জ্বলদর্চি

উত্তরপ্রদেশে সাংবাদিকের গায়ে সানিটাইজার জ্বালিয়ে খুন! স্তব্ধ বাকস্বাধীনতা!/ গৌতম বাড়ই

উত্তরপ্রদেশে সাংবাদিকের গায়ে সানিটাইজার জ্বালিয়ে খুন!

স্তব্ধ বাকস্বাধীনতা!

গৌতম বাড়ই

মনে পড়বেই হীরক দেশের রাজার কথা। স্তব্ধ বাকস্বাধীনতা, স্তব্ধ ব্যক্তিস্বাধীনতা। রাজার কথাই শেষ কথা। রাজা আর তার মোসাহেবি করা কিছু চাটুকারদের কথা।

গণতন্ত্র বারবার যেখানে খুন হচ্ছে সেই উত্তরপ্রদেশকে আজকেও খবরের শিরোনামে দেখে এতকথা মনে হল। এক সাংবাদিককে গায়ে স্যানিটাইজার জ্বালিয়ে খুন করা হয়েছে। খবরে জানা গিয়েছে রাকেশ সিং নির্ভীক ও তার বন্ধুকে গায়ে স্যানিটাইজার জ্বালিয়ে হত্যা করা হয়েছে যোগীর দেশে। ৩৭ বছর বয়সী ঐ সাংবাদিক লক্ষ্ণৌ-এর এক পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন। যোগীরাজ্যে সাংবাদিক হত্যা নতুন কিছু নয়, সবচেয়ে খারাপ লাগে গণতন্ত্র বলে আমরা এত যে নাচানাচি করি অথচ আমরা সবাই মিলে এর সপক্ষে সোচ্চার নই।
স্বৈরাচার শাসক রাষ্ট্রযন্ত্রের সে গণতান্ত্রিক ভোটদান পদ্ধতি হোক বা গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল হোক, প্রথমেই তার যে দূর্বিনীত আর বেপরোয়া  ভাবটি নজরে পড়ে তা হল বাকস্বাধীনতা আর ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা। জনগণকে জাত পাত ধর্মে বিভক্ত করে দাও আর নিজের অভিসন্ধিমূলক রাজ্যপাট দেশ চালাও। আর এরা ক্ষমতা দখল করে একটা ছদ্মবেশের আড়ালে। ক্ষমতা দখলের আগে এরাই খুব বেশি- বেশি করে গণতন্ত্রের কথা বলবে, দূর্নীতির কথা বলবে আর ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতা দখলের পর সেই ক্ষমতার মধুবন থেকে কিছুতেই সরতে চাইবে না। অথচ একদিন তো সেই অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্র, বিশ্ববরেণ্য সত্যজৎ রায়ের হীরক রাজার দেশের রাজার কথা মনে পড়বে। শেষের সেই ভয়ংকর দিন----দড়ি ধরে মার টান, রাজা হবে খানখান।

গণতন্ত্রের জন্য বাকস্বাধীনতার ভীষণ প্রয়োজন।
কেন প্রয়োজন?

মত প্রকাশের স্বাধীনতা" (freedom of expression) শব্দপুঞ্জটিকেও কখনও কখনও বাকস্বাধীনতার জায়গায় ব্যবহার করা হয়, তবে এখানে বাকস্বাধীনতার সাথে মাধ্যম নির্বিশেষে তথ্য বা ধারণার অন্বেষণ, গ্রহণ এবং প্রদান সম্পর্কিত যে কোন কার্যের অধিকারকেও বুঝিয়ে থাকে।
বেসামরিক ও রাজনৈতিক আন্তর্জাতিক চুক্তির (ICCPR) মানবাধিকার সনদ এর ১৯ নং অনুচ্ছেদ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী অভিব্যক্তির স্বাধীন প্রকাশকে শনাক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে "প্রত্যেকের অধিকার আছে নিজের মতামত এবং অভিব্যক্তি প্রকাশ করার। এই অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে নিজের স্বাধীনচেতায় কোনো বাধা ব্যতীত অটল থাকা; পুরো বিশ্বের যে কোনো মাধ্যম থেকে যে কোনো তথ্য অর্জন করা বা অন্য কোথাও সে তথ্য বা চিন্তা মৌখিক, লিখিত, চিত্রকলা অথবা অন্য কোনো মাধ্যম দ্বারা জ্ঞাপন করার অধিকার।" এই ১৯ নং অনুচ্ছেদ পরবর্তীতে ICCPR দ্বারা সংশোধিত হয়, উদ্ধৃতিতে বলা হয়; এইসব অধিকারের চর্চা বিশেষায়িত নিয়ম এবং দায়িত্বকে ধারণ করে; তবে যদি এই চর্চার দ্বারা কারো সম্মান হানি হয় বা জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় তবে কিছু ক্ষেত্রে এর অবাধ চর্চা রহিত করা হয়।

বাকস্বাধীনতাকে চূড়ান্ত হিসেবে স্বীকার নাও করা হতে পারে। মর্যাদাহানি, কুৎসা রটানো, পর্নোগ্রাফি, অশ্লীলতা, আক্রমণাত্মক শব্দ এবং মেধাসম্পদ, বাণিজ্যিক গোপনীয়তা, জননিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতা যদি অন্য কারও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে বা কারও অপকার করে তবে অপকার নীতির মাধ্যমে বাকস্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে। এই অপকার নীতির ধারণাটি প্রণয়ন করেছিলেন জন স্টুয়ার্ট মিল তার অন লিবার্টি নামক গ্রন্থে। সেখানে তিনি বলেন, "একটি সভ্য সমাজে কোন ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তার উপর তখনই ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার করা যায়, যখন তা অন্য কোন ব্যক্তির উপর সংঘটিত অপকারকে বাধা দেয়ার জন্য করা হয়।"

আমরা কিন্তু সুষ্ঠু গণতন্ত্রের জন্য রাষ্ট্রের জন্য সঠিক দিশা দেখাতে, সঠিক তথ্য পরিবেশন করতে  গিয়ে এইসব সাংবাদিকদের হত্যা আর নির্বিচারে বিচারবিহীন ভাবে জেলবন্দী হতে দেখি।

আজ শুধু উত্তরপ্রদেশে নয়, আমাদের গোটা ভারতবর্ষে এই বাকস্বাধীনতা কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি।শাসকের রক্তচক্ষু নির্মম অত্যাচারে আর জল্লাদের ভূমিকায় নেমে আসে--রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যায় অত্যাচার বা খারাপ কিছুতে আঙুল দেখালে। শাসক এই হত্যাগুলোর এক বৈধতা সৃষ্টি করবে। রাষ্ট্রের খুনের অধিকার। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে গুলি করে হত্যা করা হবে গণতন্ত্রকে।

হায়! তবুও তো চেঁচাই আমরা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে। গাল ফোলাই। শেষ করছি  হীরক রাজার দেশের সেই গান গেয়ে--কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়। ও ভাইরে!

(তথ্যসূত্র:INTERNATIONAL CONVENANT ON CIVIL AND POLITICAL RIGHTS বা সংক্ষেপে ICCPR)

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments