জ্বলদর্চি

উত্তর আমেরিকা (ক্যালিফোর্ণিয়া)- র লোকগল্প / চিন্ময় দাশ


উত্তর আমেরিকা (ক্যালিফোর্ণিয়া)- র লোকগল্প 

চিন্ময় দাশ

ভোঁদড় রাজার নতুন প্রাসাদ

[ভোঁদড়, এই আধা-জলচর জীবটিকে উদবিড়ালও বলা হয়। প্রাণীবিজ্ঞানের ভাষায়, এরা হােল- মুস্টিলিডি (Mustelidae ) গােত্রের লুট্ৰিনি (Lutrinae) উপগােত্র ভুক্ত। অস্ট্রেলিয়া ছাড়া, পৃথিবীর প্রায় সব জায়গায় এদের দেখা যায়। বিশেষত সাগর বা মহাসাগরের লাগােয়া দেশগুলােতে। লিপ্তপদী (হাঁসের পায়ের মত, পাতলা পর্দা দিয়ে জোড়া আঙুল), ধারালাে নখওয়ালা থাবা, হাতখানেক লম্বা লেজ, খাড়া লম্বা গোঁফ, আর সারা শরীর জুড়ে দু’পর্দা পুরু লােম- এই হােল ভোঁদড়ের শরীর। আর যা বলতেই হয়, তা হােল- নিশাচর এই জীবটির গায়ের উৎকট গন্ধ। জলে কুমির, হাঙর, আর ডাঙায় বাঘ, মানুষ এদের বড় শত্রু। তবে এই বিকট গন্ধের জন্য, ভোঁদড়কে এড়িয়েই চলে তারা। সহজে ঘাঁটাতে চায় না কেউ।

পৃথিবীর দেশে দেশে হাজারাে গল্প আছে ভোঁদড়কে নিয়ে। বাংলায় ভোঁদড় বিখ্যাত হয়েছে অবন ঠাকুর মশাইর কলমে। দূর কালিফোর্ণিয়া দেশের আদিম জনজাতি সমাজে একটি গল্প প্রচলিত আছে। সেটি এখানে শােনাব আমরা।]

  শত-শত মাইল বিছানাে অথৈ জলের উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর। তার পূর্বতীরে অনেকখানি এলাকা জুড়ে, আমেরিকার বড়সড় এক অঙ্গরাজ্য কালিফোর্ণিয়া। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা এই রাজ্য। আমেরিকার ৫০টি রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লােক বাস করে এখানে। মাইলের পর মাইল জোড়া এর জল-সীমানা। পশ্চিমে সমুদ্রের অগাধ জল। আর পূবে বন-পাহাড় নিয়ে ডাঙ্গা। সাগর-জলের একেবারে গা ঘেঁষে এক ভালুকের ডেরা। বউ, দুটো ছেলে-মেয়ে আর নিজেকে নিয়ে চার-চারটে পেট তাদের। সকলেরই একেবারে  নাদুস-নুদুস চেহারা। চেহারা বড়, তাই পেটও বড়। নিত্যদিন অনেকটা করে খাবার জোগাড় করতে হয় ভালুকটাকে।

  তাই অনেক ভেবে, সাগরের একেবারে গা ঘেঁষে বাসা জোগাড় করেছে ভালুক। চারটে পেটের খাবার-- সেকি আর চাট্টিখানি কথা ? বনের ভিতর সেসব জোগাড় করা বেশ মেহনতের কাজ। তার চেয়ে এখানে বেশ সুবিধা। জলে নেমে পড়লেই হােল। ভালাে ভালাে মিষ্টি স্বাদের ঢের মাছ পাওয়া যায়। পেট ভরাবার কোনও ভাবনা নাই।

  বাসাটাও জুটেছে বেশ ভালােই। বড় বড় পাথরের খাঁজে তাদের ঘর। সুন্দর নিরাপদ একটা গুহার মত। যেমন নিরাপদ, তেমনি আরামের। সুখেই থাকে পরিবারটি। একটা অভ্যাস আছে তাদের। সব কাজই তারা চারজনে একসাথে মিলে করে। সমুদ্র নেমে মাছ ধরে আনা, খেতে বসা, মাঠে গিয়ে খেলাধুলাে করা, বা স্নান করতে যাওয়া, ঘুমােনাে-সবই
একসাথে।

  তবে, একটাই অসুবিধা। বড্ড ঠাসাঠাসি করে থাকতে হয়। বাসাটা তেমন বড় নয়। বিশেষ করে চারটে ভালুকের পক্ষে। চারজনেরই যে বড়সড় চেহারা। বেশি ঝামেলা হয় রাতের বেলা। ঘুমােবার সময় পাশ ফেরা যায় না। ঘষা লেগে যায় নাকে নাকে।

  ভালুকের এই বাসাটার কথা জানত এক ভোঁদড়। দারুণ চটপটে সে। যেমন তার গায়ের জোর, তেমনি তার সাহস। বড় কথা হােল তার মগজ। ভয়াণক বুদ্ধিমান। বিশেষ করে দুষ্টুবুদ্ধিতে জুড়ি নাই তার। সেজন্যই তাকে রাজার মত মান্য করে ভোঁদড়েরা। কিছুদিন হােল সুন্দর একটি বউও হয়েছে তার।

  ভালুকের বাসা থেকে সামান্য দূরে, সমুদ্রের এক খাঁড়িতে বউ নিয়ে থাকে ভোঁদড়। ভোঁদড়রা থাকে গর্ত বানিয়ে। কিন্তু এই রাজার বাসাটা বেশ মজার। পাঁচ-পাঁচটা দরজা তার বাসার। তিনটে মুখ আছে ডাঙ্গায়। আর দুটো বানিয়েছে জলের ভিতর। এত সুন্দর বাসা অন্য ভোঁদড়দের নাই।

  কিন্তু। যেদিন থেকে বউ এসেছে ঘরে, একটা কিন্তু এসে হাজির হয়েছে ভোঁদড়রাজার জীবনে। বউ উঠতে বসতে বলতে শুরু করেছে- এটা একটা রাজার বাড়ি ? হাত-পা মেলে থাকা যায় না।

  সেই থেকে ভোঁদড়ের ঘুম উঠেছে মাথায়। রাজার মত একটা বাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে তাকে। যে করেই হােক।

  একদিন বসে বসে ভাবছে, চিড়িক করে বিদ্যুৎ খেলে গেল মাথায়। ভালুকের বাসাটার কথা মনে পড়ে গেল তার। ওটা দখল করতে পারলে, বাজিমাৎ। বউয়ের মুখঝামটাও বন্ধ হয়ে যাবে তাতে। মনে মনে ছক কষতে লাগল সে।
ভোঁদড়রা হােল রাতচরা জীব। তাদের ঘােরাঘুরি বলাে, বা খাবারের খোঁজ-- সবই রাতের বেলায়। সেদিনও রাত হােল। শিকার ধরে আনা, খাওয়া-দাওয়া শেষ। বউ ঘুমিয়ে পড়ল। যখন মাঝরাত হােল, ভালুকের বাড়িতে এসে হাজির হােল ভোদড়। বেশ নাক ডাকিয়ে ঘুমােচ্ছিল চারজন। হঠাৎই একটা ঠক-ঠক ঠক-ঠক আওয়াজ। চমকে উঠল ভালুক। এত রাতে কে এল ঘরে? বিপদ-আপদ নয় তাে ? আবার শব্দ। চারজনেরই ঘুম ছুটে গিয়েছে। বেশ ভয় করতে লাগল তাদের।

  ভালুক বলল- কে? কে ওখানে ?

  ভণ্ডামীর শেষ নাই ভোঁদড়ের। গলা নরম করে ভোঁদড় বলল- পেন্নাম হই, ভালুকমামা। আমি ভোঁদড়।

ভালুক বিরক্ত গলায় বলল- এত রাতে এসে ঘুম ভাঙালি কেন রে, হতভাগা ? 
 - তা আজ্ঞে, বড্ড ঠাণ্ডা পড়েছে বাইরে। তােমার এই ঘরটায় একটুখানি থাকতে দাও আমাকে।

  ভালুক বলল- আমাদেরই বলে থাকবার জায়গা কুলােয় না। সরে পড় এখান থেকে। 
ভোঁদড় কাতর গলায় বলল- এমনি এমনি থাকব না গাে। তােমাদের ঘরকন্নার সব কাজ করে দেব আমি। ঘরদোর সাফসুতরাে করা, খাবার-দাবার সাজিয়ে দেওয়া, এমনকি গান গেয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানাে- সব কাজ করে দেব, সব।

  ভালুক রেগে কিছু বলতে গেল। তার আগেই ভালুকের বউ বলল-- নাগাে, থাকতে দাও ওকে। শুনছাে না, সব কাজ করে দেবে। এমন লােক তুমি পাবে কোথায় ? জায়গার কথা বলছাে ? কতটুকু আর জায়গা লাগবে পুঁচকেটার।

  ভোঁদড় চটপট বলে উঠল-খেতেও দিতে হবে না আমাকে। তােমরা রাতে ঘুমিয়ে পড়লে, টুক করে বেরিয়ে, পেট ভরার কাজ সেরে নেব আমি।

  ভালুক-বউ ভারি খুশি এ কথা শুনে। ভালুক কিছু বলার ফুরসতই পেল না। সে বলল-- ঠিক আছে বাছা, তুই ঢুকে পড়। 
কথা শেষ হওয়ার আগেই সুডুৎ করে ভেতরে ঢুকে পড়েছে ভোঁদড়। একেবারে এক কোণে গিয়ে হাজির হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখল, চারজনেই চেয়ে চেয়ে দেখছে মাঝরাতের এই উৎপাতকে।

  হঠাৎই একটা ভালুকছানা, মুখখানা মাটির দিকে নামিয়ে, আঁক করে উঠল। দুর্গন্ধে বমি এসে যাচ্ছে বেচারার। তা দেখে, হাসি ফুটে উঠল ভোঁদড় বাবাজীর মুখে। এটাই তাে চাইছি সে। বিকট গন্ধ ভোঁদড়ের গায়ে। অন্য কারও পক্ষে সহ্য করা কঠিন। ভোঁদড় ভালােই জানে, সে থাকলে আশেপাশে আর কেউ থাকতে পারবে না। 
উৎকট গন্ধটা এখন গােটা ঘরখানায় ছড়িয়ে পড়েছে। হাঁচিতে নাক সুড়সুড় করছে চারজনেরই।

  একে তাে রাতের ঘুম মাটি। তার উপর এই বিশ্রী গন্ধ। ভয়াণক চটে গিয়ে, ভালুক গর্জন করে উঠল- বেরাে হতভাগা। দরকার নাই আমাদের কাজের লোক।

  অমনি ভোঁদড় চেঁচিয়ে উঠল- আমাকে চটিয়াে না, মামা। চিরে ফালা-ফালা করে দেব বাচ্চাগুলােকে। আমার নখের ধার জানা নাই তােমাদের ?

  মা-ভালুকটা চমকে উঠল একথা শুনে। ভালুক কিছু বলবার আগেই, ছুটে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল বাচ্চা দুটো। ভীষণ পেট গুলাচ্ছে তাদের। মা-ভালুকও দৌড় লাগাল বাচ্চাদের পিছন পিছন।

  শেষ রাতের জ্যোৎস্না খেলা করছে বাইরে। খােলা দরজা দিয়ে ভালুক দেখল, যাচ্ছে, তিনটে ঘুমভাঙা প্রাণী ছুটে পালাচ্ছে বনের দিকে। কী আর করে? ভালুকও পড়ি-কি-মরি করে দৌড় লাগাল তাদের পিছন পিছন।

  দরজা দিয়ে জ্যোৎস্না এসে পড়েছে ভিতরেও। বাসাটা ভালাে করে জরীপ করে নিল ভোঁদড়। তাদের দুটো পুঁচকে প্রাণীর জন্য একেবারে আস্ত একটা প্রাসাদ এটা। খাসা ঘর। দারুণ আরামে থাকা যাবে। তার নাক-উঁচু বউ আর খোঁটা দিতে পারবে না উঠতে বসতে।

  চাঁদ ডুবতে বসেছে। আলাে ফুটতে দেরি নাই বেশি। নতুন বাড়িতে বউকে আনতে, পুরানাে বাড়ির দিকে দৌড় লাগাল ভোঁদড়। বাতাসে দুলতে লাগল তার মােটাসােটা সাদা-কালাে লেজখানা।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments