জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা- ৮/ শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-৮

শুভদীপ বসু

বিষয়-মাইক্রোফোনের ইতিহাস ও ব্যবহার

মাইক্রোফোন শব্দটি গ্রিক শব্দ।Micro এর অর্থ হলো Small এবং phone এর অর্থvoice অর্থাৎ এটি এমন একটি যন্ত্র যার মধ্য দিয়ে ক্ষুদ্র বা অল্প শব্দ তীব্রতর হয়। সাধারণত আমরা মাইক্রোফোন না বলে এর 'ক্লিপিংস' মাইক্রোফোন> মাইক শব্দটি ব্যবহার করি। শব্দ শক্তিকে তড়িৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করাই মাইকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এর অনেকগুলো অ্যাপ্লিকেশন যেমন টেলিফোন হেয়ারিং এডস,কনসার্ট হল বা পাবলিক ইভেন্টের জন্য পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম, সাউন্ড রেকর্ডিং, রেডিও বা টেলিভিশন সম্প্রচার এর জন্য মাইক ইত্যাদি।

মাইক্রোফোনের ইতিহাস:

  খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রিসে শিং আকৃতির মুখের খোলামেলা থিয়েটার মুখোশ যা অ্যাম্ফিথিয়েটারে অভিনেতাদের কণ্ঠকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রসারিত করত।
১৬৬৫-ইংরেজ পদার্থবিদ রবার্ট হুক প্রথম প্রতিটি প্রান্তে সংযুক্ত কাপের সাথে প্রসারিত "প্রেমিকাদের টেলিফোন"আবিষ্কার করে,বায়ু ছাড়া অন্য কোন মাধ্যমের সাথে শব্দ যায়-এটির গবেষণার প্রথম চেষ্টা করেছিলেন।
  ১৮৬১-জার্মান উদ্ভাবক জোহান ফিলিপ রেইস একটি সাউন্ড ট্রান্সমিটার তৈরি করেছিলেন যা রেইস টেলিফোন নামে প্রখ্যাত ছিল। এটি একটি স্পন্দিত ঝিল্লির সাথে যুক্ত ধাতব বস্তু ব্যবহার করে স্রোত তৈরি করত।পরবর্তীকালে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল এবং ইলিশা গ্রেয়র প্রথমদিকে টেলিফোনে ট্রান্সমিটার ডিজাইন দিয়ে আরও ভালো ফলাফল অর্জন করেছিলেন।
  ১৮৭০-এ বছর এলো প্রথম সঠিক মাইক্রোফোন যা কার্বন মাইক্রোফোন নামে প্রসিদ্ধ। এটি স্বাধীনভাবে ইংল্যান্ডের ডেভিড এডওয়ার্ড হিউজেস এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমিল বার্লিনার এবং টমাস এডিসন দ্বারা বিকশিত হয়েছিল।
১৮৭৭-এবছর মাঝামাঝি সময়ে এডিসন কে প্রথম পেটেন্ট দেওয়া হয় তবে কিছু বছর আগে হিউজ অনেক সাক্ষীর সামনে এই মাইক্রোফোন এর কার্যকলাপ প্রদর্শন করেছিলেন এবং বেশিরভাগ ঐতিহাসিকরা তাকেই মাইক্রোফোনের আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিয়েছেন।
১৮৮৬-টমাস এডিসন এইবছর কার্বন মাইক্রোফোনটিকে পরিমার্জন করেছিলেন।এই মাইক্রোফোন টি প্রথমবার রেডিও সম্প্রচারে নিযুক্ত হয়েছিল।
১৯১৬- ইসি ওয়েন্ট প্রথম কন্ডিশনার মাইক্রোফোন দিয়ে পরবর্তী যুগের অগ্রগতি অর্জন করেছিলেন।
১৯২৩-এবছর প্রথম ব্যবহারিক চলমান কোয়েল মাইক্রোফোন নির্মিত হয়েছিল। এ বছরই ফিতা মাইক্রোফোন চালু হয়, হ্যারি উইলসন এটি চালু করেন।
বেশ কয়েক বছর ধরে এই মাইক্রোফোন গুলি বিশেষ কয়েকটি সংস্থা দ্বারা বিকশিত হয়েছিল যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরসিএ যা মাইক্রোফোন কে একটি অন্যতম দিক দিয়েছিল। মাইক্রোফোনের অগ্রগতির পেছনে এর অবদান রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে সুর ব্রাদার্স মাইক্রোফোনের উন্নত তম সংস্করণ আবিষ্কার করেন।
মাইক্রোফোন এর গঠনগত বৈশিষ্ট্য:

একে দু'ভাগে ভাগ করা হয় ১) ডায়নামিক ২)কনডেনসার
১) ডাইনামিক মাইক্রোফোন: একে ম্যাগনেটো ডাইনামিক মাইক্রোফোন বলে।শব্দতরঙ্গ এসে ডায়াফ্রামকে আন্দোলিত করে। ডায়াফ্রাম একটি পাতলা ধাতব ও পর্দা যার সঙ্গে একটি কয়েল যুক্ত থাকে।এই কয়েলের সঙ্গে আবার একটি চুম্বক যুক্ত থাকে।যা চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে।ডায়াফ্রামে ধাক্কায় চৌম্বক ক্ষেত্রে উঠলে কারেন্ট তৈরি হয়।এইভাবে শব্দ শক্তি তড়িৎ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এ ধরনের মাইক্রোফোন অপেক্ষাকৃত স্বল্পমূল্য এর resistant to moisture বেশি। তাই স্টেজ পারফর্মেন্স এর ক্ষেত্রে এ ধরনের মাইক্রোফোন এর গুরুত্ব রয়েছে।
২) কনডেন্সার মাইক্রোফোন: এটি উচ্চমানের অডিও সিগনাল তৈরি করতে পারে। স্টুডিওতে বা গবেষণাগারে রেকর্ডিং এর ক্ষেত্রে এটি বহুল প্রচলন রয়েছে।শব্দতরঙ্গ প্রবেশ করলে ডায়াফ্রাম আন্দোলিত হয়,ফলে ডায়াফ্রামের পেছনে যে প্লেটটি থাকে তার মধ্যে দূরত্ব পরিবর্তিত হয়।আর এই পরিবর্তনের জন্য তড়িৎ শক্তি সৃষ্টি হয়।কিন্তু এ তড়িৎ শক্তির পরিমাণ এতটাই কম যে একে এমপ্লিফায়ার এর মধ্য দিয়ে বের করে আনার প্রয়োজন পরে যেকোনো পারফরম্যান্স বা রেকর্ডিং এর জন্য।
মাইক্রোফোনের কোন দিকটা কার্যকরী তা অনুযায়ী তিন রকমের মাইক্রোফোন পাওয়া যায়-
১) ইউনি ডিরেকশনাল-এর শুধু সামনের দিকটায় কার্যকরী ফলে অন্য দিক থেকে শব্দ এলো এই মাইক্রোফোনে তাঁর প্রবেশ করতে পারে না সচরাচর ভোকাল বা স্পিচ মাইক্রোফোন হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়।
২) বাই ডিরেকশনাল-এই মাইক্রোফোনের সামনে এবং পেছনের দিক থেকেই কেবল শব্দ গ্রহণ করে।
৩) ওমনি-ডিরেকশনাল-ত্রিমাত্রিক গঠন হওয়ায়এই মাইক্রোফোন গোলকের মতো সবদিক থেকেই শব্দ গ্রহণ করতে পারে।

মাইক্রোফোন ও বাচিকশিল্প: মাইক্রোফোনের কাজ হলো সাধারণ কথাবার্তা কে বহু মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু বাচিক শিল্পের সাথে মাইক্রোফোন যখনই যুক্ত হয়ে যায়,তখনি শুধু কন্ঠ শ্রোতার কাছে পৌঁছে দিয়েই বাচিকশিল্পীরা খুশি হন না,তারা চান কন্ঠের সূক্ষ্ম প্রয়োগ ও নান্দনিকতা। মন্দির থেকে মন্ত্র উচ্চারণ, মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি, গির্জা থেকে ঘণ্টাধ্বনি মাইক্রোফোন এর সাহায্যে দূর-দূরান্তে ধর্ম প্রচারকরা পৌঁছে দেন।স্টেশনে ট্রেনের সঠিক সময়ে অথবা বিমান বন্দরে যাত্রীদের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে তড়িঘড়ি চলে যাওয়ার নির্দেশ আমরা মাইক্রোফোন এর সাহায্যে শুনতে পারি।নিজের ব্যবসার প্রয়োজনে যে সমস্ত ফেরিওয়ালারা মাইক্রোফোন ব্যবহার করেন সেখানেও এর ব্যবহার রয়েছে। কিন্তু এ সমস্ত ক্ষেত্রে নান্দনিকতা বিষয়টির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় না।যারা মঞ্চে আবৃত্তি,শ্রুতি নাটক,সঞ্চালনা, সঙ্গীতপরিবেশন করেন তাদের সর্বদাই মাইক্রোফোন এর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে অবশ্যই জানতে হবে।

মাইক্রোফোন এর সঠিক ব্যবহার:

১) একজন শ্রুতি নাটক শিল্পীর কাছে মাইক্রোফোন সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত।স্ক্রিপ্ট পাঠ করতে করতে কেউ পিছন ফিরে কাগজ নিতে গেলেন আর এই সময় বলা কথার অংশগুলো কিছুই শোনা গেল না এরকম হতেই পারে।
২) স্ক্রিপ্ট পাঠ করার সময় কাগজ উল্টানোর শব্দ সম্পর্কে শিল্পীর সচেতন থাকা উচিত।
৩)মাইক্রোফোনের সামনে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণের ক্ষেত্রে সদা সতর্ক থাকা উচিত।
৪)ওষ্ঠ বর্ণ যেমন-প,ফ,ব,ভ,ম উচ্চারণের সময় মুখ নিঃসৃত হাওয়ার সঙ্গে সরাসরি মাইক্রোফোনে ধাক্কা দিয়ে অবাঞ্চিত ফ্লপ আসতে পারে। শিল্পীরা এসম্পর্কে অবশ্যই সচেতন হবেন।
৫) দূরদর্শনে যেহেতু lapel microphone ব্যবহার করা হয় তাই সে ক্ষেত্রে এর নিয়ন্ত্রণ এর মূল দায়িত্বে থাকেন কোন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার।
৬)মাইক্রোফোনটি শিল্পী সোজাসুজি,কোনাকুনি,সামান্য দূরে,নাকি মুখের একেবারে কাছে থেকে ব্যবহার করবেন সে সম্পর্কে ব্যক্তি শিল্পী কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
৭) প্রত্যেক শিল্পীর একটি নির্দিষ্ট মাইক্রোফোন জোন থাকে।তার বাইরে চলে গেলে শিল্পীর কথা মাইক্রোফোন ক্যাচ করতে পারে না।তাই ব্যক্তি বিশেষে এই জোন তৈরি করে নেওয়ার ক্ষেত্রে শিল্পীকে সচেতন থাকতে হবে।
৮)মাইক্রোফোনের সামনে শিল্পীকে স্বতঃস্ফূর্ত থাকতে হবে।তার শাণিত মনন নিয়ে প্রাণখোলা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাঁর পরিবেশনা দর্শকের সামনে রাখতে হবে।
৯) রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা বক্তব্য রাখার সময় মুখের সামনে মাইক্রোফোন থাকায় অত্যন্ত চিল চিতকার করলে সমস্ত কথাগুলোই জড়িয়ে যায়। 
১০)একজন শিল্পীর ক্ষেত্রেও অত্যন্ত আবেগের ঝোঁকে গলাটা চড়াইয়া উঠে গেলেই মাইক্রোফোন থেকে অবাঞ্ছিত শব্দ বেরিয়ে আসে আবার অসাবধানতাবশত মাইক্রোফোন থেকে দূরে চলে গেলে ভরাট কণ্ঠটি ক্ষীণ শোনায়।
১০) শিল্পীরা মাইক্রোফোনের উইন্ড স্ক্রিন ব্যবহার করতে পারেন এটি ফ্লপ আটকাতে সাহায্য করে।
১১) সাউন্ড রেকর্ডিং এর জগতে দু'প্রকার মাইক্রোফোন দেখতে পাওয়া যায় ক)Contact Microphoneখ) Throught Microphone। কন্টাক্ট মাইক্রোফোনটি খুব অল্প মাত্রায় শব্দ গ্রহণ করতে সক্ষম আর থ্রোট মাইক্রোফোনটি অনেক আওয়াজ এর মধ্যে বক্তার কন্ঠটি ঠিকভাবে যাতে শোনা যায় সে জন্য,অন্য আওয়াজগুলিকে তলায় রেখে বক্তার আওয়াজকে স্পষ্ট করে তোলে।
বেতার জগতের আকাশবাণীর অন্যতম গুনি বাচিকশিল্পী শ্রী জগন্নাথ বসু মাইক্রোফোন নিয়ে পরামর্শ দিতে গিয়ে বলেন"Don't shout but project your voice"মাইক্রোফোনের ব্যবহার নিয়ে শ্রী জগন্নাথ বসুর ক্লাস ও ওয়ার্কশপ গুলো আমাকে উক্ত বিষয় সম্পর্কে অবগত হতে সাহায্য করেছে।স্টুডিও ওয়ার্কশপ ও সাধারণ অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতাই একজন বাচিকশিল্পী কে মাইক্রোফোনের নিপুন ব্যবহারের ক্ষেত্রে দক্ষ করে তোলে বলে আমার মনে হয়।
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments