জ্বলদর্চি

মকর সংক্রান্তি : গ্রাম-বাংলার আত্মার উত্‍সব/মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

মকর সংক্রান্তি : গ্রাম-বাংলার আত্মার উত্‍সব

মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

মাটির একেবারে কাছাকাছি বসবাসকারী মানুষ অর্থাত্‍ যাদেরকে আমরা বলে থাকি তথাকথিত অনুন্নত ও অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ, কিংবা চিহ্নিত করে থাকি ধুলো-মাটির না হয় প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ বলে – তাদের কাছে সবচেয়ে যে উত্‍সবটি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে তা হল মকর সংক্রান্তির উত্‍সব। অনেকে একে পৌষ সংক্রান্তির উত্‍সব বা পৌষ পার্বণও বলে থাকেন। যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন – এই উত্‍সবকে ঘিরে পল্লীবাংলার প্রতিটি পরিবারে মানুষদের মধ্যে যে বিপুল আনন্দ, উত্‍সাহ ও উদ্দীপনা দেখা যায় তা আর অন্য কোনো উত্‍সবে দেখা যায় না। এমনকি বাঙালির শ্রেষ্ঠ উত্‍সব শারদীয়া উত্‍সবেও না। 

   শারদীয়া উত্‍সব – সে তো বড়ো বড়ো মানুষদের উত্‍সব, শহর- নগরের উত্‍সব, ধনী-মধ্যবিত্ত বাঙালির উত্‍সব, চাকুরিজীবী আর ব্যবসায়ীদের উত্‍সব। গ্রাম-বাংলার তথাকথিত খেটে কাওয়া মানুষেরা, দরিদ্র লোকেদের ইচ্ছে থাকলেও নানা কারণেই এই শারদীয়া উত্‍সবে প্রাণ খুলে যোগদান করতে পারে না। কিন্তু মকর সংক্রান্তির উত্‍সব – এ যেন তাদের প্রাণের উত্‍সব-আত্মার উত্‍সব। গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে এ সময় বয়ে যায় এক অনাবিল আনন্দের জোয়ার। 

   মাঠে মাঠে পাকা সোনালি ধান। সে ধান ঘরে আসে। ভরে উঠে ধানের যত গোলা। অন্নের অভাব তখন নেই ঘরে। তাই তো মানুষ এ সময় প্রাণের আনন্দে নেচে উঠে। মকর সংক্রান্তির মহাপর্বটা পৌষ মাসের শেষ এবং মাঘ মাসের প্রথম দু’একদিনের মধ্যে চলতে থাকলেও তার শুরু কিন্তু এক মাস আগে থেকে। অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিন অর্থাত্‍ সংক্রান্তির দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় পৌষ সংক্রান্তির জন্য দিন গোনা। বাঁকুড়া জেলার সিমলাপাল, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা, চন্দ্রকোণা, ঘাটাল এলাকার বিভিন্ন ব্লকে সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিন থেকেই উত্‍সব শুরু হয়ে যায়। এই দিন গোধূলি বেলায় গাঁয়ে-ঘরের মেয়েরা বিশেষ করে ছোট ছোট মেয়েরা মাঠ থেকে কাটা ধান গাছের তিনটি গোড়া তুলে আনে। সেটাকে সারা রাত জাগিয়ে রেখে পরের দিন একটি আল্পনা আঁকা ও প্রদীপ বসানো মালসায় তা তুলে পুজো করে। এটিকে বলা হয় ‘তুসু’ বা ‘টুসু’ ঠাকুর। বাড়ির বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা আর অনুন্নত সম্প্রদায়ের ঘরে বাড়ির বৌয়েরা পর্যন্ত বেশ সুর করে গান ধরে এই টুসুর পুজো করে। নানারকম বৈচিত্র্যময় সে সুর। এলাকায় প্রচলিত কয়েকটি টুসু গানের নমুনা – 
(এক) ‘এ চালে পুঁই ও চালে পুঁই/পুঁয়ে ধরল মিচুড়ি-পুঁয়ে ধরল মিচুড়ি/রাত দুপুরে খবর এল মরল টুসুর শাশুড়ি – মরল টুসুর শাশুড়ি। / মরে গেছে ভালোই হয়েছে/চন্দন কাটে পুড়াবো – চন্দন কাটে পুড়াবো। চন্দন কাঠে না পুড়িয়ে /গঙ্গার জলে ভাসাব – গঙ্গার জলে ভাসাব।’
(দুই) ‘আমার টুসু লাইতে(নাইতে) যাবে/ জোড়া শঙ্খ বাজিয়ে – জোড়া শঙ্খ বাজিয়ে।’     
   পুরো একটি মাস ধরে প্রতি সন্ধ্যায় ধূপ-ধুনো জ্বেলে এই টুসুর পুজো চলে। পূজা শেষে শাঁখ বাজানো হয়। এই টুসু পুজোর সাথে সাথে প্রতি হিন্দু বাড়িতেই এই সময়েই প্রতি বৃহস্পতিবার বারলক্ষ্মীর পূজা করা হয়। একটি থালাতে কিছু ধান দিয়ে তার উপর একটি ঘটি বা গ্লাস রাখা হয়। ঘটির ভিতরে থাকে জলসহ দুর্বা ঘাস। প্রতি বৃহস্পতিবার পুরোহিত এসে এই লক্ষ্মীর পূজা করে যায়। 

   পৌষ মাসের শেষদিন মকর সংক্রান্তি। এর দিন পনেরো-কুড়ি আগে থেকেই ঘরে ঘরে পড়ে যায় মহাধুম। বাড়িতে বাড়িতে নতুন নতুন পোশাক-আশাক কেনার তোড়জোড় পড়ে যায়। মকর সংক্রান্তির ভোরে স্নান করে নতুন পোশাক পরতে হবে এটা যেন একটা রীতিতে দাঁড়িয়ে গেছে। মকর সংক্রান্তি মানেই তো পিঠে-পুলির উত্‍সব। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলের বাড়িতে পিঠে-পুলির আয়োজন করা হয়। স্থানীয ভাষায় একে ‘পুরপিঠে’ বলা হয়। কপি, মসুর ডাল, আলু, নারকেল, তিল, পোস্ত, দুধের চাঁছি ইত্যাদি দিয়ে সে হরেক রকমের পুরপিঠে। দু’দিন আগে থেকেই পাড়ার ঢেঁকিতে ঢেঁকিতে পড়ে যায় চালের গুড়ি কোটার পালা। সারাদিন-রাত-ভোর পল্লীবাংলার আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হয় এই ঢেঁকির শব্দ। এই সময় এখানকার যে কোনো গ্রামে যে কেউ ঢুকলেই বুঝতে পারবে গ্রাম-গঞ্জ কিভাবে নবান্ন উত্‍সবে মেতে উঠেছে। অবশ্য ঢেঁকির চল ধীরে ধীরে কমে আসছে। 
   ঘরের বৌ-ঝিয়েদের তো এই সময়ে হাজারো ব্যস্ততা। এতটুকু সময় থাকে না অবসর নেওয়ার মতো। নতুন ধান উঠছে বাড়িতে। সেই ধান সেদ্ধর পালা শুরু হয়। গাঁয়ের ধান ভাঙানো কলগুলিতে প্রচুর ভিড় পড়ে এজন্য। মকর সংক্রান্তির আগের দিন সন্ধেবেলা তৈরি করা হয় নতুন চালের পিঠে-পুলি। নানা রকমের পিঠে। একদিকে বৌয়েরা-গিন্নীরা পিঠে তৈরিতে ব্যস্ত, অন্যদিকে বাচ্চা মেয়েরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে তাদের টুসুকে পূজা করার জন্য। এই দিন সারা রাত ধরে প্রহরে প্রহরে চলে এই পূজা। অধিকাংশ পাড়াতেই আজ আর খালিমুখে টুসুর গান গাওয়া হয় না। মাইক ব্যবহার করে এই গান করে। সারারাত জেগে টুসুর গান গেয়ে পূজা করে। ভোরবেলা থেকেই শুরু হয়ে যায় তা জলে ভাসানোর তোড়জোড়। এদিন সকাল থেকেই শিলাবতী নদীর ঘাটে ঘাটে পড়ে যায় সব বয়সী মানুষের স্নান করার ধুম। মেয়েরা একটু দেরিতে স্নান করে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্নান করেই পরিধান করে সদ্য কিনে আনা নতুন জামা-প্যান্ট-চুড়িদার-পাজামা। বড়ো বড়ো মেয়েরা এবং ঘরের বৌয়েরা পরে নতুন কাপড়। থরে থরে নদীর স্রোতে ভেসে যায় টুসুর পাদপদ্মে অর্পিত হরেক রকমের ফুল।

   স্নান করে এসেই বাড়িতে শীতের রোদ গায়ে মেখে শুরু হয় পিঠে-পুলি খাওয়ার পর্ব। শীতের মিঠে রোদ নিতে নিতে মেয়েরা তাদের চুল খুলে দিয়ে খেতে শুরু করে। খাওয়ার পর্ব শেষ হলেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা অনেক জায়গায় বনভোজনে মেতে উঠে। কিশোর-যুবকরা ক্রিকেট, ভলিবল নিয়ে মাঠে ছুটে যায়। বাড়ির গিন্নীরা ব্যস্ত হয় বারলক্ষ্মীর পূজার আয়োজন করতে। প্রতি বাড়িতে পুরোহিত এসে এই লক্ষ্মীর পূজা করে যায়। পূজা বলতে একটি ‘ধানের আঁটিকে’ লক্ষ্মী হিসাবে ধরা হয়। পুরোহিত সেই ধানের আঁটিকে পূজা করে খড় দিয়ে ঢেকে দিয়ে যায়। এও আর এক মজার জিনিস। পুরোহিত যে ধানের আঁটিটিকে পুজো করে যায় সেখানে থাকে তিনটি গোবর সারের ডেলা এবং গাড়ুতে জল। সন্ধের পর শিয়াল ডেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ির যে কেউ ঐ পূজা করা গোবর ও জল নিয়ে সাতপাক ঘুরে কেউ বা তিন পাক ঘুরে একেবারে ঘরের ভিতরে গিয়ে রেখে প্রণাম করে। একে বলা হয় ‘সার ধরা’। তখন প্রতি বাড়িতে বেজে ওঠে শাঁখ। অবশ্য কিছু কিছু সম্প্রদায় তার পরের দিন এই সার ধরে। মাহিষ্য এবং সদগোপ ক্ষেত্রবিশেষে কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। শিয়ালের ডাককে হিন্দুরা খুবই পবিত্র এবং শুভ জিনিস বলে মনে করে। সেইজন্য অনেকে এই সারামাস শিয়ালের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করে না। মকর দিন রাত্রেও পিঠেপুলির আয়োজন করা হয়। পিঠে তৈরির শেষে সর্বত্র ‘বাওনি বাঁধা’ হয়। খড়ের ছোট ছোট বিচুলি করে তাতে ফুল দিয়ে গোয়াল ঘরে, ধানের মরাই-এ, ধানের পালুই-এ, ঘরের পুরোনো হাঁড়িতে, পিঠের হাঁড়িতে এবং অন্যান্য নানা পবিত্র স্থানে এই বাওনি বাঁধা হয়। একে বলে বাওনি বাঁধা। 

   মকর স্নান শেষ হলেই যে এই উত্‍সবের পরিসমাপ্তি ঘটে যায় তা নয়। পরের মাঘ মাসের প্রথম ক’টা দিন তো হিন্দুদের কাছে খুবই পবিত্র দিন। যত যেখানে দেব-দেবতা-ঠাকুর আছে তার পূজা দেওয়া হয় এই সময়। এই হচ্ছে একটা সময় যখন প্রতি দেব-দেবতা বছরে একবার হলেও পূজা পায়। তবে বেশির ভাগই বনদেবতা বা বনদেবী। নামও সব অদ্ভুত ধরনের। কারও নাম বাঁশদেবতা, কেউ বাসকাসিনি, কেউ পাথরাসিনি, কেউ ভৈরবী, কেউ নাককটি ইত্যাদি সব নাম। সারা বছর পূজা হয় না বলে এইসব দেবতার স্থানগুলো জঙ্গলে ভরে যায়, ঝোপে-ঝাড়ে ঢেকে যায়। মকর সংক্রান্তির এই সময় স্থানগুলো পরিষ্কার করে সেখানে ন্যাতা-ঝাঁটা দিয়ে পূজা করা হয়। বেশির ভাগ স্থানেই এখানে দেওয়া হয় ছোট ছোট মাটির ঘোড়া ও হাতি। গড়বেতা, চন্দ্রকোণা এবং ঘাটাল ব্লকের প্রায় প্রতি গ্রামেই এই সব দেব-দেবতাদের স্থান। অনেক দেবতার স্থানে এই উপলক্ষে মেলা বসে। তার মধ্যে মালবান্দির ভৈরবী মেলা, পাথরার পাথরাসিনি মেলা, ভেদুয়া গ্রামে ভেদোসিনির মেলা, গড়বেড়িয়ার নাককাটি মেলা, শ্যামানন্দপুরের দোমহনির মেলা ইত্যাদি। 

   তবে যত সময় যাচ্ছে এইসব মেলার ঐতিহ্য হারাচ্ছে। সময়ের ব্যবধানে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। এখন আর তেমন প্রাণময়তার স্ফূরণ লক্ষ করা যায় না। তবে মকর সংক্রান্তির যে আনন্দ উত্‍সব তাতে চিড় পড়েনি। বছর বছর যেন এই উতসবের আনন্দ বাড়ছে। গ্রাম-বাংলার বুকে যেন এই মকর সংক্রান্তির উত্‍সব তাদের চিরকালীন শাশ্বত উত্‍সব। এই উত্‍সবের মধ্য দিয়েই খুঁজে পাওয়া যায় আমাদের সুন্দর গ্রামগুলি।  

পেজ- এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments