জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -২৪/শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -২৪

শ্যামল জানা

কিউবইজম (দ্বিতীয় অংশ)

ইতিহাস বলে— কিউবিজম-এর সূত্রপাত করেন পাবলো পিকাসো এবং জর্জেস ব্রাক— এই দুজন শিল্পী৷ তবে, এক কথায় এভাবে বললে মিথ্যাচারণ হয়ে যাবে৷ প্রদীপ জ্বালানোর ইতিহাস বলতে গেলে সলতে পাকানোর ইতিহাসের কথাও বলা দরকার৷ আমরা আগে আলোচনা করেছি, যে, বিশ শতকের শুরুতে চিত্রশিল্পে পরপর, একটার পর একটা, ইজমের জন্ম হয়েছে৷ নিঃসন্দেহে বলা যায়— মৌলিকতার প্রশ্নে সেই সব ইজম প্রত্যেকটিই ছিল স্বতন্ত্র, এবং নতুন দর্শনের জন্ম দিয়েছিল৷ তা সত্ত্বেও  এ কথা মানতেই হবে, আমূল পরিবর্তন বলতে যা বোঝায়, তা কিন্তু তাঁরা ঘটাতে পারেননি! এই প্রথম কিউবিজম-এ এসে তা ঘটল৷ শিল্পক্ষেত্রের আমূল পরিবর্তন বললে, কিউবিজমই প্রথম ঘটাতে পেরেছিল৷ পাশাপাশি এটাও সত্য যে— কিউবিজম-এর সলতে পাকানোর ইতিহাসটিও বেশ দীর্ঘ এবং ঘটনাবহুল৷

  আমরা আগে আলোচনা করেছি— চোদ্দশো শতকে রেনেসাঁস-এর সূত্রপাতের সময় থেকেই ছবিতে জ্যামিতিক আকৃতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়, এবং তখন থেকেই বহু শিল্পীর ছবির কম্পোজিশনগুলি হত বিভিন্ন ধরনের কতগুলো জ্যামিতিক  আকৃতিকে কাঠামো করে৷ পরবর্তীকালে এই ধারণাকে আধুনিক রূপদান করেন পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পী পল সেজান৷ আমরা পর্ব-৫-এ পোস্ট ইম্প্রেশনিজম প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে পল সেজান প্রসঙ্গে বলেছিলাম— পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্টদের মধ্যে চিন্তা-ভাবনায় ও ছবি আঁকায় সবচেয়ে শক্তিশালী ছিলেন সেজান৷ আরও বলা ভালো— বিংশ শতাব্দীর আধুনিক শিল্পকলায় পথ প্রদর্শক ছিলেন পল সেজান। কারণ, একাধিক ইজম-এর জন্ম হয়েছিল তাঁর ভাবনা থেকে৷ ইম্প্রেশনিস্টরা যেভাবে প্রকৃতিকে দেখতেন, তিনি সেভাবে দেখতে চাইলেন না৷ তিনি নিশ্চিতভাবেই বললেন— “প্রকৃতি বা তার ল্যন্ডস্কেপ সবটাই এক সহজ জ্যামিতিক উপাদান দিয়ে গঠিত৷ আমার উদ্দেশ্য হল স্থায়ী গড়ন নির্মাণের”৷ এই ধারণাটি তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বজায় রেখেছিলেন৷

    জ্যামিতিক উপাদান, অর্থাৎ আয়তক্ষেত্র, বৃত্ত, ত্রিভূজ, চতুর্ভুজ৷ এরা আসলে দ্বিমাত্রিক (2Dimentional)৷ যখন ত্রিমাত্রিক(3Dimentional) হয়, এরাই বদলে হয়ে যায় আয়তক্ষেত্র থেকে নল(Cylinder), বৃত্ত থেকে গোলক(Sphear), ত্রিভূজ থেকে শঙ্কু(Cone), ও চতুর্ভুজ থেকে ঘনক(Cube)৷ পল সেজান, ইম্প্রেশনিস্ট ও পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট সময় থেকেই এই সবকটি জ্যামিতিক উপাদান, দ্বিমাত্রিক এবং ত্রিমাত্রিক, এই দুই ধরনকেই, ছবিতে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন৷ এবং করেওছিলেন৷ এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত করে গেছেন৷ কোনোদিন ছেদ পড়েনি৷

দক্ষিণ ফ্রান্সে চুনা পাথরের একটি বিখ্যাত পাহাড় আছে৷ নাম— “মন্তাগেঁ সেইন্তে ভিক্তোইরে”৷ এটি ছিল সেজান-এর অত্যন্ত প্রিয়৷ শেষ বয়েসে প্রায় তিরিশ বছর ধরে দুটি পর্যায়ে তিনি এরই ছবি এঁকেছেন নানাভাবে, নানা দৃষ্টিকোণ থেকে, এবং নানা মাধ্যমে৷ বিশেষ করে জলরঙে(Water Colour)ও তেল রঙে(Oil Painting)৷ এই আঁকার দর্শন ছিল— সাদা চোখে সবাই যেভাবে এই পাহাড়টিকে দেখে, তিনি আদৌ সেভাবে দেখেননি৷ অন্তর্নিহিত দৃষ্টি দিয়ে তিনি যে উপলব্ধি করেছিলেন, সেই উপলব্ধিটাই এঁকেছিলেন, এবং সেই উপলব্ধির মধ্যে জ্যামিতিক উপাদানই বেশি ছিল৷ ফলে, প্রকৃতির হবহু প্রতিফলন ছবিতে একেবারেই পড়েনি৷ এই ছবি আঁকার প্রথম পর্যায় ছিল— ১৮৭০ থেকে ১৮৯৫ সাল৷ যাকে বলা হয় “সিন্থেসিস পিরিওড”৷ দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে— ১৮৯৫ থেকে ১৯০৬ সাল, অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত৷ এই দুটি পর্যায়ে তাঁর ছবি আঁকার পরিক্রমা ইম্প্রেশনিজম থেকে কিউবিজম-এ এসে শেষ হয়৷    

  মাঝখানে, ১৮৮৬ সালে, ৪৭ বছর বয়েসে পারিবারিকভাবে তাঁর জীবনে বড় বাঁক আসে৷ এ বছরে তিনি বিয়ে করেন, আবার বাবাও মারা যান৷ প্রচণ্ড আর্থিক সমস্যা তৈরি হয়৷ স্থাবর সম্পত্তির সঙ্গে বাড়িও বিক্রি হয়ে যায়৷ ফলে, তাঁকে বিভিন্ন সময়ে দক্ষিণ ফ্রান্সের বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়৷ তখন, বিভিন্ন জায়গায় থাকার সুবাদে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে “মন্তাগেঁ সেইন্তে ভিক্তোইরে” পাহাড়টিকে আঁকার সুযোগ পান৷

  ১৮৯০ সালে সাংঘাতিকভাবে তাঁর ডায়াবিটিস ধরা পড়ে৷ কথিত আছে, এতে তাঁর চোখ আক্রান্ত হয়৷ স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন৷ ডাবল ভিশনে দেখতে শুরু করেন৷ এই অবস্থায় তিনি ছবি আঁকলে প্রচণ্ড শারীরিক ক্ষতি হয় বটে, কিন্তু ছবির ধরন সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়ে কিউবিজম-এর অভিমুখ রচনা করে(ছবি-১ ও ছবি-২)৷ ফলে, ১৮৯০-এর পর থেকে তাঁর ছবির ধরন ক্রমশ কিউবিজম-এর পক্ষে বদলাতে থাকে আমৃত্যু৷

  ১৯০৪, ১৯০৫ ও ১৯০৬ সালে এই সব সাম্প্রতিক ছবি নিয়ে “স্যাঁলো দি অটোম্নে”-তে প্রদর্শনী হওয়ার পরই তিনি মার যান৷ তারপর খুব বড় করে তাঁর একটি স্মারক প্রদর্শনী (Commemorative retrospectives)হয় ১৯০৭ সালে৷ এই প্রদর্শনীগুলি থেকেই পিকাসো ও ব্রাক সাংঘাতিকভাবে অনুপ্রাণিত হন এবং ফাইনালি জন্ম হয় কিউবিজম-এর৷      (ক্রমশ)
আরও পড়ুুন
গুচ্ছ কবিতা / শ্যামল জানা 

Post a Comment

0 Comments