জ্বলদর্চি

বাবু কৃষ্ণধন মুখোপাধ্যায় /সন্তু জানা

অনুসন্ধানীর ডায়েরি- ৪
সন্তু জানা 
অখণ্ড মেদিনীপুর পর্ব 
বাবু কৃষ্ণধন মুখোপাধ্যায় 

ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দেওয়ানি বিচারকার্যের সুবিধার জন্য ইংরেজ মেদিনীপুর সদর আদালতের সাব-অর্ডিনেট হিসেবে দক্ষিণ সীমান্তে দাঁতনে মুন্সেফ কোর্ট স্থাপন করেছিল। ১৮৯৪ সালের 'গভর্নমেন্ট গ্যাজেট ' থেকে জানতে পারি, মেদিনীপুর সদর আদালতের বিচারপতি বাবু দণ্ড ধারী বিশ্বাস কিছুদিনের জন্য দাঁতনের মুন্সেফ হয়েছিলেন। ১৮৯৫-৯৭ সাল অবধি এই পদে আসীন ছিলেন  বিজয় কেশব মিত্র। ১৮৯৭ সালের শেষ লগ্নে দাঁতন মুন্সেফ কোর্টের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব অর্পিত হয় কলকাতানিবাসী বাবু কৃষ্ণধন মুখোপাধ্যায়ের উপর। 
তিনি কেবলমাত্র একজন বিচারপতি ছিলেন না, সেই সঙ্গে  একজন প্রাজ্ঞ সংস্কৃতিমনস্ক লেখক ও দার্শনিকও ছিলেন।
তাঁর ভাবনা চিন্তায় পরিশীলিত করেছিলেন সেকালের দাঁতনকে। ১৮৯৭ সালে দাঁতনে কর্মরত অবস্থায় থাকাকালীন দর্শন ও আধ্যাত্মিক তত্ত্ব বিষয়ক একটি মাসিক পত্রিকা কলকাতা থেকে প্রকাশ করা শুরু করেন তিনি। নাম দেন 'পন্থা '। পরের বছর ১৮৯৮ সালের অক্টোবর মাসে ইংরেজ সরকার পত্রিকাটি প্রকাশ করবার জন্য অনুমতি প্রদান করে।
  বাংলার ইতিহাসে কৃষ্ণধন মুখোপাধ্যায় একেবারেই অনালোচিত একটি নাম । জন্ম কলকাতা শহরের এক বনেদি বংশে। প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষালাভ। তৎকালীন যুগে এম.এ ,বি.এল ডিগ্রি প্রাপ্ত মানুষটি বিচারবিভাগীয় পদকে নিজের পেশা হিসেবে বেছে নিলেও দর্শন ও ধর্মশাস্ত্র বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন বিস্তর। ধর্মকথা বিষয়ক সেকালের বিখ্যাত ' প্রচার ' পত্রিকার সুপ্রসিদ্ধ চিন্তাশীল লেখক রূপে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৮৯৭ সালে কলকাতায় ' বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ '-এর ষষ্ঠ মাসিক বৈঠকে রমেশ চন্দ্র দত্তের সভাপতিত্বে , মহেন্দ্র নাথ বিদ্যা নিধির প্রস্তাবে এবং হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের সমর্থনে তিনি পরিষদের আজীবন সভ্য পদে মনোনীত হন। ১৮৯৮ সালে দাঁতনে মুন্সেফ কোর্টের সদা ব্যস্তময় জীবনের ফাঁকেই ' বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ' নবম মাসিক অধিবেশনে যোগদান করেন ।১২ ফেব্রুয়ারি রবিবার বিকেল ৫ টা থেকে রাজা বিনয় কৃষ্ণ দেব বাহাদুরের ভবনে উপস্থিত সভাপতি মনমোহন বসু এবং সভ্য গণ নন্দ কৃষ্ণ বসু, সুরেশ চন্দ্র সেন , ব্যোমকেশ মুস্তফি, বরদা চরণ মিত্র এবং পরিষৎ পত্রিকার সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ বসুর সামনে মার্গ- দর্শন বিষয়ে অসাধারণ পান্ডিত্য পূরণ বক্তব্য রেখেছিলেন তিনি।

      ১৮৮৫ সালে অক্ষয় কুমার সরকার সম্পাদিত' নবজীবন 'পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ,হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, চন্দ্র নাথ বসু, নবীন চন্দ্র সেন ,রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের পাশাপাশি লেখক সূচিতে সামিল ছিল কৃষ্ণধন মুখোপাধ্যায়ের নামও। সেকালের জনপ্রিয় পত্র - পত্রিকা 'প্রচার', 'পূর্ণিমা',' হিতৈষী',' ধরনী',' 'তত্ত্ব বোধিনি','ভারতী' প্রভৃতির পাতায় প্রতিনিয়ত সৃষ্টিশীল রচনার ছাপ রেখে গেছেন তিনি । তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত রচনা হল -তত্ত্বমসি ( ভারতী ১৮৮৬),  উত্তরাখন্ডে ( পন্থা ১৮৯৮), একমেবদ্বিতীয়ম ( ভারতী ১৮৮৬) প্রভৃতি।
     ইতিমধ্যে ১৯০৪-০৫ সাল নাগাদ দাঁতন ত্যাগ করে চলে গেলেও কৃষ্ণধন বাবুর স্মৃতি থেকে দাঁতনের ছাপ মুছে যায়নি। স্বল্প সময়ের মধ্যেই দাঁতনের জন্য অনেকটাই ভেবেছিলেন কৃষ্ণধন। প্রাজ্ঞ শাস্ত্র জ্ঞানী ও আদ্যন্ত আধ্যাত্মিক মানুষ ছিলেন। তাই প্রায়ই দাঁতনের কৃষ্ণপুর মৌজায় অবস্থিত মুন্সেফ -রেসিডেন্স থেকে অনতিদূরে জঙ্গলাকীর্ণ মা কালী চন্ডির থানে নৈবেদ্য নিবেদন করে আসতেন। জাগ্রত কালী মাতার এই লৌকিক রূপ এখানে একটি গ্রানাইট পাথর রূপে প্রতিষ্ঠিত। ১৯১২ সালের ব্রিটিশ সেটেলমেন্ট মৌজা-মানচিত্রে পরিষ্কার উল্লেখ আছে, কৃষ্ণপুর মৌজার ১১৩০ নং দাগে ' কালী চন্ডির স্থান' , ১১৫৯ নং দাগে ' আদালতের রাস্তা ' এবং ১১৬৩ নং দাগে 'মুন্সেফ কোর্ট ' অবস্থিত ছিল।  কৃষ্ণধন বাবুর আমলে পবিত্র স্থানটিতে মন্দির গড়ে তোলার দাবি ওঠে। মহামান্য মুন্সেফ তখন জায়গাটির স্বত্ত্বাধিকারী রাজা রামচন্দ্রের সঙ্গে আলোচনায়  বসেন। রাজার সদিচ্ছায় এবং মুন্সেফের উদ্যোগে গ্রাম্য বিশ্বাসকে মান্যতা দিয়ে কালী চন্ডির মন্দির গড়ে ওঠে। পার্শবর্তী স্থানে ভক্ত বৃন্দের জন্য বিশ্রামস্থল ও সপ্তাহে দু দিন করে হাট বসানোর বন্দোবস্ত শুরু হয়। মুন্সেফ কৃষ্ণধন নিজ খরচে মন্দিরের পশ্চিমমুখী প্রবেশদ্বারটি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।

  প্রবেশদ্বারের উপরে বসলো দুটি সিংহ-বাহন এবং দ্বার-স্তম্ভে একটি ফলক, যাতে চিরদিনের জন্য লেখা রইলো কৃষ্ণধনের নাম। এখনো কালী চন্ডি মন্দিরের প্রবেশদ্বারে শতাব্দী প্রাচীন সেই প্রস্তর-ফলক অর্ধ-ভগ্ন অবস্থায় এক অসামান্য উদ্যোগ ও প্রয়াসের চিরন্তন  স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। লেখা আছে -" শ্রী কৃষ্ণধন মুখো "। দাঁতনের ইতিহাসে অনালোকিত এই ফলকটির গুরুত্ব অপরিসীম, অপরিমাপযোগ্য এবং বিরল ।এমনকি, এক কালের এই বিশিষ্ট লেখক, দার্শনিক,  বিচারপতি ও ' পন্থা' সম্পাদক বাবু কৃষ্ণধন মুখোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত কোন প্রস্তর-ফলক হয়তো কলকাতা শহরেও আর কোথাও নেই !

 'দণ্ডভুক্তি' পত্রিকার পক্ষ থেকে এই ফলকটির প্রকৃত ইতিহাস অনুসন্ধান করে বাংলার ইতিহাসে একটি অনুচ্চারিত অধ্যায় আলোকিত করা হয়েছে।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments