ততান্ত্রিক দেশে বেশী সংখ্যক মানুষ অল্প সংখ্যক মানুষের হাতের পুতুল যেভাবে হয়ে দাঁড়ায়, তার বিরুদ্ধে এই উপন্যাস হচ্ছে প্রতিবাদ। তাইতো তিনি বলে ওঠেন, "নদীর মত নিজের খুশিতে গড়া পথে তাঁর জীবনের স্রোত বয়ে চলে না, মানুষের হাতে কাটা খালে তার গতি।" এই 'পুতুলনাচের ইতিকথা' ভারতীয় ৯টি ভাষায় এবং ইউনেস্কো থেকে ১৯৬৮ সালে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় "The Puppet's Tale" নামে। বাংলা সিনেমাও হয়েছিল। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে লেখা এই উপন্যাস। তাঁকে তো লিখতেই হবে, কারণ পরিবারের কেউ চায়নি তিনি সাহিত্য করুন। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, দেখে নিও রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের সাথে আমার নামও উচ্চারিত হবে।অতিরিক্ত খাটুনি, সংসার চালাতে গিয়ে দিবারাত্রি পরিশ্রম। ভদ্রজীবনে নানা অনাচার থাকলেও তাকে মহৎ সুন্দর করে দেখাবার চেষ্টা হয়, অথচ চাষি- মজুর শ্রমিকদের জীবন চিরকালই অবহেলিত, উপেক্ষিত। তাঁর প্রশ্ন, "মানুষ হয় ভাল, নয় মন্দ, কিন্তু ভাল-মন্দ মেশানো হয় না কেন?" এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে রাত জেগে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যাওয়া। ছোট্ট ঘর, লেখার টেবিলও নেই। কাজের লোক নেই। এইসময় তিনি মদ্যপানে আসক্ত হয়ে ওঠেন, তাঁর কথায়, "কারণ অর্থাভাব এবং অতিরিক্ত খাটুনি, আজ এখন ওষুধ খেয়ে ঘুমালে কাল হাঁড়ি চলবে না- খানিকটা অ্যালকোহল গিললে কিছুক্ষণের জন্য তাজা হয়ে হাতের কাজটা শেষ করতে পারবো। এ অবস্থায় অ্যালকোহল ছাড়া উপায় কী?" ১৯০৮ সালে ১৯ মে জন্ম। বিহার রাজ্যে সাঁওতাল পরগনার দুমকা শহরে। আদি নিবাস বাংলাদেশের গাওদিয়া। বাবা শ্রী হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মস্থল দুমকা। মা নীরদা সুন্দরী দেবী। চার ভাইবোনের পর জন্ম। জন্মের সময় কালো কুচকুচে তাই নাম রাখা হয়েছিল 'কালো মানিক'। বাবার দেওয়া নাম ছিল প্রবোধ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে কালো মানিক নাম থেকে শুধু 'মানিক' নামে তিনি বিখ্যাত হন। বাবা মা আট ভাই ছয় বোন মিলে মোট ষোলো জনের পরিবার। বাবার বদলির চাকরি। সেই সুবাদে বাংলা বিহার উড়িষ্যার বিভিন্ন জায়গায় স্কুলজীবন কাটে। মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গায়তেও ছিলেন। ছোটোবেলায় ভীষণ দুরন্ত ও ডানপিটে ছিল। তাঁর নিজের কথায়, "ছেলেবেলা থেকেই আমি একটু অতি মাত্রায় দুরন্ত। হাঁটতে শিখেই প্রথমে মাছ কাটার মস্ত বঁটিতে নিজের পেটটা দু-ফাঁক করি-আজও সেলাইয়ের চিহ্ন আছে। এমনি আরো অনেক দুরন্তপনার চিহ্নই সর্বাঙ্গে চিরস্থায়ী হয়ে আছে। শোনা যায়, আমার নাকি একটা উদ্ভট স্বভাব ছিল। দারুণ ব্যথা পেলেও কিছুতে কাঁদতাম না। সুর করে (কালোয়াতি নয়)গান (আবোল-তাবোল) ধরতাম। ব্যথা বাড়লে সুর চড়ত আর দু-চোখ দিয়ে জল পড়ত ধারাস্রোতে। মারে বাপরে হাউমাউ করে, শুধু চেঁচিয়ে, ভ্যাঁ করে প্রভৃতি যে নানা পদ্ধতি আছে সাধারণ কান্নার, তার একটাও নাকি আমি শিখিনি। এদিকে আবার যখন-তখন আপন মনে নিজের খাপছাড়া সুরে যে কোনো কথা বা শব্দ নিয়ে গানও আমি গাইতাম। সব সময় তাই বোঝা কঠিন ছিল আমি কাঁদছি না গাইছি।" 

এক সাক্ষাৎকারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, "সাহিত্যের যথার্থ মূল্যায়ন কী?" তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, "সাহিত্য মানুষের জন্য। মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ বেদনা যে সাহিত্যে প্রতিধ্বনিত হতে পারবে না, সে সাহিত্য হয়তো কোন অপকার করবে না, কিন্তু কোন উপকারও সাধন করতে সক্ষম হবে না।" 
ক্ষুধা ও কামের মধ্যে দোলায়িত মানবজীবনকে আমরা দেখতে পাই, 'পদ্মানদীর মাঝি' উপন্যাসেও। নগর সভ্যতার বাইরে, গ্রামে আপাত অশিক্ষিত শ্রম-নির্ভর মানুষের যে সভ্যতা- সেখানেও সভ্যতা বনাম যৌনতার বিরোধ থেকে যায়। প্রসঙ্গত, সিগমুন্ড ফ্রয়েডের "It is much the same thing it we say that the conflict between civilization and sexuality is caused by the circumstances that sexual love is a relation-ship between larger groups of persons."

কুবের যদিও অন্যের স্বামী, কপিলাও অপরের স্ত্রী। তবু কুবের আর কপিলার মধ্যে ফল্গুধারার মতো এক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কুবের মেয়ে গোপীকে নিয়ে দূরের হাসপাতালে যায়। সেই অছিলায় কপিলাও যায়। রাত্রে হোটেলে থাকে। শুরু হয় কুবেরের আকর্ষণ। কারণ, "কপিলার মন বুঝিবার ক্ষমতা ভগবান কুবেরকে দেন নাই।" কপিলা প্রচ্ছন্নভাবে কুবেরের পাশে শোয়ার বাসনা প্রকাশ করে, 'ডরামু মাঝি।' ভোরে কুবের কপিলাকে বাড়ি পাঠাতে চায়, কপিলা, "রুখিয়া বলে, আরে পুরুষ।" কুবেরের চেতনার লজ্জাকে সে ভেঙে ফেলতে চায়। এই উপন্যাস মূলত পদ্মাপারে বসবাসকারী গরীব জেলেদের জীবন ঘিরে।  তিনি লেখেন, "জেলে পাড়ার ঘরে ঘরে শিশুর ক্রন্দন কোনদিন বন্ধ হয় না। ক্ষুধা তৃষ্ণার দেবতা, হাসি-কান্নার দেবতা, অন্ধকার আত্মার দেবতা, ইহাদের পূজা কোনদিন সাঙ্গ হয় না। এদিকে গ্রামের ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণতর ভদ্র মানুষগুলি তাদের দূরে ঠেলিয়া দেয়....জীবনের স্বাদ এখানে শুধু ক্ষুধা ও পিপাসায়, কাম ও মমতায়, স্বার্থ ও সঙ্কীর্ণতায়....ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লিতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।" 

১৯২৬ খৃষ্টাব্দে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মেদিনীপুর জেলা স্কুলে প্রবেশিকা পরীক্ষার পর ১৯২৮ সালে বাঁকুড়া ওয়েসলিয় মিশন কলেজে আই.এস.সি। তারপর কলিকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হন। কলেজ ক্যান্টিনে আলোচনার সময়, বন্ধুরা বলে, পত্রিকার সম্পাদক যাদের চেনে, তাদের লেখা ছাপায়। মানিক প্রতিবাদ করে। তিনি বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে তার প্রথম গল্প 'অতসি মামী' বিচিত্রা পত্রিকার সম্পাদককে পাঠান। চারমাস পর ছাপা হয়। তখন থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরপর বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা পাঠালে তা ছাপা হয়। এই লেখালেখির ফলে শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটে। ১৯৩৮ সালে তিনি কমলা চট্টোপাধ্যায়কে বিয়ে করেন। ১৯৩৯ সালে একটি প্রকাশনা সংস্থা খোলেন। কয়েকমাস পরে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৪৩ সালে কয়েকমাস সরকারি চাকরী করেন। তারপর ছেড়ে দেন। ১৯৪৪ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। 

'পুতুল নাচের ইতিকথা' থেকে 'পদ্মানদীর মাঝি' পর্যন্ত মনোবিশ্লেষণের গভীরতা বাড়তে থাকে। তা ক্রমশ ব্যক্তি (micro) মানুষকে অনুসন্ধান। 'চতুষ্কোণ' (১৯৪৮) উপন্যাসে এই ব্যক্তি মানুষের অনুসন্ধান চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করলো। এই উপন্যাসে চারটি নারী ও একটি পুরুষকে নিয়ে পরীক্ষাগারে বীক্ষণের সাফল্য ও সংযম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনবদ্য মুন্সীয়ানার সাক্ষ্য বহন করে। 

এই গ্রন্থ রচনার পর্বে মানিকের ব্যক্তিগত অন্তর্বাস্তবকে জানা আবশ্যিক হয়ে পড়ে। আঠাশ-উনত্রিশ বছর বয়সে "পুতুলনাচের ইতিকথা" রচনাকালে একদিন হঠাৎ তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এরপর থেকে একমাস, দু-মাস অন্তর এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলতে থাকে। "নিজেই চিকিৎসাশাস্ত্র ঘেঁটে" রোগের কারণ মানিক বুঝতে চেয়েছেন। মানিকের চিঠিতেও তিনি অভিন্নহৃদয় বন্ধুকে জানাচ্ছেন 'মাথার অসুখে ভুগছি।' এই মৃগীরোগের জন্য মানিককে স্বনামধন্য চিকিৎসক ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়কে দেখানো হয়। তিনিও বলেন, ঔষধে এ রোগের নিরাময় হবে না। তার জন্য প্রয়োজন মানসিক শান্তি। সেজন্য তিনি মানিককে বিবাহের পরামর্শ দেন। 

এই উপন্যাসের নায়িকা সরসী নায়ক রাজকুমারকে বলে, "একটি মেয়েকে ভালোবাসার মানে জানো।সকলকে ভালোবাসা। জীবনকে ভালোবাসা, বেঁচে থাকতেই মজা লাগে। তুমি কাউকে ভালোবাসো না, নিজেকে পর্যন্ত নয়।" 
"নদীর ধারে খ্যাপার মতো ঘুরিতে ঘুরিতে তাহার মনে হয় পৃথিবীর যতো খাদ্য ও নারী আছে একা সব দখল করিতে না পারিলে তাহার তৃপ্তি হইবে না"। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'প্রাগৈতিহাসিক' গল্পে এটাই ভিখু'র দর্শন। এরই অনুষঙ্গে আমাদের মনে হয় মানুষের জটিল চরিত্রসন্ধানে যতরকম নরনারী লিবিডো নিয়তির চাপে পড়েছে, তাদের তৃপ্তিহীন অন্বেষণ তাঁর রচনার মৌল প্রেক্ষিত। সাহিত্য রচনার সূচনা থেকেই মানুষের দুটি মৌল চাহিদা বা বোধকে মানিক তাঁর বৈজ্ঞানিক মনের অনুসন্ধানের বিষয় করেছেন। সে দুটি মৌল চাহিদার কেন্দ্র, যথাক্রমে-ক্ষুধা ও কাম। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে 'চক্র' হিন্দী ছবিতে নাসিরউদ্দিনের ডায়লগ, "ইস দুনিয়ামে জো কুছ কাম হো রহা হ্যায়, পেট কে লিয়ে আউর পেটকে নীচেওয়ালে কে লিয়ে।"

জীবনে অসম্ভব বিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে যেতে হলেও শেষদিন পর্যন্ত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়েননি নিজের বিশ্বাসের প্রতি আনুগত্য। দারিদ্র্যের যন্ত্রণা তাঁকে পথভ্রষ্ট করতে পারেনি। তিনি কেন লিখতেন তাঁর ভাষায় বলি, "জীবনকে আমি যে ভাবে যতভাবে উপলব্ধি করেছি, অন্যকে তার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশে ভাগ করে দেওয়ার তাগিদে আমি লিখি।" তাই তিনি রবীন্দ্র যুগের রোমান্টিকতা এবং কল্লোলিয়দের বাস্তব সাহিত্য সৃষ্টি করার যে অপচেষ্টা তার থেকে বেরিয়ে এসে সময়ের বাস্তবতার নির্যাসকে ঢেলে দিলেন সাহিত্যে, তবে রোমান্টিকতা যে একদম ছিল না একথা বলা যাবে না। তাই তিনি নিজেই বললেন, "উপন্যাসেও কাব্য সৃষ্টি করা যায়, কল্পনা পার হয়ে যেতে পারে বাস্তবতার সীমা।"  'কার্লমার্কস' একটি নিবন্ধে বলেছিলেন, তিনি তাঁর তত্ত্ব বুঝতে ও বোঝাতে ব্রিটিশ পলিটিকাল ইকনমিস্টদের রচনার তুলনায় ব্রিটিশ উপন্যাসিকদের কাছে শিক্ষা নিয়েছেন বেশি।অর্থাৎ 'সমাজ-বিজ্ঞানে' কার্লমার্কস অর্থনৈতিক বিজ্ঞান থেকেও তুলনায় সাহিত্যিকদের কাছে বেশি করে সমাজ অর্থনীতি বেশী জেনেছেন। কেননা সাহিত্যিকরা কোনো দেশের অতীত সমাজ জীবন বুঝতে লোককথা পুরাণ মহাকাব্য লোকশ্রুতি ও রূপকথা সব কাজে লাগান। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গল্পে বা উপন্যাসে কিছু পাইয়ে দিতে চান। তিনি অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেছেন। ওই পাইয়ে দেওয়ার ভেতর দিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যের সার্থকতা। ওই যে এলিয়ট বলেছিলেন--আবেগগত অভিজ্ঞতাগুলি সংগঠিত করে বিশেষ আবেগের তাৎপর্যে অথচ আবেগ থেকে নিঃসৃত হয়ে কবিতার সৃষ্টি হয়। কেননা কোনো সার্থক শিল্প কখনো  একরৈখিক হতে পারে না। তিনি প্রাণপণে  চেষ্টা করেছিলেন চলতি ভাবধারা থেকে বেরিয়ে সাহিত্যকে নতুন কিছু দিতে। তাই তিনি 'দিবারাত্রির কাব্য'তে সুপ্রিয়াকে দিয়ে বলেন, "...যে জীবনকে সে মহাকাব্য বলে জেনে রেখেছিল সে একটা সাধারণ কবিতাও নয়।" এই 'দিবারাত্রির কাব্য' যে কবিতা দিয়ে শুরু, "প্রাতে বন্ধু এসেছে পথিক, / পিঙ্গল সাহারা হতে করিয়া চয়ন/ শুষ্ক জীর্ণ তৃণ একগাছি।"এই পথিক তো আসলে সেই পথিক যে নিরন্তর পথ খুঁজে বেড়ায়, খুঁজে বেড়ায় তার পরম আকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু হেরম্বেের কাছে সুপ্রিয়া কিছুই পায়না। "ক্ষতবুক তৃষার প্রতীক / রাতের কাজল- লোভী কাতর নয়ন,/ ওষ্ঠপুটে মৃত মৌমাছি " হেরম্বের কাছে সুপ্রিয়ার এই হল প্রাপ্তি। 
"ওষ্ঠপুটে মৃত মৌমাছি" এই লাইনটির মানে গভীর অর্থবহ। ব্যবহৃত নারী বা তার মধু খেয়ে যাওয়া মৌমাছি, প্রতিদানে কি দেয় এক নারীকে, কাম না প্রেম? নারীর হৃদয় কিছুই পায়না! সে থাকে অতৃপ্ত! মধু লোভী মৌমাছি ফুলের কোনো প্রত্যাশা মেটায় না। সে মৃত মৌমাছি! এক শব্দের ছবি সৃষ্টি করলেন তিনি। 
শব্দমদ বেচা শুঁড়ি হতে চাননি। তাই কবিতা লেখা নিয়ে কোনো উপদেশ তিনি ধার ধারেননি। গদ্যের মতো পদ্যে ও তার জীবনের ক্ষুদ্রাংশ ধরা পড়েছে। আর তার মধ্যে তার শিল্পী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। জীবনকে ভাবুকের চোখে নয়, বাস্তববাদীর চোখে দেখতে চেয়েছেন। তাই প্রথম কবিতার কাহিনিতে, " আমি তো খেয়েছি খুদ, আমি তো করেছি উপবাস,/ আমি তো ভুগেছি রোগ চাষী মাঝি মজুরের সাথে,/ অকারণে আমি তো মরেছি লক্ষবার।" তবে মৃত্যু নয়, জীবনই কাম্য। "বেঁচে থাক জীবনের রসঘন কবিতা " -- এটা তার একান্ত প্রার্থনা। 

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। সেজন্য তার সমগ্র চিন্তা ভাবনাকে প্রভাবিত করেছিল বিজ্ঞান চেতনা। তিনি প্রচলিত কোনো কিছুকে স্থায়ী ও অবিচল সত্যরূপে মেনে নিতে চাননি। সমস্ত কিছু তিনি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। তাই তার কবিতা ও বাস্তবমুখী। বাস্তব যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে বুঝতে চেয়েছেন জীবনের ভাবকে। সর্বোপরি জীবনের জয়গানে সর্বদা মুখর ছিলেন। ' জীবন মরন ' কবিতায় বলেন - "মরণেরে বাদ দিয়ে / জীবনের মানে খোঁজা দায়/....মরে মরে বেঁচে থাকা/ জীবনের সেরা অহংকার।"

প্রেমকে তিনি দেখেছেন নেশার মতো। মনের মধ্যে সঞ্চিত হয়ে থাকা বাস্তব প্রেমকে এক অসম্ভব কল্পনায় সমাজ সংসারের বাইরে নিয়ে গিয়ে তিনি মুক্তি খোঁজেন। তিনি মনে করেন এই প্রেমই পৃথিবীতে দুঃখের কারণ। এই প্রেম সাংঘাতিক এক যন্ত্রণার ব্যাপার! তাই প্রেম চিরকাল টেকে না। প্রেম যদি চিরকাল কারোর মধ্যে বাঁচতো, তবে সেই মানুষকে আর বাঁচতে হতো না। তাই 'দিবারাত্রির কাব্য' দ্বিতীয় ভাগের সূচনা কবিতায় লিখলেন,".... মৃত্যু মুক্তি দেয়না যাহাকে / প্রেম তার মহামুক্তি,-/ নতুন শরীর মুক্তি নয় মুক্তির আভাস।"
জীবন নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা সকল লেখকের লক্ষ্য,  তবে জীবনকে দেখার স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গীই লেখককে স্বাতন্ত্র‍্য দেয়। সর্বক্ষেত্রেই শিল্প সাফল্যের কথা তিনি মনে রাখেননি। আগামী দিনের জন্য তিনি নতুন প্রজন্মের কাছে জীবনের মানে বোঝাতে চেয়েছেন। সারা জীবন দুঃখ আর দারিদ্র‍্য।
এই আটচল্লিশ বছরের জীবনে ৪০ টি উপন্যাস, ৩০০টি গল্প, কবিতা ছাড়াও অনেক প্রবন্ধও লিখেছেন। 'দিবারাত্রির কাব্য'-১৯৩৫, পদ্মানদীর মাঝি-১৯৩৬, পুতুলনাচের ইতিকথা -১৯৩৬ ইত্যাদি উপন্যাস। অতসী মামী-১৯৩৫, প্রাগৈতিহাসিক-১৯৩৭, মিহি ও মোটা কাহিনী-১৯৩৮ ইত্যাদি গল্প। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা-১৯৭০ কবিতার বই। তাঁর ১৫টি উপন্যাস সিনেমা এবং ২০টি গল্প নিয়ে সিনেমা হয়। এছাড়া পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসটি বিশ্বের ১৩টি ভাষায় অনূদিত এবং সিনেমা হয়েছে। 

প্রকাশকদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেও টাকা যা পাওয়ার, তা পাননি। কালজয়ী সাহিত্য সৃষ্টির উন্মাদনায় দারিদ্র্যকে করেছেন নিত্যসঙ্গী। স্ত্রী কমলা এক মৃত সন্তান প্রসবের পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ডায়েরিতে লিখলেন, "বাচ্চা মরে যাওয়ায় ডলি (স্ত্রী-র ডাকনাম) অখুশি নয়। বলল, বাঁচা গেছে বাবা।" অত্যধিক শারীরিক মানসিক ধকলে ১৯৩৫-এ ধরা পড়ে মৃগী রোগ। ওষুধ খাওয়ার পয়সা নেই। কাউকে কিছু বলতে পারছেন না। নিজের মনের কথা "সুকান্ত ভট্টাচার্য" নামক কবিতায় বললেন, "বসন্তের কোকিল কেশে কেশে রক্ত তুলবে /সে কিসের বসন্ত।" ৩০ শে নভেম্বর অসুখের বাড়াবাড়ি রাত থেকে। সকালে অনেকের সঙ্গে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও এসেছেন। সংজ্ঞাহীন শরীর। অচৈতন্য শরীরের তবু ডান হাতটা মাঝে মাঝে উপরে উঠছে। মানিকের চেতনা তখনও কি চেষ্টা করছিল লেখার? কারণ না লিখলে যে সংসার চলবে না! অ্যাম্বুলেন্সে তুলতে তুলতে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় মানিকের স্ত্রী'কে জিজ্ঞেস করলেন, তাঁকে আগে খবর দেওয়া হয়নি কেন? কমলা বললেন, ফোন যে করবো সেই পাঁচ আনা পয়সাও নেই ভাই। 

১৯৫৬ সালের ৩রা ডিসেম্বর। জীবন চিরতরে মানিককে মুক্তি দিল। যে প্রকাশকরা বার বার ঘুরেও টাকা দেয়নি, যারা দূর থেকে দেখে অন্যদিকে সটকে পড়তো, সেদিন সবাই ফুল নিয়ে হাজির। শেষ যাত্রায় অগণিত লোক, ফুলে ফুলে ঢাকা মানিক। মুখও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কিছুতেই বলতে পারছে না--"ফুলগুলো সরিয়ে নাও আমার লাগছে।"

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments