জ্বলদর্চি

সংক্ষিপ্ত মহাভারত -১/সুদর্শন নন্দী


সংক্ষিপ্ত মহাভারত 

সুদর্শন নন্দী

প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে শুধু ধর্মগ্রন্থ নয়, অনেক উচ্চাঙ্গের কাব্যসাহিত্য রচিত হয়েছিল। বিভিন্ন বৈদিক ধর্মগ্রন্থে কোনটিতে কবিত্বের শক্তি প্রকাশ পেলেও সেগুলি কাব্য নয়। রামায়ণ ও মহাভারত ভারতবর্ষের দুটি সুপ্রাচীন এবং শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য। এই দুই মহাকাব্যই ভারতবর্ষের প্রাণের মূর্ত বিকাশ।

গীতা মহাভারতের অংশ এবং রামায়ণ মহাভারতের অনেক আগে রচিত। সমস্ত বিশ্বে মহাভারতের মতো কাব্য আর নেই। মহাভারতের মূল কাহিনীর ভিতর রয়েছে অসংখ্য ছোট বড় কাহিনীর সমাহার। এই মূলকাহিনী ও উপকাহিনীর মধ্যেই ভারতের সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে।

অনেকে মহাভারতকে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বলে গুলিয়ে ফেলেন।  মহাভারত হিন্দুদের একটি ধর্মগ্রন্থ বললে ভুল বলা হবে। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বলা মানে মহাভারতকে একটি ধর্মের মধ্যে যেন বেঁধে রাখা। কিন্তু তাতো নয়। মহাভারত  কোন ধর্মগ্রন্থ নয়। সমস্ত ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, কাব্যের ঊর্ধ্বে। মহাভারতের আবেদন বিশ্বজনীন।

মহাভারত  কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস রচিত সংস্কৃত মহাকাব্য। মহাভারতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি হল চন্দ্রবংশীয় দুই পরিবার পাণ্ডব ও কৌরব তথা ধর্ম ও অধর্ম পক্ষের মধ্যে মহাসংঘর্ষ। ভূমির অধিকার নিয়ে যুদ্ধ। তা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ নামে পরিচিত। কুরু-পান্ডবদের ভ্রাতৃবিদ্বেষ ও যুদ্ধ এর মূল উপজীব্য। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা (দুর্যোধনাদি শতভাই) প্রপিতামহ কুরুর নামানুসারে কুরু বা কৌরব এবং পান্ডুর পুত্ররা (যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চভাই) পিতার নামানুসারে পান্ডব নামে পরিচিত। কুরুপক্ষের প্রধান দুর্যোধন, আর পান্ডবপক্ষের প্রধান যুধিষ্ঠির। যুদ্ধে কুরুপক্ষে যোগ দেন ভীষ্ম, দ্রোণ ও কর্ণ প্রভৃতি মহান চরিত্র তথা যোদ্ধারা, আর পান্ডবপক্ষে ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ, হিন্দুদের মনে প্রাণে আত্মায় স্বত্বায় যিনি ভগবান।

মহাভারতের রচনাকাল নিয়ে রয়েছে মতবিরোধ। প্রাচীনপন্থী পন্ডিতদের মতে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের পূর্বে মহাভারত রচিত হয়, কিন্তু আধুনিক ও ইউরোপীয় পন্ডিতদের মতে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যে মহাভারত রচিত হয়। বাংলা মহাভারতের রচয়িতা একাধিক। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কবি নিজের মতো করে মহাভারত  রচনা করেছেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মহাভারতের প্রভাব অপরিসীম। মহাভারতে রয়েছে ১৮টি পর্ব । সেগুলি হল – ১) আদি পর্ব, ২) সভা পর্ব,৩) বন পর্ব, ৪) বিরাট পর্ব, ৫) উদ্যোগ পর্ব, ৬) ভীষ্ম পর্ব, ৭) দ্রোণ পর্ব, ৮) কর্ণ পর্ব, ৯) শল্য পর্ব, ১০) সৌপ্তিক পর্ব, ১১) স্ত্রী পর্ব, ১২) শান্তি পর্ব, ১৩) অনুশাসন পর্ব, ১৪) অশ্বমেধিক পর্ব, ১৫) আশ্রমবাসিক পর্ব, ১৬) মৌষল পর্ব, ১৭) মহাপ্রস্থানিক পর্ব, ১৮) স্বর্গারোহণ পর্ব ।

মহাভারত নামকরণ ভারত থেকেই বলেই অনুমান করা হয়। সাধারণ ভাবে মনে করা হয় ভরত রাজার থেকে ভারতের নামকরণ হয়। ভরত  একটি ভারতীয় পৌরাণিক নাম। ভারতীয় মহাকাব্য ও পুরাণে "ভরত" নামের তিনটি পৃথক চরিত্র আছে। এদেরই একজন চন্দ্রবংশীয় রাজা ভরতের নামানুসারে ভারতবর্ষের নামাকরণ হয়েছিল। তবে ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে দেখা যায় প্রাচীনকালে ভরত নামে একজন নাট্টশাস্ত্র প্রণেতাও ছিলেন যার গ্রন্থে ভারতের নাট্যকলার বিবরণ পাওয়া যায়। সূর্যবংশীয় ভরত সূর্যবংশীয় রাজা দশরথ ও তদীয় স্ত্রী কৈকেয়ীর পুত্র ; রামের বৈমাত্রেয় ভাই। কৈকেয়ী নিজপুত্র ভরতকে রাজাসনে সমাসীন করার লক্ষ্যে রামকে বনবাসে পাঠিয়েছিল। বনবাস থেকে রাম ফিরে এলে ভরত রাজত্ব তার হাতে তুলে দেয়। অত:পর দুই পুত্র তক্ষ ও পুষ্কলকে নিয়ে ভরত গন্ধর্বদেশ জয় করে এবং তা দুই পুত্রের মধ্যে ভাগ করে দেয়। ভরত রামের মতোই সরযুসলিলে আত্মবিসর্জন করে। রামায়ণ, বিষ্ণুপুরাণ এবং ভাগবতে সূর্যবংশীয় ভরতের বিবরণ পাওয়া যায়। চন্দ্রবংশীয় রাজা ভরত রাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার পুত্র চন্দ্রবংশীয় রাজা ভরত। তার জন্ম কণ্বমুনির আশ্রমে। রাজত্ব লাভের পর সে সকল নৃপতিকে পরাজিত করে। এক পর্যায়ে পুরো ভারতবর্ষ তার শাসনাধীন হয়। বিদর্ভরাজের তিন কন্যার সঙ্গে এর বিয়ে হয়। এরই নামানুসারে ভারতবর্ষের নামাকরণ হয়েছিল বলে কথিত আছে। কুরু এর নবম বংশধর।

মহাভারতের ঐতিহাসিক সত্যতা যেন এক ধাঁধার আবর্তে ঘুরছে। কিন্তু সমস্ত প্রমাণ-অপ্রমাণের ঊর্ধ্বে রয়েছে আজ কোটি কোটি মানুষের বিশ্বাস। বিশ্বাস কোন সত্যাসত্যের ধার ধারেনা। তাই মহাভারতের কাহিনী আজ ভারতের সকল মানুষের না হলেও বেশির ভাগ মানুষের কাছে সত্যের ঊর্ধ্বে। তর্ক-বিতর্ক তাদের কাছে নিতান্তই গৌণ। মহাভারতের প্রতিটি চরিত্র থেকে আখ্যায়িকা চন্দ্র সূর্যের মতোই আপন করে নিয়েছে মানুষ। মহাভারতের যুদ্ধের কোন প্রমাণ আছে কিনা সেটিও পণ্ডিতদের গবেষণার বিষয়। হস্তিনাপুরে প্রত্নতাত্বিক খননের সাহায্যে মাটির নীচে পাঁচটি স্তর পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় স্তরে মহাপ্লাবনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই প্লাবনের পরে শহরটি পরিত্যক্ত হয়। আবার মৌষল পর্বে দ্বারকা নগরীর সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার বর্ণনা রয়েছে। প্রাচীন দ্বারকা আজ সমুদ্রে নিমজ্জিত। সমুদ্রের নীচে নগরের ধ্বংসাবশেষ মিলেছে।

এছাড়া, যে সকল ভারতীয় নগরীর কথা মহাভারতে রয়েছে, তাদের অস্তিত্ব ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানেও বেশ কিছু জনপদের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।

তবে মহাভারতের ঐতিহাসিক প্রমাণের জন্য আমাদের আরও প্রত্নবস্তু এবং পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু সেজন্য মহাভারতের গরিমা, ব্যাপকতা কোন কিছুই প্রভাবিত হবার প্রশ্নই নেই। কারণ কালের হাত ধরে হৃদয়ে গ্রথিত এই মহাকাব্যের রস রক্তের মতোই প্রতিটি শরীরে প্রবাহিত হচ্ছে।     

আমরা মহাভারতের কাহিনী শুরু করব রাজা শান্তনুর সময় থেকে। (চলবে)

(সহায়ক গ্রন্থ- প্রাচীন সাহিত্যে ভারতীয় সংস্কৃতিঃ পরিতোষ দাস, ইতিহাসঃ নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া উইকিপিডিয়ারও সাহায্য নিয়েছি।)
-----------------
চিত্র- শর্মিষ্ঠা ঘোষ।
প্রতি বৃহস্পতিবার নিয়মিত প্রকাশিত হবে এই ধারাবাহিক। আপনাদের অভিমত জানাতে পারেন। 

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 
যে সময়টাতে মা যশোদা দেবী তাঁর পুত্র শ্রীগোপালকে প্রেমরজ্জু বন্ধনে বেঁধেছিলেন তা ছিল কার্তিক মাস। বৈষ্ণব ভক্তদের নিকট দামোদর মাস। 'দাম' কথার অর্থ দড়ি বা বন্ধনরজ্জু, আর 'উদর' কথার অর্থ কোমর বা পেট। বাৎসল্য রসের বশে আজও ভক্তপ্রাণ বাঙালী প্রভুর অমৃতময় লীলাকথা শ্রবণে সারা বৎসর তৎপর থাকেন। 
🙏
কলম ধরলেন ড. বিভাস মণ্ডল


Post a Comment

0 Comments