জ্বলদর্চি

১৯২৭: বাঘ এসেছে খাকুড়দাতে / সন্তু জানা

অনুসন্ধানী র ডায়েরি : ৫
 অখণ্ড মেদিনীপুর পর্ব
সন্তু জানা

১৯২৭ : বাঘ এসেছে খাকুড়দাতে  

২০১৮ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহল লালগড়ে একটি জলজ্যান্ত রয়াল বেঙ্গল টাইগার আবির্ভূত হতে চারদিকে হুলস্থুল পড়ে যায়। বাঘবন্দী খেলায় মেতে ওঠে প্রশাসন থেকে সাধারণ মানুষ সকলে। ভয় পাওয়ারই কথা। সুন্দরবনে বাঘ থাকুক ক্ষতি নেই, আলিপুরে খাঁচার ওপার থেকে হিংস্রতার ছবি দেখতে ভালোই লাগে। কিন্তু, তা বলে একেবারে লালগড়ে, একেবারে জঙ্গল থেকে লোকালয় ঘেঁষে জলজ্যান্ত শের! 

  ভাবলেও কেমন যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। অতীতে মেদিনীপুর জেলা জুড়ে সুবর্ণরেখা, কাঁসাই , ডুলুংয়ের তীরে জনমানবহীন খড়িবনে  বাঘের দেখা মিলত বলে যুগ যুগ ধরে লোকে বলে আসছে। কিন্তু, সেও তো নিশ্চয় বহু বছর আগের কথা। জঙ্গলাকীর্ণ মেদিনীপুর জেলার  প্রান্তদেশে অতীতে বাঘের ডেরা ছিল বলেই অতীতকাল থেকে 'বাঘমুন্ডি', 'বাঘাস্তি', 'বাঘড়া' প্রভৃতি অসংখ্য গ্রামনাম উদ্ভুত হয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের ধারণা গ্রামে, গ্রামে লোকালয়ে জ্যান্ত বাঘ ঘুরে বেড়াবে আর টুপ টুপ করে একটার পর একটা মানুষ তুলে নিয়ে যাবে এই ধরনের দৃশ্য বহু বছরের পুরনো, বহুদূর অতীতের। কিন্তু যদি বলি, খুব বেশি দূর নয় , এই সবে মাত্র ১৯২৫-৪০ সালেও মেদিনীপুর জেলার বিশেষ কিছু লোকালয়ে রাস্তায় রাস্তায় বাচ্চা-কাচ্ছা নিয়ে বাঘ-বাবাজি ঘুরে বেড়াতেন, তাহলে কথাগুলি হজম করতে বেশ কষ্ট হয়। সত্যিই স্বাধীনতার কিছু বছর মাত্র পূর্বে মেদিনীপুরের গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় বাঘ ! ভারত যখন অলিম্পিকে প্রথম সোনার মেডেল জিতছে তখন মেদিনীপুরের গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় বাঘ! সত্যিই অবাক হতে হয়!!

      ১৯৪০-৪৫ সাল অবধি সুবর্ণরেখা তীরবর্তী নয়াগ্রাম, গোপীবল্লভ পুর অঞ্চলে বাঘের দেখা মিলত। প্রায় সময় নদী পেরিয়ে  রোহিণী,খড়িকা, দাঁতন, তুরকা, সাবড়া, সাউরি, জাহালদা, খাকুড়দা প্রভৃতি এলাকায় রাস্তাঘাটে, লোকালয়ে হঠাৎ বাঘের আবির্ভাব ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। বাঘের আক্রমণে এই সব এলাকায় আহত, ক্ষত-বিক্ষত মানুষ ও গবাদি পশুর ভীড় লেগ থাকত ব্রিটিশ সরকারের দাতব্য চিকিৎসালয়গুলিতে। ১৯২৭ সালে এমনই একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে বর্তমান পশ্চিম ও পূর্ব মেদিনীপুরের একেবারে সীমানাবর্তী খাকুড়দার আসন্দা অঞ্চলে। বাঘ বাবাজির হঠাৎ আক্রমণে বহু নিরীহ গ্রামবাসী ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলেন। সদলবলে বাঘের পরিবার সুবর্ণরেখা নদী তীরে খড়িবনে বাস করত। সুযোগ বুঝে দাঁতন ও তুরকা  পেরিয়ে খাকুড়দার গ্রামে বিভীষিকার মতো হাজির হয়। 

  বাংলা ১৩৩৪ সালের ৯ ই জৈষ্ঠ্য কাঁথি- বেলদা রুটের বীণাপাণি মোটর গাড়ির জনৈক চালক শ্রী বিলাস চন্দ্র মাইতি আকস্মিকভাবে একটি হিংস্র বাঘের আক্রমণে নিজের দুটি হাত ও শরীরের বিভিন্ন অংশে গুরুতর ক্ষত নিয়ে কাঁথি হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসাধীন ছিলেন দীর্ঘ ২ থেকে ৩ মাস ধরে। কাঁথি থেকে বেলদা বড় রাস্তায় তৎকালীন সময়ে  প্রায়শই বাঘের উৎপাত এতটাই ভয়ঙ্কর স্বপ্ন ছিল যে, মোটরগাড়ির চালক ও যাত্রীগণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে হরি নাম জপ করতে করতে কাঁথি থেকে বেলদার রেল স্টেশন পৌঁছত।  

তবে, মানুষও ছেড়ে কথা বলত না। শোনা যায়, এলাকা জুড়ে রীতিমত চাঁদা করে লোহার খাঁচা নির্মাণ করে ইয়া বড় বড় সব বাঘ ধরত গ্রামের সাহসী মানুষ।

  ৩১ মে ১৯২৭ সালে কাঁথি থেকে প্রকাশিত মেদিনীপুর জেলার বিখ্যাত কাগজ 'নীহার'- এর পাতায় সংবাদ পরিবেশিত হল এই ধরনের বাঘ ধরার বিস্ময়কর সংবাদ - "সাউরি ,খাকুড়দা প্রভৃতি অঞ্চলে মধ্যে মধ্যে ব্যাঘ্র এর ঐরূপ উৎপাত হইয়া থাকে। ইতিপূর্বে সাউরিতে তথাকার অধিবাসীগণ লৌহ পিঞ্জর করিয়া যেরূপ ২/৩ টি বাঘকে ধৃত ও নিহত করিয়াছিল, উক্ত স্থানেও সেই পন্থা অবলম্বন করা উচিত।"

সত্যি, সে যুগে সাধারণ মানুষের কলজে ছিল বলা চলে !!

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments