জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -২০/ শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -২০

শ্যামল জানা

ফিউচারইজম (তৃতীয় অংশ)

কিউবিজম ফিউচারিস্টদের পথ দেখাল কীভাবে? তা আমরা জেনেছি৷ জেনেছি, কিউবিজমই নির্ধারণ করে দিয়েছিল কোন শৈলীতে ফিউচারিস্টরা পরবর্তীকালে তাদের ছবিগুলি আঁকবে৷ তবে, নির্দিষ্টভাবে বচ্চিওনি ও গিনো সেভেরিনি ধারাবাহিকভবে ডিভিশনিজম-এর যে শৈলী— কাটা কাটা রঙ ও ছোটো ছোটো তুলির টান— এর সাহায্যেই ছবি এঁকে গেছিলেন৷ আর, অন্য ফিউচারিস্টরা কিউবিজম থেকে শৈলী ধার করলেও, হুবহু তাকে অনুকরণ করেনি৷ করলে, সেগুলো কিউবিজমই হয়ে যেত, ফিউচারিজম থাকত না! দুটি বিষয়ে তাঁরা কিউবিস্টদের থেকে ভিন্ন রাস্তায় হেঁটেছিলেন৷ কিউবিজম-এর যাঁরা হোতা, পিকাসো, ব্রাক্ বা গ্রিস, এঁদের কিউবিজম ছিল শান্ত বা স্থির৷ ফিউচারিস্টদের ছিল চলমান৷ আর দ্বিতীয়ত এদের বিষয়বস্তু ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন৷ এ প্রসঙ্গে তৎকালীন চিত্রসমালোচক রবার্ট হিউজেস চমৎকার একটি কথা বলেছিলেন৷ সেটি হল— “ফিউচারিজম-এর ছবিতে চোখ স্থির থাকে, অথচ অবজেক্ট চলমান৷ কিন্তু, কিউবিজম-এর শৈলীর মৌলিক বিষয় হল— তাদের সমতলক্ষেত্র খণ্ডিত, যেন একটার ঘাড়ে একটা চাপানো৷” ফলে, স্বাভাবিকভাবে কিউবিজম-এর ছবিতে চলমানতা এসে গেলেও তা ব্যহত হত সমতলক্ষেত্র খণ্ডিত হওয়ায়৷ আর, ফিউচারিস্টদের একটা অংশ কিউবিজম থেকে শৈলী ধার করলেও তাদের শৈলী স্বতন্ত্র মাত্রা পেয়েছিল যে দু-একটি কারণে, তার অন্যতম প্রধাণ কারণ ছিল হিউজেস যে কথাটি বলেছিলেন— “ফিউচারিজম-এর ছবিতে চোখ স্থির থাকে, অথচ অবজেক্ট চলমান”৷ আর, এই কনসেপ্টটিকে ছবিতে সবচেয়ে সফলভাবে প্রয়োগ করেছিলেন অন্যতম প্রধান ফিউচারিস্ট শিল্পী জিয়োকোমো বালা৷ তাঁর একটি বিখ্যাত ছবি আছে৷ যার নাম ইংরাজি করলে দাঁড়ায়— Dynamism of a Dog on a Leash (দড়িবাঁধা কুকুরের গতিশীলতা)(ছবি-১)৷
    পৃথিবীর যে অনুভূতির জগৎ, তা সর্বদা চলমান৷ এই দর্শনটিকে ফিউচারিস্টরা ধ্রুবসত্য বলে মনে করত৷ এবং এই দর্শনটির সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হচ্ছে জিয়োকোমো বালার এই Dynamism of a Dog on a Leash ছবিটি৷ ছবিতে তিনি যে কুকুরটি এঁকেছেন, পাঠক আপনারা একটু লক্ষ করলেই বুঝতে পারবেন— তার পা, লেজ, গলায় বাঁধা দড়িটি, এবং যে মহিলা ওই দড়িটি ধরে হাঁটছে, তার পা-দুটি, স্থির চিত্রের লজিকে আঁকা হয়নি! আঁকা হয়েছে চলমান দৃশ্যের (সিনেমা) লজিকে৷ অর্থাৎ, যে কোনো চলমান দৃশ্য যখন আমাদের রেটিনায় ধরা পড়ে, তা সাধারণত সেকেন্ডে ২৯টি পর পর স্থির চিত্রের সমন্বয়৷ এই চলমান দৃশ্যের লজিকটি জিয়োকোমো বালা স্থির চিত্রে ব্যবহার করেছেন৷ তাই, চলমান বোঝাতে গিয়ে তিনি চলন অনুযায়ী অনেকগুলি পা, অনেকগুলি লেজ, অনেকগুলি গলার দড়ি, অনেকগুলি মহিলার পা পর পর এঁকেছেন(ছবি-১)৷ এবং সেগুলি ঝাপসা(Blur) করেছেন এমনভাবে, যেন চলছে! এ প্রসঙ্গে যেটা বলার, তা হল, ফিউচারিস্টরা কী ছবি আঁকবে, এবং কীভাবে ছবি আঁকবে, তার জন্য তারা Technical Manifesto of Futurist Painting প্রকাশ করেছিল৷ সেখানে স্পষ্ট করে বলা ছিল— যখন কোনো ইমেজের অস্তিত্ব আমাদের চোখের রেটিনায় ধরা পড়ে, এবং সেটি যদি চলমান হয়, তাহলে, ওই একই ইমেজ পর পর স্থির অবস্থায় নিজেকে গুণিতকে বাড়াতে থাকে৷ দ্রুত কম্পনের মতো তারা নিজেদেরকে পরিবর্তন করে৷ যেমন একটা ঘোড়া যখন ছোটে, তার চারটে পা যেন কুড়িটি পা হয়ে যায়৷ এবং ওই ছুটন্ত পা-গুলি ত্রিভুজাকৃতিতে ছোটে৷ ত্রিভুজাকৃতি  কেন? আসলে, ঘোড়ার পায়ের তলদেশ, যেখানে খুর থাকে, সেই অংশটি সবচেয়ে দ্রুত এবং বেশি যায়, এবং পায়ের ওপরের অংশ, শরীর থেকে বেরিয়েছে যেখানটায়, সেখানটা কিন্তু স্থির থাকে৷ অনেকটা বৃত্ত আঁকার মতো৷ কম্পাসের যে বাহুটি কেন্দ্রে থাকে, সে স্থির থাকে৷ আর বাইরের দিকে, যে পেনসিল লাগানো বাহুটি বৃত্ত আঁকে, সেটিই চলে৷ তবে ঘোড়ার পা পূর্ণ বৃত্তাকারে যেহেতু চলে না, খানিকটা যায় বলে ত্রিভূজাকৃতি মনে হয়(ছবি-২)৷ ঠিক এই লজিকে বালার আার একটি ছবি আাছে৷ নাম— The Hand of the Violinist বা The Rhythms of the Rainbow(ছবি-৩)৷ বোঝানোর জন্য তিনি ছবিটিকেই ত্রিভুজাকৃতি ফ্রেমে এঁকেছেন৷ ছবিটি হঠাৎ করে দেখলে অ্যাবস্ট্রাক্ট মনে হবে৷ কিন্তু একটু মনোযোগ দিলে স্পষ্টতই বোঝা যাবে, বেহালার একটি অংশ ও ছড় টানা হাতটি, যেটি সর্বদা চলে৷
    এই যে ফিউচারিস্টরা Technical Manifesto of Futurist Painting প্রকাশ করেছিল, এবং ঠিক সেই মতোই যে ছবি এঁকেছিল, সেই সব ছবিগুলির প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯১১ জার্মানির মিলানে৷ আর দেশের বাইরে ১৯১২ সালে প্যারিসে৷ বেশ বড় মাপের ছিল সেই প্রদর্শনী৷ তার পর থেকেই ফিউচারিজম ও তার তত্ত্ব সারা ইয়োরোপে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল!
    আমরা জেনেছি, ফিউচারিস্টরা তাদের তৈরি করা ছবি আঁকার টেকনিক ঠিকমতো প্রয়োগ করতে গিয়ে অন্যান্য সমকালীন প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন আঙ্গিককেও ব্যবহার করেছিলেন৷ যেমন কিউবিজম৷ আবার, তার মধ্যে জিয়োকোমো বালা-র “বর্ণতত্ত্ব”ও ছিল৷ আর, ১৯১০ সালে এই টেকনিক্যাল ম্যানিফেস্টো যখন তৈরি হয়, জিয়োকোমো বালাও ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরকারী৷ বালার ফিউচারিস্ট ছাত্র বোসিওনিও আলোর বিমূর্ত ফলক ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলেন৷ এবং সেই সময় আরও অনেক উল্লেখযোগ্য চিত্রশিল্পী এই রীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ যেমন জিনো সেভারিনি, কার্লো কারা, লুইজি রুসেলো৷ আর উল্লেখ না করলেই নয়, লুইজি রুসেলো ম্যানিফেস্টো রচনাতেও মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন৷ শুধু তাই নয়, এই ফিউচারিজম ছড়িয়ে গেছিল অন্যান্য শিল্পেও৷ তাঁরা সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, সিনেমা, স্থাপত্যর সঙ্গেও রীতিমত যুক্ত ছিলেন৷
    রাজনীতিগতভাবে ফিউচারিস্টরা অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পক্ষে ছিলেন৷ বেশ ঘনিষ্ঠতাও ছিল তাদের সঙ্গে৷ তাঁরা যুদ্ধের পক্ষেই প্রচার করতেন৷ মেরিনেত্তির সঙ্গে তো মুসোলিনির বেশ ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব ছিল!
    ১৯১৬ সালে দুজন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী সামরিক অনুশীলনে মারা যান৷ এদের মধ্যে একজন হলেন বোসিওনি, যিনি ঘোড়া থেকে পড়ে মারা যান৷ এবং অন্যজন হলেন সান্ট ইলিয়া লম্বার্ডি, যিনি ভলান্টিয়ার সাইক্লিস্ট ব্যাটেলিয়ানের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে মারা যান৷ এই দুই মৃত্যুর পরেই ফিউচারিস্ট আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে৷ তবে, মেরিনেত্তির মুসোলিনির সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকলেও ১৯২০ সালে ফ্যাসিবাদ থেকে ফিউচারিজমকে সরিয়ে নেন৷ তবে, কিছুদিন পরে, তিনি আবার ফ্যাসিবাদের “গতিময় সারমর্ম”-কে তুলে ধরার জন্যে ফিউচারিজম-এর কর্মকর্তাদের জোর খাটিয়েছিলেন৷ কিন্তু সেই আন্দোলন আর তেমনভাবে দানা বাঁধেনি৷             (ক্রমশ)
জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. গভীর,ঘন,সন্নিবদ্ধ এই সমগ্র লেখাটি। অপার মুগ্ধতা নিয়ে
    পড়ছি। জানছি আর ঋদ্ধ হচ্ছি।
    ছবি তৈরির এই বিবর্তন পড়ে
    অবাকও হচ্ছি। ধন্যবাদ লেখককে।

    ReplyDelete